‘ওসি হেলাল’, আব্দুল কাদের এবং একটি সফল প্রসিকিউশন

মোঃ আব্দুর রাজ্জাক
Published : 14 June 2015, 06:57 AM
Updated : 14 June 2015, 06:57 AM

গত ১৭ মে, ২০১৫ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণ রসায়ন ও অনুজীব বিভাগের প্রাক্তন ছাত্র আব্দুল কাদেরকে নির্যাতনের অভিযোগে দায়েরকৃত মামলার বিচারের রায় হয়েছে। রায়ে কাদেরকে নির্যাতনকারী পুলিশ কর্মকর্তা পুলিশ ইন্সপেক্টর, প্রচার মাধ্যমে যিনি 'ওসি হেলাল' নামে পরিচিত, তার তিন বছরের কারাদণ্ড , ১০ হাজার টাকা জরিমানা ও অনাদায়ে আরো তিন মাসের কারাদণ্ডের সাজা দেয়া হয়েছে।  কোন ব্যক্তিকে স্বীকারোক্তি আদায়ের জন্য গুরুতর আহত করার জন্য দণ্ডবিধির ৩৩১ ধারায় অপরাধীর  সর্বোচ্চ শাস্তি হল সশ্রম বা বিনাশ্রম ১০ বছরের কারাদণ্ডসহ জরিমানা। তবে জরিমানার সর্বোচ্চ পরিমাণ নির্দিষ্ট নেই। তাই ওসি হেলালের জন্য এ শাস্তি নিম্নতমই বৈকি।

ঘটনায় প্রকাশ, গত ১৫ জুলাই, ২০১১ তারিখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণ রাসায়ন বিভাগের স্নাতকোত্তর শ্রেণির ছাত্র আব্দুল কাদের ইস্কাটন রোডে তার বোনের বাসা থেকে পায়ে হেঁটে তার আবাসস্থল ফজলুল হক হলে ফিরছিলেন। পথে সেগুন বাগিচায় তিনি খিলগাঁও থানার টহল পুলিশের সামনে পড়েন। তাকে গ্রেফতার করে থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। পর দিন সকালে থানার অফিসার-ইন-চার্জ 'ওসি হেলাল' কাদেরকে তার অফিস কক্ষে নিয়ে নির্দয়ভাবে মারপিট করেন। তিনি কাদেরকে চাপাতি দিয়ে পায়ে কোপও দেন। অতঃপর কাদেরকে বিরুদ্ধে ডাকাতির প্রস্তুতি ও অস্ত্র আইনের দুটি মামলা দেওয়া হয়। এ বাইরেও তাকে মোহাম্মদপুর থানার একটি গাড়ি চুরির মামলায় গ্রেফতারও দেখান হয়।

পত্র পত্রিকায় কাদেরে নির্যাতনের খবরটি ফলাও করে প্রকাশিত হলে  বিপাকে পড়ে ওসি হেলালের নেতৃত্বে থাকা থানা পুলিশ। অন্যদিকে ভাগ্য ভাল আব্দুল কাদেরের! তার পক্ষে প্রচার মাধ্যমের সাথে সাথে গোটা সমাজ যোগ দেয়; যোগ দেয় জাতীয় মানবাধিকার কমিশন ও সর্বশেষ মহামান্য সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ। আব্দুল কাদেরকে নির্যাতন ঘটনা অনুসন্ধান করে প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য আদালতের নির্দেশে আইন মন্ত্রণালয় এক সদস্যের একটি কমিটিও গঠন করে। একই সাথে অনুসন্ধান কমিটি তৈরি করে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ কর্তৃপক্ষও। উভয় কমিটিই তাদের প্রতিবেদনে আব্দুল কাদেরের নির্দোষত্বের প্রমাণ হাজির করে। আদালত এসব প্রতিবেদনের ভিত্তিতে আব্দুল কাদেরের প্রথমে জামিন ও পরে মামলার দায় থেকে অব্যহতি দেয়।

অন্যদিকে, আব্দুল কাদেরকে বাদী হয়ে পুলিশের বিরুদ্ধে মামলা করার পরামর্শ দেয়া হলে সে অনুযায়ী দুটো মামলা রুজু হয়। প্রথম মামলায় আব্দুল কাদেরকে গ্রেফতারকারী এসআই আলম বাদশার সাজা হয়েছিল। এরপর নির্যাতনকারী ওসির সাজা হলো। আব্দুল কাদেরের সর্বশেষ মামলার বিচারের ফলাফল বিশ্লেষণে বেশ কিছু ইতিবাচক দিক রয়েছেঃ

প্রথমত, এ সাজার ফলে প্রমাণিত হয়েছে পুলিশের উপর আরোপিত রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের অপব্যবহারের সার্বজনীন প্রবণতা বাংলাদেশেও প্রচলিত রয়েছে। এ বিষয়ে বিভিন্ন গবেষণা, জরিপ ও পত্র পত্রিকায় প্রতিবেদনসমূহ নিতান্তই অমূলক নহে। কিছু পুলিশ সদস্য সুযোগ পেলেই ক্ষমতার অপব্যবহার করবেই।

দ্বিতীয়ত, পুলিশের ক্ষমতার অপব্যবহার ও দায়িত্ব পালনে বাড়াবাড়ির বিরুদ্ধে আইনি প্রতিকারের সুনির্দিষ্ট ব্যবস্থা রয়েছে যা বিভাগীয় ও ফৌজদারি উভয়বিধ উপায়ে প্রয়োগ করা যায়। আমাদের দেশের সাধারণ মানুষ অনেক সময় ধরে নেন, পুলিশের অপকর্মের বিরুদ্ধে শুধু বলা বা প্রতিবাদ করা যায়, কিন্তু পুলিশের কিছুই হয় না। আব্দুল কাদেরের এ ঘটনাটি প্রমাণ করে, আইন সবার বিরুদ্ধেই প্রয়োগ করা যায়। ইতিপূর্বে এসব পুলিশ কর্মকর্তা বিভাগীয় অনুসন্ধানের মুখে পড়ে। তারা বরখাস্ত হন। এখন ফৌজদারি আদালত কর্তৃক দোষী সাব্যস্ত হওয়ায়, আপিলে ভিন্ন কিছু আদেশ না হলে তারা আর চাকুরীতে ফিরতে পারবেন না।

তৃতীয়ত, এ রায়ের মাধ্যমে প্রচলিত আইনের পুলিশের জবাবদিহিতার বিষয়টি আরও একবার নিশ্চিত হল। ১৮৬০ সালে তৈরি করা দণ্ডবিধিসহ আরো কিছু আইনে কর্তব্য পালনের আইন বহির্ভূত কাজের জন্য পুলিশকে বিচারের সম্মুখীন করা যায়। পৃথিবীর অনান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও এমন ব্যবস্থা প্রচলিত আছে। আব্দুল কাদেরের মামলার রায়ে অন্যান্য  ‍ভুক্তভোগী মানুষ আরো বেশি উৎসাহিত হয়ে পুলিশ অফিসারদের অপকর্মের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে আদালতের শরণাপন্ন হবেন। এতে পুলিশ অফিসারগণ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অপব্যবহারে নিরুৎসাহিত হবেন।

চতুর্থত, পুলিশের বিরুদ্ধে আব্দুল কাদেরর মামলার আসামী যেমন পুলিশ অফিসার, তেমনি এ মামলার তদন্ত, তদন্ত তদারকী এবং সাক্ষীদের বড় অংশও ছিল পুলিশ সদস্য। আদালতে উত্থাপিত ১৩ জন সাক্ষীর মধ্যে একমাত্র প্রত্যক্ষ সাক্ষী ছিলেন পুলিশ কনস্টেবল আব্দুল করিম। মামলাটির সাজা হওয়ায় প্রমাণিত হয়েছে যে সঠিক পরিবেশ ও নির্দেশনা পেলে পুলিশ অফিসারদের বিরুদ্ধে কৃত মামলার তদন্তকর্ম সঠিকভাবে সম্পন্ন হতে পারে। একজন সাব-ইন্সপেক্টর হয়েও একজন ইন্সপেক্টর তো বটেই এমন কি আরো বড় অফিসারদের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলার বস্তুনিষ্ঠ তদন্তে তেমন কোন সমস্যা নেই। পুলিশ কনস্টেবল আব্দুল করিম পুলিশ হয়েও পুলিশের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতে কুণ্ঠাবোধ করেননি।

পঞ্চমত, মামলাটির বিচারিক পর্যায়ে পুলিশের প্রসংশনীয় ভূমিকা লক্ষ করা যায়। মামলার সাক্ষী উপস্থাপনে পুলিশ যেমন আন্তরিক ছিল, তেমনি ব্যক্তি সাক্ষী হিসেবে পুলিশ সদস্যগণ সততা ও আন্তরিকতার পরিচয় দিয়েছেন। সাক্ষী হিসেবে উপস্থাপন করা একজন পুলিশ সাব-ইন্সপেক্টর ও একজন পুলিশ কনস্টেবল আদালতের কাছে সকল ঘটনা সততার সাথে উপস্থাপন করেছেন। বলাবাহুল্য, কাদেরকে নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছিল থানার ভিতরে। এখানে বাইরের মানুষের প্রবেশ সীমিত। তাই এখানে কোন বে-আইনি কর্মকাণ্ড সংঘটিত হলে তার উত্তম সাক্ষী হবেন পুলিশ সদস্যরাই। কিন্তু এসব পুলিশ সদস্য যদি ঘটনাকে গোপন করেন, প্রশ্রয় দেন এবং আদালতে সত্য গোপন করেন তাহলে আদালতে ঘটনা প্রমাণ করা একান্তই কঠিন।

ষষ্ঠত, আব্দুল কাদেরের ঘটনায় পুলিশ নেতৃত্বের সঠিক সিদ্ধান্তগ্রহণ ও ক্ষমতার অপব্যবহারকারী ব্যক্তি পুলিশ অফিসারের অপকর্মকে প্রশ্রয় না দেয়ার নীতিটি সুপ্রতিষ্ঠিত হল। পুলিশ নেতৃত্ব বারবার বলে আসছেন, পুলিশ অফিসারগণ কেবল আইন ও বিধির মধ্য দিয়েই তাদের উপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করবেন। কেউ যদি আইন ভঙ্গ করে আইন প্রয়োগ করে কিংবা আইন প্রয়োগ করতে গিয়ে নিজের ব্যক্তিগত স্বার্থ সিদ্ধির চেষ্টা করে, তবে সেই পুলিশ অফিসারকে তার সকল দায়দায়িত্ব ব্যক্তিগতভাবেই বহন করতে হবে। অসদাচারী পুলিশ কর্মকর্তাদের পাশে পুলিশ সংগঠন কখনই দাঁড়াবেনা; বরং তাদের যথাযথ শাস্তির ব্যবস্থাই করা হবে।

পুলিশের বিরুদ্ধে মামলা করার রেওয়াজ বাংলাদেশে অতি সীমিত। বাংলাদেশিদের অন্যান্যদের বিরুদ্ধে মামলা করে হয়রানি বা নির্যাতনের অপবাদ থাকলেও পুলিশের বিরুদ্ধে মামলা করার নজির তেমন নেই। এর বহুবিধ কারণের মধ্যে মামলা প্রমাণের জটিলতাও অন্যতম। কেবল পুলিশই নয়, যে কোন পেশার ক্ষেত্রেই এক সহকর্মী অন্য সহকর্মীদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতে চায় না। বিশেষ কিছু কারণে এ ধরণের ঘটনা পুলিশেই বেশি ঘটে। কিন্তু আব্দুল কাদেরের মামলার ক্ষেত্রে পুলিশ সদস্যগণ তার উর্ধ্বতন সহকর্মীকে বাঁচাবার কোন চেষ্টা করেনি। তারা মানবিক কারণে নাগরিক দায়িত্ববোধ থেকে সত্য ঘটনা আদালতের সামনে পেশ করেছেন বলেই আব্দুল কাদের ন্যায় বিচার পেয়েছেন এবং বিচারে আসামী পুলিশ অফিসারদের শাস্তি হয়েছে। পত্রিকার খবরে প্রকাশ 'ওসি হেলাল' আব্দুল কাদেরের সাথে সমঝোতা করতে চেষ্টা করেছিলেন। তাই এটা অবশ্যই অনুমান করা যায় যে তিনি হয়তো তার পুলিশ সহকর্মী সাক্ষীদেরও প্রভাবিত করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সেটা পারেননি। তাই আব্দুল কাদেরের মামলায় সংশ্লিষ্ট সকল শ্রেণির পুলিশ সদস্যদের একটা প্রশংসনীয় ভূমিকা ছিল।

পরিশেষে বলা যায়, বাংলাদেশ পুলিশ দেশের অনান্য প্রতিষ্ঠানগুলোর চেয়ে আলাদা হয়েও অন্যদের মতোই সমাজের রীতি-নীতি, চাওয়া-পাওয়া ও প্রত্যাশা-বাস্তবতার অধীন। অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের মতোই পুলিশও ব্যক্তির সমন্বয়ে দায়িত্ব পালন করে। তারা সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। তাই চলমান সমাজের সকল দোষগুণে তারা গঠিত। ক্ষমতা থাকলে তার অপব্যবহারের প্রশ্ন থাকবেই। পুলিশ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা প্রয়োগ করে। কিন্তু ক্ষমতা যেমন মানুষকে কলুশিত করে তেমনি চরম ক্ষমতা পুলিশকেও চরমভাবে কলুশিত করতে পারে। পৃথিবীর সকল সমাজেই পুলিশের ক্ষমতার অপব্যবহার রয়েছে। এখন এ অপব্যবহারের বিরুদ্ধে বিভাগীয়, প্রশাসনিক, আইনি তথা ফৌজদারি ব্যবস্থার.উৎকর্ষের বহিঃপ্রকাশই সেই দেশের পুলিশের উৎকর্ষ নির্ধারণ করে। আইন প্রয়োগকারীদের বেআইনী কার্কলাপের বিরুদ্ধেও যে আইন আছে আর সেটা প্রয়োগ বা কার্যকর করা যায়, আলোচিত 'ওসি হেলালের' বিরুদ্ধে আব্দুল কাদেরের মামলার সফল পরিণতি তারই উত্তম উদাহরণ। (১৮ মে, ২০১৫)