শিশু পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণে শুধু প্রস্তুতি নয়, চাই তৎপরতা

মোঃ আব্দুর রাজ্জাক
Published : 5 August 2014, 07:45 AM
Updated : 5 August 2014, 07:45 AM

কিছু কিছু উন্নত দেশে পর্নোগ্রাফি বা স্বল্পবসনা নারীগণ হার্বাট মার্কুইজ নির্দেশিত রিপ্রেসিভ ডিসাব্লিমেইশনের অংশ হিসেবে পরিণত হয়েছে। এসব সমাজে পর্নোগ্রাফি পুরুষের অবদমিত ধর্ষণেচ্ছার ভিন্ন মাত্রার প্রতি-অবদমন। অর্থাৎ অতিমাত্রায় অবদমনের ফলে সমাজের উৎপাদনশীলতা হ্রাস পেলে নানা ছলাকলায় যদি অবদমন প্রক্রিয়ায় বিপরীত গতি নিয়ে আসা যায়, তাহলে সমাজের সকল সেক্টরে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি পায়। যেমন, কোন অফিসের বড় কর্তার পার্সোন্যাল সেকরেটারি হিসেবে স্বল্পবসনা সুন্দরীকে নিয়োগ দিলে বড় কর্তারই শুধু নয়, সারা অফিসেরই উৎপাদনশীলতা নাকি বৃদ্ধি পায়। অনেক প্রতি-অবদমন দর্শনের সমার্থকগণ বিশ্বাস করেন, আধুনিক জগতের সাইবার পর্নোগ্রাফি নাকি সমাজে ধর্ষণ অপরাধের মাত্রা কমিয়ে দেয়। তাদের মতে কোন ব্যক্তি তার অবদমিত যৌনাকাঙ্খা যদি পর্নোপ্রাফি উপভোগের মাধ্যমে মেটাতে পারে, সে নারী ধর্ষণে উদ্বুদ্ধ হবে না কিংবা এ জাতীয় অপরাধে জড়িত হয়ে মান সম্মান হারানো থেকে শুরু করে জেলের ঘানি টানার ঝুঁকি নিবে না। যাহোক আমরা পর্নোগ্রাফি নিয়ে কোন দার্শনিক আলোচনায় যাব না। আমরা ধরে নিব ও বিশ্বাস করব যে পর্নোগ্রাফি একটি অপরাধ। আর সে অপরাধ নিবারণ, নিয়ন্ত্রণ, তদন্ত ও বিচারের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।

একথা আর অস্বীকার করার উপায় নেই যে পর্নোগ্রাফি তৈরি, বিপণন ও প্রদর্শন অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের মতো বাংলাদেশেও একটি ক্রমবর্ধমান অপরাধ ক্ষেত্রে পরিণত হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। বাংলাদেশের রাজধানী থেকে শুরু করে ছোট ছোট শহরেও বর্তমানে পর্নোগ্রাফির গোপন ব্যবসা চলে। তবে আগের ফুটপাতের চটি বই এখন সাইবার জগতের চটি সাইটে উন্নীত হয়েছে। মোবাইল ফোনে যখন তখন যেখান সেখান থেকে এখন পর্নোগ্রাফি লোড করা যায়। না বিদেশি শুধু নয়, আপনার পাশের বাড়ির না হলেও পাশের শহরের কোন শিশু বা নারীর নগ্ন ছিবি আপনার সাথে থাকা মোবাইল ফোনের মাধ্যমে পর্নোসাইটে পাওয়া যেতে পারে। এ নিয়ে মাঝে সাজে পত্রপত্রিকায় হৈচৈও হয়।

গত ১০ জুন, ২০১৪ তারিখে ঢাকা মহানগরীর খিলগাঁও থেকে সিআইডি পুলিশ শিশুদের ব্যবহার করে পর্নোগ্রাফি তৈরি করে বিদেশের খদ্দেরদের কাছে পাঠিয়ে দেয়ার অপরাধে প্রেফতার করেছে টিপু কিবরিয়া ও তার সহযোগীকে। ১৫ জুন, ২০১৪ তারিখে মহানগর মূখ্য মহানগর হাকিমের আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দীতে টিপু জানিয়েছেন তিনি ২০০৫ সাল থেকে একই কায়দায় পর্নো ভিডিও তৈরি করে জার্মানী ও সুইজারল্যান্ডের তিন ব্যক্তির কাছে পাঠাতেন। তবে পুলিশ বলছে, টিপু আসলে উত্তর আমেরিকা, ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যসহ প্রায় ১৩টি দেশের নাগরিকদের কাছে তার তৈরি পর্নো পাঠাতো। টিপু গ্রেফতারের মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হয়েছে বাংলাদেশের পর্নো অপরাধীগণ সারা বিশ্বেই তাদের তৈরি অবৈধ পণ্য পাঠাচ্ছেন এবং তা দীর্ঘদিন ধরেই পাঠাচ্ছেন। একটিপু পুলিশের হাতে ধরা পড়েছে। কিন্তু এমন হাজার হাজার টিপু যে একই ধরনের অপরাধে সক্রিয় আছে তা সহজেই অনুমেয়।

এখন প্রশ্ন হল, সাইবার ক্রাইম বা পর্নোগ্রাফির বিরুদ্ধে পুলিশ নীরব বা উদাসীন কি না। অনেকে বলার চেষ্টা করছেন, পুলিশের এ ব্যাপারে কোন মাথা ব্যাথা নেই। তাছাড়া এ ধরনের অপরাধ মোকাবেলার জন্য পুলিশের দক্ষতা বা প্রশিক্ষণও নেই। তবে প্রকৃত সত্য হল, কোন অপরাধের ব্যাপারেই বাংলাদেশ পুলিশ আসলে অসচেতন নয়। বাংলাদেশ পুলিশের নীতিনির্ধারক পর্যায়ে অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ অপরাধ নিয়ে রীতিমত আলোচনা হয়। কিন্তু আমাদের অপরাধ নিবারণের অগ্রাধিকারের ক্ষেত্রে এখন পর্যন্ত সাইবার ক্রাইম প্রথম সারিতে এসে পড়েনি। পুলিশিং এর ক্ষেত্রে আমরা যত স্বপ্রণোদিত বা প্রোএকটিভ হতে চাই না কেন, পৃথিবীর সব দেশের পুলিশই আসলে প্রাথমিকভাবে রিএকটিভ।

সাইবার ক্রাইম বা পর্নোগ্রাফি সম্পর্কে অভিযোগ পত্র-পত্রিকায় যতে বেশি প্রকাশিত হয়, পুলিশের কাছে ততোবেশি ভুক্তভোগী অভিযোগ করে না। প্রতারণার মাধ্যমে পর্নোগ্রাফি বা সাইবার স্পেসে অপরাধ সংঘটিত হলে ভুক্তভোগীরা নিরব থাকাই বেশি সমীচীন মনে করে। কিন্তু যখন এটা পাবলিক স্পেসে চলে যায়, তখন আর সহ্য করতে পারে না।

এ দিক দিয়ে পর্নোগ্রাফি হল একটি মজলুমবিহীন অপরাধ। ইংরেজিতে যাকে বলে ভিকটিমলেস ক্রাইম কিংবা ভাইস ক্রাইম। ভাইস ক্রাইমের সাথে অপরাধী ও অপরাধের তাৎক্ষণিক শিকার ব্যক্তিগণ উভয়ই জড়িত থাকে। যারা নিজেরা ক্ষতিগ্রস্ত হতে অপরাধীদের কাছে আসেন, তাদের জন্য সে সমাজই দ্রুত এগিয়ে আসে যে সমাজে আর্থিক প্রাচুর্য থাকে। পাশ্চাত্য জগতের বিশেষ করে আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্র কিংবা ইউরোপের ব্রিটেনের মতো অনেক দেশেই আর্থিক প্রাচুর্য আছে। তাই তারা শিশু পর্নোগ্রাফির বিরুদ্ধে অভিযান চালাতে স্বপ্রণোদিত হয়ে কাজ করছে। কিন্তু আমাদের সমাজ তো আর্থিকভাবে পাচুর্যশীল নয়। তাই আমরা প্রোএকটিভ হতে পারছি না। যে অপরাধের বিরুদ্ধে কেউ অভিযোগ করতে আসেন না, সে অপরাধ আমাদের পুলিশের অগ্রাধিকার তালিকার সর্বনিম্নে অবস্থান কবরে এটাই তো স্বাভাবিক।

কিন্তু নিম্ন অগ্রাধিকার সম্পন্ন হলেও এর বিরুদ্ধে পুলিশের প্রস্তুতি একেবারেই যে নেই, তা বলা ঠিক হবে না। ইতোমধ্যেই পুলিশের সিআইডিতে এ সম্পর্কে একটি সেকশন খোলা হয়েছে। সাইবার ক্রাইম ও কম্পিউটার ফরেনসিকের উপর বেশ কিছু অফিসার দেশে-বিদেশে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। মালয়েশিয়া ও কানাডাসহ বেশ কিছু দেশে আমাদের অফিসারগণ প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। কানাডা পুলিশের একটি প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান আমাদের বেশ কয়েকজন পুলিশ অফিসারকে কম্পিউটার ফরেনসিকের উপর বিশেষজ্ঞ পর্যায়ের প্রশিক্ষণ দিয়েছে। এই সব প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত পুলিশ সদস্যরা আবার দেশের অফিসারদের প্রশিক্ষণ দেবার মতো যোগ্যতা অর্জন করেছে। সাইবার ক্রাইম উদ্ঘাটনের উপযোগী কিছু যন্ত্রপাতিও ডিএমপির গোয়েন্দা বিভাগের কাছে রয়েছে যে গুলো ইতোমধ্যেই কিছু বাস্তব সাফল্য এনে দিয়েছে।

অস্বীকার করার উপায় নেই যে সাইবার ক্রাইম ও সাইবার পর্নোগ্রাফি সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও একটি ক্রমবর্ধমান অপরাধ ক্ষেত্র। অত্যধিক আর্থিক লাভ, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দক্ষতার অভাব, সাইবার স্পেস কে ব্যবহার করে জাতীয় অধিক্ষেত্রের বাইরে গিয়ে অপরাধ সংঘটিত করা যায় বলে ধরা পড়ার স্বল্প ঝুঁকি, বাদী বা ভুক্তভোগিদের অসচেতনতা, পুলিশের লো প্রাইয়োরিটি– সব কিছু মিলে সাইবার জগতের ক্রিমিনালগণ আমাদের মতো দেশগুলোতে বেশ রমরমা ব্যবসা করে যাচ্ছে।

সাইবার পর্নোগ্রাফি একটি সংঘবদ্ধ অপরাধও (ওর্গানাইজড ক্রাইম) বটে। ধরা পড়া বা উদ্ঘাতি হওয়ার স্বল্প ঝুঁকির জন্য আন্তর্জাতিক অঙ্গণে ক্রিয়াশীল অপরাধীগণ বাংলাদেশের মতো সমাজে তাদের অপরাধক্ষেত্র গড়ে তুলতে তৎপর হয়। বিষয়টি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও অবগত। তাই সম্প্রতি ইন্টারপোলের তথ্যের ভিত্তিতে ধরা পড়েছে শিশু সাহিত্য সৃষ্টির আড়ালে শিশুদের দিয়ে পর্নোগ্রাফি তৈরির কারিগর টিপু কিবরিয়ার মতো অপরাধী।

একটি সাফল্য অন্য সাফল্যের পথ প্রদর্শন করে। টিপু কিবরিয়ার অপরাধ আমাদের পুলিশকে উপলব্ধি করিয়েছে যে এ দেশে শিশু পর্নোগ্রাফি তৈরির মতো অপরাধ শিল্প বিকাশের সম্ভাবনা রয়েছে। শিশু পর্নোগ্রাফি বা পর্নোগ্রাফি তৈরি, বিতরণ, শিশুদের এ ক্ষেত্রে বাধ্যকরণ পুলিশের কাছে এই মুহূর্তে একটি নিম্ন অগ্রাধিকারের অপরাধ হলেও যেভাবে আমরা ডিজিটাইজেশনের দিকে অগ্রসর হচ্ছি, তাতে এটা হটাৎ করে মহামারি রূপ নিতে পারে। তাই পর্নোগ্রাফির বিরুদ্ধে এখন থেকেই সচেতন হতে হবে, এ ধরনের অপরাধ প্রতিরোধ, উদ্ঘাটন ও নিয়ন্ত্রণের জন্য এখন থেকেই পুলিশকে শুধু প্রস্তুতি নয়, কর্মক্ষেত্রে তৎপর থাকতে হবে।

সূত্রঃ
১. http://www.prothom-alo.com/bangladesh/article/256504/