সমকামিতার ব্লগালোচনা: বড়সিও নয়, টড়সিও নয়

মোঃ আব্দুর রাজ্জাক
Published : 4 July 2015, 03:59 AM
Updated : 4 July 2015, 03:59 AM

গত ২৬ জুন,২০১৫, আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিমকোর্ট এক ঐতিহাসিক রায়ে আমেরিকায় সমকামীদের মধ্যে বিয়েকে বৈধতা  বলে রায় দিয়েছেন।  এ রায় নাকি  রাষ্ট্রপতি বারাক ওবামার নির্বাচনী ওয়াদার অনুরূপ। সুপ্রিম কোর্টের এ রায়ে তাই  ওবামার নির্বাচনী ওয়াদা পূরণ হল। তিনি  এতে রাজনৈতিকভাবে সততার পরিচয় দিলেন। তিনি এ রায়ে যারপর নেই খুশী হলেন।

এ নিয়ে দেশে বিদেশে নানা প্রশ্নের বন্যা বয়ে যাচ্ছে। কেউ কেউ এটাকে মানবাধিকার রক্ষার পক্ষে একটি বড় ধরনের অগ্রগতির কথা বলছেন। কেউ বলছেন, এতে রাজনৈতিক সততার পরিচয় পাওয়া গেলেও মানব জাতির পক্ষে কাজ করা হল না। কারণ নারী-পুরুষের স্বাভাবিক মিলনের ফলে যে সন্তান জন্ম হয়, তাই দিয়ে প্রকৃতি তার মনুষ্য প্রজাতিকে টিকে রাখে। এখন যদি সমকামীদের বিয়ের মাধ্যমে পুরুষে-পুরুষে কিংবা নারীতে-নারীতে বিয়ে বা যৌন মিলনের ফলে কোন সন্তানেরই জন্ম না হয়, তাহলে মনুষ্য জাতি টিকবে কি করে?

বিডিনিউজ২৪.কম ব্লগে সমকামিতা সম্পর্কে বেশ কিছু তথ্যবহুল মানসম্মত নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। এগুলোর মধ্যে অন্যতম হল, 'গে-ম্যারেজ আইন বাস্তবায়ন- মানুষের যৌন স্বাধীনতার জয়'। লেখিকা মারজিয়া প্রভা তার লেখায় সমকামিতাকে সমর্থন করে সমকামিতাকে 'জাস্ট সেক্স ভেরিয়েশন ছাড়া কিছু নয়' বলে মন্তব্য করেছেন। তিনি ৩ জুলাই, ২০১৫ তারিখের ১৫:৩০ পর্যন্ত মোট পক্ষে, বিপক্ষে (নিজের উত্তরসহ) মোট ২১টি মন্তব্য পেয়েছেন। তার লেখার চেয়ে মন্তব্যগুলো অনেক বেশি মনোগ্রাহী। মন্তব্যে অংশ নিয়েছেন বাঘা ঘাঘা ব্লগারগণ। তবে মন্তব্যকারীগণ স্বাভাবিকভাবেই দ্বিধা বিভক্ত। তারা প্রত্যেকেই নিজেদের বিশ্বাসকে অক্ষুণ্ন রেখেই মন্তব্য করছেন।

সমকামিতা নিয়ে দীর্ঘ নিবন্ধ লিখেছেন জনাব আলাউদ্দিন ভূঁইয়া। তিনি ব্লগে নতুন হলেও লেখার জগতে নতুন নন। পেশায় একজন তরুণ কূটনীতিক। চাকুরসূত্রে বর্তমানে বসবাস করছেন ব্রাজিলে। জনাব আলাউদ্দিনের লেখা, 'সে, তুমি, সমকামী, মাঝখানে কেন আমি?' তে সমকামিতার পক্ষে-বিপক্ষের যুক্তিগুলো সাবলিল ভাষায় উদাহরণ ও প্রয়োজনীয় তথ্য উপাত্তসহ তুলে ধরা হয়েছে। লেখাটিকে আর একজন প্রভাবশালী ও সাহসী ব্লগার জাহেদ-উর-রহমানের পরামর্শ অনুসারে ফিচার পোস্ট করা হয়েছে।

স্বীকার করতে বাধা নেই, সমকামিতা নিয়ে আগ্রহ থাকলেও এ বিষয়ে আমি খুব একটা বেশি পড়াশোনা করিনি। ব্লগের লেখাগুলোও প্রথম দিকে কোন প্রকারের পাঠ করেছি; বিশ্লেষণ করিনি। এমনকি পত্রিকার খবরে যখন দেখি জিম্বাবুয়ের প্রেসিডেন্ট রবার্ট মুগাবে বারাক ওবামাকে বিয়ের প্রস্তাব দিবেন বলে মন্তব্য করেছেন, তখনও আমি সমকামিতার প্রতিবেদনগুলোকে পাত্তাই দেইনি। এমনকি রবার্ট মুগাবের প্রস্তাবটির শুধু হেডলাইনই পড়েছি, খবরের ভিতরে ঢুকিনি। হয়তো আলাউদ্দিনের লেখাটিকে ফিচার পোস্ট করা না হলে আমি এ সম্পর্কে তেমন কোন পড়াশোনাই করতাম না।

যাহোক আলাউদ্দিন তার দীর্ঘ লেখনির মাধ্যমে সমকামিতার আদি ইতিহাস থেকে শুরু করে বর্তমান সময় পর্যন্ত যে ফিরিস্তি তুলে ধরেছেন তাতে মনে হল, সমকামিতার একটা প্রাকৃতিক রূপও রয়েছে। তবে ২০০১ সালের পূর্বে কোন সমাজ বা রাষ্ট্রেই সমকামিতা সামাজিক বা রাষ্ট্রীয় অনুমোদন পায়নি। বিংশ শতাব্দীর শেষ প্রান্তে সমকামিতা ক্রমশই আলোচনার বিষয়ে পরিণত হয়। এবং একবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধেই সারা বিশ্বের ১৯৫ দেশের মধ্যে প্রায় ২২টি দেশে তা রাষ্ট্রীয় অনুমোদন পেয়ে যায়। তাই বলা যায়, সমকামিতার হাজার বছরের ইতিহাস মাত্র পঞ্চাশ বছরেই সফল বিপ্লব সম্পন্ন করে ফেলেছে।

পূর্বেই বলেছি, আলাউদ্দিন তার লেখায় কোন পক্ষ অবলম্বন না করে বিষয়টিকে ঐতিহাসিক, সামাজি, ধর্মীয় ও রাজনৈতিকভাবে বিশ্লেষণের প্রয়াস পেয়েছেন। তিনি লেখার শুরুতেই তিনটি প্রশ্নের উত্তর দেয়ার চেষ্টা করেছেন- সমকামিতা একটি রোগ, অর্থাৎ মানসিক বৈকল্য কি না; এটি প্রকৃতির বিরুদ্ধ অনুশীলন কিনা; এবং সবশেষে এ সমকামী বিবাহ বৈধ কি না। তবে তার লেখা থেকে জানা গেল সমকামিতা মানসিক রোগ নয়, এটা প্রকৃতরি বিরুদ্ধ কর্মও নয়। আর সমকামী বিবাহ ক্রমান্বয়ে রাষ্ট্রীয় বৈধতা পাচেছ। তবে রাষ্ট্রীয় বৈধতা পেলেও এটা এখনও পৃথিবীর মোট জনগোষ্ঠীর সামান্য অংশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়েছে।

৩ জুলাই, ২০১৫ তারিখের ১৫:৩০ ঘটিকা পর্যন্ত জনাব আলাউদ্দিনের পোস্টের মন্তব্য সংখ্যা ২৫টি(তার উত্তরসহ)। মন্তব্যকারীগণ আমাদের বিখ্যাত ব্লগারসহ স্বল্প পরিচিতগণও রয়েছেন। কেউ কেউ তাকে 'ধরি মাছ, না ছুঁই পানি' ধরনের লেখক বলে মন্তব্য করেছেন। কারণ আলাউদ্দিন তার লেখায় শতভাগ নিরপেক্ষ থেকে নিজেকে এ বিতর্কের ঊর্ধ্বে রাখার চেষ্টা করেছেন। তবে আলাউদ্দিনের লেখায় পতিতাবৃত্তি সম্পর্কে একটি ভুল তথ্য দেয়া হয়েছে। দেশে পতিতাবৃত্তির অস্তিত্ব থাকলেও এটা কোন ক্রমেই বৈধ নয়। সরকার কোন ভাবেই পতিতাবৃত্তির লাইসেন্স দিতে পারেন না কিংবা পতিতাবৃত্তিকে বৈধ বলতে পারে না। কারণ আমাদের পবিত্র সংবিধানের ১৮(২) অনুচেছদে বলা হয়েছে রাষ্ট্র জুয়া ও পতিতাবৃত্তি প্রতিরোধের জন্য কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।[1]

সমকামিতার একটি 'বিজ্ঞান ভিত্তিক বিশ্লেষণ' দিয়েছেন জনাব রাশেদুল ইসলমা রাজ। পোস্টের সংখ্যা কম থাকলেও তিনি কিন্তু বিডিনিউজ২৪.ব্লগের পুরাতন সদস্য। জিনেটক্স এর ছাত্র হিসেবে তিনি সমকামিতাকে জিনেটিক্স এর আলোকে বিশ্লেষণের চেষ্টা করেছেন। জিনের ক্রোমোজোমে বাড়তি উপাদান থাকার জন্যই মানুষ সমকামী হয়ে ওঠে। তিনি জিনগত বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণ করে গে, লেসবিয়ান ও উভয়কামীদের আলাদা আলাদা করে দেখিয়েছেন। তবে সমকামিতার জিনেটিক্স বিশ্লেষণকে অনেকে মানসিক রোগ বলতে নারাজ। মারজিয়া প্রভা রাশেদুল ইসলামের এ জিনেটিক্স ব্যাখ্যাকে তার মতের সমর্থন বলে লুফে নিয়েছেন। যদি জিনের বৈশিষ্ট্যের জন্যই কেউ সমকামী হয়ে থাকে এবং এটা কোন শারীরিক ও মানসিক বৈকল্য বা কষ্টের কোন কারণ না হয়ে থাকে তবে এটাকে প্রকৃতির একটি বৈচিত্র্য বলাই যুক্তিসংগত বলেই প্রভা মনে করেন। তাছাড়া সমকামিতাকে পূর্বে মানসিক রোগের তালিকায় রাখলেও জাতিসংঘ এটাকে সেই তালিকা থেকে বাদ দিয়েছেন অনেক আগেই। তাই প্রকৃতির বৈচিত্র্যগুলোর মতো সমকামিতাকে মানুষের যৌন জীবনের স্বাভাবিক বৈচিত্র্য বলেই ধরে নেওয়া উচিৎ বলেই মারজিয়া প্রভা মনে করেন।

কিন্তু জনাব রাশেদুল বলছেন, সমকামিতা প্রকৃতিগতভাবে হয়ে থাকলেও এটা প্রকৃতির বিরুদ্ধ ঘটনা। তার মতে যৌনতার উদ্দেশই হল সন্তান জন্মদান। কিন্তু সমকামিতা সন্তান উৎপাদনে অক্ষম প্রক্রিয়া। তাই এটা প্রকৃতির নিয়মের বিপরীত। কিন্তু ব্লগার প্রভা সেটা মানতে রাজি নন। তিনি বলেন, যদি সন্তান জন্মদানই যৌনতার একমাত্র উদ্দেশ্য  হয়, তাহলে তো একজন মানুষ জীবনে ৪০/৫০টি সন্তান জন্ম দেবার কথা। কিন্তু আমরা তো এটাকেও নিয়ন্ত্রণ করছি।

সমকামিতা নিয়ে ক্ষুরধার নিবন্ধ লিখেছেন আমাদের প্রভাবশালী ব্লগার বাংগাল। তিনি যুক্তি প্রদর্শনের পূর্বেই নিবন্ধের শিরোনামে বলেছেন, 'গে-লেসবিয়ানরা রাগ করবেন না'। তার অবস্থান সমকামিতার সম্পূর্ণ বিপরীতে। তিনি যুক্তির মাধ্যমে বুঝিয়ে দিয়েছেন, সমকামিতা একটা মানসিক রোগ।  জনাব রাশেদুল ইসলাম রাজ এর নিবন্ধে জনাব বাংগালের মতের সমর্থন পাওয়া যাবে। সমকামিতাকে যারা মানসিক রোগ বলতে নারাজ তাদের যুক্তি হল, সমকামীরা সমাজের আর দশটা মানুষের মতোই স্বাভাবিক। তবে তাদের অস্বাভাবিকতা কেবল যৌনতায়। তাই এটাকে অস্বাভাবিকতা না বলে বৈচিত্র্য বলতে তারা বেশি স্বাচ্ছন্দ বোধ করেন। কিন্তু জনাব বাংগালের মতে কোন মানসিক বিকারগ্রস্তই আসলে নিজেদের অস্বাভাবিক বলেন না। ২০ বছর ধরে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থেকেও যেমন কোন পাগল নিজেকে পাগল বলে স্বীকার করেন না, তেমনি কোন সমকামীই স্বীকার করবেন না যে তারা যৌন বিকার গ্রস্ত।

অন্যদিকে যারা স্বীকার করেন যে সমকামিতা একটি মানসিক ব্যধি কিংবা জিনগত বৈকল্য কিন্তু তারপরও সমকামিতার আইনগত বা সামাজিক স্বীকৃতি চান, তারা চোর, ধর্ষকদেরও প্রকারান্তরে সামাজিক বা আইনগত স্বীকৃতি চান বলে জনাব বাংগাল মত প্রকাশ করেন। যুক্তির ক্ষুরধারে তাই জনাব বাংগালকে পরাজিত করা সমকামিতার সমর্থকদের পক্ষে প্রায় অসম্ভব।

প্রভাবশালী সিনিয়র ব্লগার জহিরুল চৌধুরী 'বিয়ে ও ভালবাসা' নামক নিবন্ধে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের আদালতের রায়কে সমর্থন করে সমকামিতার তার মতামত ব্যক্ত করেছেন। তিনি দীর্ঘ চৌদ্দ বছর পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করছেন। এ চৌদ্দ বছরে তিনি দেখেছেন, 'যুক্তরাষ্ট্রের খুব কম সংখ্যক মানুষ কাগুজে বিয়ে এবং আনুষ্ঠানিকতায় বিশ্বাস করেন'। সেদেশের অধিকাংশ নাগরিক বিয়ের পরিবর্তে লিভ টুগেদার করতেই বেশি পছন্দ করে। তাদের বিবাহ বহির্ভূত সন্তানগণ শিশু থেকে কিশোর, কিশোর থেকে যুবক/যুবতী হয়। এরপর তারাও সন্তান-সন্ততির জন্ম দেন। কিন্তু কেউই বিয়ে করেন না।

কিন্তু প্রশ্ন হল, যে সমাজে নারী-পুরুষই বিয়ে করার মতো একটা অপ্রয়োজনীয় রীতিকে পরিত্যাগ করেছে, সেখানে এলজিবিটিগণ বিয়ের জন্য এত আইনি লড়াই চালাচ্ছেন কেন? অবশ্য এ প্রশ্নের উত্তরও তিনি দিয়েছেন। তার মতে এলজিবিটি বিয়ের উদ্দেশ্য হচ্ছে রাষ্ট্র কর্তৃক প্রদেয় সুযোগসুবধাদি গ্রহণ করা ও তাদের ভালবাসার রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি আদায় করা।

'বিয়ে এবং ভালবাসা' জনাব জহিরুল চৌধুরী একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের অবতারণা করেছেন। তিনি পাশ্চাত্যের বহু বিবাহ নিষিদ্ধকরণ আইনকে সমর্থন করে বাংলাদেশেও এ জাতীয় আইনের প্রবর্তনের প্রত্যাশা ব্যক্ত করেছেন।

লেখকের আর একটি বিশ্বাস হল, আধুনিকতা প্রথা, রীতি ও ধর্মকে অতিক্রম করে মানবাধিকারকে প্রতিষ্ঠিত করে। তার বিশ্বাসের সপক্ষে তিনি দাস প্রথার কথা উল্লেখ করেছেন। আনুষ্ঠানিকভাবে পৃথিবী থেকে দাস প্রথা বিলুপ্ত হওয়ার পূর্বে এটা ধর্মীয় বিধান দ্বারাও স্বীকৃত ছিল।

তবে বাংলাদেশ থেকে বহু বিবাহ প্রথা বিলুপ্তের প্রত্যাশা করলেও বাংলাদেশে সমকামীদের বিয়ের প্রথা চালু বা আইন পাশ হওয়ার কোন প্রত্যাশা তিনি করেননি। সমকামীদের প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়ার পরামর্শ দিয়েই তিনি তার নিবন্ধের সমাপ্তি টেনেছেন।

পাঠক ও সহব্লগারগণ জানতে চাবেন, আমি সমকামিতার ব্লগগুলো তো বিশ্লেষণ করছি। কিন্তু সমকামিতা নিয়ে আমার অবস্থান কি? প্রশ্নটাই অবশ্যই যৌক্তিক। কিন্তু এক্ষেত্রে আমার সরাসরি কোন উত্তর নেই। আমি বাংলা ভূখণ্ডের যাবতীয় আইন মান্যকারী একজন সুবোধ নাগরিক। তাই আইনের বরখেলাপ করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আমাদের দণ্ডবিধির ৩৭৭ ধারা অনুসারে প্রকৃতির বিপরীতে যৌন সম্ভোগ দণ্ডনীয় অপরাধ। তবে এ ধারায় প্রকৃতির বিপরীতে যৌন সম্ভগের পুরোপুরি কোন ব্যাখ্যা দেয়া হয়নি। এতদিন পর্যন্ত আইন প্রগোকারীগণ প্রকৃতির নিয়মের বিপরীত বলতে পায়ূপথে যৌনাচার (সোডোমি) কিংবা পশ্বাচার বলেই ধরে নিয়েছেন। আমাদের ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থায় সোডোমি কিংবা ছেলে শিশুদের যৌন হয়রানির জন্য মামলার উদাহরণ থাকলেও নারী কর্তৃক নারী ধর্ষণ কিংবা লেসবিয়ন কাজের জন্য কোন মামলা রুজু হয়েছে বলে আমার জানা নেই। তাই সমকামিতাকে আমাদের দণ্ডবিধিতে সরাসরি অপরাধ বলে উল্লেখ করা হয়নি। সমকামিতা যদি প্রকৃতির বিরুদ্ধ নিয়মে যৌনাচার হয়, তবে সেটা দণ্ডবিধি বলে নিষিদ্ধ। কিন্তু এটা যদি স্বাভাবিক যৌনকর্ম হয়, তাহলে দণ্ডবিধির ৩৭৭ ধারার আওতায় তো এটা পড়ে না।

আমার মত সরাসরি প্রকাশ না করে পাঠকদের আমি একটি বৃদ্ধদের কাছ থেকে বাল্যকালে শোনা গল্প বলব। আমি মনে করি, এ গল্পটি আমার উভয় সংকট অবস্থাটি ব্যাখ্যা করতে যথেষ্ঠ হবে।

হাড় কাঁপানো শীতের রাতে এক বিলের মধ্যে দুই ভূত মাছ খেতে খেতে একটি বড়সিতে গাঁথা মাছ খুঁজে পেল। মাছটি খাওয়ার পর তারা বড়সিটি নিয়ে গবেষণা শুরু করল। তারা বুঝতে পারলা না এটা আসলে বড়সি, না টড়সি। এক ভূত দাবি করে এটা বড়সি, অন্য ভূত বলে, না, এটা টড়সি। এ নিয়ে দুভূতের মধ্যে তুমুল লড়াই শুরু হল। লড়াইয়ের এক পর্যায়ে বড় ভূত প্রস্তাব দিল, আমরা মারামারির পরিবর্তে চল একজন মানুষকে এনে জিজ্ঞাসা করি, এটা কি।

যে কথা সেই কাজ। দুভূত চলে গেল লোকালয়ে মানুষের খোঁজে। কিন্তু সবাই ঘরের দরোজা-জানালা লাগিয়ে শীতের রাতে গভীর ঘুমে মগ্ন। কোন বাসায় ভূতদ্বয় ঢুকতে পারল না। অনেক খোঁজা খুঁজির পর গ্রামের এক প্রান্তে গিয়ে দেখে এক হোমড়া চোমড়া লোক ঘরের বাইরে চৌকি পেতে শুয়ে শুয়ে তার মূল্যবান গরুগুলো পাহারা দিচ্ছে। দুইভূত এ লোককে চৌকিসহ তুলে নিয়ে বিলের প্রায় মাঝখানে একটি দ্বীপের উপর রাখল। লোকটি ছিল আসলে গ্রামের মোড়ল। তাই তার বুদ্ধিসুদ্ধিও ছিল বেশি। তাকে ঘুম থেকে তুলে এক ভূত বড়সিটি দেখিয়ে বলল,  মাতব্বর, আমি তো মনে করি এটা বড়সি। কিন্তু এই ছোট ভূত বলে এটা নাকি টড়সি। এখন তুমি বল, এটা কি।

মাতাব্বর বড় বুদ্ধিমান। তিনি দেখলেন, এটা দুভুতের মধ্যে রীতিমত বাজি। তারা দুজনেই বাজিতে জিততে চায়। আমি জানি, এটা বড়সি। কিন্তু সঠিক কথা বললে, বড় ভূত বাজিতে জিতে খুশী হবে; কিন্তু ছোট ভূত হেরে গিয়ে  বিগড়ে যেতে পারে। আর ভূতের বিকার আমার জন্য মৃত্যুর কারণ হতে পারে। বাজিতে হেরে যাওয়া ভূত আমার ঘাট মটকে না খেলেও বিলের মধ্যে চৌকিখানা ডুবিয়ে দিতে পারেন। তাই দুজন কেই খুশী করতে হবে।

তাই গলা ঝেলে বিজ্ঞের আভিজাত্য মুখে এনে মাতাব্বর বললেন, আমি যতটুকু পরীক্ষা করে দেখলাম, তোমরা দুজনেই সঠিক। এটা আসলে বড়সিও নয়, টড়সিও নয়। এটা জাড়ে (শীতে) কোঁকড়া হয়ে আছে। মাতব্বরের রায় শুনে দুভূতই বেজায় খুশী। তারা মাতব্বরকে সসম্মানে তার বাড়িতে চৌকিসহ রেখে এল। মাতব্বর সুরা মাসুরা পড়ে বুকে ফু দিলেন, আল্লাহ শেষ পর্যন্ত আমাকে বাঁচিয়ে দিলেন! (৩ জুলাই, ২০১৫)

টীকা ও সূত্রাবলী:

[1] The State shall adopt effective measures to prevent prostitution and gambling.