প্রেম, পরকীয়া ও যৌন অপরাধের হেতু রসায়ন

মোঃ আব্দুর রাজ্জাক
Published : 10 Dec 2014, 12:14 PM
Updated : 10 Dec 2014, 12:14 PM

যৌনতা একটি জটিল বিষয়। এর সাথে প্রেমের বিস্তর পার্থক্য রয়েছে। কোন জৈব বস্তু বংশ বিস্তারের আকাঙ্খায় তার শরীর স্বতঃস্ফুর্তভাবেই কতিপয় বিশেষ আচরণ করে। কিছু বিশেষ অংগের মাধ্যমে সেসব আচরণ বাইরে দৃশ্যমান হয়। বিপরীত লিঙ্গের প্রতি সহজাত প্রক্রিয়ায় যখন মিলন ঘটে বা মিলনের পূর্বপ্রস্তুতি মূলক কোন আচরণ দৃশ্যমান হয়, সে আচরণকে আমরা যৌনতা বলে ধরে নেই।

প্রেম যৌনতার পূর্বসূরি। তবে এরা পৃথক পৃথক অস্তিত্ব নিয়ে দৃশ্যমান হতে পারে। কতিপয় জীব কোন প্রকার বাহ্যিক আচরণ ছাড়াই যৌনতার কাজটি শেষ করতে পারে। কোন কোন জীব/প্রাণীর জন্য যৌনতা পূরণের জন্য যৌনাঙ্গ তেমন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে না। পুরুষ ব্যাঙ স্ত্রী ব্যাঙের ডিম্বাণুর উপর শুক্রাণু নিক্ষেপ করেই যৌন ক্রিয়ার সমাপ্তি টানে।

কোন কোন প্রাণীর যৌন ক্রিয়া নিতান্তই মৌসুমি। একটি নির্দিষ্ট মওসুম ভিন্ন তাদের যৌনতা সুপ্তাবস্থায় থাকে। কুকুরকে কার্তিক মাসের আগে সক্রিয় হতে দেখা যায় না। তবে এদের যৌনতায় প্রেমের উপস্থিতি অতি নগণ্য।

কতিপয় প্রাণী প্রেমের মাধ্যমেই যৌনতা প্রদর্শন করে। মন দেয়া নেয়ার পর চলে দীর্ঘ অভিষার, চলে বোঝাপড়া। তারা বাসা তৈরি করে, ঘর বাঁধে ও সংসার পাতে। আমাদের অতি পরিচিত কবুতর পাখিরা মোটামুটি স্থায়ী দাম্পত্য জীবনে অভ্যস্ত। আলবাট্রস পাখিরা সারা জীবনের জন্যই নাকি সংসার পাতে। সোয়ান বা রাজহাঁস দম্পতি একে অপরের জন্য জীবন বিসর্ন দেয়। একজনের মৃত্যুতে অন্যজন করুণ বিলাপের পর জীবন উৎসর্গ করে। এই বিলাপকে আমরা রূপকের মাধ্যমে বলি সোয়ান সং- মানে কোন লেখকের সর্বশেষ রচনা।

মানব ইতিহাস অতি প্রাচীন; অতি বিচিত্র। প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকেই মানুষ একে অপরের প্রেমে মশগুল হয়। যখন থেকে মানুষের ইতিহাসে পরিবার নামক প্রতিষ্ঠানটির জন্ম হয়েছে, তারও বহু পূর্ব থেকে মানব-মানবীর মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। মানুষের ইতিহাস শুধু ইতর প্রাণী বা প্রকৃতির সাথে সংগ্রামের ইতিহাসই নয়; এ ইতিহাসের একটি বড় অংশ জুড়ে আছে মানব-মানবীর প্রেম কাহিনী ও তাদের ঘিরে চাওয়া-পাওয়ার দ্বন্দ্ব।

মুসলিম পুরান মতে আদমের সন্তানগণ তাদেরই এক বোনকে নিয়ে নিজেদের মধ্যে যুদ্ধ করে লংকা কাণ্ড ঘটিয়ে দিয়েছিল। আদমের ইতিহাসে তাই প্রথম মৃত্যুর রূপ স্বাভাবিক নয়; অস্বাভাবিক। হাবিল-কাবিলের মধ্যে দ্বন্দ্ব ছিল তাদেরই একমাত্র বোনকে নিয়ে। যদিও কোন সূত্র থেকেই হাবিল-কাবিলের সেই বোনের নাম পাওয়া যায় না, তবুও এটা বহুল প্রচারিত যে হাবিল তার ভাই কাবিলকে খুন করেছিল শুধু তার বোনকে এককভাবে পাওয়ার জন্য যে পাওয়ার পূর্বরাগ ছিল গভীর প্রেম।

মানব ইতিহাসে পরিবারের উৎপত্তি কিন্তু প্রেম থেকেই। প্রেমের উপজাত হিসেবে যে সন্তান সন্ততি জন্ম নেয়, তাদের উপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার ফয়সালা দেয় পরিবারই। কিন্তু পরিবার এক জোড়া নারী-পুরুষকে স্থায়ী সংসারের জালে আবদ্ধ রাখলেও তাদের যৌনতাকে পরিপূর্ণভাবে সীমাবদ্ধ রাখতে পারেনি। একই বস্তুতে অধিক দিন দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখতে না পারার সহজাত বাসনা থেকে উদ্ভূত হোক, কিংবা যৌন জীবনে বৈচিত্র্য প্রত্যাশায় হোক, মানুষ পরিবারের মতো একটি স্থায়ী প্রতিষ্ঠান তৈরির পরও পরিবারের বাইরে তার যৌন আকাঙ্খা পূরণের প্রচেষ্টা নিয়েছে। ইতর প্রাণিদের মতোই তারা নিজের ক্ষেতের বাইরেও বাড়িয়েছে কামনার মুখ।

কেউ কেউ বলেন, মানুষ চরিত্রগত ও জীবগতভাবেই বহুগামী। তার চরিত্রে নতুনত্ব অন্বেষণের বীজ জন্ম থেকেই প্রথিত। তাই নারী-পুরুষ তাদের পরিবারের বাইরেও সুখ খোঁজে; অনুসন্ধান করে বৈচিত্র্যের। এই বৈচিত্র্যই কি তাহলে আধুনিক জগতের পরকীয়া প্রেম?

যদিও বলা হয় মানুষ বহুগামী। কিন্তু আমাদের সমাজ এই বহুগামীতার স্বীকৃতি নারী-পুরুষ উভয়কেই সমানভাবে ভোগ করতে দেয় না। আদর্শবাদী সমাজে স্বামী-স্ত্রী ভিন্ন যৌন ক্রিয়া পুরোপুরি নিষিদ্ধ। কিন্তু পাশ্চাতে্যর মতো ন্যূনতম বাঁধনের সমাজে দাম্পত্য সম্পর্কের বাইরের যৌনতায় খুব একটা বেশি মাইন্ড করা হয় না। ওরা এটাকে যৌন স্বাধীনতা বলে। আমরা প্রাচ্যবাসিরা অবশ্য এটাকে নাম দেই অবাধ-যৌনতা। আর অবাধ যৌনতা প্রতীচ্যে সামাজিক ও ধমীয় স্বীকৃতি পায় না।

কোন কোন দেশে স্বামী-স্ত্রীর মতো বসবাস করলেও নারী-পুরুষের একটা গণ্য অংশ বিয়েই করে না। তাদের সংসার থাকে, সংসারে সন্তান-সন্ততি থাকে। কিন্তু কৌশলগত কারণে তারা স্বামী-স্ত্রী নয়; তারা প্রেমিক-প্রেমিকা। এখানে তারা একে অপরকে স্থায়ী প্রেমের জালে আটকাতে পারলেও সমাজ ও  আইন তাদের স্বামী-স্ত্রী বলে না। আরো অদ্ভুত হল, এসব সমাজে বৈধ বিবাহের বাইরে জনগ্রহণ করলেও এ সব সন্তানদের অবৈধ বা জারজ বলা হয় না।

পরকীয়া প্রেম বলতে ইংরেজিতে কিছু নেই। তবে বাংলার ব্যভিচার শব্দটিকে পরকীয়ার সাথে এক করে দেখা যায়। যদি পরকীয়া প্রেমকে ব্যাভিচার দ্বারা প্রতিস্থাপন করি তবে এটা বাংলাদেশের দণ্ডবিধির  ৪৯৭ ধারা অনুসারে দণ্ডনীয় অপরাধ। এ ধারার ভাষ্যমতে কোন বিবাহিত স্ত্রী লোকের সাথে জেনে বুঝে কোন পুরুষ যদি যৌনকর্ম সম্পাদন করে এবং সেই যৌনকর্ম যদি ধর্ষণের পর্যায়ে না পড়ে তবে সেটা হবে ব্যাভিচার বা  Adultery.  ব্যভিচারের সর্বোচ্চ শাস্তি পাঁচ বছর কারাদণ্ড কিংবা জরিমানা কিংবা উভয়েই।

এখানে একটি বিষয় লক্ষণীয় যে ব্যভিচারের ঘটনায় নারীটিকে অবশ্যই বিবাহিতা হতে হবে। তবে পুরুষটি বিবাহিতা হওয়া জরুরি নয়। অন্যদিকে এ অপরাধে নারী-পুরুষ উভয়ের সম্মতি প্রয়োজন। যদি সম্মতিহীনভাবে এ অপরাধটি সংঘটিত হয়, তা ধর্ষণের পর্যায়ে পড়বে। কিন্তু উভয়ের সম্মতিতে অপরাধটি সংঘটিত হলেও ব্যাভিচারের জন্য নারীটি কিন্তু কোনভাবেই বিচারের সম্মুখিন হবে না। কারণ আইনের ধারায় স্পষ্ট বলা হয়েছে নারীটি এ অপরাধের সহযোগী হিসেবে বিবেচিত হবে না।

সমাজের পরিবর্তনের সাথে সাথে সেই সমাজের অপরাধের ধরনও পরিবর্তিত হয়। পরিবর্তিত সমাজে নতুন অপরাধ তৈরি যেমন হয়, তেমনি পুরাতন অপরাধও চিরায়ত রূপের পরিবর্তন ঘটায়। প্রেম, ভালবাসা ও পরকীয়া সংক্রান্ত অপরাধসমূহ মানুষের আবেগীয় উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে। ফ্রয়োডিয় দর্শনে এটা Eros বা জীবনাঙ্খার প্রতিফলন। কিন্তু এ জীবনাঙ্খাই প্রায় ক্ষেত্রে জীবননাশের কারণ হয়। পৃথিবীতে সৃষ্ট অনর্থের একটি বড় অংশ জন্য নারী-পুরুষের মধ্যকার যৌনতা, প্রেম কিংবা পরকীয়াই দায়ী। অপরাধের এ  হেতু রসায়ন বা Etiology চিরন্তন। এটাকে দাই চিরতরে বিদায় করা সম্ভব নয়, নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।  ( ১০ ডিসেম্বর, ২০১৪)