এক শান্তিরক্ষীর দিনলিপি: কিস্তি-১৫ ( (বিদায় এনটেবে))

মোঃ আব্দুর রাজ্জাক
Published : 2 Feb 2016, 01:24 AM
Updated : 2 Feb 2016, 01:24 AM

০৯ নভেম্বর ২০১৫ তারিখে ভোর একটার দিকে কেনিয়ার নাইরোবি থেকে রওয়ানা হয়ে এনটেবেতে অবতরণ করেছিলাম। পাঁচ রাত ও চার দিন ছিলাম উগান্ডায়। তার মধ্যে পাঁচ রাত আর তিন দিনই কেটেছে এনটেবে ফ্লাইট মোটেলে। হোটেলটি তেমন ভাল মানের না হলেও নাস্তার আপ্যায়ন ছিল চমৎকার। সকালের নাস্তাটা আমরা সবাই বিষেশভাবে উপভোগ করেছি। কলা, আনারস, পেপেসহ অন্যান্য ফলগুলো আমাদের একয় দিন বাঁচিয়ে রেখেছিল। প্রতিরাতে একজনের ভাড়া ছিল ২০ ডলার। রুমের গেটিং ফেটিংস ভাল না হলেও হোটেল কর্মচারীরা ছিল আন্তরিক।

গতকাল গিয়েছিলাম নাইলের সোর্স দেখতে এনটেবে থেকে প্রায় ১২০ কিমি পূর্ব দিকে জিনজা নামক স্থানে। এ স্থানে ভিকেটারিয়া লেক থেকে নিল নদীর প্রধান শাখা হোয়াইট নাইলের উৎপত্তি হয়ে উগান্ডা, সাউথ সুদান, সুদান ও মিশরের উপর দিয়ে ৬,৮৫৪ কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে ভূমধ্যসাগরে পড়েছে। এর মাঝখানে নাইলে এসে পড়েছে অসংখ্য নদী, নালা ও ঝরনা। পৃথিবীর সবচেয়ে দীর্ঘ এ নদীর উৎপত্তি স্থলটি সত্যিই দেখার মতো।

প্রতিদিন যতটুকু সময় পেয়েছি, আসেপাশের স্থানে ঘুরে বেড়িয়েছি। উগান্ডার মানুষ বিমেষ করে এনটেবের মানুষগুলো বেশ আন্তরিক। খাবারদাবার বেশ সস্তা। আমি কোন দোকানে গেলেই জিনিসপত্রের দাম জানতে চাইতাম। তুলনা করে দেখতাম, সব কছিুর দাম বাংলাদেশের বাজারের দামের মতোই। আমাদের দেশের মতো উগান্ডাতেও চাইনিজ জিনিসপত্রের ছড়াছড়ি। আমাদের দেশের মতো এখানেও বেশ কিছু ডিপার্টমেন্ট স্টোর গড়ে উঠেছে।

উগান্ডার রাস্তায় বাস বা মিনি বাসের মতো বড় যানবাহন নেই। এখানে পাবলিক ট্রান্সপোর্ট বলতে রয়েছে মাইক্রোবাস ও মোটর সাইকেল। মোটর সাইকেলকে এরা বলে বোডাবোডাস। কোন পয়েন্টে কয়েকজন মানুষ একত্রিত হলেই প্রতিযোগিতামূলক মনোভাব নিয়ে দ্রুত চলে আসে বোডাবোডাস পার্টি। কে কার আগে যাত্রী ধরবে সেটা নিয়েই প্রতিযোগিতা। চিনের পাশাপাশি ইন্ডিয়াও এখানে মার্কেট দখল করে বসেছে। বস্তুত উগান্ডার স্বাধীনতার পূর্বে ইন্ডিয়ানগণই এখানে প্রায় সকল প্রকার ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করত। কিন্তু উগান্ডার এক নায়ক ইদি আমিন দাদা ইন্ডিয়ান তাড়ানোর অভিযান শুরু করে ইন্ডিয়ানরা সর্বশান্ত হয়ে দেশে ফিরে যান। তবে ইদি আমিনের পতনের পর আবার ব্যবসা-বাণিজ্যে ভারতীয়রা ফিরে এসেছে।

১৩ নভেম্বর ভোর চারটার সময় হোটেল ফ্লাইট মোটেল থেকে বের হয়ে আমরা এনটেবে বিমান বন্দরে আসি। আমাদের ইউএন ফ্লাই ছাড়ার কথা সকাল ০৮টায়। এর মাঝে আমরা এনটেবে বিমান বন্দরটি দেখে নিলাম। আমরা বর্তমানে রয়েছি নতুন টার্মিনালে। কিন্তু এখান থেকে সামান্য দূরে পুরাতন টার্মিনালে ১৯৭৬ সালে যে একটি বিস্ময়কর ঘটনা ঘটেছিল আমাদের মধ্যে অনেকেই জানেন না। ১৯৭৬ সালের জুন-জুলাইতে ফিলিস্তিনি গেরিলারা জার্মানির একটি উগ্রবাদী সংগঠনের সহায়তায় এয়ারফ্রান্সের একটি বিমান হাইজ্যাক করে এনটেবেতে নিয়ে আসে প্রায় শতাধিক ইসরায়েলি নাগরিককে জিম্মি করে। পরে ইসরায়েলি কমান্ডোরা সেটা অভিনব কায়দায় ও অসীম বীরত্বের সাথে জিম্মীদের উদ্ধার করে নিয়ে যায়। ইসরায়েলি কমান্ডোদের সেই অপারেশনের নাম ছিল অপারেশন থান্ডার বোল্ড।

এনটেবে বিমান বন্দর থেকে জুবার পথে ইউএন ফ্লাইটের এয়ারক্রাফ্টে উঠার জন্য বাসে সংক্ষিপ্ত ভ্রমণ ও এয়ারক্র্যাফ্টে ওঠার মুহূর্তে লাইনে দাঁড়িয়ে আমি গোটা বিমান বন্দরটি আরো অভিনিবেশসহ দেখার চেষ্টা করলাম। খুঁজে বের করতে চেষ্টা করলাম, কোথায় কোথায় ইসরায়েলি কমান্ডোরা অবস্থান নিয়েছিলেন, কোথায় জিম্মিরা ছিল ইত্যাদি। অপারেশন থান্ডারবোল্ড নিয়ে একাধীক ফিচার ফিল্ম ও ডকুমেন্টারি তৈরি হয়েছে। ফিল্মে দেখা ঘটনাগুলো আমার মানসপটে জীবন্ত হয়ে যেন দখো দিল।

তবে বিদায়ের আগে মনে হল, এনটেবে ও উগান্ডার অনেক কিছুই দেখা হয়নি। তাই সামনের কোন ছুটিতে অবশ্যই উগান্ডায় আসব। বিশেষ করে উগান্ডার লেইক ভিক্টোরিয়ায় একটা ছোট খাট নৌ ভ্রমণের একটা প্রবল ইচ্ছা আমার অন্তরে রয়েই গেল।