নারী নির্যাতন বনাম পুরুষ নির্যাতনঃ থানা পুলিশের দায়বদ্ধতা

মোঃ আব্দুর রাজ্জাক
Published : 25 June 2014, 06:06 AM
Updated : 25 June 2014, 06:06 AM

আমার জনৈক বন্ধু কায়েসের সুত্র ধরে বগুড়া থেকে বেশ কিছু দিন আগে এক কলেজ শিক্ষক ফোন করেছিলেন। তার বিবাহ বিচ্ছেদ সংক্রান্ত কিছু বিষয়ে তিনি আমার কাছ থেকে সাহায্য চান। কিন্তু সেই সময় ফোনে বিষয়টির উপর তেমন গুরুত্ব দিতে পারি নাই। গত ৭ জুলাই ডঃ রফিক চলে এসেছেন পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সে। উদ্দেশ্য আইজিপি মহোদয়ের সাথে সাক্ষাৎ করে তার সাহায্য চাওয়া। কিন্তু তিনি আইজিপির সাথে দেখা করতে পারেন নি। চলে এসেছেন আমার কাছ

ডঃ রফিকুল ইসলাম বগুড়া জেলার শান্তাহার সরকারি কলেজের সহকারী অধ্যাপক। তিনি অবিবাহিত। গত বছর মোবাইল ফোনে পরিচয় হয় বগুড়া শহরের শাহনাজ পারভীন নামে এক তরুণীর সাথে।তবে শাহানাজের সাথে রফিকের কোন দিন সরাসরি সাক্ষাৎ হয়নি। যা কথাবার্তা হয়েছে সবই ফোনে। গত ১০ সেপ্টেম্বর, ২০১২ তারিখে ড. রফিক ফিরছিলেন তার কলেজ থেকে। ট্রেন থেকে বগুড়া স্টেশনে নামার পরই তিনি শাহনাজের ফোন পান। ফোনে শাহনাজ রফিকের লোকেশন জেনে নেন। এর কিছু পরেই কয়েকজন যুবক এসে ড. রফিককে জোর পূর্বক তুলে নিয়ে যায়। তাকে রাখা হয় পুরাতন বগুড়ার মিশুক ছাত্রাবাসের একটি কক্ষে। সেখানে তার উপর চলে নির্যাতন। অপহরণকারীদের অনেককেই রফিক চিনতে পারেন। তারা তার মানি ব্যাগসহ টাকা পয়সাও ছিনিয়ে নেয়।

এক পর্যায়ে আটকের স্থানে উপস্থিত হন শাহনাজ পারভিন। তিনি অপহরনকারীদের কাছে রফিককে স্বামী হিসেবে দাবী করেন। অনুরোধ করেন তাকে মারপিট না করার জন্য। শাহনাজের ভাড়া করা গুণ্ডারা তৎক্ষণাৎ মারপিট বন্ধ করে। এখানে শাহানাজ তার কাছ থেকে কিছু শূন্য দলিলে জোর পূর্বক সই গ্রহণ করে। তার মধ্যে একটি ছিল বিয়ের এফিডেভিট। এখানে বলা হয়েছিল শাহনাজ ও রফিক পরস্পরকে স্বামী-স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করছে।

ডঃ রফিক অপহরণ অবস্থা থেকে উদ্ধার পাওয়ার পর বগুড়া কোতওয়ালী থানায় মামলা করতে গিয়েছিলেন। কিন্তু থানার সহায়তা নাপেয়ে কোর্টে গিয়ে মামলা করেন। আদালত জুডিসিয়াল তদন্ত করে অপরাধীদের বিরুদ্ধে সমন ইস্যু করে। কিন্তু আদালতে কেউ উপস্থিত হয় নাই

ইতোমধ্যে একদিন শাহানাজ পারভীন কৌশলে ডঃ রফিকের বাসভবনে ঢুকে পড়ে। নিজেকে তিনি সেই বাড়ীর বউ হিসাবে দাবী করেন। কিন্তু কাবিন নামা বা অন্য কোন ভাবে সে নিজেকে রফিকের বউ বলে প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয়। বিষয়টি পাড়া প্রতিবেশিদের আলোচনার বিষয়ে পরিণত হলে শাহানাজ রফিকের বাড়ী থেকে বের হয়ে থানায় চলে যান। থানার অফিসার-ইন-চার্জ রফিককে থানায় ডেকে পাঠান। ডঃ রফিক থানায় গেলে তাকে সেখানে আটকে রেখে শাহানাজকে বিয়ে করার জন্য চাপ দেওয়া হয়। থানার অফিসার-ইন-চার্জের এই অবৈধ চাপের পিছনের কারণ হল শাহানাজের বাবা এক সময় পুলিশের কনস্টবল পদে চাকরি করত। সে তার ছলাকলায় পুলিশের মনে করুণার উদ্রেক করেছ

একপর্যায়ে ডঃ রফিককে দেড় লক্ষ টাকা মোহরানা লিখে থানায় মধ্যে কাজী ডেকেবিয়েও রেজিস্ট্রি করা হয়। থানার অফিসারগণ রফিককে বোঝান যে তারা জোর করে বিয়ের ব্যবস্থা করে বরং একটি পূণ্যের কাজই করেছেন।

কিন্তু ডঃরফিক এর দুই দিন পরেই এই জবরদস্তির বিবাহ সম্পর্কের ইতি টানেন। তিনি পৌরসভার মাধ্যমে শাহানাজকে তালাক দেন। তালাকের পরবর্তীতে শাহানাজের এক ভাই শাহনাজকে যৌতুকের জন্য মারপিটের জন্য রফিক ও তার পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে থানায় নারী ও শিশু নির্যাতন আইনে মামলা করেন।
উল্লেখ্য থানায় গৃহীত মামলার এজাহারে গুরুতর অসংগতি পরিলক্ষিত হয়। থানায় জোরপূর্বক কাবিন করা হয় ২২/৯/২০১২ তারিখে। অর্থাৎ ২২ সেপ্টেম্বর তারিখের পূর্বে শাহানাজ রফিকের স্ত্রী ছিলেন না। অন্যদিকে, শাহানাজের এক ভাই ২১/৯/২০১২তারিখে থানায় জিডির দরখাস্তে লিখেছেন যে তার বোনকে যৌতুকের দায়ে রফিক ও তার পরিবারের সদস্যগণ মারপিট করছে। অর্থাৎ শাহনাজকে মারপিটের ঘটনাটি ঘটেছিল তিনি রফিকের স্ত্রী হওয়ার একদিন আগে। রফিক ২৫/৯/২০১৩ তারিখে শাহানাজকে তালাক দেন। তারও প্রায় ১ মাস পর ১৮/১০/২০১২ তারিখে শাহানাজ থানায় মামলা করেন।

ইত্যাকার অসংগতি থাকার পরেও থানার তদন্তকারী অফিসার মামলাটির অভিযোগপত্র দেন। তবে অভিযোগপত্রে শুধু ডঃ রফিকেরই নাম রাখা হয়।আমি মামলার ১৬১ ধারার জবানবন্দী সমূহ পর্যালোচনা করেছি। মামলার বাদী ফোনের মাধ্যমে খবর পেয়ে শাহানাজের শ্বশুর বাড়ীতে যান। তবে তাকে মারপিটের ঘটনাবাদি নিজে দেখেননি। তার ভাষ্য মতে আশেপাশের লোকজন শাহানাজকে মারপিট থেকে উদ্ধার করে। কিন্তু থানায় জিডি করা শাহানাজের ভাই ও শাহানাজ ভিন্ন অন্য কোন সাক্ষীই ঘটনার অস্তিত্বের কথা স্বীকার করেননি। ভিকটিম ভিন্ন ঘটনার কোন প্রত্যক্ষ সাক্ষীও নেই। যারা ভিকটিমকে মারপিট থেকে উদ্ধার করেছে মর্মে বলা হয়েছে তাদের মধ্যে কেউ ঘটনার অস্তিত্ব পর্যন্ত স্বীকার করল না। তবুও তদন্তকারী কর্মকর্তা লিখেছেন, 'ডাক্তারী সনদপত্রে ভিকটিমের আহত হওয়াই প্রমাণ করে ডাক্তার রফিক যৌতুকের দায়ে তার স্ত্রীকে মারপিট করেছে'। এজাহার, ১৬১ ধারার জবানবন্দী ও অভিযোগপত্র পাঠে আমার মনে হয়েছে থানার অফিসারগণ একটি পূর্বসংস্কারজাত মানসিকতা নিয়ে এই মামলাটির অভিযোগ পত্র দিয়েছেন।

উল্লেখিত শাহানাজ পারভীন বগুড়া জেলার নন্দীগ্রাম থানা এলাকায় একটি বেসরকারী বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন। রেকর্ডপত্রে দেখা যায় সে স্থানীয় কিছু লোকের সাথে মোবাইলে প্রেমালাপ করে। এমন দুই ব্যক্তির স্ত্রীগণ একটি মোটর সাইকেল ভাড়া করে স্কুলের প্রধান শিক্ষকের কাছে গিয়ে শাহানাজের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে। এ ঘটনার প্রেক্ষিতে শাহানাজ নন্দিগ্রাম থানায় গিয়ে ডঃ রফিককে এক নম্বর আসামী করে একটি অপহরণ মামলা রুজু করেন। অভিযোগকারিণী ঐ দুই মহিলাকে থানা গ্রেফতারও করে। যাহোক, থানা পুলিশ ঐ দুই মহিলার সাথে ডঃ রফিকের কোন সম্পর্ক স্থাপন করতে না পেরে এবং প্রকৃত সত্য উদঘাটন করে মামলাটির চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল কর

এরপর ১৯/৪/২০১৩ তারিখে দৈনিক মানবজমিনে শাহানাজের কীর্তি কলাপ নিয়ে 'ফোনের ফাঁদে কলেজ শিক্ষক'নামে একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। প্রতিবেদনে শাহানাজের অতীত বর্তমানের যাবতীয় কুকর্মের ফিরিস্তি তুলে ধরা হয়। সেখানে দেখানো হয়, শাহানাজ ইতোপূর্বে এক সৌদি প্রবাসীকে বিয়ে করেছিলেন, তার বাবা একজন ভূয়া মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। তিনি এই ভাবে আরো অনেক পুরুষকে প্রতারিত করেছেন।

এ খবর প্রকাশিত হওয়ার পর শাহানাজ নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইবুনালে মানবজমিন পত্রিকার বিরুদ্ধে মামলা করেন যার প্রধান আসামী হল ডঃ রফিক। মামলাটি এখন বগুড়া কোতয়ালী থানায় তদন্তাধীন আছে।

এইভাবে একটার পরএকটি মামলা দিয়ে ডঃ রফিককে হয়রানী করছেন শাহানাজ। জন্মসূত্রে শাহানাজ একজন পুলিশের সন্তান। অন্যদিকে তার চেহারা সুরত আকর্ষণীয় এবং নারী সুলভ ছলা-কলাও তার আয়ত্বে রয়েছে যাদি দিয়ে তিনি সহজেই পুলিশকে ম্যানেজ করতে পারেন। যদিও প্রাথমিক পর্যায়ে ডঃ রফিকের দুর্দশার কফিনে পেরেক মেরেছিল থানা পুলিশই, তবুও বর্তমানে তারা ডঃ রফিকের প্রতি সহানুভূতিশীল। তবে শাহানাজকে প্রাথমিকভাবে সহায়তা করে এবং ডঃ রফিককে জোরপূর্বক থানায় কাজী ডেকে এনে একটি ভ্রষ্টা মেয়ের সাথে বিয়ে দিয়ে তারা যে অন্যায় করেছেন, তার প্রায়শ্চিত্য কোথায়? অন্য দিকে যে নারী ও শিশু নির্যাতন আইনের অধীন মামলায় ড. রফিক চার্জশিভুক্ত কিংবা একই আইনের অন্য একটি ধারার মামলা থানার কাছে তদন্তাধীন সেগুলোর ভাগ্যে কি ঘটবে তার পূর্বাভাসই বা কে দিবে?

পুরুষ কর্তৃক নারী নির্যাতনের বিষয়ে আমাদের দেশে আইন রয়েছে। কিন্তু নারী কর্তৃক পুরুষ নির্যাতনের বিরুদ্ধে কোন বিশেষ আইন নেই। নারীরা সামগ্রিকভাবে নির্যাতিতা হওয়া আমাদের রাষ্ট্র নারীর প্রতি সহানুভূতিশীল। কিন্তু শাহানাজের মতো যেসব নারী পুরুষদের নির্যাতন করছেন, তাদের কাছ থেকে সহজে নিষ্কৃতি পাওয়ার জন্য রাষ্ট্রের কোন কার্যক্রম নেই।

তবে থানা পুলিশের সদিচ্ছা, পেশাদারিত্ব, জবাবদিহিতার উপর বহুলাংশে নির্ভর করবে শাহানাজের মতো নারীরা ড. রফিকের মতো পুরুষদের কতটা নির্যাতন করতে পারবেন।কিংবা ড. রফিকের মতো পুরুষরা রাষ্ট্র যন্ত্র কর্তৃক কতটা হয়রানীর শিকার হবেন। কোন অভিযোগের সত্য-মিথ্যার প্রাথমিক অস্তিত্ব থানা পুলিশের চেয়ে সঠিকভাবে অন্য কেউ জানেন না। কিন্তু এই থানা পুলিশই যদি সত্যকে উপেক্ষা করে মিথ্যা অভিযোগ প্রতিষ্ঠার পক্ষে কাজ করে, তাহলে, রাষ্ট্রের বিচার ব্যবস্থার উপর মানুষের আস্থা থাকবে কি করে?
সূত্রাবলীঃ
১. ড. রফিকের সাথে ব্যক্তিগত সাক্ষাৎকার,
২. তার দেখানো মামলার নথিপত্র
৪. দৈনিক মানব জমিন ১৯এপ্রিল, ২০১৩