শুধু ভূয়া মুক্তিযোদ্ধা নয়, সনদ জালের সাথে জড়িত সকলের শাস্তি হওয়া দরকার

মোঃ আব্দুর রাজ্জাক
Published : 22 July 2014, 07:05 AM
Updated : 22 July 2014, 07:05 AM

পত্রিকার হিসেব মতে এখন পর্যন্ত ১৫১ জন সরকারি কর্মকর্তা কর্মচারি ভূয়া মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে। এসব ভূয়া মুক্তিযোদ্ধা বা প্রতারক আমাদের মহানমুক্তি যুদ্ধের অর্জনকে ভূষণ্ডির কাকের মতো ছিঁড়েকুড়ে খাবার জন্য ওৎ পেতে ছিল। তাই মুক্তিযুদ্ধ না করেও তারা মুক্তিযোদ্ধার সম্মন ও সুযোগসুবিধা নেয়ার জঘন্যতম অপরাধে লিপ্ত হয়েছিল।

যদি বলি এরা শুধু সরকারি সুযোগ সুবিধা নিয়ে জনগণের অর্থ সংকট বাড়িয়ে তা হলে আংশিক বলা হবে। এরা প্রথমেই যে অপরাধটি করেছে, তাহল, আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের মহত্ব ও মর্যাদাকে ম্লান করার চেষ্টা চালিয়েছে। তারা মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে একটি বিভাজন সৃষ্টি করেছে। এরা এন্তনি চেখভের গল্পের মতো সেই মা যিনি তার স্বামীর উপর প্রতিশোধ নেয়ার জন্য মিথ্যাভাবে প্রচার করেছিল যে তার ছয়টি সন্তানের মধ্যে একটি তার স্বামীর ঔরসজাত নয়। এ তথ্য জানার পর ঔ স্বামী তার সব সন্তানের মধ্যেই ভিন্নতা দেখতে পেতেন। তিনি বুঝতে পারতেন না, আসলে কোন সন্তানটি তার ঔরসজাত নয়। ফলে তিনি তার সব সন্তানকেই নিজের নয় বলে মনে করতেন এবং ভিতরে ভিতরে কঠিন পীড়া ভোগ করতেন।

এই সব কুলাঙ্গারের জন্য মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে একটা বিভাজন তৈরি হয়েছিল এবং ভূয়া মুক্তিযোদ্ধা নামে একটি শব্দ আমাদের ডিকশনারিতেই শুধু নয় সমাজেও ঢুকে পড়েছিল। প্রতিষ্ঠিত মুক্তিযোদ্ধারা ছাড়া সমাজে অবস্থানহীন মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকেই সন্দেহ পোষণ করত। আমাদের মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক মন্ত্রী যেটা স্বীকার করেছেন। তাই এ অপরাধের সাজাটাই হতে হবে সবচেয়ে বড়। আমি তো মনে করি এ সব ভূয়া মুক্তিযোদ্ধাদের ছবি পত্রিকায় ছাপিয়ে তাদের প্রতি দেশবাসিকে ঘৃণা জানাবার আহব্বান জানানো যেতে পারে।

তারা সরকারি অবস্থানে থেকে সরকারি ক্ষমতার অপপ্রয়োগ করে নিজেদের পরিচয় গোপন নয়, উন্নত করার চেষ্টা করেছেন। তাই তাদের প্রতারণা বহুমাত্রিক- এক. তারা সরকারি কর্মচারি হিসেবে বিশ্বাস ভঙ্গ করেছেন, দুই. তারা অফিসিয়ালি দলিলপত্রের মাধ্যমেও প্রতারণা করেছেন। তাই তাদের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক প্রতারণার মামলা হতে পারে। তৃতীয়ত তারা নিয়মিত দুর্নীতির অপরাধেও দণ্ডিত হবেন।

ভূয়া মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে যারা চাকরির বয়স বাড়িয়ে সরকারের দায়িত্বশীল পদে ছিলেন বা আছেন যেমন, পুলিশ বিভাগে কিংবা অন্যকোন বিভাগে যেখানে অহরহই আইনগত বা বিচারিক বিষয়গুলো দেখভাল করতে হয়, সে সব কর্মকর্তা আরো বেশি মাত্রায় অপরাধ করেছেন। যেমন, কেউ যদি পুলিশের ইন্সপেক্টর হয়ে থানার অফিসার-ইন-চার্জ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন, তাহলে, তাকে মামলা রেকর্ড করতে হতে পারে, কিংবা অবৈধ জনতা নিয়ন্ত্রণের জন্য ফৌজদারি কার্যবিধির কিছু ধারা প্রয়োগ করতে হতে পারে। এখন যদি তারা ভূয়া মুক্তিযোদ্ধা হয়, তাহলে তো তাদের চাকরির বয়স বাড়ানোটা আইনগত ছিল না। তাই মুক্তিযোদ্ধার সনদ দেখিয়ে চাকরি বাড়িয়ে নেয়ার পরবর্তী সব কাজই অবৈধ। তনি যদি পুলিশ হন, তাহলে তার মামলা রেকর্ড করা অবৈধ, তিনি যদি বিচারক হন, তার বিচারও হবে অবৈধ। এমতাবস্থায়, এ জাতীয় ভূয়ারা জাতির জন্য একটি ধারাবাহিক সংকটের জন্ম দিয়েছেন।

যারা ভূয়া মুক্তি যোদ্ধা সাজিয়ে তাদের সরকারি চাকরির সুযোগ সুবিধা কিংবা সময় বাড়ানোর জন্য আবেদন করেছিলেন, এ ধারাবাহিক অপরাধ শুধু তারা একাই করেননি। দরখাস্ত গ্রহণ থেকে শুরু করে সর্বশেষ মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সনদ বিতরণ পর্যন্ত এ শৃঙ্খলে যারাই সম্পৃক্ত ছিলেন, তারা প্রত্যেকেই কোন না কোন ভাবে দায়ী। তাই প্রত্যেকটি ঘটনার বিপরীতে ভূয়া মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে যখন ব্যবস্থা নেয়া হবে, তখন সে উচ্ছ্বিস্টভোগিদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে। এ অপরাধ শৃঙ্খলের মধ্যে সে ভূয়া মুক্তিযোদ্ধা, যিনি তার জন্য সুপারিশ করেছেন, যিনি তার মুক্তিযুদ্ধে জড়িত থাকার বিষয়টি অনুসন্ধান করে প্রতিবেদন দিয়েছেন, যিনি অনুসন্ধানকে ভূয়া ভেবেও তা গ্রহণ করেছেন, এ ধরনের সকল সহযোগির শাস্তি হওয়া দরকার।

মুক্তিযোদ্ধাদের ভূয়া সনদ অন্য যে সংকটটি তৈরি করেছে, তাহল তাদের সনদ দিয়ে তাদের সন্তান-সন্ততি কিংবা তাদের নাতি-নাতনিগণও সরকারি চাকরি সংগ্রহ করতে পারে। এখন যদি তারা ভূয়া প্রমাণিত হয়, তাদের সনদ দিয়ে যত প্রকার সুযোগ গ্রহণ করা হয়েছে তার সবই ভূয়া বা অবৈধ হবে। যদি তাদের সনদ দেখিয়ে তাদের পোষ্যগণ সরকারি চাকরি গ্রহণ করে, তবে তাও ভূয়া হবে। আর এ কারণে সে পোষ্যদেরও চাকরি চলে যাওয়ার কথা।

যারা নিজেরা মুক্তিযুদ্ধ, জাতি ও সরকারে সাথে বেইমানী করেছে, প্রতারণা করেছে, তারা তো রাজাকারদের চেয়েও খারাপ। কেননা, রাজাকারগণ দেশ ও জনগণের প্রকাশ্য শত্রু। আর এ ভূয়ারা ছদ্মবেশি শত্রু। রাজাকার আলবদরগণ বাইরে থেকে আমাদের বুকে ছুরি মারতে চায়, আর এ ভূয়ারা আমাদের বুকের মধ্যে প্রবেশ করে বুকে ছুরি নয়, বুকের অভ্যন্তরে বাস করে হৃৎপিণ্ডের ধমনীতেই আঘাত করেছে। তাই ঘরের শত্রু এ বিভীষণদের রাজাকারদের চেয়েও কঠিন শাস্তি হওয়া দরকার।