নিজ দেশে পরবাসীঃ বাঙালিরা পাকিস্তানিদের কখনও স্বদেশী ভাবেনি

মোঃ আব্দুর রাজ্জাক
Published : 21 Nov 2014, 06:32 PM
Updated : 21 Nov 2014, 06:32 PM

মেজর জেনারেল(অবঃ) খাদিম হোসেন রাজার a stranger in my own country East Pakistan, 1969-1971 পড়ে শেষ করলাম। এ জেনারেল ঊনিশ শত ঊনসত্তর, সত্তর ও একাত্তরের বিক্ষুব্ধ দিনগুলোতে বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে পাকিস্তান আর্মির বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে অধীষ্ঠিত ছিলেন। ২৫ মার্চের কালো রাতে সারা দেশে 'অপারেশন সার্চ লাইট' নামে বাঙালি নিধন অভিযান চালান  হয়েছিল, সে অভিযানও ছিল তারই পরিকল্পনা ও নেতৃত্বের ফসল।

তার বইতে তৎকালে বাংলাদেশের রাজনৈতিকি পরিস্থিতির বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সামরিক শাসনকে তিনি অত্যন্ত দুর্বল বলে উষ্মা প্রকাশ করেছেন। ঊনসত্তরের গণ অভ্যূত্থানের পর ইয়াহিয়া খান ক্ষমতায় অধিষ্ঠীত হলে, পাকিস্তানকে গণতান্ত্রিক ধারায় ফেরানোর চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ইয়াহিয়া আবার কঠিনতম পথ অবলম্বন করে পাকিস্তানকে দ্বিখণ্ডিত করার পথ উন্মোচন করেন।

বইটিতে জেনারেল টিক্কাখান ও এএকে নিয়াজিসহ অনেকের চরিত্র বিশ্লেষণ করা হয়েছে। টিক্কা খান ছিলেন কঠোর স্বভাব ও নিষ্ঠুর ব্যক্তিত্বের অধিকারী। তিনি বন্দী বঙ্গবন্ধুকে বাংলাদেশের মাটিতেই ফাঁসি দেয়ার প্রতীজ্ঞা করেছিলেন।

অন্যদিকে, জেনারেল নিয়াজি ছিলেন নৃতাত্বিক ধারায় সাম্প্রদায়িক ব্যক্তি। তিনি একাধারে ছিলেন নিষ্ঠুর, মদ্যপ ও নারীলোভী। জনাব খাদিম রাজার কাছ থেকে দায়িত্ব গ্রহণের পর অফিসারদের সাথে ব্রিফিংকালে তিনি বাঙালি নিধনের তিব্র প্রত্যয় ব্যক্ত করতে গিয়ে সীমাহীন অশ্লীলতার আশ্রয় নিয়েছিলেন। প্রকাশ্য দরবারে বাঙালি অফিসারদের উপস্থিতিতেই তিনি বাঙালি নারীদের উপর পাকিস্তানি সৈন্যদের লেলিয়ে দিয়ে তাদের ধর্ষণ করার মাধ্যমে বাঙালি জাতির নৃতাত্বিক গঠনই পরিবর্তন করে দেয়ার প্রতীজ্ঞা করেছিলেন।

বাঙালিদের উপর এমন নির্যাতন পরিকল্পনা ও বাঙালি মা-বোনদের প্রতি অবমানাকর মন্তব্যের যন্ত্রণায় ছটফট করতে থাকেন সেই অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকা বাঙালি অফিসারগণ। সেই দরবারে উপস্থিত মেজর মোস্তাক বাসায় এসেই বাথ রুমে ঢুকে নিজ অস্ত্র মাথায় ঠেকিয়ে আত্মহত্যা করেছিলেন। লেখকের মতে, মেজর মোস্তাকই ছিলেন বাংলাদেশে নিয়াজির নৃশংসতার প্রথম শিকার। জেনারেল নিয়াজি এতটাই নারীলোভী ছিলেন যে এ ব্রিফিং এর পর দিন তিনি লেখকের কাছে তার ঢাকার মেয়ে বন্ধুদের টেলিফোন নম্বর চেয়ে তাকে অবাক করে দিয়েছিলেন।

জেনারেল খাদিমের বই পড়ে বোঝা গেল, পাকিস্তানী সেনাবাহিনী অনেক আগেই বুঝতে পেরেছিল যে শেখ মুজিবের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করলে বাংলাদেশ আর পাকিস্তানের সাথে থাকবে না। বিগত তেইশ বছরে বাঙালিদের উপর যে নির্যাতন চালান হয়েছে, তাদের সকল ক্ষেত্রে যেভাবে বঞ্চিত ও শোষিত করা হয়েছে, তাতে এক মাত্র পূর্ণ স্বাধীনতাই তাদের এক মাত্র লক্ষ্য। আর এ লক্ষ্য অর্জনের অবিসংবাদিত নেতা হলেন বঙ্গবন্ধু। তাই যে কোন মূল্যে তারা বঙ্গবন্ধুকে ক্ষমতার বাইরে রাখতে চেয়েছিলেন।

তবে তারা বঙ্গবন্ধু ও বাঙালিদের সম্পর্কে সঠিক ধারণা অর্জন করতে পারেনি। তারা মনে করেছিলেন, সামরিক ব্যবস্থার মাধ্যমে বাঙালিদের স্তব্ধ করে দেয়া যাবে। কিন্তু পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে কর্মরত বাঙালি অফিসার ও ফোর্সগণ যে প্রথম সুযোগেই বিদ্রোহ করে প্রতিরোধ গড়ে তুলবে এবং অল্প সময়ের মধ্যেই একটি নিয়মিত প্রতিরক্ষা বাহিনীসহ একটি অপ্রতিরোধ্য মুক্তিবাহিনী গড়ে তুলবে, সেটা তারা অনুমানই করতে পারেনি।

জনাব খাদিম রাজার বর্ণনায় প্রমাণিত হয়েছে যে, পাকিস্তানি কর্মকর্তাগণ এদেশে এসে শাসন শোষণের মৌরসী পাট্টা কায়েম করলেও তারা প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত এদেশে আসলে অনাকাঙ্খিত ও বহিরাগতই ছিল। পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে প্রবেশের পর শিক্ষাণবিশ অবস্থায় তিনি যখন প্রথমবার তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান তথা বাংলাদেশে এসেছিলেন, তখনই দেখেছিলেন যে এদেশের দোকানদারগণ পর্যন্ত পাকিস্তানিদের কাছে সওদা বিক্রিতেও উৎসাহী নয়। এদেশের আপামর মানুষের কাছে পাকিস্তানি মানেই বিদেশি ছিল। এক্ষেত্রে তারা ১৯৪৭ সালের পূর্বের ব্রিটিশ শাসকদের চেয়ে আলাদা ছিলেন না।

পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধু ঘোষিত অসহযোগ আন্দলনের সময় বাঙালিরা পাকিস্তানিদের কাছে একদম জিনিসপত্র বিক্রয় বন্ধ করে দিয়েছিলেন বলেও আমরা জনাব খাদিম রাজার বই থেকে জানতে পারি। দেশের সকল ক্যান্টমেন্টে বাঙালি সরবরাহকারীগণ শাকশব্জি ও কাঁচা খাবার সরবরাও বন্ধ করে দিয়েছিলেন। বঙ্গ বন্ধুর ৭ই মার্চের সেই ভাষণ, 'আমরা তোমাদের ভাতে মারব, পানিতে মারব, বাংলার মাটিকে মুক্ত করে ছাড়ব, ইনশাআল্লাহ'  সারা বাংলার মতো পাকিস্তানি অধ্যূষিত ক্যান্টনমেন্টগুলোতেও পৌঁছে গিয়েছিল।

কোন মহল থেকেই বাঙালিরা পাকিস্তানিদের কোন দিনই আপন বলে মেনে নেয়নি। তাই বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন ছিল একটা সময়ের ব্যাপার মাত্র। ক্ষেত্র প্রস্তুত ছিল। অভাব ছিল শুধু নেতৃত্বের। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান বাঙালিদের সেই নেতৃত্ব দিয়ে ধন্য করেছিলেন। তার ঐশ্বরিক নেতৃত্বে বাঙালিরা জনাব খাদিম রাজার বাংলাদেশ ত্যাগের মাত্র ৮ মাসের মাথায় পাকিস্তানি জেনারেল নিয়াজিকে অপমানজনক আত্মসমর্পণে বাধ্য করেছিল।