পুলিশের চাকুরি একটি পেশা (Profession) নাকি একটি যাদু বিদ্যা তা নিয়ে অনেক বিতর্ক আছে। কোন কর্মকাণ্ড পেশাদারিত্বে উন্নীত হতে হলে কতগুলি শর্ত মানতে হয়। এই সব শর্তের মধ্যে প্রধানতম হল স্ব-নিয়ন্ত্রণ (Self-regulated). যেমন আইনজীবীরা সরকারের বাইরে বার এসোসিয়েশন দ্বারা নিজেদের নিয়ন্ত্রণ করে। মেডিকেল এসোসিয়েশনের মাধ্যমে ডাক্তারি পেশার সনদ নিয়ন্ত্রিত হয়। কিন্তু পুলিশিং এর ক্ষেত্রে এমনটি হবার জো নেই। পুলিশ সরকারের নির্বাহী বিভাগ কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত একটি সংস্থা। এর উন্নতি-অধোগতিসহ সব কিছুর নিয়ন্ত্রক হচ্ছে সরকার। তবে বর্তমানে পুলিশকে সরকারের অযাচিত হস্তক্ষেপ থেকে মুক্ত করে পেশাদারিত্বে উন্নীত করার প্রচেষ্টা বিশ্বব্যাপী পরিলক্ষিত হচ্ছে।
পেশাদরিত্বে উন্নীত হতে হলে কোন পেশা সংক্রান্তে কিছু গবেষণালব্ধ জ্ঞানার্জন, জ্ঞান আরোহণ, বিতরণ ইত্যাদির একটা নিরবিচ্ছিন্ন ব্যবস্থা চালু থাকে। যেমন, মেডিকেল শাস্ত্রে নিত্য নৈমিত্তিক পদ্ধতির আবিষ্কার হচ্ছে। পেশার সাথে সংশ্লিষ্টগণ নতুন আবিষ্কারের সাথে নিজেদের পুরাতন জ্ঞানকে মিলিয়ে নিজেদের আধুনিক করেছেন। কিন্তু পুলিশিং এর ক্ষেত্রে নিরবিচ্ছিন্ন গবেষণার ক্ষেত্র অতি সীমিত। পাশ্চাত্যে পুলিশিং নিয়ে সীমিত আকারে গবেষণা হলেও আমাদের মতো প্রতীচ্যের দেশে তা একেবারে অনুপস্থিত। আমাদের দেশে সামরিক বিজ্ঞান, সাচিবিক বিজ্ঞান ইত্যাদি একাডেমিক পাঠ্যসূচিতে স্থান পেলেও পুলিশ বিজ্ঞান এখনো মানুষের কাছে অজানা।
প্রত্যেক পেশার একটি নীতি-সংহিতা বা Code of ethics থাকে। এই সংহিতায় প্রত্যেকে একনিষ্ট থাকেন। বাইরের কোন প্রতিষ্ঠান প্রাত্যহিক পাহারা দিয়ে সেই নীতি সদস্যদের মানতে বাধ্য করেন না। পেশার প্রত্যেক সদস্যই আপন গুণে তা মেনে চলেন। কিন্তু পুলিশের ক্ষেত্রে এ নীতি সংহিতা অনুপস্থিত না থাকলেও এর বাস্তবায়ন স্বেচ্ছা ভিত্তিক বা স্বনিয়ন্ত্রিত নয়।
কোন পেশার পেশাদারিত্ব প্রমাণের জন্য সে পেশাদারদের একটি বিশেষ ডিগ্রির আবশ্যক থাকে। যেমন, আইনে স্নাতক না হলে এ্যাডভোকেট হওয়া যায় না। এমবিবিএস পাশ না করলে ডাক্তার হওয়া যায় না। কিন্তু পুলিশিং পেশায় এমন কোন প্রফেশনাল ডিগ্রির আবশ্যকতা নেই। সাধারণ এসএসসি পাশ করে পুলিশ কনস্টেবল পদে চাকুরী নিয়ে এসপি পর্যন্ত হওয়া যায়। যদিও সরাসরি এসআই বা এএসপি পদে প্রবেশের ক্ষেত্রে ন্যূনতম স্মাতক ডিগ্রির দরকার হয়, কিন্তু বিভাগীয় কর্মকর্তাদের পদোন্নতিতে উচ্চতর ডিগ্রির কোন শর্ত নেই। এমনকি ব্যাংকিং ক্ষেত্রেও পদোন্নতির ক্ষেত্রে ডিপ্লোমা কিংবা অন্য কোন ডিগ্রির দরকার হয়। কিন্তু পুলিশের পদোন্নতিতে প্রবেশকালীন ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতার চেয়ে অন্য কোন প্রফেশনাল ডিগ্রি অর্জন অনাবশ্যক।
কোন প্রফেশনের স্বীকৃতির ক্ষেত্রে বহির্বিভাগীয় অনুমোদন আবশ্যক। অর্থাৎ সংশ্লিষ্ট পেশার বাইরের পেশাজীবীরা এই কর্মকাণ্ডকে পেশা বলে স্বীকৃতি দিবেন। কিন্তু পুলিশিং এর ক্ষেত্রে এই অনুমোদন এখনো পাওয়া যায় না।
পুলিশের প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রেও পেশাদারিত্বে উপাদানগুলোর যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে। সারদা বা অন্যান্য ট্রেনিং সেন্টারগুলোতে মৌলিক প্রশিক্ষণের বিরাট অংশ জুড়ে থাকে পিটি-প্যারেড বা শারীরিক শিক্ষা। এখানে ক্লাসরুমের তাত্ত্বিক জ্ঞানের চেয়ে মাঠের শারীরিক কসরতকেই বেশি মূল্যায়ন করা হয়। এসআই বা এএসপিদের ক্ষেত্রে তাত্ত্বিক জ্ঞানের পাঠ থাকলেও কনস্টেবলদের মাঠের প্রশিক্ষণকেই মূখ্য হিসেবে বিবেচনা করা হয়। যদিও বর্তমানে এএসপিদের প্রশিক্ষণে আধুনিক বিষয়াবলী অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে, কিন্তু পুলিশ কর্মযজ্ঞের মেরুদণ্ডের সাথে তুলনীয় এসআইদের সিলেবাসে আধুনিক শিক্ষার উপাদান এখনও বহুলাংশে অনুপস্থিত।
পুলিশ প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রে সাধারণত পুলিশ অফিসারগণই প্রশিক্ষক হিসেবে কাজ করেন। কিন্তু প্রশিক্ষক হওয়ার জন্য তাদের বিশেষ ডিগ্রির প্রয়োজন পড়ে না। কিংবা প্রশিক্ষক হওয়ার জন্য তেমন কোন মানদণ্ডও মেনে চলা হয় না। এখানে বিশেষ বিশেষ বিষয়ের উপর বিশেষজ্ঞদের প্রকট অনুপস্থিতি রয়েছে।
পুলিশের এসআই ও এএসপি পদে ১ বছর একাডেমির প্রশিক্ষণ শেষে রয়েছে একটি বাস্তব প্রশিক্ষণের কাল। এসআইদের জন্য এর মেয়াদ পূর্বে ছিল দুই বছর। বর্তমানে তা কমিয়ে করা হয়েছে এক বছর। অন্যদিকে এএসপিদের জন্য এই প্রশিক্ষণের মেয়াদ হল ৬ মাস। এ বাস্তব প্রশিক্ষণে অফিসারগণ মুলত মাঠ পর্যায়ের অফিসারদের তত্ত্বাবধানে হাতে কলমে প্রশিক্ষণ নিয়ে থাকেন। কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে এই প্রশিক্ষণে তত্ত্বাবধায়কগণ থাকেন নির্বিকার। বস্তুত এ বাস্তব প্রশিক্ষণ মুলত গুরুর কাছে শিষ্যদের তালিম নেওয়ার মত। এখানে সিনিয়রগণ শিক্ষানবিশকে গুরুর মতোই শেখানোর কথা। কিন্তু বাস্তবে তাও সম্ভব হয় না।
শিক্ষানবিশগণ কেউ নিজের ইচ্ছায় শিখলে ভাল, অন্যথায় বাস্তব প্রশিক্ষণে মাঠ পর্যায়ে পুলিশ কর্মকর্তাদের দৈনন্দিন কার্যক্রম পর্যালোচনা করার বাইরে শিক্ষানবিশ অফিসারের কোন কাজই থাকে না।
যাদু বিদ্যা বা কলা বিদ্যার সবচেয়ে প্রকট চিত্রটি পাওয়া যাবে একজন পুলিশ সাব-ইন্সপেক্টরের পেশা পর্যালোচনা করে। নিয়োগ সূত্রেই একজন সাব-ইন্সপেক্টর একজন তদন্তকারী কর্মকর্তা। সাধারণ মারামারির মামলা থেকে শুরু করে অজ্ঞাত খুন বা সহিংস বোমা হামলার অপরাধও তাকে তদন্ত করতে হয়। কিন্তু করুন বিষয় হল, একজন পুলিশ সাব-ইন্সপেক্টর সারদার মৌলিক প্রশিক্ষণের বাইরে তদন্ত বিষয়ক উচ্চতর অন্যান্য কোন প্রশিক্ষণই সময় মতো গ্রহণের সুযোগ পান না।
তদন্তের প্রশিক্ষণের জন্য বাংলাদেশ সিআইডি এর অধীন ঢাকায় একটি ডিটেকটিভ স্কুল (ডিটিএস) রয়েছে। অতীতে এ প্রতিষ্ঠানে সাব-ইন্সপেক্টরদের তদন্ত প্রশিক্ষণ ছিল স্বেচ্ছামুলক। কিন্তু তখন খুব সামান্য সংখ্যক অফিসারই এই প্রশিক্ষণ গ্রহণ করত। পরবর্তীতে ইন্সপেক্টরদের পদে পদোন্নতির ক্ষেত্রে ডিটিএস এর তদন্ত প্রশিক্ষণকে বাধ্যতামুলক করা হয়। কিন্তু চাহিদার তুলনায় ডিটিএস এর সামর্থ্য এতটাই অপ্রতুল যে পদোন্নতি পরীক্ষায় পাশ না করলে কোন এসআই এ প্রশিক্ষণের সুযোগ পান না। এমনও হয় যে তদন্ত বিষয়ে উচ্চতর প্রশিক্ষণের পূর্বে কোন কোন অফিসার ২০ বছর অতিক্রম করেছেন। ইতোমধ্যে তিনি হাজার হাজার ফৌজদারি মামলার তদন্তও শেষ করেছেন। তার তদন্তকৃত মামলায় অনেকের ফাঁসিও হয়েছে। কিন্তু তিনি তদন্ত বিষয়ে সারদার মৌলিক প্রশিক্ষণের বাইরে অন্য কোন প্রশিক্ষণে উপস্থিত হতে পারেননি। তদন্ত বিষয়ে কোন নিবিড় প্রশিক্ষণ না পেয়েও পুলিশ তদন্তকারীগণ বেশ সাফল্য প্রদর্শন করেন। এটা তাদের পেশাদারিত্ব নয়, কলা বিদ্যা বা যাদু বিদ্যা আয়ত্ব করার মাধ্যমেই অর্জিত হয়েছে।
যদিও পুলিশিংকে পেশা দারিত্বে উন্নীত করার জোর প্রচেষ্টা বহির্বির্শ্বে লক্ষনীয়, বাংলাদেশে বিষয়টি বেদনাদায়কভাবে অনুপস্থিত। যুক্তরাস্ট্রের অনেক রাজ্যে পুলিশ বিভাগের বাইরেও স্ব-স্বাশিত বা বেসরকারী প্রতিষ্ঠান গুলো পুলিশিং প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে। এ সব যুবক পুলিশের চাকুরিতে প্রবেশের পূর্বেই পেশাগত প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। অনেক দেশে এমন কি সুদানের মতো একটি দেশেও পুলিশের উচ্চপদে প্রবেশকারীগণ পূর্ণ দুই বছর পুলিশ একাডেমীতে তাত্ত্বিক জ্ঞান অর্জন করেন। কিন্তু বাংলাদেশে সর্বসাকুল্যে দেড় বছর প্রশিক্ষণ নিয়েই পুলিশ সিনিয়র অফিসারগণ মাঠের কঠিন দায়িত্ব গ্রহণ করে।
পুলিশিংকে একটি স্বীকৃত পেশায় উন্নীত করতে হলে এ বিষয়ে সরকারি-বেসরকারি উভয় পর্যায়ে গবেষণা, পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও আচরণ নীতিমালার প্রবর্তন দরকার। সবচেয়ে বড় বিষয় হল পুলিশিং বিষয়ে একটি গবেষক শ্রেণি তৈরি করা। এ গবেষক শ্রেণি সরকারি বা পুলিশ কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রণের বাইরেই তাদের গবেষণাকর্ম চালিয়ে যাবেন। দেশের বিদ্যাপীঠসমূহ হবে এসব গবেষকদের কর্ম ও পৃষ্ঠপোষণ ক্ষেত্র। এদের গবেষণা হবে সম্পূর্ণ তাত্ত্বিক ও বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি নির্ভর। পুলিশ কর্তৃপক্ষ বা সরকার এসব গবেষকদের সহায়তা কামনা করতে পারে। তবে তাদের গবেষণা সরকার নিয়ন্ত্রিত হবে না। আমার মতে এমন একটি গবেষক বা বুদ্ধিজীবী শ্রেণির বিকাশ ঘটাতে না করতে পারলে বাংলাদেশে পুলিশিং প্রফেশনের মর্যাদা কখনোই পাবে না। আগস্ট, ৪ ২০১৩
মর্তুজা আশীষ আহমেদ বলেছেনঃ
সেইসাথে শিক্ষাব্যবস্থার দ্রুত উন্নয়ন প্রয়োজন।
বাংগাল বলেছেনঃ
“যারা এই ঘটনার সাসপেক্টেড খুনিকে চটজলদি বেইল দিয়েছেন, তাদের হাতেও অভিজিতের রক্তের দাগ লেগে আছে। এ ঘটনায় প্রমাণিত হয়, আমাদের পুলিশ আনইফিসিয়েন্ট।”
“তিনি (সাসপেক্টেড খুনি) কারাগারে ছিলেন, বেইল নিয়ে বের হয়ে গেছেন। তাই বলা যায়, বিচার বিভাগের হাতেও রক্তের দাগ লেগে আছে।”……….
……….সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক আজই বলেছেন একথাগুলো ।
আর পুলিশিং যাদুবিদ্যা নয় ,বলি কি করে ? আমার নিকটাত্মীয় ‘ যাদুবিদ্যায় ‘ পারদর্শী উচ্চ পদস্থ একজন কর্মকর্তা , যাদুবিদ্যার বরকতে মাশা আল্লাহ ঢাকা এবং আশেপাশে অন্তত ২০ কোটি টাকার অস্থাবর সম্পত্তির মালিক ।
সরি , এমন হাইলাইটেড পোস্টে অনাকাঙ্ক্ষিত মন্তব্য করার জন্য ।
বাংগাল বলেছেনঃ
দুঃখিত , স্থাবর হবে শব্দটি , অস্থাবর নয়