অপরাধ প্রোফাইলিং ও সিরিয়াল কিলিং এর গল্প (চতুর্থ পর্ব)

মোঃ আব্দুর রাজ্জাক
Published : 6 Dec 2014, 04:31 AM
Updated : 6 Dec 2014, 04:31 AM

প্রথম সঠিক ও সফল প্রোফাইলিং

১৯৪০ থেকে ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত প্রায় ১৬ বছর একজন অজ্ঞাত অপরাধী নিউইর্য়ক পুলিশকে ব্যতিব্যস্ত করে রাখে। এ অজ্ঞাত বোমাবাজকে কালক্রমে মিডিয়া জগত পাগল বোমারু বা Mad Bomber বলে ডাকতে থাকে। ইউটিলিটি সার্ভিস প্রোভাইডার কনসোলিডেইউ এডিসন কোম্পানীর জেনারেটর অপারেটর ছিলেন জর্জ মেটেস্কি নামের এক প্রাক্তন সৈনিক। কিন্তু ১৯৩৪ সালে তিনি মেশিন দুর্ঘটনায় আহত হয়ে চাকরি হারান। পরে তার নিউমোনিয়া ও শেষ পর্যন্ত যক্ষারোগ ধরে। ম্যাটেস্কি তার এ শারীরিক বিকলাঙ্গতাকে তার এডিশন কোম্পানিতে কাজ করার ফল হিসেবে উল্লেখ করে কোম্পানির কাছ থেকে ক্ষতি পূরণ দাবি করেন। আইনী লড়াইয়ে তিনি হেরে যান। এরপর তিনি তার ভোগান্তি ও বঞ্চনার খবর প্রচারের জন্য প্রচার মাধ্যমের আশ্রয় গ্রহণ করতে চান, সিটি মেয়র থেকে শুরু করে সরকারি বেসরকারি হাজারো কর্তৃপক্ষের কাছে প্রায় সহস্রাধিক চিঠি লিখেন। কিন্তু কেউ তার বঞ্চনার খবর ছাপতে রাজি হয়নি, কেউ তাকে সুবিচার দেয়নি বলে তিনি বোমা বিস্ফোরণের মাধ্যমে তার বঞ্চনা, হিংসা ও প্রতিশোধ গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নেন। ১৯৪০ সালে এডকন কোম্পানির একটি বহিঃ অফিসে তিনি তার লোহার পাইপের ভিতর গান পাউডার দিয়ে প্রথম বোমা স্থাপন করেন। বোমার সাথে একটি চিরকুটে লিখেন Ed con crook, this is for you

যুক্তরাষ্ট্র ১৯৪১ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জড়িয়ে পড়লে মেটেস্কি বোমা স্থাপন ও বিষ্ফোরণ স্থগিত রাখেন। কিন্তু যুদ্ধের পর আবার সিনেমা হল, এডিশন অফিস, বিনোদন পার্ক, মার্কেট, স্টেশন, থিয়েটারসহ বিভিন্ন স্থানে তার হাতে তৈরি নিম্ন মানের বোমা স্থাপন অব্যহত রাখেন। তিনি মোট ৩২ টি স্থানে বোমা স্থাপন করেন। কিন্তু অক্লান্ত পরিশ্রম সত্বেও ইউএস এ পুলিশ বোমাবাজকে শনাক্ত করতে সক্ষম হয়নি। তবে তদন্তকারীগন একটা বিষয়ে নিশ্চিত হয়েছিলেন যে বোমা স্থাপনকারী একজন প্রাক্তন এডকন গ্রুপের কর্মচারী হবেন যিনি কোম্পানী দ্বারা কোন না কোন ভাবে বঞ্চিত হয়েছিলেন। এডকন কোম্পানীর রেকর্ডপত্রে এমন শত শত বঞ্চিত বলে পরিচিত মানুষের নাম ঠিকানা রয়েছে যেখান থেকে আসল বোমা বাজকে শনাক্ত করা প্রায় অসম্ভব ছিল।

তদন্তের সকল দিক প্রয়োগ করেও ব্যর্থ পুলিশ কর্মকর্তাগণ বিখ্যাত মনোচিকিৎসক ড. জেমস ব্রাসেলস এর স্মরণাপন্ন হলেন। তবে পুলিশ কর্মকর্তাদের তখনও ধারণা ছিল না যে পুলিশি তদন্তের একজন মনোচিকিসক বিভাবে সহায়তা করবেন। ড. ব্রাসেলস একজন অপরাধ বিজ্ঞানী হলেও তিনি পুলিশের সাথে ইতোপূর্বে সরাসরি কোন কাজ করেননি। তিনি নিউইয়র্ক রাষ্ট্রীয় মানসিক পরিচ্ছন্নতা বিভাগের সহকারী কমিশনার হিসেবে কাজ করতেন ।

নিউইয়র্ক পুলিশ গবেষণাগারের প্রধান ইন্সপেক্টর হাওয়ার্ড ই, ফেনি ও বন্ধু ক্যাপ্টেন জন ক্রোনিনের অনুরোধ পেয়ে মনোচিকিৎসক ও অপরাধ বিজ্ঞানী ড. জেমস ব্রাসেল মাতাল বোমারুর ঘটনাস্থল সমূহের স্থির চিত্র পর্যালোচনা করলেন। বোমাবাজের রেখে যাওয়া হাতের লেখা চিরকুটসহ অন্যান্য চিঠিপত্র বিশ্লেষণ করলেন। তাছাড়া গত ১৬ বছর ধরে চলে আসা বোমাবাজির সমস্যা নিয়ে প্রকাশিত মিডিয়া খরব ও বিশ্নেষণ তার আগে থেকেই জানা ছিল। সবকিছু মিলে ড. ব্রাসেলস পাগলা বোমাবাজের একটি ব্যক্তিত্বের বর্ণনা বা প্রোফাইল তৈরি করলেন যা পৃথিবীর ফৌজদারি মামলা তদন্তের ইতিহাসে প্রথম সফল ও সঠিক প্রোফাইলিং হিসেবে স্বীকৃতি পেল।

ড.ব্রাসেল্সের প্রোফাইল মতে, বোমাবাজ একজন অবিবাহিত মানুষ। তার বয়স ৪০ থেকে ৫০ বছরের মধ্যে হবে । তিনি অন্তর্মুখী ব্যক্তিত্বের অধিকারী । তিনি আচরণে অসামাজিক হলেও সমাজ বিরোধী নন। তিনি একজন দক্ষ মেকানিক ধূর্ত, যন্ত্রের ব্যাপারে খুবই নিখুঁত। তার যান্ত্রিক দক্ষতার জন্য আত্মশ্লাঘা রয়েছে। তিনি অপরাপর ব্যক্তিদের প্রতি ঘৃণাপোষণ করেন। তিনি সমালোচনায় অত্যন্ত বিরক্ত হন। তবে তার বিরক্তি গোপন করতে পারেন। তার নৈতিকতা ও সততা রয়েছে। তিনি নারীদের প্রতি উৎসাহী নন। তিনি সম্ভবত উচ্চ বিদ্যালয় পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন । তবে তার কলেজ ডিগ্রি নেই। সামরিক ও বেসামারিক গোলাবারুদ বিষ্ফোরকের ব্যাপারে তার বিশেষ জ্ঞান রয়েছে। তিনি ধার্মিক। সমালোচনার প্রতি হঠাৎ সহিংস আচারণ করতে পারেন। তিনি Consolidated Edison কোম্পানীর সাবেক অথবা কর্মরত চাকুরে । বোমাবাজির কারণ হল, তিনি প্যারানয়েডগ্রস্ত এবং তার এ মানসিক অসুস্থতা বর্তমানে পরিপক্ক স্তরে রয়েছে ।

ড.ব্রাসেলস তার এসব সিদ্ধান্তের পিছনে যুক্তিও তুলে ধরেছেন । তার মতে অপরাধী একজন অভিবাসি আমেরিকান যিনি মধ্য ইউরোপ থেকে আমেরিকায় এসেছেন । তিনি নৃতাত্বিকভাবে শ্লাভ জাতির। ধর্মে রোমান ক্যাথলিক। এর ব্যাখ্যা হল, মধ্য ইউরোপের মানুষ প্রতিবাদের ভাষা হিসেবে বোমার বিষ্ফোরণ ঘটানোকে ঐতিহাসাহিক ভাবেই প্রধান্য দেয়। মধ্যে ও পূর্ব ইউরোপের লোকজন শস্নাভ জাতির । তারা প্রায় সকলেই রোমান ক্যাথলিক। ব্রাসেলসের মতে অপরাধী নিউইয়র্কে নয়, তিনি কানেক্টিকাটের অধিবাসি। কারণ তার পত্রিকাও অন্যান্য কর্তৃপক্ষের কাছে প্রেরিত চিঠিসমূহ কাছাকাছি কাছাকাছি ওয়েস্টচেস্টার কাউন্ট্রি থেকে পোস্ট করা হয়েছে। তাছাড়া কোয়ান্টিকোতে মধ্য ইউরোপীয় অধিবাসিদের বসতি অত্যন্ত বেশি। বোমাবাজের বয়স ৪০ থেকে ৫০ এর মধ্যে বলে ধারণা করার কারণ হল তিনি প্যারানয়েড গ্রস্ত। এই মানসিক রোগ সাধারণত ৩৫ বছর বয়সের পরে প্রকাশিত হয়। বোমাবাজ আজ থেকে ১৬ বছর পূর্ব থেকে তার বিকৃত কর্ম শুরু করেছেন। সেজন্য ৩৫ থেকে ১৬ বছরের ব্যবধানে তিনি অবশ্যই ৫০ বছরের কাছাকাছি বয়সের। চিঠির ভাষায় ব্যবহৃত " DASTARDLY DEEDS শব্দগুলো আধুনিক ইংরেজিতে ব্যবহৃত হয় না। অধিকন্তু মাতৃভাষার ইংরেজ বা আমেরিকানরা এ ধরনের শব্দ ব্যবহারও করেন না। তাই শব্দ নির্বাচনের ধরন ও প্রমাণ করে অপরাধী একজন অভিবাসী ও অ-ইংরেজ।

ব্রাসেলসের মতে, অপরাধী অবিবাহিত থাকার কারণ সম্ভবত তার ভিতর ইডিপাস কম্পেক্স রয়েছে যা মায়ের প্রতি ছোট বেলায় অত্যধিক ভালবাসা ও বাবার প্রতি বিদ্বেষের ফলে সৃষ্টি হয়। অপরাধী সম্পর্কে ব্রাসেলসের ব্যতিকমধর্মী ভবিষ্যদ্বাণী ছিল যে তিনি ডাবল-ব্রেস্টেড কোর্ট পরেন এবং কোর্টের সকল বোতাম লাগিয়েই পরেন। তাই, তাকে কোর্ট পরিহিত কেতাদুরস্ত অবস্থায় গ্রেফতারের সম্ভাবনাই বেশি।

ইন্সপেক্টর হাওয়ার্ড ফেনি ও ক্যাপ্টেন ক্রোনিন অপরাধীর এ বর্ণনা পাওয়ার পরেও বুঝতে পারছিলেন না আসলে তারা এ প্রোফাইল নিয়ে কি করবেন। কারণ এ এ প্রোফাইলিং এর সাথে মিলে যাবে এমন মানুষের সংখ্যা হতে পারে অসংখ্য। তখন ড. ব্রাসেলস পরামর্শ দিলেন, এ প্রোফাইল পত্র-পত্রিকায় ব্যাপকভাবে প্রচার করতে হবে। এতে মানুষ যেমন অপরাধীকে দেখে চিনতে পারবে, তেমনি অপরাধী নিজ থেকেও ধরা দিতে পারে।

কিন্তু সমস্যা হল, পুলিশের তদন্ত সম্পর্কিত এ ধরনের গোপন বিষয় প্রচার মাধ্যমে প্রকাশ করার সুযোগ নেই। এটা তদন্তের গোপনীয়তা নষ্ট করে। কিন্তু ১৬ বছরের প্রচেষ্টায় ব্যর্থ পুলিশ কর্তৃপক্ষ অপরাধীকে শনাক্ত ও গ্রেফতার করে নিউ ইয়র্কবাসিদের মন থেকে বোমাতঙ্ক দূর করার প্রত্যাশায় শেষ পর্যন্ত তাদের বিভাগীয় নীতিতে শৈথিল্য নিয়ে এসে এ প্রোফাইল পত্রিকায় প্রকাশের সম্মতি দেয়।

নিউ ইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় ২৫ অক্টোবর, ১৯৫৬ তারিখে পাগল বোমাবাজের প্রোফাইলটি প্রকাশিত হয়। এর শিরোনাম ছিল, '16-Year Search for a Madman' অর্থাৎ এক পাগলের জন্য ১৬ বছরের তল্লাশি। এর পরদিন New York Journal American এ আর একটি প্রতিবেদনে অপরাধীকে আত্মসমর্পণের আহব্বান জানান হয়।

অপরাধী পত্রিকার অফিসে চিঠি লিখে জানা তিনি জীবনের শেষ প্রান্তে উপনীত হয়েছেন। এখন তিনি প্রতিশোধ নিতে চান। তিনি কবরে গিয়ে হলেও প্রতিশোধ নিবেন। এচিঠিতে তিনি পুনরায় dastardly শব্দটি ব্যবহার করেন। এভাবে পত্রিকার সাথে তার আরো পত্র বিনিময় হয় যেখানে তার উপর কন এড কোম্পানির অবিচার, তার কষ্টের কথা কোন পত্রিকা না ছাপানো, তার বোমা তৈরির কলাকৌশল, বোমা স্থাপনের স্থানসমূহ ইত্যাদি বিষয়ে বিস্তারিত বর্ননা দেয়া হয়।

এর কিছুদিন পরে con edition কোম্পানির এক মহিলা ক্লার্ক এলিমকেলি তাদের কোম্পানির প্রাক্তন ঝামেলা সৃষ্টিকারী কর্মচরীদের ক্ষতিপুরণদান সংক্রান্ত ফাইলগুলো পর্যালোচনা করতে গিয়ে দেখতে পান, একটি ফাইলে লাল কালিতে ঝামেলা সৃষ্টিকারী হিসেবে চিহ্নিত একজন কর্মচারি রয়েছেন। তার নাম জর্জ মেটেস্কি। তিনি ১৯৩১ সালে এক দুর্ঘটনা আহত হয়েছিলেন। তার ফাইলের চিঠিপত্র ঘাঁটতে গিয়ে এলিমকেলি Dastardly deeds" শব্দটি খুজে পান যা জার্নাল এমেরিকানে প্রকাশিত অপরাধীরা চিঠিতে উল্লেখ ররেছে।

বিষয়টি পুলিশকে জনানো হল। ১৯৫৭ সালের ২১ জানুয়ারী পুলিশ কানেকাট শহরের ১৭ নং চতুর্থ রোডের বাসায় হানা দিলে মেটেষ্কিকে পায়জামা পরা অবস্থায় খুঁজে পায়। তারা মেটেক্সির হাতের লেখার নমুনা চায়। নমুনার G অক্ষর তার পূর্ববর্তী লেখার সাথে মিলে যায়। মেটেক্সি পুলিশকে বলেন, আমি জানি তোমরা কেন এসেছ। তোমরা জান, আমিই সেই পাগল বোমাবাজ। পুলিশ তাকে জিজ্ঞাসা করে F.P এর অর্থ কি? মেটেস্কি বলে Fair play । পুলিশ ব্রাসেলসের প্রোফাইলের সাথে মেলানোর জন্য মেটেস্কিকে বলে, আপনাকে ওয়াটার বেরি পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সে যেতে হবে। তাই পোশাক পরে আসুন। মেটেস্কি তার শোবার ঘরে গিয়ে ডাবল ব্রেস্টের কোর্ট পরে পুলিশের সামনে উপস্থিত হয় যার সবগুলো বোতাম লাগানো ছিল।

পাগলা বোমাবাজের প্রোফাইল তৈরি, তা পত্রিকায় প্রকাশ এবং এর ভিত্তিতে ১৬ বছরের বেশি সময় ধরে নিউয়র্ক শহরের আতংক সৃষ্টিকারী বোমাবাজ গ্রেফতার হওয়ায় এবং প্রোফাইলের সাথে গ্রেফতারকৃত বোমাবাজের শতভাগ মিল থাকায় ড.জেমস ব্রাসেলস সারা বিশ্বে অপরাধী প্রোফাইলিং এর জনক বলে পরিচিত হলেন এবং তাকে সত্যিকারের সার্লোক হোমস বলে ডাকা হতে লাগল। শুধু এই নয়। এর পরবর্তীতে ব্রাসেলসের তৈরি করা প্রোফাইলের উপর ভিত্তি করে ১৯৬৪ সালে বোষ্টন ফাঁসুডে (Boston Strangler) নামে তের খুনের আসামী ডি স্যিালভোসহ আরো অনেক অপরাধীকেই গ্রেফতার ও বিচার করা সম্ভব হয়েছে যা সাধারণ তদন্তকারীদের পক্ষে ছিল এক প্রকার অসম্ভব।