পুলিশের অসদাচরণ বনাম সংশ্লিষ্টদের ‘তানা না না’

মোঃ আব্দুর রাজ্জাক
Published : 3 Feb 2016, 05:25 PM
Updated : 3 Feb 2016, 05:25 PM

সম্প্রতি রাজধানীর মোহাম্মদপুর থানার এক এসআইয়ের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ ব্যাংকের জনৈক কর্মকর্তাকে গ্রেফতার করে পাঁচলাখ টাকা উৎকোচ আদায়ের প্রচেষ্টার খবর বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমে ফলাও করে প্রচারিত হয়েছে। এ নিয়ে পত্র-পত্রিকা, রেডিও, টেলিভিশন, অনলাইন পত্রিকা, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, ব্যক্তিগত ব্লগ সব স্থানেই ব্যাপক আলোচনা সমালোচনা হচ্ছে।

প্রত্যেকেরই বলা, কওয়া আর লেখার একই সুর – পুলিশ লাগাম ছাড়া হয়েছে। সরকার পুলিশকে লাই দিচ্ছে কিংবা পুলিশ মানুষের বন্ধু নয়, শত্রু। সবাই যখন যোগ দিচ্ছেন, কি বোর্ডের খোঁচায় খোঁচাখুঁচি করা যখন আমারও মজ্জাগত হয়ে দাঁড়িয়েছে, তাহলে আমি আর পিছিয়ে থাকি কেন?

তবে লেখার শুরুতেই বলে নেই, আমি কোন পুলিশ সদস্যের ব্যক্তিগত অসদাচরণ কিংবা অপকর্মের দায়দায়িত্ব নিতে চাই না। পেশাগত জীবনে এটা আমি কোন দিনই করিনি। ভবিষ্যতেও করব না। আমার প্রতিবেদনের প্রেক্ষিতে রিমান্ডের আসামীকে নির্যাতনকারী এক দারোগার বিরুদ্ধে নোয়াখালীতে সরাসরি হত্যা মামলা গ্রহণ করে তাকে গ্রেফতার করে জেলে ঢোকান হয়েছিল। আমিই ছিলাম র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের প্রথম সহকারী পরিচালক যার প্রতিবেদনে তিনটি বাহিনীর তিনজনের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা রুজু হয়েছিল। তাদের মধ্যে দুই বাহিনীর দুজন বাড়ি চলে গেছেন এবং পরে অন্য মামলায় গ্রেফতারও হয়েছেন। আমার কাছে কেউ অধীনস্তদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করলে আমার লোক দিয়েই তাদের দরখাস্ত লিখে দে্ই। অভিযোগ রীতিমত অনুসন্ধান করে ব্যবস্থা গ্রহণ করি। এ ব্যাপারে আমার অবস্থান শেইক্সপিয়রের হ্যামলেটের মত, I must be cruel only to be kind.

কেননা আমার দেশের নাগরিকদের প্রতি দয়ালু হব বলেই আমাকে অপরাধীদের বিরুদ্ধে নিষ্ঠুর না হলেও কঠোর হতে হবে। পুলিশের ইউনিফর্ম পরে, প্রশিক্ষণ শেষে মানুষের জানমালের নিরাপত্তা রক্ষার জন্য যারা শপথ গ্রহণ করেন, তাদের কাজেকর্মে ত্রুটি-বিচ্যূতি মেনে নেয়া যায়, অপকর্ম বা ফৌজদারি অপরাধ মেনে নেয়া যায় না।

পুলিশের অভ্যন্তরে কেউ যদি অপকর্ম করে সেটা তার নিজের উপর বর্তায়। পুলিশের এমন কোন আইন বিধি, প্রবিধান নেই যার মাধ্যমে সাংগঠনিকভাবে কোন দুর্বৃত্তকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দেয়া যায়। অন্যান্য উর্দিধারী কিংবা বিচারবিভাগীয় কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যে পেশাগত সেইফগার্ড আছে পুলিশের জন্য কিন্তু তার কোনটিই নেই। পুলিশ যে জনগণরই অংশ, পুলিশের জন্য ফৌজদারি আইনে আলাদা রক্ষাকবজ না থাকাটা তারই জ্বলন্ত প্রমাণ। আলোচ্য নিবন্ধে আমি পুলিশের পেশাগত বা পেশাগত দায়িত্বের বাইরের অসদাচরণগুলো নিয়েই কিছু বাড়তি প্রশ্ন তুলব।

প্রথমেই বলতে হয়, শুধু বাংলাদেশেই নয়, পৃথিবীর সকল সমাজেই মানুষ পুলিশের উপর অত্যধিক প্রত্যাশা করে। এ প্রত্যাশার সামান্য অংশই মাত্র পুলিশ পূরণ করতে পারে। পুলিশিং সাহিত্য পড়ে যতটুকু বুঝেছি, পৃথিবীতে এমন কোন সমাজ ছিল না, এখনও এমন কোন সমাজ নেই এবং ভবিষ্যতেও এমন কোন সমাজ হয়তো প্রতিষ্ঠিত হবে না যেখানে সমাজের সকল মানুষ সকল সময় পুলিশকে সমানভাবে বন্ধু ভাববে। আমি বলতে চাইছি যে পৃথিবীর কোন দেশের পুলিশকে গড়পড়তা নাগরিকগণ ফিরিস্তা ভাবা তো দূরের কথা, সভ্য মানুষের একাংশ বলে স্বীকার করতেও কুণ্ঠিত বোধ করেন।

পুলিশ শব্দের অক্ষরগুলোর নিয়ে নানা প্রকার ব্যাখ্যা দেন অনেকেই। পি-তে পোলাইট, ও-তে অবিডিয়েন্ট, এল-তে লয়াল, আই-তে ইন্টিলিজেন্ট, সি-তে কারেইজাস আরো কত কি! আবার পুলিশ শব্দকে ভিন্নার্থক ভিলেন অর্থে ব্যাখ্যা করার মানুষের অভাব নেই। তারা বলেন, পি-তে পাজি কিংবা ও-তে অপদার্থ, সবটা ভুলেই গেছি।

কিন্তু ইতিবাচক কিংবা নেতিবাচক যাই হোক, এসব ব্যাখ্যা বা বিস্তৃতিকরণ আসলে এক প্রকার মানুষের সচেতন মনের ফ্যান্টাসি ছাড়া কিছুই নয়। কারণ পুলিশ শব্দটির উৎপত্তির ইতিবৃত্ত আসলে ভিন্ন। 'পুলিশ' শব্দটির উৎপত্তি ও বিবর্তনের সাথে এর আসলে কোন সম্পর্ক নেই। ল্যাটিন মেট্রোপলিশ বা নগর থেকে এ শব্দটি চলে যায় ফ্রান্সে। সেখানেই মূলত বর্তমান রূপ পরিগ্রহ করে। পৃথিবীর আধুনিক পুলিশের শুভ বা অশুভ যাত্রা মধ্যযুগে ফ্রান্সেই শুরু হয়েছিল। ১৮৩২ সালে রবার্ট পিল যখন আধুনিক স্টাইলের মেট্রোপলিটন পুলিশ গঠন করেন, তখনও কিন্তু ইংল্যান্ডবাসীর কাছে ফ্রান্সের কেন্দ্রীভূত পুলিশ সংগঠনের উদাহরণ ছিল। সেই কেন্দ্রীভূত পুলিশের কোন সুনাম নয় বরং তারা রাষ্ট্রের অত্যাচারের সহযোগী সংগঠন রূপেই সারা বিশ্বে না হলেও অন্তত ব্রিটিশ সমাজের কাছে পরিচিত ছিল। তারা সরকারের বা রাষ্ট্রের পক্ষে ব্যক্তি স্বাধীনতা হরণ করত। ব্রিটিশগণ যেহেতু প্রচণ্ড স্বাধীন চেতা ছিলেন, তাই তারা ফ্রান্সের অনুরূপ কেন্দ্রীয়ভাবে নিয়ন্ত্রিত কোন পুলিশ বাহিনী গঠনের পরিবর্তে বিচ্ছিন্নভাবে 'নাইট ওয়াচ'গ্রুপ ধরনের নিজস্ব ক্ষমতাহীন পুলিশ সংগঠনের পক্ষেই ছিলেন। তাই তো রবার্ট পিলের লন্ডন মেট্রোপলিটন পুলিশ বিল পার্লামেন্টে তৃতীয়বার নাকচ হয়ে যাবার পর চতুর্থবার মাত্র সামান্য সংখ্যা গরিষ্ঠতায় পাশ হয়েছিল।

যাহোক, সেটা ভিন্ন ঘটনা, আলাদা গল্প। আমি লক্ষ করছি, সমাজের অগণিত আমজনতার মতো প্রচার মাধ্যমে উঠতি, পড়তি এমনকি মধ্যগগণে থিতুপ্রায় লেখকগণ পর্যন্ত সবাই পুলিশের প্রতি অসম্ভব প্রত্যাশা পোষণ করেই লিখছেন। পুলিশ নিয়ে এত মাতামাতি কিন্তু এ কারণেই।

কিছু দিন পূর্বে কয়েকটি পত্রিকায় পুলিশ বিভাগের নিজস্ব পরিসংখ্যানে তাদের সদস্যদের অসদাচরণ কিংবা ফৌজদারি অপরাধে জড়িয়ে পড়ার জন্য ডিসিপ্লিন শাখা কর্তৃক গৃহীত ব্যবস্থাবলীর একটি পরিসংখ্যান প্রকাশিত হয়েছিল। এ পরিসংখ্যান প্রকাশিত হলে, আশা করা গিয়েছিল যে, সবাই জানবে, তাদের সদস্যদের অপকর্মকে পুলিশ প্রশাসন কোনভাবেই প্রশ্রয় দেয় না। আর এর ফলে জনগণ নিশ্চিন্ত হবে, উৎসাহী হবে ও আস্বস্ত হবে যে পুলিশের অভ্যন্তরে থেকে অপরাধ বা অসদাচরণ করে কেউ পার পায় না। এতে পুলিশের প্রতি জনগণের আস্থা বৃদ্ধি পাবে। কিন্তু ঘটনা দেখি ঘটছে তার উল্টো!

কিছু কিছু লেখক কিংবা প্রচারমাধ্যম পুলিশ অফিসারদের শাস্তির সম্মুখীন হওয়াটাকে ইতিবাচকভাবে তো নয়ই, বরং দিগুণ উদ্যোমে তা নেতিবাচক মোড়ক দিয়ে পাঠক তথা জনগণের কাছে তুলে ধরতে চেষ্টা করছেন। তাই পুলিশ নেত্বেত্বের কাছে এটা ভাবা অস্বাভাবিক নয় যে, স্বচ্ছতার খাতিরে পুলিশ তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়গুলো যতই জনসম্মুখে প্রকাশ করছে, জনগণ ততোই এটাকে ভিন্নার্থে ও খারাপ অর্থেই নিচ্ছে।

প্রায় পৌনে দুই লাখ সদস্যের একটি সংগঠনে যারা কাজ করেন, তাদের সবাইকে নির্ভেজাল ফিরিস্তা কিংবা শয়তান কোনটাই মনে করার কারণ নেই। এরাও রক্তমাংশের মানুষ । তাই তাদের মধ্যেও মানবিক কামনা-বাসনা-প্রাপ্তি-বঞ্চনার প্রপঞ্চগুলো সমানভাবে ক্রিয়াশীল। বাংলাদেশের অপরাধ পরিসংখ্যান পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, এখানে প্রতি এক লক্ষ মানুষের বিপরীতে প্রায় ৪-৬টি মামলা হয়। বাংলাদেশে নারী ও শিশু নির্যতন প্রতিরোধ আইনের অধীন মামলাগুলোর কথাই ধরি। পুলিশের প্রায় দুই লাখ সদস্য থাকায় তো এ বাহিনীর সদস্যদের বিরুদ্ধেও প্রতি বছর অন্তত ১০/১২টি মামলা হওয়া অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু বাস্তবে তো তা হয় না। কদাচিৎ কিছু পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে ধর্ষণ কিংবা অন্যান্য প্রকারের নারী নির্যাতনের মামলা হয়। যদি চুরির কথা বলি, তাহলে অপরাধ পরিসংখ্যানের গড় বিভাজনে বাংলাদেশ পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে প্রতি বছর একাধিক মামলাও হতে পারে। কিন্তু সেটা তো হয় না। তার মানে পুলিশ মানুষ হলেও তাদের মানবিক বদগুণগুলো অনেকটাই সংযত।

অন্যদিকে, পত্রিকায় প্রকাশিত পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় শাস্তিগুলোর সবটাই তো ফৌজদারি প্রকারের নয়। এখানে অধঃস্তন কর্তৃক ঊর্ধ্বতন অফিসারের আইনানুগ আদেশ অমান্য করার মতো শৃঙ্খলাজনিত অপরাধ/অসদাচরণও জড়িত আছে। তাই যাদের শাস্তি দেয়া হয়েছে তারা সবাই তো সেই অর্থে দুর্বৃত্ত নয়।

বলাবাহুল্য, পত্রিকায় পুলিশের অসদাচরণ কিংবা ফৌজদারি অপরাধে জড়িত হওয়ার খবর যেমন প্রকাশিত হচ্ছে, তেমনি তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা থেকে শুরু করে ফৌজদারি মামলা রুজুর খবরও তো প্রকাশিত হচ্ছে। এই তো কিছু দিন আগেও চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের কয়েকজন সসদ্যেকে রীতিমতো স্বর্ণ ছিনতাই মামলা গ্রেফতার করা হল। ঐ স্বর্ণের মালিক কিন্তু নিশ্চিত ছিলেন না যে কতিপয় পুলিশ সদস্যই এ ছিনতাইয়ের ঘটনার সাথে জড়িত। তবে তিনি পুলিশের কাছে তার সন্দেহের কথা বলেছিলেন, পুলিশের কাছে তার জবানবন্দীতে সব কিছু খুলে বলেছিলেন। তদন্তকারী কর্মকর্তারা তাদের বস্তুনিষ্ঠ ও নিরপেক্ষ তদন্তে কয়েকজন পুলিশ সদস্যের জড়িত থাকার আঁচ পান এবং তদন্তের এক পর্যায়ে তাদের গ্রেফতার করেন। এই যে তদন্তের মাধ্যমে খুঁজে খুঁজে ফৌজদারি অপরাধের সাথে জড়িত পুলিশ সদস্যদের শনাক্ত করার প্রচেষ্টাগুলোও কি মানুষের প্রশংসা পেতে পারে না?

বাংলাদেশ ব্যাংকের জনৈক কর্মকর্তাকে নির্যাতনের জন্য দায়ি মোহামম্মদপুর থানার সেই এসআই এর বিরুদ্ধে তো তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।তিনি বরখাস্ত হয়েছেন। এখন তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা চলমান। যদি ভুক্তভোগী বিভাগীয় ব্যবস্থায় সন্তুষ্ট না হন, তবে তার জন্য তো আদালতের দরোজা খোলাই আছে। তবে তিনি সেই সব পথে না গিয়ে কেবল প্রচারমাধ্যমেই কাসুন্দি ঘাঁটছেন কেন? তবে কি তিনি মিডিয়া ব্যক্তিত্ব হওয়ায় কেবল মিডিয়া ট্রায়ালেই সন্তুষ্ট? সর্বশেষ তথ্যানুশানে গোলাম রাব্বী নয় কয়েকজন আইনজীবী নাকি এ নিয়ে হাই কোর্টে রিট করেছিলেন। তার প্রেক্ষিতে আদালত রাব্বীর ডিসি তেজগাঁর কাছে দেয়া দরখাস্তকে এজাহার হিসেবে গণ্য করার নির্দেশ দিয়েছে। তবে সরকার পক্ষের আপীলের কারণে সেটা আবার স্থগিত ছিল। সর্বশেষ রায়ে চলা হয়েছে রাব্বীর ঘটনাটি কোন ভাবেই জনস্বার্থে নয়, এটা একটা ব্যক্তিগত স্বার্থ। তাই মামলাটা তাকেই করতে হবে। আর যদি তিনি সে মামলা করতে চান, পুলিশ কিংবা আদালত সে মামলা অবশ্যই নিবন্ধন করবেন।
কিন্তু বিষয়টি আদালতে গড়ালেও ভুক্তভোগী রাব্বী কিন্তু এখন পর্যন্ত আদালতে যাননি।

বলতে কি মিডিয়া ট্রায়ালের মাধ্যমে একজন ব্যক্তির চরিত্র হণন করা যায়, একটি প্রতিষ্ঠানের সৎ প্রচেষ্টাগুলোকে প্রশ্নবিদ্ধ করে সেই প্রতিষ্ঠানের সুনাম ক্ষুণ্ন করা যায়, কিন্তু আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয় না। আর অবস্থা দৃষ্টে মনে হয়, আমরা কেউই আসলে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হোক তা চাই না। আমরা কেবল চটকদার প্রচারের মাধ্যমে নিজেকে প্রচারিত করতে চাই; বিকল্প পথে প্রচারিত হতে চাই। লালনের সেই উক্তিটি মনে হয় অন্তত পুলিশের বিরুদ্ধে খুবই সত্য। পুলিশ নিয়ে কেউ সঠিক পথে অগ্রসর হতে চায় না।– কারণ সত্য পথে কেউ নয় রাজি/ সবই দেখি তানা না না।
(১৪ জানুয়ারি, ২০১৬, ই্উএন হাউজ, জুবা, দক্ষিণ সুদান)