রাজন হত্যার ভিডিও চিত্র কী মানুষের চিরায়ত মরণেচ্ছার বহিঃপ্রকাশ?

মোঃ আব্দুর রাজ্জাক
Published : 16 July 2015, 02:22 PM
Updated : 16 July 2015, 02:22 PM

সিলেট মহানগরীর জালালাবাদ থানার অন্তর্গত মুইয়ারচর গ্রামে ০৮ জুলাই, ২০১৫ তারিখে ১২/১৩ বছর বয়সী কিশোর  সামিউল ইসলাম রাজনকে একটি রিকসা ভ্যান চুরির অভিযোগে স্থানীয় কয়েকজন ব্যক্তি পিটিয়ে হত্যা করে। প্রথমে খুঁটির সাথে বেঁধে এবং পরে মাটিতে ফেলে দিয়ে লোহার রড দিয়ে শরীরের বিভিন্ন স্থানে পিটিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করা হয় এ সদ্য কৈশোরে উত্তীর্ণ শিশুটিকে। রাজনের লাশটি একটি মাইক্রোবাসে করে অন্যত্র সরিয়ে নেয়া কিংবা গুম করার চেষ্টাকালে স্থানীয় লোকজন প্রধান অভিযুক্ত মুহিতকে ধরে পুলিশের হাতে তুলে দেয়।

কিন্তু ঘটনাটির জঘন্যতা প্রকাশিত হয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেইসবুকে একটি ভিডিও আপলোড করার পর থেকে। এ নৃসংশ ঘটনার প্রায় পুরোটাই মোবাইল ফোনের ভিডিওতো ধারণ করে নির্যাতনকারীদের সহযোগী একজন। তার স্বীকারোক্তি মতে প্রধান আসামীর অনুরোধেই একজন এ ঘটনাটি ভিডিও ধারণ করে। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হচ্ছে, এ ভিডিওটি মূলত ফেইসবুকে আপলোড করে সর্বত্র ছড়িয়ে দেয়ার উদ্দেশ্য ছিল অপরাধীদের। ভিডিও ধারণকারী প্রধান আসামী মুহহিতকে মামা বলে ডাকেন। মামার ভাষ্য ছিল, রাজন পাকা চোর। তাই তাকে নির্যাতনের ভিডিও চিত্র ফেইসবুকে ছড়িয়ে দেয়া দরকার।

বিষয়টিকে নানাজন নানা দিক দিয়ে বিবেচনা করছেন। সমাজ বিজ্ঞানী, মনোবিজ্ঞানী, অপরাধ বিজ্ঞানী, রাজনীতিবিদ, পুলিশ, প্রশাসন—সবাই তাদের নিজ নিজ দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ঘটনাটি বিশ্লেষণ করছেন। এসব বিশ্লেষণের মধ্যে কিছু কিছু বিশ্লেষণে সার বস্তু থাকলেও অনেক বিশ্লেষণকে আমার কাছে হাস্যকর বলে মনে হয়েছে। বিশেষ করে রাজনৈতিক বিশ্লেষণগুলো যারপর নেই স্থূল।

শিশু রাজন হত্যাকাণ্ডটি আমার মতে একটি অতি সরল সামাজিক আচরণ। তবে এটাকে তাত্ত্বিকতার সূক্ষ্ণতায় নিয়ে যাওয়া যায়। কেননা, সাধারণ সামাজিক আচরণগুলোর পিছনে অবশ্যই সূক্ষ্ণ মনো-সামাজিক বিশ্লেষণ রয়েছে।

অতি সরলভাবে ব্যাখ্যা করলে দেখা যাবে, শিশুদের প্রতি আমাদের সমাজে এমন নিষ্ঠুর আচরণ নিত্য-নৈমিত্তিক ঘটনা। গ্রাম-বাংলায় প্রতিনিয়তই শিশুদের প্রতি পিতামাতা থেকে শুরু করে গৃহকর্তারা এমনকি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকগণ পর্যন্ত এ ধরনের আচরণ করে আসছেন। এগুলোর ছিঁটেফোটা মাঝে মধ্যেই পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়। পিতা কর্তৃক সন্তানকে হত্যা, শিক্ষক কর্তৃক ছাত্রকে পিটিয়ে বেহুস করা গৃহকর্তা কর্তৃক নাবালিকা কাজের মেয়েকে গরম পানি কিংবা খুন্তি দিয়ে শরীরে ছেঁকা দেয়ার অনেক ঘটনাই তো প্রতিনিয়তই পত্রিকায় প্রকাশিত হচেছ।

তবে শিশু নির্যাতনের প্রাত্যহিক ঘটনাগুলোর সাথে রাজন নির্যাতনের ঘটনাটি দুটি কারণে পৃথক। প্রথমত, নির্যাতনের ফলে রাজন মৃত্যুবরণ করেছে, দ্বিতীয়ত, রাজন নির্যাতনের ঘটনাটি ভিডিও চিত্র ধারণ করে ফেইসবুকে শেয়ার করা হয়েছে যা দেশে বিদেশে ব্যাপক প্রচার পেয়েছে।

প্রথম ক্ষেত্রে যদি রাজন নিহত না হত, তাহলে এ নিয়ে যে খুব বেশি হৈচৈ হত, তা আমার বিশ্বাস হয় না। কারণ, এধরনের ঘটনা গ্রামেগেঞ্জে অহরহই ঘটছে। এটা শিশুদের ক্ষেত্রে যেমন ঘটছে, তেমনি ঘটছে বয়স্কদের ক্ষেত্রেও। আমার ছোট কালেও আমাদের গ্রামে চুরির অপরাধে অনেককেই নির্দয়ভাবে প্রহার করতে দেখেছি আমি।একজন কথিত চোরকে গ্রাম্য সালিসদারদের সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতে বট গাছের ডালে ঝুলিয়ে নির্মমভাবে পেটাতে দেখেছি আমি। আমার মনে হয়, আমার পাঠকগণেরও এধরনের অভিজ্ঞতা রয়েছে। শিশু রাজনকে নির্যাতনের ঘটনাটি কালের প্রবাহে একটু আধুনিকতা লাভ করেছে— এই আর কি!

আমাদের দেশে আজকাল গণপিটুনিতে অভিযুক্তদের হত্যা করার ঘটনাগুলো নিয়মিত বিরতিতে প্রকাশিত হয়। কথিত ডাকাত, চোর, সন্ত্রাসী ইত্যাদি লেবেলধারী কতিপয় আদম সন্তানকে হাজার হাজার মানুষের সামনে পিটুনি দিয়ে ঘটনাস্থলেই হত্যা করার ঘটনাগুলো অতি পরিচিত। এসব ঘটনায় হাজার হাজার মানুষ উপস্থিত থাকলেও সবাই যে হত্যাকাণ্ডে অংশগ্রহণ করে তাও নয়। কিন্তু আমাদের হাতে এমন উদাহরণ খুব কমই আছে যে প্রকৃত দোষীদের শনাক্ত করে বিচারের সম্মুখীন করা হয়েছে। বরং গণপিটুনির বিষয়টি অনেকক্ষেত্রেই চিহ্নিত বা কথতি অপরাধীদের চিরতরে বিদায় করার একটি উত্তম পন্থা হিসেবে সামাজিক স্বীকৃতি পেয়েছে।

নৃশংসতা সৃষ্ট জীবের অভ্যন্তরে সুপ্রথিত একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য বা ইন্সটিঙ্কট। একটি শুয়ো পোকা থেকে শুরু করে সুবৃহৎ ডাইনোসরের মধ্যেও নৃশংসতার জিন রয়েছে।তবে কালের প্রবাহে ও সমাজের উৎকর্ষের ফলে নৃশংসতার মুখে মানুষ লাগাম টেনে দিয়েছে। এক সময় নৃশংসতা অপরাধীদের সাস্তি দেয়ার সমাজ ও রাষ্ট্র স্বীকৃত উপায় ছিল। আধুনিক বিচার ও শাস্তি ব্যবস্থা চালু হওয়ার পূর্বে কতিত অপরাধীদেরউপর শারীরিক নির্যাতন করে  সমাজকে শৃঙ্খলে রাখার চেষ্টা করা হত।

মিশের ফুকোর 'ডিসিপ্লিন এন্ড পানিশ' বইটির প্রথম দিকেই এমন একটি নির্যাতনের ঘটনার সন্ধান পাওয়া যাবে। এই শাস্তিটি চলে ১৮ দিন ধরে। প্রথম দিন অপরাধীর একটি হাত গরম পানিতে ঝলসে দেয়া হয়। পরদিন দ্বিতীয় হাতটি। এর পর চলে তার  বুকে, পিঠে ও শরীরের বিভিন্ন স্থানে গরম শিশা ঢেলে দেয়া। এভাবে শরীর ঝলসে দেয়ার পালা শেষ হলে শুরু হয় অঙ্গ কর্তনের পালা। শরীরের হাত-পা ও অন্যান্য অঙ্গসমূহ পর্যায়ক্রমে কর্তন করা হয়। এভাবে ১৮ দিনের মাথায় শাস্তির সমাপ্তি ঘটে অপরাধীর মৃত্যুর মধ্য দিয়ে।

অপরাধীর অঙ্গহানী করে শাস্তি প্রদান মিশরের ফেরাউনদের মধ্যে প্রচালিত ছিল। হযরত মুসা(আ) এর অনুসারীদের ফেরাউন শরীরের অঙ্গগুলো বিপরীতক্রমে কর্তন করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। অনেক দেশে, বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেয়ে অপরাধীর কব্জি কর্তনের আইন এখনও বিদ্যমান। অধিকন্তু পৃথিবীর অনেক দেশে মত্যৃদণ্ডের বিধানটিও তো নৃশংসতারই স্বীকৃত রূপ।

মনোবিজ্ঞানী সিগমন্ড ফ্রয়োডের মতে অন্যান্য প্রাণীর মতো মানুষের ভিতরও দুটো পরষ্পর বিরোধী বৈশষ্ট্য সতত ক্রিয়াশীল। এদের একটি হল জীবনেচ্ছা বা লাইফ ইন্সটিঙ্কট, অন্যটি মরণেচ্ছা ব ডেথ ইন্সটিঙ্কট। প্রেম-ভালবসা, মানুষসহ অন্যান্য প্রাণীদের সাহায্য করা সেবা করা হল জীবনেচ্ছা। অপরপক্ষে খুন-জখম বা প্রাণীদের নির্যাতনের ঘটনাগুলো মানুষের মরণেচ্ছা প্রকাশ করে। ডুবন্ত মানুষ যেমন খড়কে আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চায়, তেমনি আধুনিক মারণাস্ত্রের পিছনে কোটি কোটি ডলার খরচ করে তাদের মরণেচ্ছার বহিঃপ্রকাশ ঘটায়।

এখন পর্যন্ত শিশু রাজনকে নির্যাতনে মাধ্যমে হত্যাকারী মানুষগুলোর বিরুদ্ধে ইতোপূর্বে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িত হওয়ার কোন রেকর্ড পাওয়া যায়নি। এরা নিতান্তই সাধারণ মানুষ যারা আটপৌরে জীবন যাপনের এক পর্যায়ে তাদের অন্তরের মরণেচ্ছা প্রকাশ করেছেন মাত্র। এ মরণেচ্ছার মধ্যেও যে আনন্দ আছে তা প্রকাশিত হয়েছে তাদের নির্যাতনের ঘটনাটি নিজেরাই ভিডিও করে ফেইসবুকে ছড়িয়ে দেয়ার মাধ্যমে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ প্রান্তে আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্র তাদের নব নির্মিত পারমাণবিক বোমার কার্যকারিতা পরীক্ষা করার জন্য বেছে নিয়েছিল জাপানের হিরোসীমা ও নাগাসাকি নগরকে। এ দুশহরে পারমাণবিক বোমা নিক্ষেপের পূর্বেই জাপান আত্মসমর্পণের  সিদ্ধান্ত মিত্রবাহিনীকে জানিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু তারপরও আমেরিকা বোমা নিক্ষেপের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসেনি। তারা তাদের নিরীক্ষার শেষ গিনিপিগ হিসেবে বেছে নিয়েছিল প্রায় ৪০ হাজার নিরীহ বেসামরিক নারী-পুরুষ ও শিশুকে। আর মজার বিষয় হল, তাদের এই অত্যাধুনিক মরণ খেলাটির ভিডিও চিত্র তারাই অন্য একটি ফাইটার বিমানে বসে ধারণ করেছিল যা এখন যে কেউ ইন্টারনেটে দেখতে পারেন, আমি বলব উপভোগ করতে পারেন! শিশু রাজনের নির্যাতন ও সেই ঘটনার ভিডিও চিত্র ধারণ এবং আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের হিরোশিমা-নাগাসাকি ঘটনার ভডিও চিত্র ধারণের মধ্যে কোন অমিল আছে বলে আমি মনে করি না। পাঠকগণ করেন কি?

(১৫ জুলাই, ২০১৫)