উন্নয়ন, অপরাধ ও হার্দিক এনোমি

মোঃ আব্দুর রাজ্জাক
Published : 29 Oct 2014, 05:13 AM
Updated : 29 Oct 2014, 05:13 AM

একথা স্বীকৃত যে জাতি হিসেবে আমরা অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে যাচ্ছি। স্বাধীনতার পর থেকে বিভিন্ন ক্ষেত্রে নানা বিশৃঙ্খলা ও অবনতির মধ্যেও গত ৪৫ বছরে আমাদের অর্জনও উল্লেখযোগ্য। ১৯৯০ সালের পর থেকে আমাদের অর্থনীতি মূলত দেশিয় উপার্জনের উপর দাঁড়াতে শুরু করে। এর পর গত ১৪/১৫ বছরে এখন আমরা আমাদের অর্থেই বাজেট রচনা ও বাস্তবায়ন করতে পারি। শুধু অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেই নয়, উন্নয়নের সকল সূচকেই বাংলাদেশের বিচরণ রয়েছে। শিক্ষা, চিকিৎসা, যোগাযোগ, বিনিয়োগ, শিল্পায়ন, নগরায়ন এমন কোন দিক নেই যে দিকে বাংলাদেশের উন্নয়ন ঘটেনি। তবে সুষম উন্নয়ন যাকে বলা হয়, তা হয়তো হয়নি।  সর্বশেষ ২০১৪-১৪ সালের জাতীয় বাজেটের ব্যাপক আকার আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে আমরা আসলেই একটি দ্রুত উন্নয়নশীল জাতির মর্যাদা অর্জন করেছি। আমরা এগিয়ে যাচ্ছি।

কিন্তু উন্নয়নের উপজাত হিসেবে আসে অনুন্নয়ন ও কিছু কিছু ক্ষেত্রে অধঃগতিও। এ অধঃগতিটি আসলে আসে আমাদের সামাজিক, মানসিক ও সাংস্কৃতির জীবনে। অর্থনৈতিক উন্নয়নে রাষ্ট্রের বা সমাজের সকল উপাঙ্গ সমান তালে চলতে পারে না। কোন না কোনভাবে কোথাও না কোথাও থেকে যায় অসংগতি ও ভারসাম্যহীনতা।

উন্নয়নের উপজাত হিসেবে যে হটাৎ করে বিভিন্ন ক্ষেত্রে বড় ধরনের ভারসাম্যহীনতার সৃষ্টি হয় তাকে ফরাসি সমাজবিজ্ঞানী এমিল দুর্খেইম বলেছেন 'এনোমি'। এই এনোমিকালে সমাজের মানুষ এমন সব কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হয়, যেগুলো সমাজ সামগ্রিকভাবে অনুমোদন করে না। এ অনুমোদনহীন কর্মকাণ্ডই হল অপরাধ। তবে এক্ষেত্রে অপরাধকে আচরণের বিচ্যূতি বলাই শ্রেয়। কেননা সমাজ কর্তৃক অস্বীকৃত বা অননুমোদিক সকল আচরণই রাষ্ট্রীয় আইনে নিষিদ্ধ নয়। যে সব আচরণ সমাজ অনুমোদন করে না, রাষ্ট্র যদি সেগুলোকে নিষিদ্ধ করে সংসদে আইন পাশ না করে, তাহলে আইনের ভাষায় সে আচরণকে অপরাধ বলা যাবে না। তবে সামাজিক এনোমিকালে সমাজে বিচ্যূত আচরণের অনেকগুলোই রাষ্ট্রীয় আইনে নিষিদ্ধ হয়ে যায় এবং রাষ্ট্র কর্তৃক নিষিদ্ধ আচরণগুলোর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য রাষ্ট্রীয় আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো সর্বদা সচেষ্ট থাকে।

হাল আমলে আমাদের বাংলাদেশি সমাজে চলছে এমনি ধরনের এনোমি। দুর্খেইমের ভাষায় বিপ্লবাত্মক পরিস্থিতির মতো ওলট-পালট করে দেবার মতো সামাজিক ভারসাম্যহীনতা আমাদের সমাজে এখনও তৈরি হয়নি। তাই অনেকে এটাকে দুর্খেইমের এনোমি হয়ত বলবেন না, কিন্তু অপরাধ বিজ্ঞানী রবার্ট মার্টনের সংজ্ঞায়িত সামাজিক এনোমিতে আমরা অবশ্য বসবাস করছি। মার্টনের মতে, সামাজিক এনোমি শুধু যে  কোন ওলট-পালট করে দেয়ার মতো উল্লেখযোগ্য ঘটনার মাধ্যমেই সৃষ্টি হয়, তা নয়। বরং দ্রুত পরিবর্তনশীল সমাজে প্রতিনিয়তই এনোমি চলছে। মুক্ত বাজারের প্রতিযোগীতা সম্পন্ন পুঁজিবাদী গণতান্ত্রিক সমাজে প্রত্যেকটি মানুষের সামনেই উন্নতি ও প্রতিষ্ঠা পাবার হাতছানি রয়েছে। এখানে যে কেউ যে কোন দিন হতদরিদ্র অবস্থা থেকে কোটিপতিতে পরিণত হতে পারে। এখানে পূঁতিগন্ধময় বস্তির বাসিন্দা থেকে আকাশচূম্বী অট্রালিকার মালিক হওয়া যায়। রাস্তার টোকাই থেকে ক্ষমতার শীর্ষে ওঠা যায়। এখানে রাজনীতির ক্রমধারায় 'উড হাউজ' থেকে 'হোয়াইট হাউজে' প্রবেশের সুযোগ করে নেয়া যায়।

কিন্তু সমাজ তার সদস্যদের সামনে এ ধরনের প্রতিষ্ঠার হাতছানি দিলেও সবার জন্য সমান সুযোগ দিতে পারে না। তাই শুরু হয় প্রতিষ্ঠার প্রতিযোগীতা। এ প্রতিযোগীতায় যোগ্যতমরাই টিকে থাকে। আর যেহেতু যোগ্যতমদের টিকে থাকার ধারণাটি ডারউইনের বিবর্তন ধারায় ইতরপ্রাণীদের মধ্যেই সবচেয়ে বেশি পরিলক্ষিত হয়, তাই সভ্যযুগের মানুষও এই প্রতিযোগীতায় জয়লাভ করতে ইতর প্রাণীদের গুণগুলো চর্চা করতে শুরু করে। আমি বলি, ইতর প্রাণীদের সেই গুণগুলোই হল অপরাধ। সমাজ স্বীকৃত পথকে অপ্রতুল মনে করে মানুষ যখন ভিন্ন পথে প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা চালায়, কোন সমাজে সেটাই হয় অপরাধ। সমাজের অভিভাবক প্রতিষ্ঠানগুলো যদি এই ইতরসদৃশ প্রতিযোগীতার চর্চাগুলোকে নিয়ন্ত্রণ বা সীমীত করতে না পারে, তবে সেই সমাজ হয় দুর্নীতিবাজ, অপরাধ প্রবণ তথা মাৎস্যন্যায়ের মূর্ত প্রতীক।

আমাদের বাংলাদেশি সমাজে যে বিদ্যমান এনোমির মাত্রা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে তা আসেপাশে তাকালেই বোঝা যাবে; প্রচার মাধ্যমে চোখ রাখলেই স্পষ্ট হবে। সরকারি-বেসরকারি সকল খাতেই অসুস্থ প্রতিযোগীতার একটি স্পষ্ট ধারা চারদিকে প্রবহমান। প্রচার মাধ্যমের হাজার হাজার ঘটনা আমাদের এ এনোমির অস্তিত্বকে প্রকট করে তোলে। সমাজের সকল স্তরে, দেশের সকল স্থানে, মানুষের সকল শ্রেণিতে চলছে বিচ্যূত ও সমাজ অননুমোদিক আচরণের চর্চা। বিচ্যূত আচরণের প্রতিনিধিত্বকারী এ ধরনের কিছু ঘটনাকে এখন আমরা উদাহরণ হিসেবে পর্যালোচনা করব। তবে আমাদের শিরোনামের প্রতি সুবিচার করে আমরা নারী-পুরুষের প্রাগৈতিহাসিক কামনা তথা কিছু হৃদয়ঘটিত ব্যাপারস্যাপার বা হার্দিক ঘটনার মধ্যেই আমাদের আলোচনা সীমিত রাখব। আমরা দেখানোর চেষ্টা করব মানুষের চিরায়ত যৌনতাড়না কিভাবে মানুষকে বিচ্যূত আচরণের মাধ্যমে তাকে জঘন্য অপরাধ-কর্মে উদ্বুদ্ধ ও জড়িত করে।

যৌনতার জালে কলেজ ছাত্র ও একটি নৃসংশ খুন

১৯ অক্টোবর, ২০১৪ রাতে ঢাকা মহানগরীর মিরপুর-১০ এর ১৫ নম্বর লেইনের ১১নম্বর বাসায় খুন হন গার্মেন্টস ও ঝুট ব্যবসায়ী গিয়াস উদ্দীন। ১০ বছরের দাম্পত্য জীবনে দুই সন্তানের জনক এ ব্যবসায়ীকে খুন করেন তার স্ত্রী লাবনী ইয়াসমিন লীনা। অসম বয়সী কলেজ ছাত্রের সাথে পরকীয়া প্রেমের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ানোর ফলে লীনা তার কলেজ পড়ুয়া প্রেমিক তানভিরের সহায়তায় লাঠি দিয়ে পিটিয়ে, দা দিয়ে কুপিয়ে ও বালিশ দিয়ে শ্বাসরোধ করে নিজ স্বামীকে নৃসংশভাবে হত্যা করে। তানভিরের সাথে বন্ধু হিসেবে যোগ দেয় আরো দুই যুবক। লীনা বিষয়টিকে প্রথমে ডাকাতির ঘটনা হিসেবে চালিয়ে দেয়ার চেষ্টা করলেও চতুর ও অভিজ্ঞ পুলিশ অফিসারদের কাছে তা শেষ পর্যন্ত গোপন রাখতে পারেননি।

তার স্বীকারোক্তি মতে একে একে গ্রেফতার হয়েছে তার প্রেমিক তানভির, তানভিরের বন্ধু আকিবুল ইসলাম জিসান ও সাদমান ইসলাম মুক্ত। হত্যাকাণ্ডে অংশ নেয়া সবাই বোন না কোনভাবে পুলিশের কাছে হত্যাকাণ্ডের কথা স্বীকার করেছে। পত্রিকার খবরে প্রকাশ নিহতগিয়াসের স্ত্রী তার কৈশোরকাল থেকেই বেপরোয়া। তিনি বিয়ের পরেও তার বিবাহপূর্ব প্রেমের সম্পর্ক টিকিয়ে রেখেছেন। শুধু তাই নয়, তিনি তার যৌন কামনা চরিতার্থ করার জন্য একাধিক পুরুষের সঙ্গ পেতে উদ্গ্রীব হয়ে থাকেন। তার অনিয়ন্ত্রিত যৌনতার জালে ধরা পড়ে কলেজপড়ুয়া তানভীর।আর তানভীরকে বন্ধুত্বের খাতিরে সহায়তা করতে এসে ফেঁসে যান তার দুই বন্ধু জিসান ও মুক্ত। ঘটনাটি আবেগ, নৃসংশতা ও ব্যক্তিত্ব বিকৃতির একটি উৎকৃষ্ট উদারহণ।

বিচ্যূত আচরণ হিসেবে কলেজ ছাত্র তানভিরের এটিই একমাত্র রেকর্ড। সে কোন রাজনৈতিক ক্যাডার নয়, পাড়ার পুসকে মাস্তান নয়, এমনকি সহপাঠীদের উত্যক্তকারী কোন টিনএজার ইভটিজারও নয়। এমনিভাবে তার দুই বন্ধু জিসান ও মুক্তও কোন অস্বাভাবিক চরিত্রর ছেলে নয়। ইতোপূর্বে তারা মানুষ হত্যা তো দূরের কথা কারো সাথে বড় ধরনের ঝগড়া-ফাসাদেও জড়ায়নি। অথচ বন্ধুর মধ্যবয়সী এক প্রেমিকার জন্য একজন নিরপরাধ ও অপরিচিত মানুষকে পিটিয়ে, কুপিয়ে ও শ্বাসরোধ করে পরিকল্পিতভাতে হত্যা করল।আরো মজার বিষয় হল, বন্ধুত্বের খাতিরে মানুষ খুন করতে গিয়ে তারা নিজেদের অজান্তেই ভাড়াটিয়া খুনিদের মতো পারিশ্রমিকও আদায় করল। তাদের ভাষায় তানভির খুনের কাজে অংশ গ্রহণ করে প্রেমের টানে, আর জিসান ও মুক্ত খুনের অপরাধে অংশগ্রহণ করে বন্ধুত্বের টানে। তাদের ভাষ্যমতে এটা মূলত একটি হ্রদয়ঘটিত ব্যাপারস্যাপার। কিন্তু মানুষের হৃদয়ের টান কিভাবে মানুষকে চিরায়ত অপরাধে জড়িত করে এ ঘটনাটি তারই প্রকৃষ্ট উদাহরণ।

হতাশা-উগ্রতা ও পরকীয়ার বলী মসজিদের ঈমাম

সিলেটের বালাঞ্জ থানার ইলাশপুর বড়চর গ্রামের সৌদি প্রবাসী ফিরোজ আলীর বাড়ির ভিতরের গর্ত খুঁড়ে গত ২৩ অক্টোবর, ২০১৪ তারিখে পুলিশ দুই ব্যক্তির লাশ উদ্ধার করেছে। এদের একজন মাওলানা আব্দুল হামিদ ও অন্যজন অটোরিকসা চালক আরস আলী। মাওলানা হামিদের সাথে তার শ্যালিকা গৃহকর্তী আফিয়া বেগমের পরকিয়া প্রেমের সম্পর্ক ছিল। তার স্বামী বিদেশে থাকার সুবাদে আফিফা বেগম বালাগঞ্জ পূর্ববাজার জামে মসজিদের ইমাম তার দুলাভাই মাওলানা আব্দুল হামিদেরসাথে পরকিয়া প্রেমের সম্পর্ক জড়িয়ে পড়ে।

বিষয়টি নিয়ে আফিফার যুবক ছেলে-মেয়েরা আপত্তি তোলে। তারা মাওলানাকে তাদের বাড়িতে আসতে নিষেধ করলেও মাওলানা তার পরকিয়ার টান ছাড়তে পারেন না। শেষ পর্যন্ত তার প্রেমিকার ছেলেমেয়েদের হাতেই তাকে জীবন দিতে হল। উন্নয়ন ও সম্মৃদ্ধির আশায় বাংলাদেশের বিপুর সংখ্যক মানুষ বিদেশে অবস্থান করছেন। কিন্তু টাকা পয়সা রোজগার করে আর্থিক সম্মৃদ্ধি নিয়ে এলেও তারা পারিবারিকভাবে হয়ে পড়ছে একেবারেই নিঃস্ব। ( দৈনিক মানবজমিন, ২৪ অক্টোবর, ২০১৪)

উন্নয়নের ভারসাম্যহীনতা আফিয়া বেগমকে লাগামহীন করে তুলেছিল। অন্যদিকে মসজিদের ইমাম হলেও আব্দুল হামিদ মানুষের প্রাগৈতিহাসিক কামনার ঊর্ধ্বে উঠতে পারেন নি। তাই শালীকার সাথে তিনি তৈরি করে ছিলেন অবৈধ দৈহিক সম্পর্ক। আর এ পাপই তাকে শেষ পর্যন্ত পুড়ে মেরেছে। আর প্রবাসী ফিরোজ আলীর সোমত্ব সন্তানেরা মায়ের প্রাগৈতিহাসিক কামনার মূল্যটুকুও বুঝতে পারেন নি। তারাও হয়ে পড়েছেন অন্তুষ্ট, অসহিঞ্চু, বিব্রত, অপমানিত, হতাশ ও উগ্র। এ হতাশার ফলে উদ্ভূত উগ্রতার কবলে পড়ে ঈমাম সাহেব তার অটোরিকসা চলকসহ নিহত হলেন। পুলিশকে উদ্ধার করতে হলতার গতিল লাশ। (কালের কণ্ঠ, ২৪ অক্টোরব, ২০১৪)

ক্ষমতা, উগ্রতা আর রক্ষিতার জন্য যুদ্ধনাটক

গত ১৯ অক্টোবর, ২০১৪ সিএনজি অটোরিক্সা চালক শাহ আলমকে দুই পায়ে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালে ভর্তি করায় পুলিশ। পুলিশের ভাষ্যে বলা হয়, শাহআলম ছিনতাই চক্রের সদস্য। ঢাকার আগার গাঁয়ে গত তারিখে রাত্রে ছিনতাইয়ের চেষ্টাকালে সে পুলিশের সাথে বন্দুক যুদ্ধে আহত হয়। তার কাছ থেকে গুলিভর্তি পিস্তল ও উদ্ধার করা হয়। তাই তার নামে ছিনতাইয়ের চেষ্টা, অবৈধ অস্ত্র দখলে রাখা ও পুলিশকে আক্রমণের জন্য মামলা করা হয়। সে এখন আহত অবস্থায় চিকিৎসাধীন।

কিন্তু পত্রিকার খবরবে বেরিয়ে আসে অন্য ঘটনা। এই শাহ আলম এসআই আনোয়ারের পূর্ব পরিচিত। ইতোপূর্বে যখন এসআই আনোয়ার মোহাম্মদপুর থানায় কর্মরত ছিলেন, তখন শাহ আলম তার সোর্স হিসেবে কাজ করত। পরে সে সিএনজি চালাতে শুরু করে।কিন্তু শাহ আলম যেন এসআই আনোয়ার হোসেন শুধু সোর্সই ছিল, ছিল আরো বেশি কিছু। এসআই আনোয়ার শাহ আলমের বাসা পর্যন্ত যাতাযাত শুরু করে। বাসায় যাতায়াতের ফাঁকে শাহ আলমের স্ত্রী শান্তার সাথে এসআই আনোয়ারের প্রেমের সর্ম্পক গড়ে ওঠে।

কিন্তু এ পরকীয়ার বিষয়টি শান্তার স্বামী শাহ আলম সহেকেই ছেড়ে দিতে পারেন নি। এ নিয়ে শান্তার সাথে তার মনোমালিন্য হয়। এক পর্যায়ে শান্তা তার স্বামীর বিরুদ্ধে নারী ও শিশু নির্যাতন আইনে মামলা করেন। এসআই আনোয়ার শান্তাকে এ বিষয়ে সর্বাত্মক সহযোগীতা দিয়ে যান। শান্তাকে তার স্বামী থেকে দূরে রাখার যাবতীয় ব্যবস্থা তিনি পাকাপোক্ত করেন।

সম্প্রতি ঢাকার কেরানীগঞ্জ থানাধীন আরশিনগর আবাসিক এলাকায় একটি বাসা ভাড়া নিয়ে আনোয়ার তার রক্ষিতা হিসেবে শান্তাকে রেখে দেন। সেখানে তিনি শান্তার স্বামী পরিচয়ে যাতায়াতও করেন। এ নিয়ে শান্তার স্বামী শাহ আলমের সাথে এসআই আনোয়ারের বিরোধ চরমে ওঠে। প্রেমিকার স্বামী শাহ আলমকে চরম শিক্ষা দেয়ার জন্য আনোয়ার পরিকল্পনা করে। যেহেতু আনোয়ারে কাছে শিক্ষাদানের সবচেয়ে সহজলভ্য উপায় হচ্ছে তার পুলিশি ক্ষমতার অপব্যবহার, তাই তিনি শাহ আলমকে ছিনতাইকারী সাজিয়ে পায়ে গুলি করে তাকে পঙ্গু করে দেয়ার চেষ্টা করে এবং চূড়ান্তভাবে তাকে একাধিক মামলার আসামী হিসেবে গ্রেফতার করে জেল হাজতে পাঠাবার ব্যবস্থা করে। ( দৈনিক মানব জমিন ২৩ অক্টোবর, ২০১৪)

প্রচার মাধ্যমের ভাষায়,পুলিশের নিজস্ব তদন্তে এসআই আনোয়ারের সাথে শাহ আলমের স্ত্রী শান্তার পরকীয়া প্রেমের সম্পর্ক ও তার জের ধরে পরিকল্পিতভাবে শাহ আলমকে ফাঁসানোর সত্যতা মিলেছে। আনোয়ারের বিরুদ্ধে নিয়মিত ফৌজদারি মামলা রুজু হয়েছে। বর্তমানে তিনি ডিএমপির গোয়েন্দা ও অপরাধ তথ্য বিভাগের তদন্তকারীদের রিমান্ডে রয়েছেন। ( বাংলাদেশে প্রতিদিন, ২৪ অক্টোবর, ২০১৪)

এসআই আনোয়ার কর্তৃক শাহ আলমকে ফাঁসানোর ঘটনাটি একটি চিরায়ত অপরাধের ঘটনা হলেও এর ভিন্ন মাত্রা রয়েছে। উন্নয়নের উপজাত হিসেবে আমাদের সমাজে নানা মাত্রার অপরাধ ও ‍উন্নত কৌশলের অপরাধীদের সংখ্যা বেড়েছে। অপরাধীগণ আগের চেয়ে অনেক বেশি সংখ্যায় আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করছে। আগের চেয়ে অনেক বেশি মাত্রায় তাদের নৃসংশতা ও জঘন্যতা বেড়ে গেছে। ঠিক একই মাত্রায় পুলিশের কার্যকারিতা ও কর্মতৎপরতা বেড়েছে। ২০০০ সালের পূর্বে এদেশে অপরাধী/সন্ত্রাসীদের সাথে পুলিশ বা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাথে বন্দুক যুদ্ধ তো দূরের কথা, অপরাধীদের সামনাসামনি ধস্তাধস্তির খবরও তেমন প্রকাশিত হত না।

কিন্তু ক্রমান্বয়ে সে অবস্থা পাল্টে যায়। বর্তমানে প্রতিনিয়তই সন্ত্রাসী, ছিনতাইকারী, ডাকাত, মাস্তান, জঙ্গি প্রভৃতি বর্ণনার অপরাধীদের সাথে বন্দুক যুদ্ধের খবর পত্রিকায় প্রকাশিত হচ্ছে। বাধ্য হয়ে হোক, বা নিজ থেকেই হোক বর্তমানে পুলিশকে বিচ্যূত আচরণের নাগরিকদের বিরুদ্ধে অস্ত্র প্রয়োগ করতে হচ্ছে। পুলিশের অস্ত্র প্রয়োগের এই যে উন্নয়ন তারও একটি অন্ধকার দিক রয়েছে। আজ থেকে ১০ বছর আগে হলে এসআই আনোয়ারের মতো বিচ্যূত চরিত্রের পুলিশ অফিসারগণ তার প্রতিপক্ষকে বড় জোর একটি মিথ্যা মামলায় গ্রেফতার কিংবা একটি যোগসূত্রহীন হত্যা মামলায় 'Shown Arrest' দেখাতেন। কিন্তু কালের বিবর্তনে এখন তারা প্রতিপক্ষকে বন্দুক যুদ্ধের নাটকের মাধ্যমে পঙ্গু কিংবা হত্যা করছেন। মার্টনের চলমান এনোমি সমাজের আর দশটা প্রতিষ্ঠানের মতো পুলিশেও প্রবেশ করেছে। এর ফলে পুলিশেও বিচ্যূত চরিত্রের সদস্যের সংখ্যা বেড়ে যাবে এটাই তো স্বাভাবিক।

একসাথে দুই স্বামী ও প্রষিতভর্তৃকাদের যৌনতার এনোমি

২৪ অক্টোবর, ২০১৪ তারিখের দৈনিক পত্রিকাগুলোর খবর থেকে জানা যায়, লক্ষীপুর জেলার রায়পুর থানার সাগরী গ্রামের রফিক উল্ল্যার ছেলে জয়নাল আবেদিন লক্ষীপুর আদালতে অভিযোগ করেছেন যে তার স্ত্রী তার চার মাসের শিশু সন্তানকে নিয়ে কোম্পানীগঞ্জের চরকাঁকড়া গ্রামে অন্য স্বামীর বাড়িতে চলে গেছে। আর কোম্পানীগঞ্জ থানায় তার নামে চাঁদাবাজি ও প্রতারণার মামলাও করেছে। পত্রিকার ভাষ্য মতে ২০০৯ সালে কোম্পানিগঞ্জ থানার মুছাপুর ইউনিয়নের চরকাঁকড়া গ্রামের ওবায়দুল হকের মেয়ে মারজান বেগমের সাথে একই গ্রামের অলি আহমদের ছেলে আজাদ হোসেনের বিয়ে হয়। বিয়ে রেজিস্ট্রি করেন কোম্পানীগঞ্জ নিকাহ অফিসের কাজি হাফেজ আহমদ। বিয়ের পর আজাদ বাহরাইনে চলে যায়।

স্বামীর অনুপস্থিতিতে মারজান মোবাইল ফোনের মাধ্যমে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তোলে লক্ষীপুরের জয়নাল আবেদিনের সাথে। পরে তারা প্রথমে এফিডেভিট ও পরে ২০১২ সালে লক্ষীপুর নিকাহ অফিসের কাজী মাওলানা সালেহ আহমদের কাছে বিবাহ রেজিস্ট্রি করে। বিয়ের পর মারজান নাকি তার দ্বিতীয় স্বামী জয়নাল আবেদিনের নিজ বাড়ি লক্ষীপুরের রায়পুর থানার সাগরী গ্রামেই থাকতেন। কিছু দিন আগে বাপের বাড়িতে চলে যাওয়ার পর মারজান আর ফিরে আসেন নি। তাই জয়নাল আবেদিন বউ বাচ্চাকে নিজ বাড়িতে নিয়ে আসার জন্য শ্বশুর বাড়িতে গেলেও তাদের আনতে পারে নি। এর পর তিনি জানতে পারেন যে তাকে বিয়ে করার পূর্বেও তার স্ত্রী মারজান আরো একটি বিয়ে করেছিল এবং সে স্বামীও বর্তমান। সেও ছয় মাস আগে বাহরাইন থেকে ছুটিতে বাংলাদেশে এসে ২০ দিন আগে পুনরায় বিদেশে ফিরে গেছেন। এখন তার স্ত্রীর দুই স্বামী। তাকে স্ত্রী স্বামী হিসেবে স্বীকৃতি দিচ্ছেন না। আর তার চার মাস বয়সী বাচ্চার পিতৃত্ব নিয়েও বড়  স্বত্তের ঘোট পেকেছে। ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমে তা নির্ধারণের জন্য ও তিনি আবেদন করছেন আদালতে। ( দৈনিক মানব জমিন ও দৈনিক যুগান্তর, ২৫ অক্টোবর, ২০১৪)

যৌনতা মানুষের অন্যতম প্রাথমিক প্রেষণা। এই প্রেষণা তার ক্ষুধা, তৃঞ্চা আর নিরাপত্তার মতোই অবশ্যপূরণীয়। যদি এ প্রেষণা প্রচলিত পথে পূরণ করা না যায়, তাহলে তা ভিন্ন পথে পূরণ করার প্রচেষ্টা ইতরপ্রাণীদের প্রচেষ্টার মতোই উগ্র হয়ে দেখা দিতে পারে। প্রবাস জীবন মানুষকে যেমন উন্নতি আর অগ্রগতির হাতছানি দেয়, তেমনি অনুন্নয়ন ও সর্বস্ব হারানোর সম্ভাবনাও থাকে এতে। দীর্ঘদিন স্বামী অনুপস্থিত থাকলে কোন নারী তার যৌন কামনা প্রশমিত করার জন্য বিচ্যূত পথ বেছে নেয়। পূর্বে যোগাযোগ ব্যবস্থা অনুন্নত ছিল। তাই মানুষের যোগাযোগ শুধু তার পরিবার, পাড়া বা গ্রামের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকত। তখন প্রষিতভর্তৃকাদের বিচ্যূত পথে যৌন তাড়না প্রশমনের খবরগুলো খুব একটা বাইরে আসত না। কিন্তু যোগাযোগ ব্যবস্থার ডিজিটাইজেশন, পরিবহন ব্যবস্থার আধুনিকায়ন ও প্রচার মাধ্যমের উৎকর্ষের ফলে আজ প্রষিতভর্তৃকাদের যৌন তাড়না প্রশমনের খবরগুলো সহজেই বাইরে আসছে। আর একই সাথে এটার মাধ্যম ও পদ্ধতিও শানিত হচ্ছে।

একবিংশ শতাব্দীর এ সূচনাপর্বে আমাদের সমাজ দ্রুততার সাথে সামনের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। কিন্তু সমাজের সকল উপাঙ্গ একই গতিতে উন্নত হচ্ছে না। এক অংশের উন্নয়ন তাই অন্য অংশকে অতিকর্মী বা অকর্মক করে তুলছে। আমাদের সমাজ তার প্রচলিত মূল্যবোধ হারাচ্ছে। পরিবার, আত্মীয়তা ও নৈকট্যের বন্ধন অতি দ্রুত শিথীল হয়ে আসছে। একে একে ভেঙ্গে পড়ছে প্রচলিত মূল্যবোধগুলো। কিন্তু নতুন কোন একক ও সার্বজনীন মূল্যবোধ এখনও প্রতিষ্ঠিত হয়নি।

অন্যদিকে সমাজবিদ, রাজনীতিবিদ ও রাষ্ট্রপরিচালকদের কাছে বাহ্যিক উন্নয়ন  যেমন গুরুত্ব পাচ্ছে,মানসিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উন্নয়ন ততোটা গুরুত্ব পাচেছ না। উন্নয়নের ভারসাম্যহীনতায় অন্যান্যদের মতো খেই হারিয়ে ফেলছেন আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রনায়কেরাও যা দুর্খেইমের বিপ্লবাত্মক এনোমির দিকে আমাদের ধাবিত করছে। আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রকে সঠিক পথে পরিচালিত করতে হলে তাই এ এনোমি থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। উন্নয়নের সকল উপাঙ্গের মধ্যে ভারসাম্য ফিরিয়ে আনতে হবে।বস্তুগত উন্নয়নের সাথে সাথে আমাদের সামাজিক, সাংস্কৃতিক তথা আত্মীক উন্নয়নের জন্য বিনিয়োগ করতে হবে। কোন উন্নয়ন পরিকল্পনার সাথে সাথে তার উপজাত হিসেবে যে ভারসাম্যহীনতা ও বিচ্যূত আচরণের উদ্ভব হবে তাকে মোকাবেলার জন্যও উন্নয়ন পরিকল্পনায় অর্থের সংস্থান রাখতে হবে।

১. http://www.bd-pratidin.com/last-page/2014/10/24/38807

২. http://www.jugantor.com/last-page/2014/10/25/163869

৩.http://mzamin.com/details.php?mzamin=NDcxMDU=&sMg==