জয়ললিতার জয়-পরাজয় ও গণতন্ত্র

মোঃ আব্দুর রাজ্জাক
Published : 28 Sept 2014, 06:20 PM
Updated : 28 Sept 2014, 06:20 PM

ভারতের তামিল নাড়ু রাজ্যের মূখ্যমন্ত্রী জয়রাম জয়ললিতা বিভিন্ন কারণেই ভারতের নারীদের কাছে অনুসরণীয়। তিনি প্রথমত ছিলেন একজন সফল চলচ্চিত্র অভিনেত্রী তথা নায়িকা। সে অর্থে একসময় ছিলেন যুবকদের হার্টথ্রব। কিন্তু রাজনীতিতে যোগ দিয়ে নিজেকে পরিচিত করালেন অন্য পরিচয়ে। তিনি হলেন তামিল-নাড়ুর মূখ্যমন্ত্রী। মূখ্যমন্ত্রী হিসেবে নানা দিক দিয়েই তিনি সফল। নারী ক্ষমতায়নের ক্ষেত্র জয়ললিতার অবদান যে কেউ স্বীকার করবেন। তামিলনাড়ু রাজ্য পুলিশকে তিনি নানা ভাবে শক্তিশালী করেছিলেন। জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা কার্যক্রমের ইতিহাসে ২০০৭ সালে লাইব্রিয়ায় প্রথম যে নারী ব্যাটালিয়ন মোতায়েন করা হয়েছিল, তা ছিল ভারতের তামিলনাড়ু রাজ্যের। তিনিই পৃথিবীর পুলিশিং ইতিহাসে সর্বপ্রথম নারী কমান্ডো রিক্রুট করে একটি পূর্ণ নারী কমান্ডো ব্যাটলিয়ন গড়ে তুলেছিলেন যা শুধু ভারতেই নয়, সারাবিশ্বের মডেল।(১)

কিন্তু ক্ষমতা সর্বগ্রাসী। ক্ষমতার ভালমন্দ দুই দিকের ভারসাম্য রক্ষা করতে না পারলে ক্ষমতাসীনরা শিঘ্রই বেসামাল হয়ে পড়েন। নিরঙ্কুশ ক্ষমতা মানুষকে চূড়ান্তভাবে দূষিত করে। তাই দূষিত হয়েছিলেন তামিলনাড়ু রাজ্যের মূখ্যমন্ত্রী জয়ললিতাও।

জয়ললিতা ঘোষণা করেছিলেন মূখ্যমন্ত্রী হলে তিনি বেতন নিবেন না। তিনি তার প্রতিশ্রুতি রেখেছিলেন। তাই তার মাসিক বেতন ছিল নিয়ম রক্ষার জন্য। মাসিক মাত্র এক রুপি। এতে তার সংসার চলত না এমনটি নয়। তিনি চলচ্চিত্র অভিনেত্রী হিসেবে ইতোমধ্যেই অনেক অর্থকড়ি কামিয়েছিলেন। তাই দিয়ে তিনি শান-শওকতে চলতে পারতেন। এ জন্য তাকে সরকারের অর্থ চুরি করতে হতো না কিংবা অন্যের কাছে হাত পাততে হতো না বলে অনুমান করা যায়।

কিন্তু অর্থের লোভ সামলানো বড় কঠিন। পরিমাণ হিসেবে অর্থ সব সময় অপ্রতুল হয়। ভিক্ষুকের কাছে ১০০ টাকার ভিক্ষা অপ্রতুল। তার আরও বেশি ভিক্ষা পেলে ভাল হয়। ব্যবসায়ী-শিল্পপতির কাছে ১০০ কোটি টাকা অপ্রতুল। তার ১০০০ কোটি টাকা থাকলে ভাল হয়। জয় ললিতাও মানুষ। তার কাছেও তার সঞ্চিত সম্পদ অপ্রতুল ছিল। তাই মাসে ১ রুপি বেতন নিলেও তিনি সরকারি সম্পদ অন্যরূপে আত্মসাৎ করতেন। তার বাচ্চা কাচ্চা ছিল না। তাই তার পালিত পুত্র সখকরণই হল সব সম্পদের ডন।

প্রথমবার ক্ষমতা চলে যাওয়ার পর (১৯৯১-১৯৯৬) জয়ললিতা আয়ের সাথে সঙ্গতিহীন সম্পদ দখলে রাখার মামলায় পড়েন। তিনি ৬৬ কোটি ৬৫ লাখ রুপির কোন বৈধ উৎস দেখাতে পারেননি। মূখ্যমন্ত্রী হওয়ার সময় তার সম্পদ ছিল মাত্র ৩ কোটি রুপি। অথচ ১৯৯৬ সালে তিনি তার পালিতপুত্র সখকরণের বিয়েতেই খরচ করেছিলেন পাঁচকোটি রুপি।

সেই সময় আয়কর বিভাগের কর্মকর্তারা জয়ললিতার বাসায় তল্লাশি চালিয়ে ৩০ কেজি সোনা , ৮৮০ কেজি রুপা, ১২ হাজার শাড়ি, ৭৫০ জোড়া জুতা, ৯১টি দামী ঘড়িসহ অন্যান্য মালামাল জব্দ করে, যেগুলোর কোন বৈধ উৎস ছিল না। এ সবের বাইরেও তিনি ছিলেন দুই হাজার একর সম্পত্তির মালিক।(২)

তবে এত কিছুর পরও জয়ললিতা পরবর্তীতে তিন তিনবার তামিলনাড়ুর মূখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন। সর্বশেষ সাজা হওয়ার সময়ও তিনি মূখ্যমন্ত্রীই ছিলেন। এর কারণ গণতন্ত্র্ত্রে ঘোড়া আর গাধার মধ্যে পার্থক্য নেই। ভারতীয় উপমহাদের মানুষ একবার যাকে নেতা হিসেবে বেছে নেয় তাকে আর ছাড়তে চায় না; ছাড়তে পারে না।

অন্যদিকে সম্পদ থাকলে ভোট কেনা যায়, ভোটারদের জিম্মি করা যায়; তাদের মানসিকভাবে সম্মোহিত করা যায়। গণতন্ত্রকে ব্যক্তিতন্ত্রেও রূপান্তরিত করা যায়। কিন্তু ভারতের বিচার ব্যবস্থাও কম শক্তিশালী নয়। এত কিছুর পরও জয়ললিতার বিরুদ্ধে বোঙ্গালুরের একটি আদালত তাকে ৪ বছরের সাজা ও ১০০ কোটি রুপি জরিমানা করেছেন। একই সাথে দণ্ডিত হয়েছেন তার ঘনিষ্ট তিনজন ও তার পালিত পুত্র সখকরণ। বিচারের দিক দিয়েও ললিতার বিচার বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। সরকারের পক্ষে ২৫৯ জন ও ললিতার পক্ষে সাফাই সাক্ষ্য দেন ৯৯ জন সাক্ষী।
এখন জয় ললিতা কারাগারে। তিনি আর মূখ্যমন্ত্রীও নন, সংসদ সদস্যও নন।

তবে রাজনীতি বড়ই জটিল; বড়ই কুটিল। হয়তো তার অভিনয় জীবনের কাল্পনিক ঘটনাগুলো এখন বাসত্মবে রূপ নিবে। তিনি জন সমর্থন-বল, অর্থবল আর গণতন্ত্রের মূর্খতার সুযোগ নিয়ে আবার জেল থেকে বেরিয়ে আসবেন। আবার ক্ষমতায় বসবেন। আবার আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে পৃথিবীর বৃহৎ গণতান্ত্রিক দেশেই গণতন্ত্রের মূর্খতাকে প্রকট করে তুলবেন। আবার প্রমাণ করবেন আম জনতার নির্বাচন আম-কাঁঠালের মতোই হাটে-বাজারে ক্রয়-বিক্রয় করা যায়।

কিন্তু গণতন্ত্র এর পরও গণতন্ত্র। এখন পর্যন্ত এর চেয়ে ভাল রাষ্ট্রচালনা পদ্ধতি আবিষ্কৃত হয়নি। এখন পর্যন্ত আমাদের বিশ্বসমাজ গণতন্ত্রের আবর্তেই ঘুরপাক খাচ্ছে। গণতন্ত্রকে পূঁজি করে জয়ললিতা বারংবার জয়ি হচ্ছেন। কিন্তু গণতন্ত্র আছে বলেই জয়ললিতার সাজাও হচ্ছে। গণতন্ত্রভিন্ন একজন ক্ষমতাসীন মূখ্যমন্ত্রীকে বিচারে সাজা দেয়া তো দূরের কথা তাকে আদালতের কাঠ গড়ায় দাঁড় করান সম্ভব হত না।(২৮সেপ্টেম্বর, ২০১৪)
সূত্রাবলীঃ
১. http://www.msmagazine.com/spring2005/indianpolicewomen.asp ‍
২. http://www.amadershomoys.com/newsite/2014/09/27/114063.htm#.VCeIwVeGZ04