এক শান্তিরক্ষীর দিনলিপি- কিস্তি-৩ (জেট এয়ারে মুম্বাই রওয়ানা)

মোঃ আব্দুর রাজ্জাক
Published : 16 Dec 2015, 07:41 PM
Updated : 16 Dec 2015, 07:41 PM

যাত্রা করেছি ইন্ডিয়ার জেট এয়ারে। আমাদের গন্তব্য এখন বোম্বের দিকে। বিমান ছাড়ল ১২:১৫ মিনিটে। তবে আকাশে উড়াল দিতে দিতে কেটে গেল আরো পনের মিনিট। আমাদের যাত্রা তিন ঘন্টার। বোম্বে এয়ারপোর্টে আমরা অবতরণ করব স্থানীয় সময় ১৫:৩০ মিনিটে। এখানে আমাদের দুই ঘন্টার ট্রানজিট।

আমরা বসেছিলাম মাঝামাঝি স্থানে। তবে বিমানের পিছনের দিকে বেশ অংশ খালি। আমার সহকর্মীদের অনেকেই ঘুমাচ্ছেন। আমার ঘুম আসছিল না।। ভাবলাম, এই সুযোগ কিছুটা গল্প লিখি। তাই একটু পিছনে গিয়ে আমার নেটবুকে বসে এ কাহিনীটুকু লিখছি। বিমান উড্ডয়ন ও অবতরণের সময় ইলেকট্রনিক্স যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা নিষিদ্ধ। কিন্তু বিমান যখন আকাশে উঠে তার যাত্রাপথ ঠিক করে নেয় তখন এসব ব্যবহারে ক্ষতি নেই। মোবাইল ফোনের অন্যান্য এপস ব্যবহার করতে হলে তা ফ্লাইট মোডে দিয়ে করা যেতে পারে।

এ লেখা যখন শেষ করছি তখন বাজে বাংলাদেশ সময় দুপুর ০২:১৫। তার মানে, আমরা আকাশে আছি দু ঘন্টা ধরে। বিমানের জানালার বাইরে দিয়ে তাকালাম। মনে হল, সাদা সাদা মেঘগুলো সাগরের জলে বরফের টুকরার মতো ভাসছে। আকাশের মেঘশূন্য স্থানগুলোকে সাগরের বিশাল জলরাশির মতো মনে হচ্ছে। আমরা এখন অসীম শূন্যতায়। উপরে-নিচে, ডানে-বায়ে সব স্থানেই শূন্যতা।

ছত্রপতি শিবাজী বিমান বন্দর, মুম্বাই

প্রায় আড়াই ঘন্টা আকাশে থাকার পর স্থানীয় সময় আড়াইটায় আমরা বোম্বের ছত্রপতি শিবাজী বিমান বন্দরে অবতরণ করলাম। বিমান থেকে নেমে অনেক দূর হেঁটে আসতে হল ৭৪ নম্বর গেটে। এখানে এখনও বিমানে যাত্রী তোলার প্রক্রিয়া শুরু হয়নি। তাই অপেক্ষা করছি। স্থানীয় সময় সাড়ে চারটায় আমাদের বিমানে উঠতে হবে।

বিমান বন্দরের আন্তর্জাতিক টার্মিনালে ফ্রি ওয়াইফাই পাওয়া যায়। আমরা ওয়াইফাইএর সংযোগ পাওয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হলাম। পরে জানা গেল, এখানে এক বুথে গিয়ে নিজেদের নাম ঠিকানা রেজিস্ট্রি করে ইন্টারনেটে প্রবেশাধিকার লাভ করতে হয়। আমাদের কয়েকজন সদস্য সেটা করেও ফেলেছেন। কিন্তু এই বুথটি ৭৪ নম্বর গেট থেকে প্রায় এক কিলোমিটার দূরে। সময়ও কম। তাই শুধু কয়েক মিনিটের ওয়াইফাইয়ের জন্য হেঁটে হেঁটে শক্তি ক্ষয় করলাম না। হাজার হলেও বিদেশ তো। কোন সময় কি হয় বলা যায় না।

আমার ফোনে ভাইবার ইন্সটল করার বহুত চেষ্টাও সফল হয়নি। তাই ওয়াইফাই পেলে সোমাকে একটা মেইল করা যেত, ফোনে কথা বলা যেত না। তবুও সঙ্গীদের মোবাইলে সোমাকে ফোন দিতে চেষ্টা করলাম। কিন্তু ওর ভাইবার, আইএমও কিংবা ইয়াহু মেসেন্জার কোনটাই পেলাম না। চেষ্টা করলাম শ্যলিকা জিসার ফোনে ফোন দিতে। ওতেও ব্যর্থ হয়ে আমার ফেইসবুক একাউন্টে গিয়ে ওদের কিছু ম্যাসেস দিলাম। হয়তো পরে সেটা পাবে। তা ছাড়া আমার ফেইসবুক ওয়ালেও একটা স্টাটাসে সবাইকে জানিয়ে দিলাম আমাদের মুম্বাই পৌঁছার কথা।

ছত্রপতি শিবাজী বিমান বন্দরটি বেশ বড়সড়োই মনে হল। তবে উন্নত দেশের এয়ারপোর্টগুলোর চেয়ে কম আকর্ষণীয় লাগল। ১৯৪২ সালে চালু হওয়া এ বিমান বন্দরটির পূর্ব নাম ছিল শাহার আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর। দিল্লির পরেই ভারতের এটি সবচেয়ে ব্যস্ত এয়ারপোর্ট যেখানে প্রতিদিন প্রায় ৭৮০টিরও বেশি বিমান ওঠানামা করে।

বোম্বের পূর্ব নাম ছিল মুম্বাই। কিন্তু ইংরেজগণ তার নাম পরিবর্তন করে রেখেছিল বোম্বে। এটা অবশ্য তারা করে থাকে। যেমন আমাদের চাটগাঁ বা চট্টগ্রামকে ওরা বলত, চিটাগাং, ঢাকাকে বলত ডাকা। এমনিভাবে কোলকাতাকে বলত ক্যালকাটা। কিন্তু পরবর্তীতে ইংরেজদের দেয়া নামগুলোতে ভারতীয়রা বেশ পরিবর্তন এনেছে। তারা বোম্বেকে আবার মুম্বাই বলা শুরু করেছে, ক্যালকাটাকে, কোলকাতা। আমরা অবশ্য ঢাকা নামের বানানটি ছাড়া আর কিছুই পরিবর্তন করিনি।

বোম্বে হল ভারতের ২৯টি অংগ রাজ্যের অন্যতম মহারাষ্ট্রের রাজধানী। এই এলাকাটি পূর্বে দক্ষিণাত্য নামে পরিচিত ছিল। এটা হল মারাঠা সম্প্রদায়ের আবাসস্থল। মুঘোল আমলে মারাঠাগণ বেশ প্রভাবশালী ছিল। তারা মুঘোল সম্রাটদের সর্বদাই ভীতির মধ্যে রাখত। দক্ষিণাত্য দিল্লি থেকে অনেক দূরে হওয়ায় মুঘোল বাহিনী মারাঠা বিদ্রোহীদের দমনে প্রায়শই ব্যর্থ হত।

মুঘোলত্রাস শিবাজী
মারাঠাদের শ্রেষ্ঠ নেতা ছিলেন শিবাজী। তার জন্ম হয়েছিল ১৬৩০ সালে। তার বাবা আদিল শাহী সুলতানদের একজন সেনাপতি ও জমিদার ছিলেন। কিন্তু শিবাজী ছিলেন মুসলিম সুলতানদের ত্রাস। মুঘোল সম্রাট আওরঙ্গজেবের সময় শিবাজী প্রথম মুঘোল রাজ্য আক্রমণ করেছিলেন। আওরঙ্গজেব তার মামা সায়েস্তা খানকে শিবাজীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে প্রেরণ করেন। সায়েস্তা খান শিবাজীকে অনেকটাই কোনঠাসা করে ফেলেন। কিন্তু চতুর শিবাজী ১৬৬৩ সালে চাকান নামক স্থানে রাতের বেলা অতর্কিতে সায়েস্তা খানের শিবির আক্রমণ করেন। লন্ডভণ্ড হয়ে যায় সায়েস্তা খানের শিবির।কচুকাটা হয় মুঘোল সৈন্যদল। অপ্রস্তুত যুদ্ধে সায়েস্তা খান নিজের হাতের একটি আঙ্গুল হারিয়ে কোন প্রকারে প্রাণ নিয়ে পালিয়ে আসেন।

শিবাজীর বিরুদ্ধে মুঘোল সেনাপতি সায়েস্তা খান দারুণভাবে পরাজিত হয়ে দিল্লি পালিয়ে এলে দিল্লির দরবারে নানা প্রকার কানাঘুষা শুরু হয়। সায়েস্তা খানকে অনেকে বিশ্বাসঘাতক বলা শুরু করে। তখন আওরঙ্গজেব এক প্রকার শাস্তি দিয়েই সায়েস্তা খানকে বাংলার সুবেদার হিসেবে প্রেরণ করেন। আর বাংলাতেই সায়েস্তা খান তার বীরত্ব ও প্রশাসনিক দক্ষতার স্বাক্ষর রাখেন। শিবাজী কর্তৃক পরাজিত না হলে হয়তো আমরা, বাঙালিরা, আজ সায়েস্তা খানের নামটিও জানতাম না।

এরপর আওরঙ্গজেব শিবাজীর বিরুদ্ধে রাজা জয়সিংকে প্রেরণ করেন। এবার শিবাজী পরাজয়ের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হন। তিনি তখন মুঘোলদের সাথে চুক্তিতে আবদ্ধ হয়ে ক্ষতিপূরণ দিয়ে নিজের অর্ধেক দূর্গ রক্ষা করেন। তার ছেলে সম্ভুজীকে মুঘোল দরবারে সভাসদ হিসেবে প্রেরণেরও অঙ্গীকার করেন।

একবার আওরঙ্গজেব শিবাজীকে সৈন্য সামন্তসহ তার দরবারে হাজির হওয়ার নির্দেশ দেন। সম্রাটের ইচ্ছে ছিল শিবাজীকে তিনি কান্দাহারে পারসিকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে প্রেরণ করবেন। এতে কান্দাহার যেমন মুঘোলদের দখলে থাকবে, তেমনি শিবাজীও আওরঙ্গজেবের নিয়ন্ত্রণে থাকবে।

কিন্তু মুঘোল দরবারে হাজির হলে শিবাজীকে আওরঙ্গজেব যথাযথ মর্যাদা না দিয়ে সেনাপতিদের পিছনের সারিতে স্থান দেন। এতে শিবাজী ঔদ্ধত্যপূর্ণ প্রতিবাদ করলে সম্রাট আওরঙ্গজেব শিবজীকে তার পুত্র সম্ভুজীসহ বন্দী করে রাখেন। কিন্তু চতুর শিবাজী সম্রাটের কারারক্ষীদের চোখে ধুলো দিয়ে ফলের ঝুড়ির ভিতর লুকিয়ে পালিয়ে গিয়ে আবার মুঘোলদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করেন।

সম্রাট সাজাহানও তার রাজত্বের একটি বড় অংশ মারাঠাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ব্যয় করেন। মারাঠাদের সাথে যুদ্ধরত অবস্থাতেই সম্রাট সাজাহানের প্রিয়তমা মহিষী মমতাজ মহল সন্তান প্রসবকালীন মৃত্যুবরণ করেন। তখন তাকে এখানেই কবরস্থ করা হয়। তিনমাস পর লাশ তুলে আবার আগ্রায় নিয়ে গিয়ে আজকের তাজমহলের সমাধীস্থলে তাকে পুনকরস্থ করা হয়।

মুঘোল রাজশক্তির কাছে শিবাজী ভীতির কারণ হলেও মুঘোলরা শিবাজীকে একজন বড় মাপের দস্যু ভিন্ন অন্য কিছু মনে করত না। যদিও মুঘোলদের শেষ দিকে শিবাজীহীন মারাঠীরা একটা বড় অংশ এক প্রকার স্বাধীনভাবেই পরিচালনা করত তবুও শিবাজীকে মুঘোল ইতিহাসবিদগণ দস্যু হিসেবেই চিত্রিত করেছেন।

মারাঠাদের একটি অংশ জলদস্যুরূপে সাগর এলাকায় মধ্যপ্রাচ্যগামী জাহাজ লুট করত বলে জনশ্রুতি আছে। অনেক সময় তারা সমুদ্রপথে বাংলা পর্যন্ত চলে যেত। তার মানে সায়েস্তা খান শুধু দক্ষিণাত্যেই মারাঠাদের ঠেলায় বেশামাল হননি। বাংলাতেও তাকে মারাঠাদের মোকাবেলা করতে হয়েছিল। তিনি বাংলায় মারাঠা ও পর্তুগীজ জলদস্যুদের দমন করে বেশ কৃতীত্ব দেখিয়েছিলেন।

কালক্রমে ভারত মুঘোলদের হাত থেকে ইংরেজদের হাতে চলে যায়। দুইশত বছরের ইংরেজ শাসনের পর ভারত পরিপূর্ণভাবে স্বাধীনতা লাভ করে। স্বাধীন ভারতে শিবাজী একজন ছত্রপতি বা সম্রাট রূপেই পরিচিত। তিনি ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রথম পুরুষ বলেও অনেকে মনে করেন। কারণ ভারতীয় উপমহাদেশে মুঘোল শক্তিকে চ্যালেঞ্জ করার মতো বীরত্ব একমাত্র শিবাজীই দেখিয়েছিলেন। মুম্বাইয়ের এই ছত্রপতি শিবাজী বিমান বন্দরটি তাই ভারতের জাতীয় জীবনের একটি সুমহান ঐতিহাসিক পর্বের দিকে আমাদের দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয়।
০৮ নভেম্বর, ২০১৫
রবিবার।
3. Daily Accounts of a Peacekeeper, Episode-3