নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইনঃ একটি পর্যালোচনা

মোঃ আব্দুর রাজ্জাক
Published : 2 August 2014, 05:55 AM
Updated : 2 August 2014, 05:55 AM

১. ভূমিকা
নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইনটি ২০০৯ সালে বেসরকারি বিল হিসেবে সংসদে উত্থাপন করেছিলেন তৎকালীণ সরকারি দলের সংসদ সদস্য জনাব সাবের হোসেন চৌধুরি। অনেক যাচাই বাছাই করে দীর্ঘ চার বছর পর ২০১৩ সালে এ বিলটি আইনে পরিণত হয়। ২০টি ধারা সম্বলিত এ আইনে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাসহ অন্যান্য সকল প্রকার সরকারি হেফাজতে নির্যাতন ও হত্যার শাস্তি ও বিচারের প্রক্রিয়া বর্ণিত হয়েছে। একাদশ সংসদের মেয়াদের শেষ দিকে পাশ হওয়া এ আইনটির বিশেষ কিছু উল্লেখযোগ্য ব্যতিক্রমী দিক বা বিষয় রয়েছে। অপরাধের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের, অনুসন্ধান ও তদন্ত, বিচার , জামিন ও আপীল, জরিমানা আদায় এমনকি সাক্ষীদের সুরক্ষার ক্ষেত্রেও বিশেষ কিছু বিধান সন্নিবেশিত হয়েছে এ আইনে। যারা আইন নিয়ে নাড়াচাড়া করেন বিশেষ করে পুলিশ অফিসারদের জন্য এ সব বিষয়ে সঠিক জ্ঞান থাকা জরুরি বলে মনে করি। এ নিবন্ধে আমরা আইনটির বিশেষত্ব আলোচনাপূর্বক এর কিছু সীমাবদ্ধতা ও ভবিষ্যৎ প্রভাব নিয়ে আলোচনা করব।

১.১. অভিযোগ দায়ের
নির্যাতনের শিকার কোন ভিকটিম আদালতে অভিযোগ করলে সাধারণভাবে আদালত তার জবানবন্দী লিপিবদ্ধ করে প্রয়োজনে ভিকটিমের ডাক্তারী পরীক্ষার আদেশ দিবেন (ধারা-৪)। এর পর আদেশের কপি সংশ্লিষ্ট পুলিশ সুপার কিংবা অভিযুক্তের নিয়ন্ত্রণকারী তদুর্ধ্ব পদের পুলিশ কর্মকতার কাছে তদন্ত অনুষ্ঠানের জন্য পাঠিয়ে দিবেন। বাদীর আবেদনের প্রেক্ষিতে আদালত বিচার বিভাগীয় তদন্তেরও নির্দেশ দিতে পারেন কিংবা অভিযুক্ত ব্যক্তির পদমর্যাদার নিচে নয় এমন কোন পুলিশ কর্মকর্তাকেও সরাসরি তদন্তের আদেশ দিতে পারেন (ধারা-৫)। আইনটির বিশেষ দিকগুলোর মধ্যে রয়েছে হেফাজতে মৃত্যু ও নির্যাতনের ক্ষেত্রে দায়ীদের বিরুদ্ধে যে কেউ বিচার প্রার্থনা করতে পারবেন (ধারা-৬)। এর বাইরেও তৃতীয় কোন ব্যক্তি নিজে নির্যাতনের শিকার না হলেও জেলা জজ কিংবা পুলিশ সুপার বা তদুর্ধ্ব পদের কর্মকর্তাদের কাছে সংশ্লিষ্ট পুলিশ অফিসারদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করতে পারবেন। এরূপ ক্ষেত্রে পুলিশ সুপার বা দায়িত্বপ্রাপ্ত ইউনিট কমান্ডার নিয়মিত মামলা রুজু করে ২৪ ঘন্টার মধ্যেই জেলা জজের কাছে প্রতিবেদন প্রেরণ করবেন (ধারা-৭)।

১.২. তদন্ত ও অনুসন্ধান
অভিযোগ তদন্তের ক্ষেত্রে একটি বিশেষ বিষয় হল, নির্যাতন ও হেফাজতে হত্যার ঘটনার ক্ষেত্রে মূল অপরাধীর সাথে তার নিয়ন্ত্রণকারী তথা হেফাজতের সাথে জড়িত সকল ব্যক্তিই সরাসরি কিংবা সহায়তা বা কর্তব্যে অবহেলাজনিত অপরাধের সংঘটনকারী হিসেবে বিবেচিত হবেন। অভিযোগ দায়েরের নব্বই দিনের মধ্যে তদন্ত সম্পন্ন করতে হবে। আদালত অতিরিক্ত ত্রিশ দিন সময় বৃদ্ধি করতে পারবেন। তবে সেক্ষেত্রে তদন্তকারী কর্মকর্তাকে সশরীরে আদালতে উপস্থিত হয়ে সময় বৃদ্ধির প্রার্থনা করতে হবে এবং আদালত বাদী পক্ষের শুনানী সাপেক্ষে সে সময় বৃদ্ধির আবেদন মঞ্জুর করতে পারবেন (ধারা-৮)।

১.৩. বিচার ও শাস্তি
এ আইনের বিচার শুধু দায়রা জজ আদালতেই সম্পন্ন হবে। প্রথম অভিযোগ দায়ের থেকে শুরু করে বিচারকার্য ১৮০ দিনের মধ্যে সম্পন্ন করতে হবে। বিচার নিষ্পত্তির জন্য প্রয়োজনে আরো ত্রিশ দিন বর্ধিত করা যেতে পারে(ধারা-১৪)। নির্যাতনের সর্বনিম্ন সাজা পাঁচ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড, পঁঞ্চাশ হাজার টাকা জরিমানা কিংবা উভয় দণ্ড। অধিকন্তু অতিরিক্ত ২৫ হাজার টাকার দণ্ড যা ক্ষতিপূরণ হিসেবে নির্যাতিত ব্যক্তিকে পরিশোধ করতে হবে। নির্যাতনে সহায়তা, উসকানিদান, ষড়যন্ত্র কিংবা উদ্যোগী হওয়ার শাস্তি সর্বনিম্ন দুই বছরের সশ্রম কারাদণ্ড অথবা সর্বনিম্ন বিশ হাজার টাকা জরিমানা কিংবা উভয়বিধ দণ্ড। নির্যাতনের ফলে হেফাজতে মৃত্যুর সর্বনিম্ন সাজা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড, কমপক্ষে এক লক্ষ টাকা জারিমানা কিংবা উভয়বিধ দণ্ড এবং অতিরিক্ত দুই লক্ষ টাকার জরিমানা যা ক্ষতিপূরণ হিসেবে ভিকটিমের ওয়ারিসদের দিতে হবে (ধারা-১৫)। আরো লক্ষণীয় দিক হচ্ছে, অভিযুক্তরা তাদের সকল কৃতকর্মের জন্য ব্যক্তিগত ভাবে যেমন দায়ী থাকবেন, তেমনি জরিমানার টাকাও ব্যক্তিগতভাবে পরিশোধ করবেন। পাশ্চাত্য দেশের মতো পুলিশ বিভাগ অভিযুক্তদের পক্ষে জরিমানার অর্থ পরিশোধ করবে না (ধারা-১৩(৩))।

১.৪. আপীল
বিচারের পর আপীলের ক্ষেত্রেও একটি বিশেষ বিধান রয়েছে এ আইনে। আপীল করতে হবে হাইকোর্টে। বাদী বিবাদী উভয়েই আপীল/রিভিশনের সুযোগ পাবেন (ধারা-১৬) নিম্ন আদালতের রায়ের ১৪ দিনের মধ্যেই বিচারিক আদালতে জরিমানার টাকা জমা দিতে হবে এবং শাস্তি হিসেবে আরোপিত জরিমানা পরিশোধ না করা পর্যন্ত আপীল গ্রহণযোগ্য হবে না (ধারা-১৫(৪)।

১.৫ জরিমানার দণ্ড আদায়
আইনে ক্ষতিপূরণের বিষয়টি বেশ প্রশংসনীয়। সাধারণভাবে আমাদের দেশের বিচার ব্যবস্থায় ভিকটিম বা ক্ষতিগ্রসত্ম ব্যক্তিদের পাওয়ার কিছু নেই। ফৌজদারি অপরাধ রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কৃত অপরাধ হিসেবে অপরাধীর কাছ থেকে যা জরিমানা আদায় করা হয়, তা রাষ্ট্রের কোষাগারেই জমা হয়। কিন্তু সামান্য কিছু আইনের মতো নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইনে প্রত্যেক ক্ষেত্রে আরোপিত জরিমানার অতিরিক্ত নির্ধারিত জরিমানার অর্থ ক্ষতিপূরণ হিসেবে ভিকটিম বা ভিকটিমদের ওয়ারিসদের প্রদানের শাস্তি আরোপ করা হয়েছে (ধারা-১৫)। সম্ভবত এক মাত্র এ আইনেই রাষ্ট্র নিজের বিরুদ্ধে কৃত অপরাধের ক্ষতিপূরণের পাশাপাশি ব্যক্তিকেও ক্ষতিপূরণ প্রদানের বিষয়টি নিশ্চিত করেছে।

১.৬ সাক্ষী ও সংক্ষুব্ধ ব্যক্তির সুরক্ষা
সাক্ষীদের নিরাপত্তা বিধান রাষ্ট্রের জন্য একটি বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ। অহরহই অভিযোগ ওঠে যে অপরাধীদের ভয়ে সাক্ষীগণ আদালতে সাক্ষ্য দিতে চান না। তারা অপরাধীদের ভয়ে পালিয়ে বেড়ান। অনেক সময় অভিযুক্তদের ভয়ে মিথ্যা সাক্ষ্যও দিয়ে থাকেন। নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইনের অভিযুক্তগণ মূলত আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্য হবেন। তাই তারা সাক্ষীদের প্রতি অবৈধ চাপ প্রয়োগে সক্ষম। তাই এই আইনেই সাক্ষী সুরক্ষার বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়েছে। এক্ষেত্রে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি দায়রা আদালতে আবেদন করলে আদালত বিবাদীদের নোটিশ করতে পারবেন এবং তদন্তকারী কর্মকর্তাকে সাক্ষীর নিরাপত্তা বিধানের নির্দেশ দিতে পারবেন। এমনকি আদালত অভিযুক্তদের কোন নির্দিষ্ট এলাকায় প্রবেশ নিষিদ্ধও করতে পারেন (ধারা-১১)। সাক্ষী সুরক্ষাসহ অন্যকোন কারণে বাদী বা সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি ক্ষতিগ্রসত্ম হলে যে সরকারি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অবহেলার অভিযোগ আনা হবে সে কর্মকর্তাকেই প্রমাণ করতে হবে যে তিনি সেরূপ অবহেলা করেননি (ধারা-১৯)।

২. অস্পষ্টতা ও সীমাবদ্ধতা
উপরিউল্লিখিত বিশেষ ব্যবস্থার বাইরেও এ আইনের কিছু বিশেষ দিক রয়েছে। এগুলো অনেকের কাছে আপাতত অস্পষ্ট লাগতে পারে। হয়তো প্রয়োগের ক্ষেত্রে তদন্তকালীন কিংবা বিচারকালীন যা স্পষ্ট হতে পারে।

২.১ দণ্ডবিধির সংশ্লিষ্ট ধারারগুলোর প্রয়োগ
হেফাজতে নির্যাতন ও হত্যার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের দণ্ডবিধিতে বেশ কিছু বিশেষ ধারা সংযোজিত রয়েছে। যেমন, যে কোন হত্যার ক্ষেত্রেই দণ্ডবিধির ৩০২ ধারা প্রযোজ্য। কিন্তু নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইনে এমন কোন বিধান নেই যাতে যে কোন ক্ষেত্রে এই আইনেই ব্যবস্থা নেয়া জরুরি হয়ে পড়ে। একই ভাবে দণ্ডবিধির স্বীকারোক্তি বা চোরাইমাল উদ্ধারে তথ্য আদায়ের জন্য কোন গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিকে নির্যাতনের মাধ্যমে সাধারণ কিংবা গুরুতর আহত করার অপরাধের শাস্তির জন্য প্রযোজ্য দণ্ডবিধির ৩৩০ ও ৩৩১ ধারার বিধান স্থগিত করা হয়েছে কিনা তাও আইনে স্পষ্ট নয়। এমতাবস্থায়, দণ্ডবিধিতে প্রদত্ব ধারাগুলোতে মামলা রুজুর প্রক্রিয়া অব্যহত থাকবে এবং মাঠ পর্যায়ে যে আইনে মামলা রুজু করা পুলিশের পক্ষে সুবিধাজনক হবে সেই আইনে মামলা রুজু অব্যহত থাকবে। এক্ষেত্রে বিশেষ আইনের পরিবর্তে দণ্ড বিধিতে মামলা রুজুর প্রবণতা বৃদ্ধি পাবে। যেমন, চাঁদাবাজির মামলা দণ্ডবিধির ৩৮৫ ধারা কিংবা আইন-শৃঙ্খলা বিঘ্নকারী অপরাধ (দ্রুতবিচার) আইনেও রুজু করা যায়। এ ক্ষেত্রে কোন আইনে মামলা রুজু করা হবে তা পুলিশের স্ববিবেচনার উপর নির্ভর করে এবং এ ক্ষেত্রে পুলিশ প্রায় 'সিলেক্টিভ এনফোর্সমেন্টের' আশ্রয় গ্রহণ করে যা প্রকারান্তরে পুলিশের আইন প্রয়োগে নিরপেক্ষতা ক্ষুন্ন করে।

২.২ আপীলের শর্ত হিসেবে জরিমানা প্রদান
এ আইনে দণ্ডের বিরুদ্ধে আসামীদের আপীলের শর্ত হিসেবে আরোপিত জরিমানার অর্থ সরকারি কোষাগারে জমাদান আবশ্যিক করা হয়েছে। শর্তটি অভিযুক্তদের জন্য একটু বেশি বাড়তি বোঝা হয়ে যাবে বলে আমার বিশ্বাস। কেননা আইনের শর্ত হিসেবে নির্দোষত্ব প্রমাণের ভার দেয়া হয়েছে অভিযুক্তদের উপর । এক্ষেত্রে চূড়ান্ত আদেশের পূর্বেই অভিযুক্তদের নিম্ন আদালতের রায় পর্যন্ত অনেক অর্থ ব্যয় করতে হবে। তারা স্বাভাবিকভাবেই দণ্ডের বিরুদ্ধে আপীলে উদ্যোগী হবেন। কিন্তু রায় প্রকাশের মাত্র ১৪ দিনের মধ্যে জরিমানার সমপরিমান অর্থ যোগাড় করা তাদের পক্ষে সম্ভব নাও হতে পারে। যদি শুধু অর্থের অভাবেই কোন অভিযুক্ত আপীলের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়, সেটা রাষ্ট্রের জন্য ন্যায় বিচার নিশ্চিত করবে না। অন্যদিকে আসামী যদি চূড়ান্ত বিচারে খালাস পেয়ে যান, তাহলে তার শাস্তি হিসেবে প্রদত্ত আর্থিক ক্ষতিও পূরণযোগ্য হবে না।

উদাহরণস্বরূপ ১৯৯৮ সালে ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটির ছাত্র সামীম রেজা রুবেল হত্যা মামলার কথা উল্লেখ করা যায়। রুবেলকে নির্যাতনের দায়ে ডিএমপির গোয়েন্দা বিভাগের তৎকালীন সহকারী পুলিশ কমিশনার আক্রামসহ ১৪ জনের বিচার সম্পন্ন হয়। ২০০৩ সালের নিম্ন আদালতের রায়ে ১৩ জনকে যাবজ্জীবনসহ বিভিন্ন মেয়াদের কারাদণ্ড দেয়া হয়। কিন্তু ২০১১ সালে সুপ্রিম কোর্টের আপীলে একমাত্র মূল আসামী এসআই হায়াতুল ইসলাম ছাড়া অন্যরা বেকসুর খালাস পান। হায়াতুল ইসলামের শাস্তিও যাবজ্জীবন থেকে কমিয়ে ১০ বছর করা হয়। তদন্ত থেকে শুরু করে আপীলে খালাস পর্ন্ত আক্রাম প্রায় ১৩ বছর জেল হাজতে ছিলেন ( দি ডেইলি স্টার, ৬ মে, ২০১১)। এ ধরনের অবস্থায় যদি আপীলের শর্ত হিসেবে জরিমানা পরিশোধ জরুরি হয়, কিংবা অর্থের অভাবে কোন আসামী যদি আপীল করতে অপারগ হয়, তাহলে তারা সর্বোচ্চ আদালতের বিচারে প্রবেশই করতে পারবেন না।

৩. সম্ভাব্য পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া/পরিবর্তন
নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন মাঠ পর্যায়ে প্রয়োগের ক্ষেত্রে নানাবিধ সমস্যা হতে পারে। এ সমস্যা শুধু প্রয়োগ নয় বিচারিক ও পুলিশ অনুশীলনসহ পুলিশ দক্ষতায় বড় ধরনের প্রভাবও ফেলতে পারে।

৩.১ সীমিত প্রয়োগের আশংকা
প্রথমত, নির্যাতন, বিশেষ করে পুলিশ হেফাজতে নির্যাতনের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধিতে প্রদত্ত ধারাগুলোর মতো এ আইনটিও কদাচিৎ প্রয়োগ হতে পারে। যদিও দণ্ডবিধিতে শুরু থেকেই স্বীকারোক্তি আদায়ের জন্য কিংবা আলামত বা হারানো মাল উদ্ধারের জন্য হেফাজতে থাকা ব্যক্তিদের নির্যাতনের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট ধারা (দণ্ডবিধির ৩৩০/৩৩১) রয়েছে তবুও হর হামেশাই পুলিশসহ অন্যান্য আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর বিরুদ্ধে নির্যাতনের অভিযোগ পাওয়া যায়। এ নিয়ে প্রচার মাধ্যমে কিংবা মানবাধিকার সংগঠনগুলো কাছ থেকে বেশি প্রচার বা নিন্দাও বর্ষিত হয়। কিন্তু হেফাজতে নির্যাতনের বিরুদ্ধে নিয়মিত মামলা কিংবা অভিযোগ দায়ের খুবই বিরল ঘটনা। নির্যাতনের ফলে মৃত্যু হলে হয়তো নিয়মিত মামলা হয়, কিন্তু নির্যাতনের ফলে গুরুতর আহত বা পরবর্তীতে পঙ্গু হলে কেউ আর পুলিশের বিরুদ্ধে মামলা করতে যায় না। সাম্প্রতিককালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আব্দুল কাদেরকে নির্যাতনের বিরুদ্ধে একটি নিয়মিত মামলা হয়েছিল এবং সে মামলায় সংশ্লিষ্ট পুলিশ অফিসারের শাস্তিও হয়েছিল ( দি ডেইলি স্টার, ৩ এপ্রিল, ২০১২)। কিন্তু এ মামলাটিও হয়েছিল সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশে। আব্দুল কাদের কিংবা কোন মানবাধিকার সংগঠন তার পক্ষে পুলিশের বিরুদ্ধে মামলা করতে যায়নি।

পুলিশি হেফাজতে নির্যাতনের নানা প্রকার অভিযোগ আদালতেও অভিযুক্তরা করে বলে শোনা যায়। কিন্তু এর প্রেক্ষিতে আদালতে সংশ্লিষ্ট পুলিশ অফিসারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছেন কিংবা নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন এমন খবর সত্যিই বিরল। তাই বিদ্যমান আইনেরই যখন প্রয়োগ কদাচিৎ হয়, তখন একটি নতুন আইনের প্রয়োগ কতটুকু করা হবে, সে বিষয়ে সংশয় থেকেই যায়।

৩.২ তদন্তজনিত দক্ষতা হ্রাস
এ আইনে নির্দেশিত শাস্তির ভয়ে পুলিশ অফিসারগণ আসামীদের জিজ্ঞাসাবাদে তৃতীয়মাত্রা প্রয়োগের সুযোগ না পেয়ে তদন্তে অসফল হওয়ার ঝুঁকির মধ্যে পড়তে পারেন। কেননা আমাদের তদন্তকারীদের যোগ্যতা, প্রশিক্ষণ, দক্ষতা ইত্যাদি এখনও সন্তোষজনক মানের নয়। কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে দোষস্বীকারোক্তির বাইরে কিংবা স্বীকারোক্তি ছাড়াই অপরাধ প্রমাণের জন্য প্রয়োজনীয় সাক্ষ্য-প্রমাণ সংগ্রহ করা তাদের জন্য অসম্ভব না হলেও সাংগঠনিক দক্ষতার বাইরে। বছরের পর বছর তৃতীয়মাত্রার জিজ্ঞাসাবাদ প্রয়োগ করে অনেক ক্ষেত্রেই মামলার তদন্ত একটি অভিযোগপত্র দেয়ার মতো করে তৈরি করা হয়। তাই এ আইনের ফলে তৃতীয়মাত্রা প্রয়োগ সম্ভব হবে না। তাই তদন্তের ক্ষেত্রে পুলিশের দক্ষতা কমতে পারে যা প্রভাব শেষ পর্যন্ত পড়তে পারে বিচার ব্যবস্থায় শাস্তির সামগ্রিক হারের উপর। আমাদের দেশের ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থায় এমনিতেই সাজার হার দুঃখজনকভাবে কম, এরপরও যদি পুলিশের মনে নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইনটি ভীতির সঞ্চার করে এবং তারা তৃতীয়মাত্রায়ই শুধু নয়, যে কোনভাবে আসামীকে জিজ্ঞাবাদে 'সেকি ফিল' করেন, তাহলে মামলা উদ্ঘাটনের হার কমতে পারে। আর সামগ্রিক অবনতির কারণ হিসেবে এ আইনটিকে সামনে আনার একটা প্রবণতা তৈরি হতে পারে।

৩.৩ অপরাধীগণ কর্তৃক আইনের অপপ্রয়োগ
তৃতীয়ত, পেশাদার অপরাধীগণ এ আইনটির যথেষ্ঠ অপপ্রয়োগে উৎসাহী হতে পারে। পুলিশ হেফাজতে এলেই তারা নির্যাতনের অভিযোগ শুরু করতে পারে। যদিও বর্তমানে এ ধরনের প্রবণতা বিদ্যমান, তবুও আইনের প্রয়োগ করে কিছু পুলিশ অফিসারকে সায়েস্তা করার নজির সৃষ্টি হলে চোর-ডাকাত থেকে শুরু করে রাজনৈতিক মাস্তানগণও পুলিশের হেফাজতে যেতে না যেতেই নির্যাতনের অভিযোগ শুরু করে দিতে পারে। তারা জর্জকোট আর পুলিশ সুপারদের কাছে ভূয়া অভিযোগ দিয়ে দক্ষ পুলিশ অফিসারদের বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে তাদের নিষ্ক্রিয় করার প্রচেষ্টা গ্রহণ করতে পারে। আইনের নির্দেশ অনুসারে জেলা ও সেসন জজের কাছে করা অভিযোগের ক্ষেত্রে বিচারক তার স্ববিবেচনা প্রয়োগ করে অভিযোগ খারিজ করে দেয়ার এখতিয়ার ভোগ করলেও পুলিশ কর্তৃপক্ষের কাছে করা অভিযোগকে নিয়মিত মামলা রুজু করত তার তদন্ত করতেই হবে। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে ভাল ও দক্ষ পুলিশ অফিসারটির বিরুদ্ধে সবচেয়ে বেশি মামলা রুজু হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এমতাবস্থায়, পুলিশের ভয়ে অপরাধীগণ নয়, বরং অপরাধীদের গ্রেফতারকারী পুলিশ অফিসারগণ হেফাজতে নির্যাতনের মামলার ভয়েই ভীতু থাকবেন যা তদন্তকাজে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করবে।

৩.৪ পুলিশের দক্ষতা বৃদ্ধির নিয়ামক
চতুর্থ একটি পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হতে পারে এ আইনের প্রয়োগের ফলে যা অবশ্য ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থার জন্য প্রত্যাশিত। আইনের ফলে তৃতীয়মাত্রার জিজ্ঞাসাবাদ অকেজো হয়ে পড়লে পুলিশ সাংগঠনিকভাবেই তাদের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য উদ্যোগী হতে পারে। এর ফলে দোষস্বীকারোক্তিমূলক তদন্ত ব্যবস্থা দ্রুত বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির উপর প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। 'শর্ট-কার্ট' পদ্ধতিতে মারপিট করে স্বীকারোক্তি আদায়ের সুযোগ না থাকায় তদন্তকারী অফিসারগণ নিজেদের মেধা খাটিয়ে কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে অপরাধের সপক্ষে সকল প্রকার আলামত-সাক্ষ্য উদ্ধারে ব্রতী হবেন। তারা জিজ্ঞাসাবাদের তৃতীয় মাত্রা পরিত্যাগ করে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে আসামীর মানবাধিকার সমুন্নত রেখে নিখুঁত মানের তদন্তকাজে দক্ষতা অর্জন করতে পারবেন যা যে কোন গণতান্ত্রিক সমাজে বহুল প্রার্থীত।

৪. উপসংহার
যে কোন আইনের প্রয়োগ প্রাথমিকভাবে কিছু কিছু অসুবিধার সৃষ্টি করে। কোন আইন যত বেশি কঠোর তার অপপ্রয়োগও ততো বেশি হয়ে থাকে। ২০০০ সালে নারী ও শিশু নির্যাতন (প্রতিরোধ) আইনটি পাশ হওয়ার পর পরই এর যথেচ্ছ অপব্যবহার শুরু হয়েছিল। অপরাধ পরিসংখ্যান পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে এই আইনে ২০০৩ সালে সর্বোচ্চ মামলা হয়েছিল। কিন্তু সে প্রবণতা ক্রমান্বয়ে কমে আসতে থাকে। এসিড অপরাধ দমন আইনেও প্রথম দিকে অনেক বেশি মামলা হতে শুরু করে। কিন্তু ক্রমশ তা কমতে শুরু করে। পর্যালোচনায় দেখা গেছে, প্রথম দিকে মামলাগুলোতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন প্রদানের হার ছিল কম। কিন্তু ধীরে ধীরে চূড়ান্ত প্রতিবেদন মিথ্যা দাখিলের হার বৃদ্ধি পায়। বর্তমানে এই আইনের মামলায় অভিযোগপত্র ও চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিলে হার প্রায় সমান সমান। অর্থাৎ মামলা করলেই প্রতিপক্ষকে আর ঘায়েল করা যাচ্ছে না। তাই হয়রানীমূলক মামলা দায়েরেও হারও কমে গেছে। ঠিক নির্যাতন ও হেফাজতে নির্যাতন(নিবারণ) আইনের ক্ষেত্রেও এমন অবস্থা সৃষ্টি হতে পারে। এ আইনের প্রয়োগ পুলিশের দক্ষতাকে আপাতত হ্রাস করবে বলে মনে হলেও এর ফলে পুলিশের তদন্তক্ষেত্রে সামগ্রিক দক্ষতার উন্নয়ন ঘটতে পারে। তবে এর জন্য পুলিশকে সাংগঠনিকভাবে বিশেষ পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে এবং সরকার তথা রাষ্ট্রকে পুলিশের উন্নয়নে আরো বেশি তৎপর হতে হবে। কেননা কোন সমস্যা সমাধানের মূল সূত্রই হল তার পিছনে ক্রিয়াশীল কারণগুলো দূর করা। যদি নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যুর জন্য পুলিশের অদক্ষতাই মূল কারণ হয়, তাহলে পুলিশ ও সরকারকে সেই অদক্ষতাজনিত সমস্যাই প্রথম সমাধান করতে হবে।

(রংপুর, ২৮ জুলাই, ২০১৪)