দোহাই অফিসারগণ, অন্যের ফোনে কান দিবেন না

মোঃ আব্দুর রাজ্জাক
Published : 24 Sept 2014, 05:59 AM
Updated : 24 Sept 2014, 05:59 AM

অভ্যসাবসত ফোনটা খুলেই ঘুমাই। ইতোপূর্বে মাঠ পয়ায়ের পুলিশিং-এ ফোন খোলা রাখা অনেকটাই পেশাগত দায় ছিল। রাত-বিরেতে পুলিশকে ফোন করে যদি মানুষ না পায়, তাহলে, পুলিশ রেখে লাভ কি? একজন পুলিশ অফিসার হিসেবে তো বটেই, একজন নাগরিক হিসেবে আমারও একই প্রশ্ন। আইন অনুসারে পুলিশ অফিসাগণ দিবারাত্র ২৪ ঘন্টাই কর্মরত। তাদের নিজস্ব বা ব্যক্তিগত সময় বলতে কিছু নেই। আইন বলে, Police Officers are Always on Duty.

রাতকে বিধাতা ঘুমানোর জন্য উত্তম সময় করে দিয়েছেন। তাই রাত হলে মানুষ ঘুমিয়ে পড়ে। রাত যতই গভীর হয়, নাগরিকদের ঘুম ততোই গভীর হয়। নাগরিকদের রাতের নিদ্রা আর দিনের কর্মকে নির্বিঘ্ন রাখাই তো পুলিশের কাজ।

মানুষ কেন পুলিশকে ফোন করে? Why the people call the Police?. আষাঢ়ে গল্পে মসগুল হতে কিংবা কৌতূকে সময় কাটানোর জন্য মানুষ পুলিশকে ফোন করে না। কেউ যখন পুলিশকে ফোন করে, তখন বুঝতে হবে সেই মানুষটি এমন এক পর্যায়ে পুলিশকে ফোন করেন বা ডাকেন, যখন তার হাতের কাছের সব উপায় নিঃশেষ হয়ে গেছে। People call the police when everything else has failed.

কোন নাগরিক যদি দিনের বেলায় পুলিশকে ফোন করে, তাহলে আমি বুঝি, নাগরিকটির পুলিশকে অবশ্যই দরকার। কেউ যদি রাতের বেলা পুলিশকে ফোন করে, আমি বুঝি দিনের বেলায় যে মানুষটি পুলিশকে ফোন করে, রাতের বেলায় যিনি ফোন করেছেন তার প্রয়োজনটি আরো অনেক বেশি জরুরি। কেউ যদি পুলিশকে গভীর রাতে ফোন করে, আমি বুঝে নেই, সেই মানুষটির সমস্যা বা বিপদটি আরো বেশি গভীর। সমস্যার গভীরতা রাতের গভীরতাকে অতিক্রম না করলে কেউ কি পুলিশ ডাকে?

মানুষকে সেবা দেওয়ার মানসিকতায় আমাকে একটি বদঅভ্যাসে অভ্যস্ত করে তুলেছে। আমি দিবারাত্র আমার ফোনটি খোলা রাখি এবং সব ধরণের কলই রিসিভ করি। কিন্তু, গভীর রাতের ফোনটি যদি হয় একটি উটকো তদ্বিরের, তখন কেমন লাগে?

আজ রাত আড়াইটায় বেজে উঠল ফোনটি। অনিচ্ছা সত্ত্বেও ধরলাম। অনিচ্ছ এই জন্য যে বর্তমানে আমি জরুরী পুলিশ সেবা দেওয়ার কাজে নিয়োজিত নই। আমি পুলিশ হেডকোয়ার্টাসে এখন একজন মাঝারী মাপের কেরানির কাজ করি। আমার বর্তমান কাজের ধরন পুলিশ সেবাপ্রার্থীদের কাছে আমাকে এখন ততোটা বেশি জরুরি বা অপরিহার্য করে তোলে নাই। তবে, সাথে সাথে এও বুঝি, গভীর রাতে যদি কেউ আমাকে স্মরণ করে, নিশ্চয় সে খোস গল্প করার জন্য আমাকে ফোন করেনি।

কিন্তু না, এটা এক ধরণের খোশ গল্পই বলব। কুড়িগ্রাম জেলার উলিপুর থানার একটি টহল পুলিশ দল একটি ট্রাক থামিয়েছে। ট্রাকের সাথে কাগজপত্র নেই। ট্রাক চালকের ভাষ্য মতে, কিছু দিন আগে রংপুর শহরে হরতালকারীগণ এই ট্রাকটি পুড়ে দিয়েছিল।( এই খবর সত্য)। আর ট্রাকের সাথে ওর পরিচয়ধারী কাগজপত্র গুলোও পুড়ে গেছে। কিন্তু ট্রাকের শরীরখানা খুব দ্রুত পুনর্গঠিত হলেও গাড়ির অত্যাবশ্যক দলিলাদির পূনর্জন্ম এখন পর্যন্ত হয়নি।

ট্রাকটি পাথরে বোঝাই। এই রাস্তা দিয়ে ভারী ট্রাক চলাচলও নিষেধ। সব কিছু মিলে টহল দলটি এই ট্রাকটিকে শুধু থামানোই নয়, জব্দ করে থানায় নিয়ে যেতে পারে। কিন্তু, আইনগতভাবে বৈধ হলেই কি পুলিশ সব পারে? ট্রাকের মালিক আছে না? আর ট্রাকের মালিকের ঊর্ধ্বতন পুলিশ-আত্মীয়টি আছে না?

একবারের প্রচেষ্টায় ফোনে আমাকে পেয়ে ট্রাকের চালক বড়ই খুশি। আমার কাছে টহল পুলিশ ও তার দলনেতা সম্পর্কে এক গাদা অভিযোগ করে বসল। ইনিয়ে বিনিয়ে বলতে লাগল, এত রাতে তারা আমার ট্রাক থামাবে কেন? এরা ঘুসের জন্য অযথাই ঝামেলা করে। পুলিশগুলো বড় বদমাস!(তবে তিনি যার কাছে ফোন করছেন, তিনিও যে পুলিশ সেটা তিনি ভুলেই গেছেন।)

বড় উদ্ভট এ তদবির! ট্রাকের সাথে কোন কাগজপত্র নেই। ট্রাফিক আইন আর মোটরযান আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘণ করেছে ড্রাইভার। নিষিদ্ধ রাস্তা দিয়ে ট্রাক চালানো, পুলিশের সংকেত অমান্য করে গাড়ি চালানো, নিজের ড্রাইভিং লাইসেন্সখানা দুই নম্বর— এসবের কোনটিই তার কাছে অপরাধ নয়। টহল পুলিশ রাতের বেলায় তার ট্রাকখানা থামিয়ে তার কাগজপত্র দেখতে চেয়েছে, এটিই হল বড় অপরাধ। এটা হল পরিবহন মালিক শ্রমিকদের নিজস্ব দণ্ডবিধি।

ড্রাইভার তার ফোনটি ধরিয়ে দিল টহল দলের নেতার কাছে। তিনি এসআই সাইফুল। কমিউনিটি পুলিশিং নিয়ে মিশনারির মতো সারা দেশে ঘুরে বেড়ানোর সুবাদে এসআই সাইফুল আমাকে চেনেন। অতি বিনয়ের সাথে তিনি সব খুলে বললেন। ট্রাক ড্রাইভারের ভাষ্য আর তার ভাষ্যের মধ্যে কত পার্থক্য! তদবিরকারীগণ তদবির করার সময় ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তাদের কাছে সাধারণত সবটুকু বলেন না। তদবিরকারীগণ তাদের দোষগুলো যথাসম্ভব গোপন রেখে মাঠ পর্যায়ের পুলিশগুলোকে ইবলিশ শয়তানরূপে উপস্থাপন করেন।

আর আমি যার পর নেই বিরক্ত। এসআই সাইফুলকে বললাম, এটা আমার এক আত্মীয়ের ট্রাক। যদি ড্রাইভার আপনার সাথে বেয়াদবী করে, তাহলে সেও পুলিশের কাছ থেকে বড় ধরনের আতিথ্য নীতিগতভাবে দাবি করতে পারে না। আর আমি নিজেও বড় বিপদে আছি। আপনি ফোনে আমার সাথে কথা না বললেই আমি বেশি খুশি হতাম।

এসআই সাইফুলকে বললাম, দয়া করে আমার আত্মীয়ের পরমাত্মীয় এ ট্রাক ড্রাইভারের দুই গালে দুটো থাপ্পড় দিবেন। না, না, টহল দলের নেতা হিসেবে নয়। আপনি কাজটি করবেন আমার খাতিরে। রাত আড়াইটায় আমাকে অবৈধ তদবিরের জন্য ঘুম ভাঙ্গার কষ্ট দেওয়ায় তার অন্তত এক জোড়া থাপ্পড় পাওনা হয়ে গেছে। শয়তানকেও তার পাওনা বুঝে দিতে হয়। তাই আমার পরমাত্মীয়ের পাওনাটা মেটাবেন না? তবে আমি নিশ্চিত, পুলিশ আমার আত্মীয়ের ট্রাকের ড্রাইভারটিকে তার প্রাপ্যটুকু দেয়নি। বরং তাকে দলিলপত্রহীন ট্রাকটি নিয়ে তার গন্থব্যে যেতে দিয়েছেন।

দোহাই অফিসারগণ, আমার নাম করে কেউ যদি আপনাদের কাছে কোন ফোন এগিয়ে দেয়, ধরবেন না। তদবির যদি করতেই হয়, আমি আমার ফোন থেকে আপনাদের ফোনে ফোন দিয়েই তা করব। অন্যের এগিয়ে দেওয়া ফোনে কান দিবেন না। (৩০ সেপ্টেম্বর,২০১৩)