ন্যায় বিচারের প্রহেলিকা

মোঃ আব্দুর রাজ্জাক
Published : 23 April 2014, 06:34 PM
Updated : 23 April 2014, 06:34 PM

নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের অধীন অপহরণের কথিত অপরাধে যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত এক নির্দোষ দম্পতির সম্প্রতি জামালপুর জেলখানা থেকে মুক্তির পর অনেকের মনেই প্রশ্ন জেগেছে আমাদের বিচার ব্যবস্থায় নির্দোষ মানুষকে সাজা দেয়া হয় কিভাবে? যেখানে শতশত অপরাধী আমাদের নাকের ডগায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। চিহ্নিত অপরাধীগণ প্রকাশ্য দিবালোকে মানুষ খুন করে আদালতের সদর দরজা দিয়ে বের হয়ে আসছে, যেখানে দেশের ফৌজদারি আদালতে বিচারে সাজার হার ১৩% এর বেশি নয়, সেখানে একজন নিরীহ মানুষকে সাজা দেয়ার বিষয়টি বিস্ময়কর নয় কি ? যদি সম্পূর্ণ নিরপরাধ এই দম্পতির যাবজ্জীবন সাজার রায় হতে পারে তবে এটা কি অসম্ভব যে আমদের বিচার ব্যবস্থায় অনেক নির্দোষ মানুষের মৃত্যুদণ্ডের আদেশ হয়। অনেক নির্দোষ মানুষ হয়তো এরই মাঝে অপরাধ না করেও বড় ধরনের সাজা ভোগ করছে, কেউ কেউ বিনা দোষে জেল খেটে মুক্ত জীবনের স্বাদ পেলেও জেলখানায় হারিয়ে এসেছেন জীবন-যৌবন, সুখ-স্বাচ্ছন্দ| এমনও তো হতে পারে ইতোমধ্যেই একাধিক ব্যক্তির বিনা দোষে মৃত্যুদণ্ড পর্যন্ত কার্যকর হয়েছে। আর বড় বড় সাজার ক্ষেত্রে যা হয়েছে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অপরাধের সামান্য প্রকৃতির সাজার ক্ষেত্রে নিশ্চয়ই এর হার অপেড়্গাকৃত বেশি হবে ?

হ্যাঁ, প্রত্যেক দেশের ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থায় শত শত অপরাধী যেমন নিত্য দিনের অপরাধে কোন সাজাই হয় না তেমনি অনেক নিরপরাধ আদম সন্তানও বিনাদোষে মারা পড়ে, জেলের ঘানি টানে। একই কথা আমাদের দেশের বিচার ব্যবস্থাতেও বিদ্যমান। এই বিষয়কে অনেকে বিচার ব্যবস্থার পদ্ধতিগত ক্ষতি বা সিস্টেম লস বলতে চান, কেউ কা বলেন এটা বিচারের নামে প্রহসন কিংবা বিচারের প্রহেলিকা। ইংরেজিতে বলে, Miscarriage of Justice| আমার পেশাগত জীবনে তিনটি ঘটনা উল্লেখ করে বিষয়টি নিয়ে গভীর বিশ্লেষণ দেওয়ার চেষ্টা করব।

ঘটনা-১
২০০৮ সালের প্রথমার্ধে আমি ঝালকাঠি জেলার ভারপ্রাপ্ত পুলিশ সুপারের দায়িত্ব পালন করি। এই সময় আমার কানে আসল যে, নারী ও শিশু নির্যাতন মামলার আসামীদের ১৪ বছর পর্যন্ত সাজা হওয়া পর অপহরণ ও গুম মামলার ভিকটিম নিজেই উদ্ধার হয়ে এলাকায় এসেছে। ঘটনাটি ছিল ঝালকাঠি জেলার সদর থানা এলাকায়। ঘটনাটি ছিল এমন। এক বাসায় একটি কিশোরী মেয়ে কাজ করত। মেয়েটি একদিন লা-পাত্তা হয়। মেয়েটির মামা বাদী হয়ে মামলা করে। তদন্তে প্রকাশ পায় যে মেয়েটি নিখোঁজ। পুলিশ তথ্য, প্রমাণ ও আলামত উদ্ধার করে। মেয়েটির এক জোড়া কানের দুল গৃহ কর্তৃর তথা আসামীদের একজনের কাছে পাওয়া যায়। গৃহকর্তীর ভাষ্য মতে মেয়েটি স্বেচ্ছায় চলে যাওয়ার কয়েকদিন পূর্বে সে তার কানের দুল তার কাছে বিক্রয় করেছে। তবে সে কোথায় গেছে, কিভাবে গেছে তিনি তা বলতে পারেন না। মেয়েটি যে কাউকে না বলে লাপাত্তা হবে তিনি তা বুঝতে পারেননি।

কিন্তু সে শোনে কার কথা! ভিকটিম লা-পাত্তা, মামলার তদন্ত শেষে প্রতিবেদন দাখিলের সর্বোচ্চ সময় তিন মাস। তাই পুলিশ পুরো ঘটনা উদঘাটন করতে না পারলেও আদালতে একটা অভিযোগ পত্র দিয়ে দেয়। আদালত এর প্রেক্ষিতে বিচার করে। ঝালকাঠি জেলার অতিরিক্ত দায়রা জজের আদালতে মামলাটির বিচার হয়। বিচারক দুই জনকে ১০ বছর করে ও একজনকে ১৪ বছরের কারাদণ্ড দেন। মামলার তদন্ত বিচার সবটাই দ্রুত হয়। আসামীদের মধ্যে একজন ছিল পলাতক অন্য দুইজন হাজতে। কিন্তু এরই মাঝে ভিকটিম নিরুদ্দেশ অবস্থা থেকে বের হয়ে এলাকায় আসে। সে ঘোষণা করে সে অপহৃত হয়নি। স্বেচ্ছায় ঢাকায় চলে গিয়েছিল। সে সাক্ষ্য দেয় যে আসামীরা নির্দোষ তাদের ভাষ্যই সঠিক।

ঝালকাঠি থানা পুলিশ এই ভিকটিমকে গ্রেফতার করে বিজ্ঞ মূখ্য বিচারিক হাকিমের সামনে উপস্থিত করেন। ভাগ্যের কি পরিহাস এই একই বিচারক অতিরিক্ত জেলা জজ থাকাকালীন এই মামলার বিচার করেছিলেন। যে কিশোরীকে অপহরণ ও গুমের দায়ে তিনজন নিরপরাধ ব্যক্তিকে সাজা দিয়েছিলেন তিনি, সেই ভিকটিমই তার এজলাসে পাঁচ বছর পর দাঁড়িয়ে জবানবন্দী দিচ্ছেন তাকে কেউ অপহরণ করেনি। বিচারক যাদের সাজা দিয়েছিলেন, তারা নির্দোষ। বিষয়টি শুধু পুলিশের কাছেই বিব্রতকর ছিল না, বিব্রতকর ছিল স্বয়ং বিচারকের কাছে। সাধারণত কোন মামলায় আসামী পক্ষ সাজার বিরুদ্ধে উচ্চতর আদালতে আপীল করেন। কিন্তু আপীলেট অথরিটি না হলেও বিষয়টি তারই কাছে অন্য আঙ্গিকে এসে বিচারককে যার পর নেই বিব্রত করেছে। পূর্বে বিচারক ছিলেন অতিরিক্ত দায়রা জজ। বর্তমানে মূখ্য জুডিশিয়াল হাকিম। পুলিশ মেয়েটিকে তার কাছেই নিয়ে গেল। বিচারক মেয়েটিকে নিয়ে কি করবেন, নিজেই বুঝে উঠতে পারছিলেন না।

ঘটনার পর দুই তিন মাস আমি ঝালকাঠি জেলায় কর্মরত ছিলাম। পত্র-পত্রিকায় এ নিয়ে বেশ ঝড় ওঠে। সবাই পুলিশের ত্রম্নটি খুঁজে বেড়ান। এক সময় মাননীয় আইজিপি জনাব নূর মোহাম্মদ আমাকে ফোন করে বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চান। তিনি আমাকে নির্দেশ দেন, আমি যেন ব্যক্তিগত ভাবে খোঁজ নিয়ে দেখি পুলিশের দোষ কোথায় ছিল? প্রয়োজনে জড়িত পুলিশ সদস্যদের আমি যেন বিভাগীয় শাসিত্মর আওতায় আনি। আর বাদীর বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেই। তার ভাষায় বাদীকে ধরে 'ছ্যাঁচা' দেই।

আমি মামলার ডকেটটি পাইনি, আদালতের পুরো রায়টিও আমার পক্ষে পুরো পড়া সম্ভব হয়নি। তবে সবকিছু খোঁজ খবর নিয়ে যা জেনেছি তা হলো মেয়েটির রেখে যাওয়া কানের দুল জোড়াই এই ভুল রায়ের পিছনে নিয়ামক ভুমিকা পালন করেছে। যে মেয়েটি আসামীদের জিম্মায় ছিল তাকে আর পাওয়া গেল না অথচ তার কানের দুল জোড়া আসামীদের হেফাজতে পাওয়া গেল এর ব্যাখ্যায় আদালত এই সাজার রায়। বিষয়টি নিয়ে হৈ চৈ হওয়ার প্রেড়্গিতে সমজাতীয় অভিযোগগুলোতে অভিযোগপত্র দাখিলে আমার তদন্তকারী কর্মকর্তার বড়বেশি খুত খুত করতেন। তারা পারতপক্ষে মামলা শেষ করতেই চাইতেন না। ভিকটিম উদ্ধার না হওয়া পর্যন্ত তারা মামলার তদন্তই শেষ করন না। কিন্তু এইসব ক্ষেত্রে ভিকটিম উদ্ধার করা বড় কঠিন। আবার তিন মাসের মধ্যে মামলার তদন্ত শেষ করতে না পারলে বিভাগীয় ব্যবস্থার মুখোমুখি হতে হয়। সবকিছু মিলে মাঠ পর্যায়ে তদন্তকারী কর্মকর্তারা নারী ও শিশু অপহরণ কিংবা গুম মামলা নিয়ে বড়ই সিদ্ধান্তহীনতায় থাকে। আমি কয়েক মাস পরেই ঝালকাঠি জেলা থেকে সুদান মিশনে চলে যাই। এই ঘটনার সর্বশেষ কী হয়েছিল তা সঠিক জানি না ? তবে এটা ঠিক যে ভিকটিম উদ্ধার হওয়ায় এবং সে নিজে আসামীদের নির্দোষ ঘোষণা করায় আসামীরা ছাড়া পেয়েছিল। কিন্তু এই ছাড়া পাওয়াটা ছিল অনেক কষ্টের পর, অনেক সময়, অনেক অর্থ আর মান-সম্মান হারানোর পর।

ঘটনা-২
মাগুরা জেলায় অতিরিক্ত পুলিশ সুপার হিসেবে কাজ করতে গিয়ে এ জাতীয় দু'টো ঘটনার কথা জেনেছিলাম। একটি অপ্রকৃতিস্ত যুবক তার এক মামার বাসা থেকে নিখোঁজ হলে তার বাবার পক্ষ থেকে একটি অপহরণ ও গুমের মামলা করা হয়। ওয়ারিসসূত্রে প্রাপ্ত জায়গা জমি নিয়ে গণ্ডগোলের সুবাদে বোনের স্বামী তার ভাইদের এক হাত দেখে নেয়ার একটা ব্যবস্থা করে। ভিকটিম উদ্ধার হয়নি। তবে ভিকটিম যে সেচ্ছায় কোথাও চলে গিয়েছিল তার পক্ষে সামান্য প্রমাণ পাওয়া যায়। অসমর্থিত সূত্রে জানা যায় যে ভিকটিম একটি বিদ্যুৎ দুর্ঘটনায় ঢাকায় মারা গিয়েছিল। মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেখা হলে প্রভাবশালীদের চাপে তার নারাজি পড়ে।

ঘটনা-৩
মাগুরার শ্রীপুর থানার এক গ্রামের এক ভিক্ষুক একই গ্রামের অন্য এক ভিক্ষুকের সাথে যশোর অঞ্চলে ভিক্ষা করতে গিয়ে নিখোঁজ হয়। নিখোঁজ ভিক্ষুকের আত্মীয়রা মামলা করলে মামলাটির তদন্ত বেশ কিছুদিন ধরে চলে। থানা পুলিশ চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করে। পরে তার অধিকতর তদন্ত শেষে পূনরায় চুড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হয়। বা দ্বিতীয়বারের মতো নারাজি দিয়ে মামলাটি সিআইডিকে দিয়ে তদন্ত করানোর আবেদন করে । আদালত সিআইডিকে দিয়ে তদন্ত করানোর নির্দেশ দিলে সিআইডি যশোর জোনের এএসপিকে এর তদন্তভার অর্পণ করে। এর মাঝে পুলিশ হেডকোয়ার্টার্স থেকে জানতে চাওয়া হল ভিকটিম উদ্ধার না হওয়া সত্ত্বেও কেন বার বার এই মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হচ্ছে। উত্তর তৈরি করার ভার পড়ে আমার উপর। আমি সার্কেল অফিসে সংরক্ষিত সকল রেকর্ডপত্র পর্যালোচনা করি। আমি দেখতে পাই, এই ভিক্ষুক তার প্রতিবেশির সাথে যশোরে গিয়ে পুরাতুন কাপড় ভিক্ষা করে মার্কেটে বিক্রয় করত। একটি নির্দিষ্ট দোকানে সে কাপড়গুলো দিতো। অনেক সময় তার দাম বাকী থাকত। একদিন কাপড় দিয়ে তার দাম নিয়ে সে চলে যাওয়ার পরে সে আর আসেনি। সে যে বাসায় ভাড়া থাকত সেই বাসার মালিকও সাক্ষ্য দেয় যে পুরাতন কাপড় চেয়ে-চিন্তে সেগুলো স্টেশনের এক দোকানে বিক্রয় করে ভিকটিম তাকে বাড়ি ভাড়া দিত। নিখোঁজ হওয়ার মাসেও সে বাড়ি ভাড়া পরিশোধ করেছে।

এও প্রমাণ পাওয়া যায় যে তার প্রতিবেশির সাথে যশোরে যাওয়ার পরেও ভিকটিম কয়েকবার বাড়িতে এসেছিল। কিন্তু সে হঠাৎ করে লা-পাত্তা হলে সেই প্রতিবেশীকে দোষারোপ করা হয়। পুলিশের এই সব বিষয়ের উপর তদন্ত সঠিক ছিল। কিন্তু তাদের দুর্বলতা ছিল তারা ভিকটিমকে জীবিত উদ্ধার করতে পারেনি। এক্ষেত্রে সন্দেহপূর্ণ তদন্তের মাধ্যমে আদালতে একটি অভিযোগপত্র জমা দেয়া যায়। কিন্তু তা দিয়ে আসামীদের শাস্তি দেয়া যেত না। অন্য দিকে আসামীদের এই পরিস্থিতিতে সাজা দিলে কি তা ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠিত হতো? এই মামলার তদন্ত প্রক্রিয়ার টানা-পোড়েন এখানেই। সিআইডির এএসপি জনাব আব্দুল হালিম আমাকে জানিয়েছিলেন যতদিন ভিকটিম কিংবা তার লাশ উদ্ধার না হবে ততোদিন এই মামলাটি তাদের কাছে তদন্তাধীনই থাকবে। এভাবে নিশ্চয়ই অনেক মামলা হিমাগারে পড়ে আছে।

আমার উপরে আলোচিত ঘটনাগুলোর প্রেক্ষিতে পুলিশ ও বিচারকদের এই জাতীয় অপহরণ মামলাগুলো নিয়ে একটি হেঁয়ালীপনার ভাব লক্ষ্য করা যায়। এক্ষেত্রে আদালত ও পুলিশ উভয়েই বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে। আর এই সব পরিস্থিতিতেই ভুল তদন্ত আর সেই তদন্ত কিংবা বিচার প্রক্রিয়ার দুর্বলতার জন্য নির্দোষ ব্যক্তিদের সাজা হতে পারে। এই সাজা যদি যাবজ্জীবন বা জেল জরিমানার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে তবে কোন এক সময় তার ত্রুটিগুলো উম্নোচিত হয়। ভুল সংশোধনের জন্য সময় পাওয়া যায়। কিন্তু এই সাজা যদি হয় মৃত্যুদণ্ড তাহলে ন্যায় বিচারের পথ রুদ্ধ হয়ে পড়ে; দ্রুত নিঃশেষ হয় বিচার ব্যবস্থার উপর সাধারণ মানুষের বিশ্বাসে।

বিশ্বব্যাপী বিচার ব্যবস্থার এই ত্রুটির পাল্টা প্রতিক্রিয়া হিসেবে মৃত্যুদন্ডের বিধান তুলে দেওয়ার দাবী ওঠেছে। দুনিয়া থেকে মৃত্যুণ্ড তুলে দেয়ার জন্য খোদ জাতিসংঘই কাজ করছে। আর ভুল বিচার বা miscarriage of justice থেকে নিরপরাধ ব্যক্তিদের মুক্ত করতে এগিয়ে এসেছে কতিপয় মানবাধিকার সংগঠন যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক The Innocence Project হল তারই অন্যতম। এই প্রজেক্ট বিশ্ব ব্যাপী miscarriage of justice নিয়ে কাজ করছেন, গবেষণা করছে ও নির্দোষ ব্যক্তিদের আইনী জুলুম থেকে বাঁচানোর জন্য ডিএনএ পরীক্ষার আশ্রয় নিচ্ছে।

কোন দশের বিচার ব্যবস্থায় কতজন মানুষ নির্দোষ হয়েও সাজা ভোগ করছে তার হিসেব করা বড়ই দুরহ। কেননা একবার শাস্তি হয়ে গেলে তাকে নির্দোষ বলা আইনগতভাবেই অন্যায়। তবে ১৯৯০ সালের এক জনউপলব্ধি জরীপের ফলাফলে দেখানো হয়েছে আমেরিকা যুক্ত রাষ্ট্রের জেলখানাগুলোতে সেই সময় প্রায় ১০ হাজার মানুষ কতিপয় জঘন্য অপরাধের জড়িত হওয়ার দোষে সাজা খাটছে। ১৮৮ জন বিচারক, আইনজীবী, অহিও রাজ্যের পুলিশ প্রধান ও ৪১ জন সরকারি কৌশলী গবেষকদের সাথে সাক্ষাৎকারে দাবি করেছেন যে যুক্তরাষ্ট্রের শতকরা ১ ভাগের কম তবে শূন্য ভাগের চেয়ে বেশি মানুষ বিনা দোষে সাজাপ্রাপ্ত হয়। গবেষকগণ এই জরীপ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের মোট সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের শতকরা মাত্র ০.৫ ভাগকে নিরপরাধ ধরে এই সংখ্যা নির্ধারণ করেছেন । তবে এই হিসেবে সাধারণ প্রকৃতির অপরাধে সাজাপ্রাপ্তদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। শুধু এফবিআই এর তালিকাভুক্ত গুরুতর প্রকৃতির অপরাধ যেমন হত্যা, ডাকাতি, অপহরণ, গুরুতর আঘাত, সিঁধেল চুরি ইত্যাদি রয়েছে।

গবেষণায় দেখা গেছে কোন মামলায় নির্দোষ ব্যক্তির সাজা হওয়ার পিছনে বেশ কিছু কারণ ক্রিয়াশীল(১) ৷ এগুলো হল
• মিথ্যা সাক্ষ্য প্রতক্ষদর্শীদের ভুল শনাক্তকরণ
• ত্রুটিপূর্ণ ফরেনসিক পরীক্ষা ও ভুল মতামত
• মিথ্যা স্বীকারোক্তি বা বিবৃতি
• সরকারি অসদাচরণ
• রাজসাক্ষী/সোর্স/সহযোগীদের ভুল তথ্য
• আইনজীবীদের দুর্বলতা
নিরপরাধ ব্যক্তিদের সাজা হওয়ার পিছনে সবচেয়ে বড় কারণ হল, প্রত্যক্ষ সাক্ষীদের মিথ্যা সাক্ষ্য বা ভুল শনাক্তকরণ৷ ইন্নোসেন্ট প্রকল্পের প্রতিষ্ঠিত প্রথম ২২৫ টি মিথ্যা সাজার মধ্যে ১৭৩ টি (৭৭%) ছিল মিথ্যা সাক্ষ্য বা ভুল শনাক্তকরণের জন্য৷ এর পরেই রয়েছে ত্রুটিপূর্ণ ফরেনসিক আলামত বা গবেষণাগারের ভুল রিডিং৷ এ ক্ষেত্রে ফরেনসিক আলামতের ত্রুটিপূর্ণ বা দুর্বল ব্যবস্থাপনাই মূলত দায়ী৷ ফরেনসিক আলামতের ব্যবস্থাপনা বলতে আলামত সংগ্রহ, সংরক্ষণ, পরিবহন থেকে গবেষণাগারে আলামতের নমুনা পরীক্ষা করে মতামত প্রদান পর্যন্ত বোঝায়৷ ১৯৮৯ সাল থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত ইন্নোসেন্ট প্রকল্প যুক্ত রাষ্ট্রের ৩৬ টি অংগ রাজ্যের বিচার ব্যবস্থা থেকে প্রায় ৩১২ জন মানুষকে মুক্ত করেছে(২) ৷

ইন্নোসেন্ট প্রকল্পের নির্দোষ ব্যক্তি খোঁজার কার্যক্রম অবশ্য ডিএনএ টেস্টের মধ্যেই সীমাবদ্ধ৷ তাই সে সব মামলার ক্ষেত্রে ডিএনএ আলামত সংরক্ষিত নেই কিংবা ডিএনএ আলামত সংগ্রহ করা সম্ভব নয়, সেই সব ক্ষেত্রে নির্দোষ ব্যক্তিদের খুঁজে বের করার কোন পদক্ষেপ নেই৷ গবেষণায় প্রমাণিত হয় যে ৭৭% ভুল সাজা হয় মিথ্যা সাৰ্য বা মৌখিক সাক্ষীদের ভুল শনাক্তকরণের জন্য৷ তাই ইন্নোসেন্ট প্রকল্পের আওতার বাইরে যে হাজার হাজার নিরপরাধ ব্যক্তি জেলখানার ঘানি টানছে এ বিষয়ে সন্দেহ কি৷

বাংলাদেশের ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থার প্রায় পুরোটাই অবৈজ্ঞানিক ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে আছে। এখানে সাক্ষ্য আইন অনুসারে মৌখিক সাক্ষ্যই হল প্রত্যক্ষ সাক্ষ্য। বৈজ্ঞানিক তদন্ত বাংলাদেশে এখনও প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। যদিও হস্তরেখা, পদরেখা, অনুবিশ্লেষণ ইত্যাদি পদ্ধতি আমাদের তদন্ত ও বিচার ব্যবস্থায় দীর্ঘ দিন থেকে প্রচলিত রয়েছে িএবং এই ব্যবস্থাগুলোকে আধুনিকীকরণে হাল আমলে প্রচেষ্টাও চলছে, তথাপিও বৈজ্ঞানিক বৈজ্ঞানিক তদন্ত এই দেশে কোন দিনই মূলধারার তদন্তের অংশ হতে পারেনি। ব্যতীক্রম ক্ষেত্র ছাড়া আমাদের পুলিশি তদন্ত মৌখিক সাক্ষ্যের উপর নির্ভরশীল।

উদাহরণ স্বরূপ সিআইডিতে ২০০১ সালে চালু হওয়া  Automated Fingerprint Identification System (AFIS) বা স্বয়ংক্রিয় হস্তচ্ছাপ শনাক্তকরণ পদ্ধতি চালু করা হয়। এই সিস্টেমে প্রতিদিনই কিছু না কিছু ফিংগারপ্রিন্ট সংরক্ষণ করা হলেও এইসব সংরক্ষিত ফিংগারপ্রিন্ট ব্যবহার করে অপরাধী শনাক্তকরণের  এখন পর্যন্ত দুই তিনটির বেশি ঘটনা ঘটেনি। বস্তুত মাঠ পর্যায়ের তদন্তকারী কর্মকর্তাগণ ঘটনাস্থল থেকে অপরাধীদের ফিংগারপ্রিন্ট উত্তোলন করে তার সাথে আফিস ডাটা বেইসে সংরক্ষিত কিংবা তাদের গ্রেফতারকৃত বা নিয়ন্ত্রণাধীন সন্দিগ্ধ ব্যক্তিদের কাছ থেকে নমুনা নিয়ে তাদের সাদৃশ্য বা বৈসাদৃশ্য খোঁজার জন্য সিআইডিতে কদাচিত প্রেরণ করেন। অর্থাৎ তদন্তক্ষেত্রে পুলিশের মাঠ এখনও বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি ব্যবহারে তেমন আগ্রহী নয়। তারা এখনও মৌখিক সাক্ষ্য আর আসেপাশের কিছু আলামত নিয়েই তাদের তদন্তকার্য সমাপ্ত করছেন। এর ফলেেএক দিকে যেমন অপরাধীদের সাজার দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না, অন্যদিকে তেমনি নিরপরাধ ব্যক্তিদের সাজা পাবার সম্ভাবনাও বৃদ্ধি পাচ্ছে।

রচনাসূত্র:
১. http://www.innocenceproject.org/understand/
২.http://www.innocenceproject.org/Content/How_many_people_have_been_exonerated_through_DNA_testing.php