ব্যাংক ডাকাতি, জনতার প্রতিরোধ ও ভবিষ্যৎ দুশ্চিন্তা

মোঃ আব্দুর রাজ্জাক
Published : 22 April 2015, 12:30 PM
Updated : 22 April 2015, 12:30 PM

গত ২১ এপ্রিল, ২০১৫, ঢাকা জেলার আসুলিয়ার কাঠগড়া বাজারে দিনে দুপুরে ব্যাংক ডাকাতির মতো ঘটনা ঘটেছে[১]। ডাকাতরা মোটর সাইকেলে করে এসে গ্রাহকের বেশে ব্যাংকে ঢুকে প্রথমের আক্রমণ করে গানম্যানকে। এরপর ম্যানেজারের টেবিলে গিয়ে হাতবোমা রেখে ভীতি প্রদর্শন করে ভল্টের চাবি চায়। কিন্তু ম্যানেজার চাবি দিতে অস্বীকার করলে তাকেও ডাকাতগণ এলোপাতাড়িভাবে কোপাতে থাকে। ফিম্লি কায়দায় তারা ব্যাংকের কর্মচারী ও সেবাপ্রার্থীদের মেঝেতে শুয়ে পড়ার আদেশ দেয়। সন্ত্রস্ত সেবাপ্রার্থীগণ এসময় এদিক ওদিক ছোটাছুটি করে। তখন ডাকাতগণ গ্রেনেড চার্জ করে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। এ ফাঁকে চলে ক্যাশ কাউন্টার থেকে টাকা লুটের মহোৎসব।

কিন্তু ভরা দুপুরে জনাকীর্ণ স্থানে বাইরের লোকজন টের পেয়ে যায়। পাশের মসজিদের মাইক থেকে ডাকাতির কথা ঘোষণা দিয়ে সবাইকে প্রতিরোধের জন্য আহব্বান জানান হলে হাজার হাজার মানুষ ডাকাতদের ঘিরে ফেলে। এতে ডাকাতগণ ধরাপড়ায় ভয়ে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে এবং এলোপাতাড়ি গুলিে ছাড়ে ও গ্রেনেড চার্জ করে। এতে প্রায় সর্বমোট আটজন নিহত হয়। ডাকাতরা পালিয়ে যাওয়ার সময় জনগণ দুইজনকে ধরে ফেলে। এদের মধ্যে একজন গণপিটুনিতে নিহত হয়। ভল্টের চাবি না পাওয়ায় এবং জনগণ তাদের চারদিক থেকে ঘিরে ফেলায় ডাকাতগণ শুধু ক্যাশের টাকা লুটের মধ্যেই সীমবদ্ধ থাকে। তাই তারা মাত্র পাঁচ লাখ টাকা লুট করকে পেরেছিল। কিন্তু জনগণ ধাওয়া দিয়ে সে পাঁচ লাখ টাকাই উদ্ধার করে ফেলেছে।

এভাবে ত্রাসের রাজত্ব কায়েক করে দিনে দুপুরে বাংক ডাকাতির ঘটনা বাংলাদেশ খুব একটা বেশি নেই। প্রাত্যহিক খবরের কাগজে মাঝে মধ্যেই আমরা ব্যাংকে চুরির ঘটনা পড়ে থাকি। প্রতি বছর বাংলাদেশে দু তিনটি ব্যাংকে চুরির ঘটনা ঘটে। কিন্তু ব্যাংক ডাকাতির ঘটনা খুবই সামান্য। এ ঘটনার মধ্য দিয়ে দেশের অপরাধ জগত জানান দিল যে ব্যাংক ডাকাতি করার মতো যথেষ্ঠ সাহস ও মারণাস্ত্র এদেশের ডাকাত তথা অপরাধীর কাছে আছে। নিঃসন্দেহে এটা পুলিশের জন্য একটি চিন্তার বিষয়।

সাধারণভাবে যে অপরাধের ক্ষেত্রে অপরাধীগণ ভিকটিম বা সাধারণ মানুষের ভয়ে নিজেদের গোপন করার চেষ্টা করে, সে জাতীয় অপরাধ ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থায় লঘু শাস্তির আওতায় আসে। যেমন, চুরির ঘটনা। এর শাস্তি অবস্থা ভেদে তিন থেকে ১০ বছরের মধ্যে। গোপনে মালিকের অজান্তে অসদুদ্দেশ্যে স্থানান্তরযোগ্য কোন বস্তুকে কেউ যদি স্থানান্তর করে, দণ্ড বিধির ভাষায় সেটা চুরি হয়। যখন তাৎক্ষণিক ক্ষতির ভয় দেখিয়ে মালিককে অপরাধীর হাতে হস্তান্তরযোগ্য বস্তু সমর্পণে প্রলুব্ধ করা হয়, তখন সেটাকে বলা হয় বলপূর্বক আদায়। বলপূর্বক আদায় বা চুরির ক্ষেত্রে যদি অপরাধী ভিকটিমের ক্ষতি বা আহত করে, মৃত্যুর তাৎক্ষণিক ভয় দেখায় বা বলপূর্ব আটক করে কিংবা আটকের ভয় দেখায়, সেটা হবে দস্যুতা। আবার দস্যুতা সংঘটনকারী  ও তাদের সহায়তাকারী ব্যক্তিদের সংখ্যা যদি পাঁচ বা তার চেয়ে বেশি হয়, তাকে বলা হবে ডাকাতি।
 সাধারণভাবে চুরির শাস্তি সর্বোচ্চ তিন বছর কিংবা শুধু জরিমানা অথবা দুটোই হতে পারে। তবে চুরির মাত্রা ভেদে এর শাস্তির পরিমাণ ১০ বছর পর্যন্ত হতে পারে। কিন্তু ডাকাতি এমনি একটি অপরাধ যা মানুষকে ভীতির মধ্যে ফেলে কিংবা মানুষকে হত্যা করে সংঘটিত হয়। এক্ষেত্রে আপামর মানুষ অপরাধীদের ভীষণ ভয় পায়। আর এজন্যই ডাকাতির শাস্তি সর্বোচ্চ মৃত্যুদণ্ড পর্যন্ত। অনেক ক্ষেত্রে আবার ডাকাতির জন্য সর্বনিম্ন শাস্তির মেয়াদ দেয়া আছে, কিন্তু উচ্চসীমা নেই। যেমন, সশস্ত্র অবস্থায় ডাকাতির শাস্তি সর্বনিম্ন সাত বছর।

বাংলাদেশে ডাকাতি ও দসুতা নামে দুটো পৃথক ধরনের অপরাধ থাকলেও দস্যুতা ও ডাকাতি আসলে একই প্রকার অপরাধ। এখানে ভেদরেখাটি হচ্ছে অপরাধীদের মোট সংখ্যা। অপরাধীর সংখ্যা চার জন বা তার নীচে হলে অপরাধটা হয় দস্যুতা কিন্তু চারের বেশি হলে হয় ডাকাতি। কিন্তু অন্যান্য দেশে দস্যুতা ও ডাকাতিকে পৃথক অপরাধ মনে করা হয় না। সেখানে সবই দস্যুতা। ইংরেজিতে যাকে বলা হয় Robbery। এমনকি ডাকাতি(Dacoity) শব্দটাও সম্পূর্ণ বঙ্গভারতীয়। Banditry কিংবা Brigandage শব্দগুলো ডাকাতির কাছাকাছি। তবে এগুলোর তীর্যকতা আবার মহাসড়কে ডাকাতির দিকেই বেশি। তবে ব্যুৎপত্তিগত অর্থ যাই হোক ডাকাতি বাংলাদেশে সম্পত্তির বিরুদ্ধে সংঘটিত অপরাধগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি জঘন্য বলে পুলিশের কাছে বিবেচিত। ডাকাতির সাথে যখন খুনও সংঘটিত হয়, কোন পুলিশ অধিক্ষেত্রে এর প্রভাব আরো ভয়াভহ হয়। ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তাদের কাছে নিম্নতম কর্মকর্তাদের জবাব দিতে দিতে গায়ের ঘাম ছুটে যায়।

আসুলিয়ার এ ব্যাংক ডাকাতির ঘটনাটিকে অনেকে দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির চরম পর্যায় বলে মনে করতে পারেন। অবশ্য এটা মনে করার কারণও আছে। কারণ ডাকাতির ঘটনা আমাদের দেশে প্রাত্যহিক ঘটনাগুলোর চেয়ে অনেকটাই আলাদা। চুরির ঘটনার সাথে আমাদের প্রাত্যহিক পরিচয় হলেও ডাকাতির ঘটনা কম। আবার দেশে কালে ভদ্রে ব্যাংক ডাকাতির ঘটনা ঘটে। তাই দিনের বেলা সশস্ত্র কায়দায় ব্যাংক ডাকাতি মানুষের মনে আতঙ্ক সৃষ্টি করবেই।

পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সের ডাকাতির পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত ২১ বছরে গড়ে বাংলাদেশে বছরের ০৫টি করে ব্যাংক ডাকাতির ঘটনা ঘটেছিল। ২০০২ সালে সর্বোচ্চ ১৮টি ব্যাংক ডাকাতির ঘটনা ঘটেছিল। ১৯৯৩ থেকে ১৯৯৭ সালের ব্যবধানে ব্যাংক ডাকাতির গড় ছিল সবচেয়ে বেশি। তবে ২০০৮ সালের পর থেকে এর সংখ্যা দ্রুত কমতে থাকে।  ২০০৯ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত গত পাঁচ বছরে মাত্র ছয়টি ব্যাংক ডাকাতির ঘটনা ঘটেছিল। ২০০৮ ও ২০১১ ও ২০১৪ সালে দেশে কোন ব্যাংক ডাকাতি হয়নি। উন্নত অবকাঠামোগত নিরাপত্তার বাহিরেও প্রায় ব্যাংকে সিসিটিভি স্থাপনও এ অপরাধ হ্রাসের অন্যতম কারণ।

২০০৯-২০১৪ সালে বাংলাদেশে সংঘটিত ব্যাংক ডাকাতির পরিসংখ্যান

বছর                               ডাকাতরি সংখ্যা
১৯৯৩                                ৬
১৯৯৪                                ৮
১৯৯৫                                ১৭
১৯৯৬                                ৬
১৯৯৭                                ১০
১৯৯৮                                ১
১৯৯৯                                ১
২০০০                                ১
২০০১                                ৩
২০০২                                ১৮
২০০৩                                ১০
২০০৪                                ৩
২০০৫                                ৪
২০০৬                                ৩
২০০৭                                ৮
২০০৮                               ০
২০০৯                                ১
২০১০                               ২
২০১১                              ০
২০১২                               ২
২০১৩                               ১
২০১৪ ০

অপরাধের শ্রবণ ও দর্শন প্রকৃত অপরাধের শিকার হওয়ার চেয়েও অনেক বেশি ভীতকর। আলোচিত ঘটনাটি ভরাদুপুরে শত শত কর্মচারী, সেবাভোগী ও ব্যাংকে সশস্ত্র প্রহরীদের শতর্ক পাহারার মাঝেও সংঘটিত হওয়ায় এর প্রেক্ষিতে প্রকাশিত খবর পড়ে, শুনে ও টেলিভিশনের পর্দায় দেখে যে কেউ চিন্তিত হবেন। আমাদের আটপৌর জীবনের অপরধ–ভীতিকে এ ঘটনা তো তুঙ্গে তুলবেই।

আমি মনে করি, ঘটনার সহিংসতার সাথে আরো একটি বিষয় পুলিশের মাথা ব্যথার কারণ। আমাদের দেশের ডাকাতদের সবচেয়ে বড় মারণাস্ত্র ছিল মূলত পাইপগান, দেশি বন্দুক কিংবা ব্যতিক্রম ক্ষেত্রে পিস্তল। কিন্তু আসুলিয়ার কাঠগড়ার ব্যাংক ডাকাতির নায়করা এবার বোমা ও গ্রেনেড ছুড়েছে। পুলিশের কর্তাব্যক্তিরা বলছেন এসব অস্ত্র দেশি নয়, বিদেশি। এগুলোর ব্যবহার নাকি সামরিক বাহিনীর বাইরে সাধারণ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও করে না[২]। তাই এসব গ্রেনেড ও বোমার ব্যবহার ও তা প্রাপ্তির শিকড়টি আরো বেশিদূর পর্যন্ত বিস্তৃত। এ ঘটনা আমাদের স্মরণ করিয়ে দিবে যে এদেশের ডাকাতদলে বোমা বা গ্রেনেড তৈরি করার মতো দক্ষ কারিগর রয়েছে কিংবা তাদের সাথে বিষ্ফোরক দ্রব্যের আধুনিক প্রযুক্তিতে পারদর্শী কোন গ্রুপ বা ব্যক্তিদেরও সংযোগ রয়েছে। সেক্ষেত্রে আমরা ধারণা করতে পারি, এ বিশেষ ডাকাত দলের আরো অনেক সহায়ক, সেবাভোগী রয়েছে। এর চেয়েও মারাত্মক খবর হচ্ছে এ ডাকাতদলের সাথে জঙ্গি-সম্পর্কের অনুমান [৩]। প্রচার মাধ্যমে যা খবর আসছে, তাতে ডাকাতরা নিজেও জঙ্গিদলের সদস্য হতে পারে কিংবা জঙ্গিরা তাদের ব্যবহার করতে পারে[৪]। যতি সত্যিই এটা হয়, তাহলে জঙ্গিরা আমাদের জন্য আরো বেশি মাথা ব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়াবে।

তবে একটি ডাকাতি কিংবা ব্যাংক ডাকাতির ঘটনা ঘটলেই তাকে আইন-শৃঙ্খলার চরম অবনতি বলা সমীচীন হবে না। কারণ এটা বাংলাদেশে একটি কালে ভদ্রে সংঘটিত অপরাধ। যুক্তরাষ্ট্রের প্রাত্যহিক অপরাধের তুলনায় এ অপরাধ তেমন কিছুই নয়। কারণ সে দেশে প্রতি দেড় মিনিটে একটি করে ডাকাতির ঘটনা ঘটে। ঘটনাটির একটি উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে যে স্থানীয় মানুষ অপরাধটির প্রতিরোধে এগিয়ে এসেছে। নিকটস্থ মসজিদের মাইক থেকে জনগণকে যার যা আছে তাই নিয়ে ডাকাতদের প্রতিহত করার ঘোষণা দেয়া হয়েছে। সে অনুযায়ী আসেপাশের লোকজন এগিয়ে এসেছে।

কিন্তু ডাকাতদল এতটাই বেপরোয়া ছিল যে তারা এলোপাতাড়ি গুলি চালিয়ে, বোমা ফাটিয়ে তাদের পালাবার পথ তৈরি করেছিল। ডাকাতদের গুলিতে প্রতিরোধকারীদের কয়েকজন নিহতও হয়েছিল। এরপরও জনতা ক্ষান্ত হয়নি। তারা ডাকাতদের ধারওয়া করে দুজনকে হাতেনাতে ধরে ফেলেছিল। এদের একজন অবশ্য গণপিটুনিতে মারাও গেছে। উদ্ধার হয়েছে লুট হওয়া প্রায় সব টাকাই। লুটের টাকা উদ্ধারের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হল এক ডাকাত জীবিত গ্রেফতার হওয়ার ফলে এ ডাকাত দলটি পুরোপুরি শনাক্ত হয়েছে। এদের জিজ্ঞাসাবাদে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যাবে। এ তথ্যের মাধ্যমে তাদের ভবিষ্যৎ অপরাধের পরিকল্পনা যেমন জানা যাবে, তেমনি অপরাপর ব্যাংক ডাকাদের দলগুলোকেও চিহ্নিত করা যাবে। আরো সুখের বিষয় হচ্ছে, প্রতিরোধকালে নিহতদের স্বজনদের ক্ষতিপূরণ হিসেবে এক লাখ করে টাকা দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক[৫]। যদিও কোন কিছুই জীবনের মূল্যের প্রতিদান হয় না। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের এ ঘোষণা ভবিষ্যতের প্রতিহতকারীদের অনুপ্রেরণা যোগাবে।(২২ এপ্রিল, ২০১৫)
সূত্রাবলী:
১. দৈনিক প্রথম আলো, ২২ এপ্রিল, ২০১৫