প্রতারণা, লোভ ও একজন সৎপাত্রের অনুসন্ধান

মোঃ আব্দুর রাজ্জাক
Published : 16 June 2014, 04:52 PM
Updated : 16 June 2014, 04:52 PM

তিনি এসেছিলেন রংপুর থেকে। তার এক ভাজতির অনুরোধে ঢাকায় আসা। তার ভাসতিটি একটি বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থানীয় ক্যাম্পাসের শিক্ষক। তার ভাষায় অধ্যাপিকা। এই অধ্যাপিকা অবিবাহিতা। তাই তার জন্য একজন উপযুক্ত পাত্র প্রয়োজন। আর এই পাত্র যদি হয় বাংলাদেশ পুলিশের একজন এএসপি তাহলে কেমন হয়?

হ্যাঁ, উপযুক্ত পাত্র যেমন উপযুক্ত পাত্রী খোঁজেন, তেমনি পাত্রীও বসে থাকেন না। পূর্বে ঘটকদের মাধ্যমে কাজটি হয়ে থাকত। আদিতে এক শ্রেণির মানুষ ছিলেন যারা নিঃস্বার্থভাবে পাত্র-পাত্রীদের খোঁজ-খবর রাখতেন । পরে এরা পেশাদার হয়ে যায়। বর্তমানে ঘটকের পেশার বারটা বাজিয়েছে মোবাইল ফোন আর ফেইসবুক। মোবাইলে কথা হয়, ফেইসবুকে দেখা হয়। এই কথা আর দেখার এক ফাঁকে পাত্র-পাত্রী স্বামী-স্ত্রীতে পরিণত হয়।

কিন্তু এই স্বনিয়ন্ত্রিত সাইবার ঘটকালীতে বড় বিপত্তি আছে। পাত্রগণ নিরাপদ অবস্থায় থাকলেও পাত্রীগণ প্রায়ই প্রতারিত হন। মোবাইলে মন দিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে এসে দেখেন তার পছন্দের পরুষটি নিতান্তই রিকসা চালক কিংবা কয়েক বাচ্চার জনক। অবিবাহিতা তরুণীটির তখন আর পিছনে ফেরার উপায় থাকে না।

কিন্তু আমাদের আলোচিত অবিবাহিতা অধ্যাপিকার মোবাইল প্রেমিক শুধু প্রেম করেই খান্ত হননি। তিনি তার প্রেমিকার কাছ থেকে দিনের পর দিন বিভিন্ন সুতায় অর্থ হাতিয়ে নিয়েছেন অনেক টাকা। সর্বশেষ তাদের ইনগেইজমেন্ট হওয়া কথা। এজন্য ঢাকায় প্রেমিকটি কিছু কেনা কাটা করবেন। তাই তার প্রেমিকার এক চাচাকে ঢাকায় আসতে বলেন। প্রেমিকার চাচা তার নিজস্ব কাজ কর্ম রেখে ঢাকায় আসেন।

আমাদের এই সাইবার প্রেমিক পুলিশের নাকি ৩১তম ব্যাচের এএসপি। তিনি নাকি চাকরি করেন পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সে। কিন্তু মেয়ের চাচাকে বলেন, খবরদার পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সে আসবেন না। আমার সাথে দেখা করতে হবে গুলিস্তান গোলাপশাহ মাজারের কাছে। আর পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সে অন্যকোন অফিসারকে বলাও যাবে না। মেয়ের চাচা আমিসহ আরো কয়েকজন ঊর্ধ্বতন পুলিশ অফিসারের রেফারেন্স দেন। প্রতারক সবাইকে চিনেন। তবে সিনিয়রদের এ বিষয়ে বলা উচিৎ হবে না বলে মেয়ের চাচাকে বারংবার অনুরোধ করেন। মেয়ের চাচাও কাউকে বলেননি।

কিন্তু অধ্যাপিকা মেয়েটির চাচা প্রতারকের নিষেধ অমান্য করেই এসে পড়েন পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সে। আর এই খবর জানতে পেরে প্রতারক তার ফোন বন্ধ করে দেয়। ফোনে যোগাযোগ করতে না পেরে ভদ্রলোক এসে পড়েন আমার অফিস কক্ষে। কারণ তিনি আমার স্বদেশী, রংপুরের মফিজ।

আমি তার গল্প শুনে অবাক! পুলিশের এএসপি পরিচয় দিয়ে তার ভাতিজিকে বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে দিনের পর দিন এই প্রতারক টাকা খসিয়ে যাচ্ছেন মেয়ের কাছ থেকে। সব টাকাই গ্রহণ প্রেরণ হয়েছে বিকাশের মাধ্যমে। আজ তার পরিসমাপ্তি ঘটল। তারা বুঝতে পারলেন, কোন এএসপি নয়, একজন সাধারণ শ্রেণির সাইবার প্রতারকের হাতে পড়েছেন তারা। তবে ভাগ্য ভাল। অল্পের মধ্য দিয়েই ফাঁড়া কেটেছে। কিছু টাকা গচ্চা গেছে, প্রতারককে বিয়ে করতে হয়নি।

আমি সম্ভাব্য সব স্থানে খবর নিলাম। প্রতারকের দেয়া গ্রামের বাড়িতে খবর নিলাম স্থানীয় থানার অফিসার-ইন-চার্জের মাধ্যমে, পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সে খবর নিলাম প্রশাসন শাখার মাধ্যমে। কিন্তু প্রতারকের দেয়া নামে কোন এএসপির সন্ধান কোথাও পেলাম না।

এভাবেই নিত্য নতুন কৌশলে চলছে প্রতারণা। প্রতারণা চলছে মোবাইল ফোনে, ফেইসবুকে এবং প্রতারণা চলছে সামনাসামনি, মুখোমুখিও। প্রতারকগণ বেশ কিছু ব্যতীক্রমী গুণের অধিকারী। তারা কথা ও আচরণের মাধ্যমে অন্যদের মনে বিশ্বাস জন্মাতে পারে। আর তাদের পাল্লায় যারা পড়েন, তারাও নিতান্তই সরল নন। তারা একটু বেশি মাত্রায় লোভী। লোভ আর প্রতারণা একে অপরের পরিপূরক। অনেক সময় নির্ভোল মানুষ প্রতারণার শিকার হয় বটে, কিন্তু লোভী মানুষ প্রতারণার উত্তম শিকার। জ্ঞানীরা বলেন, লোভে পাপ আর পাপে মৃত্যু। এই ভদ্রলোক ও তার ভাতিজি লোভের মাধ্যমে পাপ করেছেন, তবে তারা মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে গেছেন।

বিঃদ্রঃ
প্রতারণার মামলা বর্তমানে দুদকের সিডিউলভূক্ত মামলা। এই অপরাধের মামলা থানা পুলিশ রুজুও করতে পারে না, তদন্তও করতে পারে না। এক আইনজীবীর কাছ থেকে শুনলাম কেউ এই অপরাধের জন্য মামলা করতে চাইলে তাকে প্রথম যেতে হবে থানায়। থানা মামলা নিতে অস্বীকার করলে(এবং করবেই) তাকে যেতে হবে আদালতে। আদালত এই বিষয়টি হলফান্তে শুনানী করবেন। তারপর দুদককে নির্দেশ দিবেন। দুদক নির্দেশ পাওয়ার পর প্রাথমিক অনুসন্ধান করবে। এর পর প্রয়োজন হলে মামলা রুজু করে নিয়মিত তদন্ত করবে। তাই আমার রংপুরী ভাইয়ের ভাতিজির প্রতি প্রতারণা করে উক্ত প্রতারকের ধরা খাওয়া সম্ভাবনা ক্ষীণ।