শিক্ষাসেবা, শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান ও ডিপার্টমেন্ট স্টোরসমূহ

মোঃ আব্দুর রাজ্জাক
Published : 31 May 2015, 06:55 AM
Updated : 31 May 2015, 06:55 AM

৩০ মে ,২০১৫ এএসসি ও সমমান পরীক্ষার ফলাফল বেরিয়েছে। অনেকে আনন্দে আত্মহারা হয়েছেন, অনেকে আবার অশ্রুবর্ষণও করছেন। এরই মাঝে কেউ কেউ কেবল স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছেন। যা হোক তাদের সন্তান একটি সার্টিফিকেট অর্জন করেছে যা ভবিষ্যতে তার শিক্ষাগত যোগ্যতা থেকে শুরু করে পরিচয় পত্র হিসেবেও ব্যবহৃত হবে। আমারও ভাল লাগছে। কারণ আমারও কয়েকজন আত্মীয় এ পরীক্ষার্থীদের মধ্যে ছিল।
কোন স্কুল কোনটার চেয়ে ভাল–  এনিয়ে দারুণ হৈচৈও হচ্ছে। দেশের নামিদামি স্কুলগুলো ক্রমান্বয়ে তাদের শীর্ষ অবস্থান হারাচ্ছে আর উপরে উঠে আসছে নামহীন স্কুলগুলো। ঢাকা শহরের ছেলেদের জন্য গবর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি স্কুল, মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল, ভিকারুন নিসা নুন স্কুলসহ আরো নামিদামি স্কুলগুলো ভাল ফলাফলের জন্য প্রায়সই কৃতীত্ব দাবি করে। তাদের দাবি হল, মানসম্মত শিক্ষা দেয় বলেই তাদের স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীগণ এত ভাল ফলাফল করে।

কিন্তু স্কুল কর্তৃপক্ষের এ দাবির অসারতা প্রমাণ করে এক অভিভাবক  মোটামুটি গোমর ফাঁস করে দিয়েছেন। তার দাবি তিনি অর্থ খরচ করেছেন। তার মেয়েকে নিজে পড়িয়েছেন ও প্রাইভেট শিক্ষকদের কাছে প্রতিমাসে ২০ হাজার টাকারও বেশি খরচ দিয়ে পড়িয়েছেন। এ জন্য তার মেয়ে জিপিএ-৫ বা গোল্ডেন এ প্লাস পেয়েছে। তিনি যদি বাচ্চাকে নিজে না পড়াতেন, কিংবা প্রাইভেট কোচিং এ না দিতেন তাহলে তার মেয়ে এমন ফলাফল করতে পারত না। তাই তার মেয়ের  ভাল ফলাফলের পিছনে যদি কৃতীত্ব থেকে থাকে, সেটা তার পরিবারের, কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নয়। তিনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মেয়েকে পাঠিয়েছেন বাধ্য হয়ে। কারণ প্রতিষ্ঠানে না পড়ালে তো আর এসএসসি পরীক্ষা দিতে পারত না।

দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার বর্তমান প্রেক্ষাপটে এ অভিভাবক সকল অভিভাবকের মনের কথাই বলেছেন। আর সবচেয়ে সত্য হল তিনি কেবল সত্যটিই বলেছেন। দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ছাত্র-ছাত্রীদের পাঠদান করার মতো মানসিকতা আমাদের শিক্ষক সমাজের নেই। যে প্রতিষ্ঠান যত বেশি নামিদামি সেই প্রতিষ্ঠানের ছাত্র-ছাত্রীগণ ততো বেশি অর্থ খরচ করে প্রাইভেট টিউটরদের কাছে পড়েন। সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত ছেলেমেয়েরা যে স্কুলে ক্লাস করে, সেটা নিতান্তই সময় নষ্ট করা। স্কুলের ক্লাসরুমে এখন কোন ছাত্র-ছাত্রী তার পড়াটুকু তৈরি করা তো দূরের কথা বিষগুলো সামান্যটুকু বোঝে বলেও আমার মনে হয়না। শিক্ষকগণ বোঝাতে চাননা আবর বোঝাতে সমর্থও নন।

অনেক স্কুলের ক্লাসরুমে বাচ্চাদের না পড়িয়ে বাসায় একগাদা কাজ দেয়া হয়। এ কাজগুলো তারা বোঝে না। তাই বোঝানোর জন্য দরকার পড়ে গৃহশিক্ষকের। যাদের অর্থ আছে, যারা তা খরচ করতে চান, তারা তাই স্কুলকে গৌণ ধরে প্রাইভেট টিউশনি কিংবা কোচিং সেন্টারকে মূখ্য হিসেবে বিবেচনা করেই বাচ্চাদের শিক্ষালাভে ব্রতী হন।
বিষয়টি অত্যন্ত কষ্টের যে আমাদের সরকার জাতীয় বাজেটে সবচেয়ে বেশি বরাদ্দ দেয় শিক্ষাখাতে। কিন্তু বাস্তবতা হল, বাজেটের সেই বরাদ্দ কোনভাবেই আমাদের কাজে আসেনা। এদেশে শিক্ষাকে রীতিমত উচ্চমূল্যে ক্রয় করতে হয়। একটি মেয়েকে এসএসসি পাশ করাতে প্রতিমাসে যদি স্কুলের বেতনের বাইরেও ২০ হাজার টাকারও বেশি ব্যয় করতে হয়, তাহলে আমি মনে করি, এ দেশে সবচেয়ে দামি (কস্টলি) সেবা হল শিক্ষাসেবা। আর সবচেয়ে বড় কথা হল, এ সেবার পুরোটাই শুধু প্রাইভেট বা বেসরকারি নয়, এটা রীতিমত ব্যক্তিগত। আজকাল শিক্ষাগ্রহণ প্রতিষ্ঠানে হয়না, কোচিং সেন্টার কিংবা গৃহশিক্ষকের কাছেই এসেবা গ্রহণ করতে হয়।
অনেকে বলেন, শিক্ষা এখন পণ্যতুল্য। অনেকের মত আমিও সেটা বিশ্বাস করি। কিন্তু এর সাথে এটাও বিশ্বাস করি,  পণ্য ক্রয়-বিক্রয়ের জন্য নির্দিষ্ট দোকান বা হাটবাজার থাকে। কিন্তু আমরা এখন এমন সব স্থান থেকে শিক্ষা সেবা গ্রহণ করছি যাকে দোকানও বলা যায়না। দেশের নামি-দামি স্কুল কলেজগুলোকে তাই বড় বড় ডিপার্টমেন্ট স্টোরের মর্যাদাও দেয়া যায়না। ডিপার্টমেন্টস্টোর থেকে পণ্য কেনা যায়, পণ্যের মানের গুণাগুণ যাচাই করা যায়। ডিপার্টমেন্ট স্টোরের পরিচালক ও সেলসম্যানগণ ক্রেতাদের সর্বোচ্চ সেবা দেয়ার চেষ্টা করেন, ক্রেতাদের সম্মান করে বিদায়কালে পুনর্বার আসার আহব্বান জানান।
কিন্তু আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো আমাদের শিক্ষা পণ্য তো দিতেই পারেননা, আবার ক্রেতারূপী অভিভাবকদের সম্মানও দেননা।  একটি নামি স্কুলে বাচ্চাদের হোম ওয়ার্ক ঠিক মতো না হলে কিংবা বাচ্চা ভাল রেজাল্ট করতে না পারলে নাকি অভিভাবকদের স্কুলে ডেকে নিয়ে শিক্ষকরা আচ্ছাতারে বকুনি দেয়। সরকারের সুনীতির ফলে তারা বাচ্চাদের পিটুনি দিতে পারেননা। তাই অভিভাবকদের বকুনি দিয়ে সুদে-আসলে তা উসুল করেন। কত বড় দায় আমাদের! বাচ্চার জন্য প্রতিমাসে বেতন দিয়ে স্কুলে পাঠাই। আমার প্রত্যাশা শিক্ষকরা তাকে শিক্ষা দিবেন। কিন্তু শিক্ষকগণ বা স্কুল কর্তৃপক্ষ সেটা  আবার আমার উপরই চাপিয়ে দেন। কতবড় বিপদে পড়লে কোন অভিভাবক শিক্ষারূপ ভিক্ষা জলাঞ্জলি দিয়ে স্কুল কর্তৃপক্ষের কাছে কুত্তা সমলানোর নিবেদন করে, এবার বুঝুন! এমতাবস্থায়, এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে উপযোগিতা কতটুকু তা পুনর্বিবেচনা করা দরকার। (৩০ মে, ২০১৫)