শিক্ষণ, প্রশিক্ষণ ও কমিউনিটি পুলিশিং বাস্তবায়ন

মোঃ আব্দুর রাজ্জাক
Published : 20 Oct 2014, 06:23 PM
Updated : 20 Oct 2014, 06:23 PM

কমিউনিটি পুলিশিং একটি নতুন পুলিশিং দর্শন যা চলমান সনাতনী পুলিশিং থেকে সম্পূর্ণ পৃথক না হলেও এর কিছু নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে। কমিউনিটি পুলিশিং হল, পুলিশ ও জনগণের যৌথ অংশীদারিত্বে পরিচালিত একটি পুলিশিং ব্যবস্থা যা কালীক বিচারে অবশ্যই নতুন। এমতাবস্থায়, এ দর্শন বাস্তবায়নে পুলিশ ও জনগণের সকল স্তরে প্রশিক্ষণ পরিচালনা অতীব গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু পুলিশিং এর সকল অভিনভত্বের মতো কমিউনিটি পুলিশিং বিষয়টির মৌলিক দিকগুলো পুলিশ সদস্যদের মধ্যে সঞ্চারিত করাই আসল চ্যালেঞ্জ।

পুলিশ সংস্কার প্রকল্পে দীর্ঘ তিন বছর কর্মরত থেকে প্রশিক্ষণসহ অন্যান্য কাজে আমি গভীরভাবে সম্পৃক্ত ছিলাম। তাই আমার কাছে প্রশিক্ষণ সংক্রান্ত বিষয়টিই সবচেয়ে বেশি চ্যালেঞ্জের বলে মনে হয়েছে। পুলিশ সংস্কার প্রকল্প কর্তৃক ইতোপূর্বে নির্বাচিত থানার কমিউনিটি পুলিশিং অফিসারদের সাধারণত এক দিনের প্রশিক্ষণ দেয়া হত। এটা হত মূলত অফিসার-ইন-চার্জ ও সিপিওদের নিয়ে কর্মশালা। কর্মশালায় আমি কমিউনিটি পুলিশিং এর মৌলিক বিষয়গুলো ব্যাখ্যা করতাম। এর পর তাদের ব্যবহারিক কাজের কিছুটা ধারণা দেয়া হত। তবে সবচেয়ে বেশি অংশ জুড়ে থাকত তারা পিআরপি কর্তৃক প্রদত্ত তহবিলটি কিভাবে ব্যবহার করবেন। এর বাইরে আরো দুটো কারণে তাদের কর্মশালায় ডাকা হত। একটা হল, সিপিএফ এর নির্বাচিত সদস্যদের সাথে তারা এক দিনের কর্মশালায় উপস্থিত থাকতেন। এখানে সিপিএফএর সাথে তারা কিভাবে যৌথ অংশীদারিত্ব প্রতিষ্ঠা করবেন সে সম্পর্কে আলোকপাত করা হত। এসব কর্মশালায় কমিউনিটি সদস্যদের সাথে একই শ্রেণিকক্ষে পুলিশ অফিসারগণ উপস্থিত থেকে কমিউনিটি পুলিশিং এর ধারণা লাভ করত। তৃতীয় প্রশিক্ষণটি দেয়া হত সাধারণত সিপিওদের। এটা হত মূলত ফাইন্যান্সিয়াল অরিয়েন্টেশন। পিআরপি কর্তৃক প্রদত্ত অর্থতহবিল তারা কোন কোন খাতে, কত পরিমাণে ব্যবহার করবেন এবং এসব ব্যয়ের ক্ষেত্রে তারা কিভাবে সরকারি কেনাকাটা ও ব্যয়ের বিধান অনুসরণ করবেন সেটাই তাদের শেখানো হত।

২০১১ সাল থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত পিআরপি নির্বাচিত সিপিএফসমূহে ব্যয় করার জন্য প্রায় ১০০০ ডলারের সমপরিমাণ অর্থের একটি তহবিল দিত। এসব তহবিল সংশ্লিষ্ট সিপিএফ এর কার্যকারিতা বৃদ্ধি ও কমিউনিটির সদস্য ও পুলিশ অফিসারদের মধ্যে অপরাধ প্রতিরোধ ও সমস্যা সমাধানে যৌথভাবে কাজ করার একটা অনুশীলন চালু করার জন্য ব্যবহার করা হত। এই যে পুলিশ ও জনগণের সাথে অপরাধ প্রতিরোধে যৌথভাবে কাজ করার যে অনুশীলন – এটা পিআরপির সহায়তাপুষ্ট ইউনিয়নের সিপিএফগুলোতে একটা আদর্শিক রূপ লাভ করবে বলে মনে করা হত। এজন্য এগুলোকে বলা হত কমিউনিটি পুলিশিং এর মডেল ইউনিয়ন (মেট্রোপলিটনে ওয়ার্ড)।

কিন্তু এসব বিষয়ে কমিউনিটি পুলিশিং বিষয়ে যে প্রশিক্ষণ দেয়া হত সেখানে কমিউনিটি পুলিশিং দর্শনের সামান্য অংশই আলোচনার সুযোগ হত। কেননা এক দিনেরও কম সময়ে উদ্বোধনী পর্ব, তার পর উপস্থিত অংশগ্রহণকারীদের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া জানাজানি, অভিজ্ঞতা বিনিময়, অর্থব্যয়ের নিয়মকানুন ইত্যাদি শিখতে গিয়ে পুলিশ অফিসারগণ কমিউনিটি পুলিশিং এর মূল দর্শনকে সঠিকভাবে জানার মতো সময়ই পেতেন না। এমতাবস্থায় আমার প্রস্তাব ছিল যে সিপিওদের আলাদাভাবে কমিউনিটি পুলিশিং এর উপর অন্তত তিন দিনের প্রশিক্ষণের আয়োজন করা হোক। কিন্তু আমি পিআরপিতে থাকা অবস্থায় এটা সম্ভব হয়নি।

কমিউনিটি পুলিশিং বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে যত সমস্যা রয়েছে সবগুলোর মূলেই রয়েছে এ দর্শন সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট সকলের সঠিক জ্ঞানের অভাব। বিশ্বের পুলিশিং ইতিহাসে এটা একটি নতুন দর্শন। সনাতনী পুলিশিং এর সাথে এর গুণগত ও পদ্ধতিগত পার্থক্য বিদ্যমান। তাই আনুষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ ও স্বউদ্যোগে জ্ঞানলাভ ছাড়া এ দর্শন বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। অন্যদিকে এটাএমন একটি দর্শন যা প্রচলিত পুলিশিং পদ্ধতিই শুধু নয়, প্রচলিত পুলিশিং সংস্কৃতিকে একটি নতুন সংস্কৃতির মাধ্যমে প্রতিস্থাপন করবে। তাই এ সম্পর্কে ভাসা ভাসা জ্ঞান দিয়ে এটা বাস্তবায়নে নেতৃত্ব দেয়া সম্ভব নয়। এজন্য সকল শ্রেণির পুলিশ অফিসারদের এ সম্পর্কে অন্তত মৌলিক প্রশিক্ষণ থাকা চাই। একই সাথে এক শ্রেণির পুলিশ অফিসারকে কমিউনিটি পুলিশিং এর উপর উচ্চতর জ্ঞান থাকা চাই।

যারা মৌলিক জ্ঞানের অধিকারী হবেন, তারা মাঠ পর্যায়ে এটা বাস্তবায়নে তৎপর থাকবেন। অন্যপক্ষে বিস্তারিত জ্ঞানার্জনকারী পুলিশ অফিসারগণ এ বাস্তবায়নকারী অফিসারদের দিক নির্দেশনা দিবেন, তাদের কাজের তদারক করবেন ও অনেক ক্ষেত্রে মাঠ পর্যায়ে নিজেরা আদর্শ স্থাপনের মাধ্যমে অন্যদের মৌল বিষয়ের শিক্ষাও দিবেন। অন্যদিকে উচ্চতর শিক্ষা অর্জনকারী পুলিশ অফিসারগণ কমিউনিটি পুলিশিং এর ক্ষেত্রে নীতি নির্ধারণ, গবেষণা ও সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশে এটা বাস্তবায়নের বৃহত্তর কৌশল নির্ধারণ করবেন। তাছাড়া পুলিশ অফিসারদের বাইরেও কমিউনিটি পুলিশিং দর্শনের উপর উচ্চতর জ্ঞান ও গবেষণার জন্য একটি অপুলিশ গবেষক ও অধ্যাপক শ্রেণির উদ্ভবও কাম্য। কেননা শুধু পুলিশ অফিসারদের জ্ঞান দিয়েই একটি দর্শন বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। এজন্য দরতার নিরপেক্ষ গবেষক ও একাডেমিশিয়ান। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় বাংলাদেশে এ সব কিছুরই যথেষ্ঠ অভাব রয়েছে।

এখনও বাংলাদেশের অধিকাংশ পুলিশ অফিসার কমিউনিটি পুলিশিং এর মৌলিক বিষয়ে সম্মক ধারণা রাখেন না। ২০০৭ সালের পূর্বে বাংলাদেশের কোন পুলিশ প্রশিক্ষণ কেন্দ্রেই কমিউনিটি পুলিশিং এর উপর প্রশিক্ষণের কোন আলাদা মডিউল ছিল না। আমি যতদূর জানি ২৫তব বিসিএস অফিসারদের জন্য বাংলাদেশ পুলিশ একাডেমি সারদায় যখন পুলিশ সাইন্সের উপর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন মাস্টার্স ডিগ্রি চালু হয়, তখন সনাতনী ধারায় প্রশিক্ষণের পরিবর্তে একটি আধুনিক পাঠ্যক্রম চালু হয় এবং এ পাঠ্যক্রমের একটি অংশে কমিউনিটি পুলিশিং পড়ানোর ব্যবস্থা করা হয়। তবে এ সম্পর্কে দক্ষ প্রশিক্ষকের অভাবে এ মডিউলে খুব একটা বেশি কার্যকর জ্ঞানলাভ সম্ভব ছিল না। ইতোপূর্বে সারদায় প্রশিক্ষণে আমাদের বর্তমান আইজিপি জনাব একেএম শহীদুল হক বিপিএম-পিপিএম স্যার কয়েকটি ক্লাস নিতেন। কিন্তু মাত্র তিনটি ক্লাসে কমিউনিটি পুলিশিং এর সকল দিক তো দূরের কথা প্রধান দিকগুলোই আলোচনা করা সম্ভব হয় না। আমি সারদায় প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত অনেক তরুণ পুলিশ অফিসারের সাথে কথা বলে বুঝতে পেরেছি, তারা পিটি-প্যারেড আর ফৌজদারি আইনের বাইরে অন্যান্য বিষয়ে খুব একটা বেশি জ্ঞানলাভে উৎসাহী ছিলেন না। এদের মধ্যে অনেকেই কমিউনিটি পুলিশিং দর্শনে এখনও অস্বস্তিবোধ করেন।

এতো গেল যারা কমিউনিটি পুলিশিং সম্পর্কে কিছু না কিছু হলে সারদায় শিখেছেন তাদের কথা। কিন্তু যারা এসম্পর্কে পুলিশ প্রশিক্ষণের কোন পর্যায়েই ন্যূনতম একটি ক্লাসেও উপস্থিত ছিলেন না, তারা কিভাবে কমিউনিটি পুলিশিং সম্পর্কে জ্ঞানলাভ করবেন? তাদের জন্য হয় ইন-সার্ভিস প্রশিক্ষণের আয়োজন করতে হবে, নয়তো তারা নিজ দায়িত্বে বিদ্যমান সাহিত্য থেকে কমিউনিটি পুলিশিং দর্শনটি আত্মস্থ করবেন।

কিন্তু আমার জানা মতে জুনিয়র পুলিশ অফিসারকে কোন না কোনভাবে ইন-সার্ভিস ট্রেনিং বা পিআরপি এর সহযোগিতায় কোন সংক্ষিপ্ত প্রশিক্ষণ বা কর্মশালায় একত্রিত করা গেলেও সিনিয়র পুলিশ অফিসারদের জন্য আসলে এ ধরনের প্রশিক্ষণের আয়োজন করা সম্ভব হয়নি। তবে পুলিশ স্টাফ কলেজে পিআরপি কর্তৃক এএসপি ও অতিরিক্ত এসপি পর্যায়ে পাঁচ দিনের কয়েকটি ব্যাচে প্রায় ২০০ এর মতো অফিসারকে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। এমতাবস্থায়, কমিউনিটি পুলিশিং দর্শন ও তার বাস্তবায়ন সম্পর্কে পুলিশের সাব-ইন্সপক্টের, ইন্সপেক্টর এবং সামান্য কিছু সংখ্যক এএসপি ও অতিরিক্ত এসপি প্রশিক্ষণ গ্রহণ করলেও এসপি বা তদুর্ধ্ব পদের পুলিশ অফিসারদের আসলে এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিক প্রশিক্ষণের তেমন কোন ব্যবস্থাই হয়নি। সিনিয়র পুলিশ অফিসারদের অনেকেই স্বউদ্যোগে কমিউনিটি পুলিশিং সম্পর্কে বিস্তারিত পড়াশোনা হয়তো করেছেন। কিন্তু অধিকাংশ সিনিয়র পুলিশ অফিসার এসম্পর্কে এখনও দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ও সনাতনী ভাবধারাতেই রয়ে গেছেন।

অনেকে কমিউনিটি পুলিশিংকে অত্যন্ত ক্ষুদ্র দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে দেখার চেষ্টা করেন। অনেকে তাদের সীমিত জ্ঞানে মনে করেন এটা বাংলাদেশে বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। কেউ কেউ মনে করেন, অপরাধ প্রতিরোধ আর আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত ও বিশেষভাবে অনুশীলনের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন পুলিশের সাথে আনপড়, অনভিজ্ঞ ও ক্ষুদ্র পরিসরে নিজেদের স্বার্থ উদ্ধারে ব্যস্ত সাধারণ মানুষকে অংশীদার বানানোর কোন মানেই হয় না। এমতাবস্থায়, কেন্দ্র থেকে যত প্রকার প্রচেষ্টাই প্রহণ তরা হোক না কেন, মাঠ পর্যায়ে কমিউনিটি পুলিশিং বাস্তবায়ন এখনও কাঙ্খিত গতি পায়নি।  তাই কমিউনিটি পুলিশিং বাস্তবায়নের জন্য পুলিশের সকল স্তরের অফিসারদের প্রশিক্ষণ প্রদান অত্যন্ত জরুরি। (মূল, ২০ অক্টোবর, ২০১৪ পরিমার্জন ১১ জানুয়ারি, ২০১৫)