আন্ডারস্ট্যান্ডিং অর্গানাইজড ক্রাইম: একটি প্রয়োজনীয় বই

মোঃ আব্দুর রাজ্জাক
Published : 8 July 2015, 02:46 AM
Updated : 8 July 2015, 02:46 AM

আন্ডারস্ট্যান্ডিং অর্গানাইজড ক্রাইম। দ্বিতীয়বার পড়ছি বইটি। বইটি সংগ্রহ করেছি মাননীয় আইজিপির স্টাফ অফিসারের কাছে থাকা লাইব্রেরি থেকে। আইজিপিকে কোন বই উপহার দেয়া হলে সেগুলো সাধারণত তার স্টাফ অফিসারের রুমে সংরক্ষণ করা হয়। এ বইটিও আইজিপিকে উপহার দেয়া। প্রাক্তন আইজিপি জনাব নূর মোহাম্মদ বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশের দ্বিতীয় প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীতে পরিদর্শনে বরিশাল গেলে তৎকালীন পুলিশ কমিশনার এম আকবর আলী বিপিএম, পিপিএম বিএমপির পক্ষ থেকে তাকে বেশ কিছু বই উপহার দিয়েছিলেন যেগুলোর মধ্যে এ বইটিও অন্যতম।

উৎসর্গ পত্রের লেখাটাও চমৎকার:

ক্রেস্ট, অসংখ্যতায় হারিয়ে যায়,

অপ্রয়োজনীয় হয়, বিবর্ণ হয়।

বই, কখনও হারানোর নয়,

অপ্রয়োজনীয় নয়, বিবর্ণ নয়।

হ্যাঁ, সত্যিই বই কখনও অপ্রয়োজনীয় হয় না। বরং ক্রমান্বয়ে তা অনেক বেশি প্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে। বইটি উপহার দেয়া হয়েছিল ২০০৮ সালে। তখন বাংলাদেশে অর্গানাইজড ক্রাইমের প্রসার ততোটা হয়নি। দীর্ঘ সাত বছর পরে বইটি আগের চেয়ে আরো বেশি প্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছে।

যদিও বিভিন্ন প্রশিক্ষণ, কর্মশালা, বা সেমিনারে অরগানাইজড ক্রাইম নিয়ে দুচার কথা হয়, তবুও এ সম্পর্কে আমাদের তাত্ত্বিক শিক্ষা অতি সামান্য। পুলিশ অফিসারদের মধ্যে যারা পুলিশে আসার পর কিংবা পূর্বে অপরাধ বিজ্ঞান কিংবা অপরাধ সম্পর্কিত কোন উচ্চ শিক্ষায় গমন করেননি তাদের পক্ষে অর্গানাইজড ক্রাইমের উপর সম্পূর্ণ একটি বই পড়ার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। আমাদের পুলিশ প্রতিষ্ঠানের গ্রন্থাগারগুলোর মধ্যে হয়তো পুলিশ স্টাফ কলেজে এ বিষয়ের উপর কিছু বই রয়েছে। তবে অধিকাংশ গ্রন্থাগারেই এ বিষয়ে তেমন কোন টেক্সটবুক নেই।

সিআইডির অর্গানাইজড ক্রাইমে দীর্ঘদিন কাজ করা এক পুলিশ অফিসারকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, তিনি এ বিষয়ে  কোন সম্পূর্ণ বই পড়েছেন কি না। তিনি নেতিবাচক উত্তর দিয়েছিলেন। তবে  বই না পড়লে যে বাস্তব ক্ষেত্রে কাজ করা যায়না তা কিন্তু নয়। পুলিশিং এখনও একটি যাদু বিদ্যার মতো। একাডেমির চেয়ে গুরুগৃহেই পুলিশিং বেশি শিক্ষালাভ করতে হয়। পুলিশের জন্য গুরুগৃহ হল অপারেশনাল পুলিশ স্থাপনাগুলো আর কর্মক্ষেত্র। একাডেমি যা শেখায়, যেভাবে শেখায়, বাস্তব কর্মক্ষেত্রে তার চেয়ে বেশি কিছু শেখায় ও ভিন্ন কিছু শেখায়। তাই কর্মক্ষেত্রই হল পুলিশং শেখার, এখন পর্যন্ত উত্তম ক্ষেত্র।

বাস্তবে যা ঘটে, তত্ত্বজ্ঞান তাকেই ব্যাখ্যা করে। যেমন, নিউটনের পড়ন্ত বস্তুর তত্ত্ব আবিষ্কারের পূর্বে পিশার হেলান টাওয়ার থেকে যে কোন বস্তু নিচে পড়ত না, তা নয়। কিন্তু নিউটন এ পড়ন্ত বস্তুর ধর্মগুলো আবিষ্কার করে তা বিধিবদ্ধ করেছেন। তার সূত্র বা আইন ব্যবহার করে পরবর্তীতে আবিষ্কৃত হয়েছে দোলক ঘড়ি এবং আরো অনেক প্রকারের প্রযুক্তিনির্ভর নিত্য প্রয়োজনীয় বস্তু।

এমনিভাবে তাত্ত্বিকজ্ঞান পুলিশিং এর নিয়ত পরিবর্তনকে দ্রুত  আত্মীকরণ করতে পারে। মাঠের শিক্ষা ট্রায়েল এন্ড এরোর পদ্ধতিতে গ্রহণ করতে হয়। একবার ভুল হলে পরবর্তীতে সে ভুল সংশোধন করে শুদ্ধ কাজটি করা যায়। কিন্তু তাত্ত্বিকজ্ঞান থাকলে ট্রায়েল এন্ড এরোরের মাত্রা কমানো যায়। যে ট্রায়েল এন্ড এরোর কোন পুলিশ অফিসার মাঠে করবেন, গবেষকগণ তা পূর্বেই করে রেখেছেন।

বাংলাদেশে সংঘবদ্ধ বা অর্গানাইজড অপরাধের শিকার ইতোমধ্যেই হয়েছে। এখানে যুক্তরাষ্ট্রের ইটালিয়ান মাফিয়া, জাপানের ইয়াকুজা,  চায়নার মতো ট্রাইয়াডের মতো কোন কুখ্যাত সংঘবদ্ধ অপরাধ গোষ্ঠী নেই বটে, কিন্তু ইতোমধ্যে মাদক পাচার, অস্ত্র পাচার ও মানব পাচারের মতো যে অপরাধগুলো সংঘটিত হচ্চে সেগুলো কোন না কোন ভাবে অর্গানাইজড ক্রাইমের পর্যায়ভুক্ত। মানব পাচারের ক্ষেত্রে ইতোমধ্যেই  আন্তর্জাতিক পাচারকারী গোষ্ঠীগুলোর সাথে এক শ্রেণির দালাল যোগ দিয়েছে। পুলিশের সিআইডির অর্গানাইজড ক্রাইম শাখা এরই মধ্যে কাতার, ইনান, তুরস্ক প্রভৃতি দেশে গিয়ে বাংলাদেশি নাগরিকদের জিম্মি করে মুক্তিপণ আদায়সহ অন্যান্য বেশি কিছু মামলার তদন্ত শেষ করেছে। এ ক্ষেত্রে তারা কিছু ভিকটিমকে উদ্ধার করেও দেশে এনেছে।

মালয়েশিয়া মানব পাচারের বিষয়টি ইতোমধ্যেই আন্তর্জাতিক চিন্তার বস্তুতে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশ, মায়ানমান, থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ার মানব পাচারকারী সংঘবদ্ধগ্রুপগুলো ইতোমধ্যেই তাদের মধ্যে আন্তঃসম্পর্ক স্থাপন করেছে বলে মনে হয়। বাংলাদেশ থেকে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশিদের ভুলিয়ে ভালিয়ে পাঠান এবং তারপর এসব আলাভোলা মানুষকে জিম্মি করে তাদের পরিবারের কাছ থেকে বিকামের মাধ্যমে অর্থ আদায় করার ভিকটিমদের যে সংখ্যা বেসরকারি সংস্থাগুলো প্রচার করছে সেটা অত্যন্ত ভয়াবহ। সরকারি হিসেবে এ থেকে অনেক কম। তবে সরকারি হিসেবের সাথে বেসরকারি হিসেবের গরমিল থাকলেও এ সংখ্যাটা যে নেহায়েত ছোট নয় তা অনুমান করা যায়।

সম্প্রতি চট্টগ্রাম সামুদ্রিক বন্দর দিয়ে সূর্যমুখী তেলের আড়ালে আমদানী করা  ড্রামে কোকেনের সন্ধান পাওয়া গেছে। পুলিশের গোপন সংবাদের ভিত্তিতে ছাড় করার পূর্বে এসব কথিত তেল পরীক্ষা করা হলে সেগুলোতে কোকেনের সন্ধান পাওয়া যায়। এ নিয়ে একটি মামলা তদন্তাধীন। এ সব তেল দক্ষিণ আমেরিকা থেকে সিংগাপুরের মাধ্যমে চট্টগ্রাম বন্দরে এসে পৌঁচেছিল। তা অতি স্বাভাবিকভাবেই ধরে নেয়া যায়, এ মাদক আমদানীতে আন্তর্জাতিক অর্গানাইজড ক্রিমিন্যাল গ্রুপ জড়িত রয়েছে। কলম্বিয়ার কেলি কার্টেল, মেডেলিন কার্টেল কিংবা মেক্সিকোর মাফিয়া গোষ্ঠী  সারা বিশ্বব্যাপী যে মাদক চোরাচালানের নেটওয়ার্ক বিস্তার করেছিল, সেটা যে এখনও ক্রিয়াশীল তা চট্টগ্রাম বন্দরে এ তরল কোকেন আমদানীর ঘটনা থেকেই বোঝা যায়।

এমতাবস্থায়, বাংলাদেশ পুলিশের অফিসারদের অর্গানাইজড ক্রাইমের উপর তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক উভয় ধরনের জ্ঞান অর্জন করতে হবে। বইটির লেখক স্টিফেন এল. ম্যালোরি আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্রের মিসিসিপি রাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব মিসিসিপি, অক্সফোর্ড এর আইন শাস্ত্রের সহযোগী অধ্যাপক। বইটি মূলত আমেরিকান প্রেক্ষাপটেই লেখা হয়েছে। তাই এখানে স্বাভাবিকভাবেই বেশি স্থান পেয়েছে সংঘবদ্ধ অপরাধের আমেরিকান ধরনগুলো। তবে একই সাথে লেখক বিষয়টিকে আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটেও বিবেচনা করেছেন। কারণ সংঘবদ্ধ অপরাধের একটা স্বাভাবিক আন্তর্জাতিক রূপ রয়েছে।