বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক বনাম পুলিশের কনস্টেবল

মোঃ আব্দুর রাজ্জাক
Published : 16 May 2015, 05:23 PM
Updated : 16 May 2015, 05:23 PM

এক আর এক যোগ করলে দুই হয়। কিন্তু দুইটি খারাপ কাজ একত্র করলে একটি ভাল কাজ হয়না। তাই আমার এ নিবন্ধ পড়ে দুটো খারাপ কাজের যোগফলকে একটি ভাল কাজের উৎপত্তি অর্থাৎ অপকর্মকে প্রশ্রয় দেয়ার প্রচেষ্টা বলে ধরে নিবেন না। এটাকে যুক্তির কূটাভাস বলেই ধরে নিবেন।

গত ১০ মে, ২০১৫ তারিখে ছাত্র ইউনিয়নের ডিএমপি ঘেরাও কর্মসূচির প্রেক্ষিতে একজন নারীকে একটি বিচ্ছিন্ন পুলিশ দলের কয়েকজন সদস্য মারপিট করেছিল। এটা যেমন ছিল জনসাধারণের কাছে দৃষ্টিকটু ও নিন্দনীয়, তেমনি পুলিশ প্রশাসনের কাছেও ছিল অনভিপ্রেত, অপেশাদার ও বিভাগীয় শৃঙ্খলা পরিপন্থি। এজন্য ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ কর্তৃপক্ষ কাল বিলম্ব না করে একজন পুলিশ সদস্যকে তাৎক্ষণিকভাবে বরখাস্ত করে বিষয়টির তদন্ত শুরু করে একটি কমিটি গঠন করেছে। বিষয়টিকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে পুলিশের সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষ পুলিশ হেডকোয়ার্টার্স থেকেও একটি কমিটি গঠিত হয়েছে। পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সের কমিটি শুধু একজন নারীকে হেস্তনেস্ত করা নয়; গোটা বিষয়টির উপরই অনুসন্ধান করছেন। অধিকন্তু ঘটনাটির প্রেক্ষিতে দায়ি পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে কি ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে, তা জানানোর জন্য মহামান্য হাইকোর্ট বিভাগও পুলিশের আইজিপিকে নির্দেশ দিয়েছেন। এসব কিছুই একটি ঘটনাকে ঘিরে হয়েছে যার হয়তো মূল অংশই ছিল নারীকে হেস্ত নেস্ত করা।

এ বিষয়ের উপর অনেকেই লিখছেন ও লিখবেন। অনেকে উপদেশ দিবেন। পুলিশকে দানব ভাববেন। দু একজন পুলিশের অপেশাদার আচরণের প্রেক্ষিতে গোটা পুলিশকে পরিমাপ করে তার ফলাফলও প্রকাশ করবেন। অনুসিদ্ধান্ত টানবেন, পুলিশ পুরোটাই পচে গেছে ইত্যাদি ইত্যাদি।

বিষয়টি নিয়ে যারা লিখেছেন ও লিখবেন, তাদের মধ্যে একটি অংশ আছেন বা থাকবেন আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকগণ। এ জ্ঞানতাপস লেখকদের মধ্যে আবার সংখ্যা গরিষ্ঠ হবেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকগণ। এমনি একটি কলাম লিখেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের জনৈক সহযোগী অধ্যাপক । তিনি পুলিশকে পুরুষতান্ত্রিকতার আবরণেই ব্যাখ্যা করেছেন। তার লেখনির শিরোনাম হল, 'পুরু পুলিশতান্ত্রিকতা'। চমৎকার লেখা বটে! এ অধ্যাপককে মিডিয়া ব্যক্তিত্ব হিসেবেও আমরা চিনি। তাই তিনি বাংলাদেশে পরিচিত একটি মুখ।

উপদেশ খয়রাতের ব্যাপারে শিক্ষকগণ যে অগ্রগণ্য থাকবেন, তা অতি প্রত্যাশিত। শিক্ষা জীবনে ডক্টর অব ফিলোসোফি নিয়ে কর্মজীবনের শীর্ষে উঠেও কোন ছাত্র যখন তার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের এন্ট্রাস পাশ শিক্ষককে সালাম দিতে যান, গুরু কিন্তু তখনও তার ছাত্রটিকে ছোট কালের সেই বালকটিই ধরে নিয়ে অমৃতবচনে উপদেশের বন্যা ছোটান। এ উপদেশ যত অপ্রাসঙ্গিক বা তুচ্ছই হোক, তা কিন্তু গুরুর হৃদয় নিঙড়ানো ভালবাসারই বহিঃপ্রকাশ। তাই গুরুর উপদেশকে গুরুত্ব দিতেই হয়।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকগণের উপদেশও তাই আমরা মেনে নিব। কিন্তু আমরা তো আর সেই পিচ্ছি ছাত্রটি নেই। আমরাও গুরুকেও দুচারখান কথা শুনিয়ে দেবার সামর্থ্য অর্জন করেছি। গুরু গৃহেও যে ইদানীং অন্ধকার নেমে এসেছে এবং সে অন্ধকার গৃহ থেকে বের হয়ে এসে শিষ্যরা গোটা বাংলাদেশকেই অন্ধকারে ডোবানোর মতো কর্ম-অপকর্ম করে যাচ্ছেন, সে দায়ভারের কিছুটা হলেও তো নিতে হবে আমাদের গুরুদের। গুরুর প্রাক্তন শিষ্যরা তো বটেই, তাদের বর্তমান শিষ্যরাও যে খুন, জখম, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি এমনকি খোদ গুরুদেরই সামনে পিছনে লাত্থিঘুসি মেরে আহত করছে, তাদের সম্পর্কে গুরুদের কি কৈফিয়ত আছে? আমি যদি প্রশ্ন করি, 'গুরু কি ছাত্র তুমি বানাইলা। আদব কায়দা কিছু নাই'  —  বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ‍গুরুগণ কি  উত্তর দিবেন?

শুধু শিষ্যদের কথা বলব কেন? গুরুরগণ নিজেও কি আর ইদানীং কম যাচ্ছেন! শুধু  প্রাচ্যের অক্সফোর্ড ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের প্রায়  পাবলিক ও প্রাইভেট  বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-অধ্যাপকগণ আজ দুর্নীতি, স্বজন প্রীতি, অপকর্ম আর অপেশাদার কাজের সাথে জড়িয়ে পড়েছেন। একজন অশিক্ষিত, আনপড় আর অনভিজাত আদমের একম কোন দোষ নেই যে দোষে আমরা গুরুদের দোষী করতে পারিনা। স্বায়ত্বশাসিত কিংবা প্রাইভেট হবার জন্য গুরুদের উপর সরকারি নিয়ন্ত্রণও শিথিল। তাই এখন নিজ ক্যাম্পাসে বিল্ডিং তোলার পাশাপাশি গুরুগণ নিজেদের বাড়িতেও পার্সেনটেন্সের বিল্ডিং তোলেন। পুকুর কাটতে কাটতে গোটা পুকুরটিই চুরি করে হাল আমলে বিদেশেও নিয়ে যাচ্ছেন অনেক গুরু। আমাদের গুরুগণ এখন আর কেবল ছাত্র পড়ান না, অধ্যাপনা করেন না; একাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে  তারা রীতিমত টিউশনি করে বেড়ান। আমাদের গুরুগণ শুধু বিদ্যা বিক্রয় করেন, বিদ্যা বা জ্ঞান তৈরি, মানে, গবেষণার ধারের কাছেও যাননা।

হাল আমলে, গুরুদের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় অভিযোগটি হল নারী নির্যাতন ও যৌন হয়রানি। অনেকে নিজেদের বউকে নির্যাতন করে নারী ও শিশু নির্যাতন মামলার আসামী হয়ে জেলে যেমন চাচ্ছেন জ্ঞান বিক্রির বিনিময়ে অসহায় শিষ্যাদের দেহ কেনার চেষ্টাও করেন।* দেশের অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর কথা বাদই দিলাম, এখন পর্যন্ত শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বিরুদ্ধে নারী নির্যাতন ও যৌন হয়রানির যে অভিযোগগুলো উত্থাপিত হয়েছে এবং যত অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে, বাংলাদেশ পুলিশের দেড় লাখ সদস্যের বিরুদ্ধে ততো বেশি অভিযোগ ওঠেও নি, প্রমাণিতও  হয়নি।

এমতাবস্থায়, গুরুদেব, আপনারা যদি আয়নায় একবার নিজেদের মুখগুলো দেখতেন, তাহলে হয়তো লজ্জা পেতেন। কিন্তু আমি নিশ্চিত যে আপনাদের মধ্য নগণ্য সংখ্যক আদর্শস্থানীয় অধ্যাপক ছাড়া, কেউ কখনও আয়নায় নিজেদের মুখ  দেখেন না। কলিকালের কোন গুরুই আসলে আয়না দেখেন না।

তারপরও, গুরু, পুলিশ আপনার উপদেশ মেনে নিবে। নিজেকে শুদ্ধ করার চেষ্টা করবে। নিজেদের ভুল থেকে শিক্ষা নিবে। বাংলাদেশ পুলিশের বর্তমান প্রশিক্ষণ কার্যক্রমের অন্যতম উপাঙ্গ হল, মানবাধিকার ও জেন্ডার ইসু। বর্তমানের পুলিশ কোন ক্লাস রুমে কয়েক দিনের জন্য প্রশিক্ষণ নিতে বসলেও এ দুটো বিষয়ে তাদের তাত্ত্বিক পাঠ নিতেই হয়। তার বাইরেও নারী ও শিশুদের প্রতি মানবিক আচরণ এবং মানবাধিকারের উপর বিশেষ কোর্সেরও ব্যবস্থা আছে।

তবে ক্লাসের প্রশিক্ষণের সাথে বাস্তবের কর্মের অনেক তফাৎ থাকে। তাই গুরুদের সকল উপদেশ যেমন শিষ্যগণ কর্মে প্রতিফলিত করতে পারেননা, তেমনি  বাংলাদেশ পুলিশও তাদের একাডেমির ওস্তাদ ও ঊর্ধ্বতন কর্তাদের নির্দেশনাগুলোর শতভাগ মাঠে প্রতিফলিত করতে পারেননা। তবে গুরুর শিষ্য আর পুলিশের মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য পার্থক্য রয়েছে। গুরুগণ তো বটেই, এমনকি গুরুদের শিষ্যরাও প্রায় ক্ষেত্রে শাস্তি ও শৃঙ্খলার বাইরে থাকেন। কিন্তু পুলিশ সব সময় শৃঙ্খলিত। তাদের অপকর্মের জন্য বিভাগীয় ও ফৌজদারি ব্যবস্থার সম্মুখিন হতে হয়; গুরু ও তাদের শিষ্যগণ গড়পড়তা আইনের ঊর্ধ্বে থাকেন। তাই সালাম গুরু, সালাম!

সূত্রাবলী: