ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের ৪২ বছরঃ একটি বিশ্লেষণ

মোঃ আব্দুর রাজ্জাক
Published : 4 Feb 2017, 02:16 AM
Updated : 4 Feb 2017, 02:16 AM

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) এর প্রতিষ্ঠার ৪২ বছর পার হল। ১৯৭৬ সালের টালমাটাল দিনগুলোতে এর প্রতিষ্ঠা। মেট্রোপলিটন পুলিশের ধারণা যদিও রবার্ট পিলের লন্ডন মেট্রোপলিটন পুলিশ থেকে গ্রহণ করা হয়েছে তবুও বাংলাদেশের মেট্রোপলিটন পুলিশগুলো ঠিক লন্ডন মেট্রোপলিটন পুলিশের হুবুহু প্রতিরূপ নয়। এ  ব্যবস্থার সাথে মিল আছে মাদ্রাজ/মুম্বাই পুলিশ কিংবা কোলকাতা পুলিশের। তবে অন্য যেকোন প্রতিষ্ঠানের সাথে মিল থাকলেও বাংলাদেশে মেট্রোপলিটন পুলিশ ব্যবস্থা কিন্তু একটি স্বতন্ত্র ধারায় প্রবাহিত হযেছে।

লন্ডন মেট্রোপলিটন পুলিশ একটি রাজ্য পুলিশ থেকে সম্পূর্ণ পৃথক। এর কমিশানরকে নিয়োগ দেন সে দেশের রানি বা রাজা। তবে আইন অনুসারে লন্ডন মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার কোন সরকার, রাষ্ট্র কিংবা রানির কাছেও দায়বদ্ধ নন। তিনি দায়বদ্ধ শুধু আইনের কাছে। অন্য দিকে কোলকাতা পুলিশ অনেকটাই রাজ্য পুলিশের বাইরে। এখানে রাজ্য পুলিশের বাইরে নিজস্ব নিয়োগ হয়। রাজ্য পুলিশের সদস্যরা কোলকাতা পুলিশে প্রেষণে যেতে পারে; নিয়মিত পোস্টিং এ নয়।

কিন্তু বাংলাদেশের মেট্রোপলিটন পুলিশগুলো সম্পূর্ণ আলাদা আলাদা আইনে গঠিত হলেও এগুলো পুলিশ আইন-১৮৬১ অনুযায়ী  গোটা দেশে অধিক্ষেত্রসম্পন্ন মূল পুলিশের একক কমান্ডের বাইরে নয়। জেলা পুলিশ থেকে মেট্রোপলিটন পুলিশের মূল পার্থক্য হল, এখানে জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের নিয়ন্ত্রণ নেই। নানা ধরনের আইন-শৃঙ্খলাজনিত সমস্যায় জেলা পুলিশকে জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের মুখাপেক্ষী হতে হয়। যেমন- গাড়ি রিকুইজিশন, গণজমায়েতের লাইসেন্স/অনুমতি প্রদান, গণজমায়েত নিষিদ্ধকরণ তথা ১৪৪ ধারা জারি, এলাকায় সান্ধ্য আইন জারি ইত্যাদি ক্ষেত্রে জেলা পুলিশকে জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের দারস্থ হতে হয়। এর ফলে দ্রুত উদ্ভূত আইন-শৃঙ্খলা জনিত সমস্যার প্রতি সাড়াদান সময় মতো হয় না। কারণ এতে অনুমতি বা বিধি এক জনের হাতে, কিন্তু সাড়াদান কিংবা বাস্তবায়ন থাকে অন্যজনের হাতে।

কিন্তু মেট্রোপলিটন পুলিশিং ব্যবস্থায় এ সব কিছুই পুলিশ কমিশনারের হাতে ন্যাস্ত থাকে যাতে আধুনিক শহরের জটিল সমস্যাগুলোর প্রতি সরকার বা কর্তৃপক্ষের সাড়াদান দ্রুত হয়, মানুষকে দ্রুত পুলিশিং সেবা প্রদান করা যায়।

ডিএমপি ১৯৭৬ সালের পহেলা ফেব্রুয়ারিতে যাত্রা শুরু করেছিল মাত্র ৬ হাজার সদস্য নিয়ে। তখন এর থানার সংখ্যা ছিল মাত্র ১২টি। ঐ সময় ঢাকা শহরের জনসংখ্যা ছিল প্রায় ৪০ লাখ। কিন্তু বর্তমানে ঢাকার জনসংখ্যা প্রায় দেড় কোটির মতো। তাই জনসংখ্যা বৃদ্ধি, অপরাধের ধরন ও পরিমাণ/সংখ্যা বৃদ্ধি এবং একই সাথে অপরাধের জটিলতা বৃদ্ধিকে মোকাবেলা করতে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশকে তাল মিলিয়ে চলতে হয়েছে। বর্তমানে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের সদস্য সংখ্যা ২৬ হাজার ৬৬১ জন। এদের মধ্যে অতিরিক্ত আইজিপি পদমর্যাদার একজন কমিশনার, ডিআইজি পদমর্যাদার ৬ জন অতিরিক্ত কমিশনার, অতিরিক্ত ডিআইজি পদমর্যাদার ৯ জন যুগ্ম কমিশনার, পুলিশ সুপার পদমর্যাদার ৪১ জন উপপুলিশ কমিশনার রয়েছেন। অর্থাৎ ডিএমপিতে শুধু ক্যাডার পদের পুলিশ অফিসারই আছেন ২৮৩ জন। এ বিবেচনায় পুলিশের তিন/চারটি রেঞ্জের সমান জনবল রয়েছে ডিএমপিতে।

এজন্য ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশকে অনেকগুলো ইউনিটে বিভক্ত করা হযেছে। এগুলোকে বলা হচ্ছে অপারেশনাল ডিভিশন বা বিভাগ। বর্তমানে এখানে ছয়টি অপারেশনাল বিভাগ রয়েছে, যেমন-
১.গোয়েন্দা ও অপরাধ তথ্য বিভাগ,
২.ক্রাইম ও অপারেশন বিভাগ
৩.ট্রাফিক বিভাগ
৪.নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা বিভাগ
৫.পাবলিক অর্ডার ম্যানেজমেন্ট ও হেডকোয়ার্টার্স বিভাগ। এবং
৬. এন্টিটেরোরিজম এন্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম

প্রত্যেক বিভাগের দায়িত্বে আছেন একজন করে অতিরিক্ত কমিশনার। ক্রাইম ও অপারেশন বিভাগের অধীন রয়েছে থানাগুলো। ১৯৭৬ সালে যেখানে মাত্র ১২টি থানা ছিল সেখানে বর্তমানে ডিএমপিতে ৫৩টি থানা রয়েছে এবং আরো চারটি থানা গঠনের প্রক্রিয়া চলছে। আর পুলিশ সদস্যের সংখ্যা মাত্র ২৭ হাজারের মতো। অর্থাৎ এখানে প্রতি ৬৪৩ জন লোকের বিপরীতে একজন পুলিশ সদস্য রয়েছে।

কিন্তু যদি আমরা নিউইয়র্ক শহরের দিকে তাকাই দেখব সেখানে ২৪২ জন জনসংখ্যার বিপরীতে একজন পুলিশ সদস্য রয়েছে। একই ভাবে লন্ডন মেট্রোপলিটন পুলিশ এরিয়ায় মাত্র ২৮৮ জন নাগরিকের বিপরীতে একজন পুলিশ সদস্য রয়েছে। এমনকি আমাদের প্রতিবেশি দেশ ভারতের রাজধানী দিল্লি পুলিশেও প্রতি ২৫৭ জন নাগরিকের বিপরীতে একজন পুশিশ সদস্য রয়েছে। ঢাকা শহরের লোক সংখ্যা ১ কোটি ৭১ লাখ ৫১ হাজার ৯২৫ জন, আয়তন মাত্র ৩১৫ কিলোমিটার।

লন্ডন মেট্রোপলিটন পুলিশে সদস্য সংখ্যা ৪৮,৬৬১ জন। এর বাইরেও খণ্ডকালীন কর্মচারী হিসেবে প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার স্পেশাল কনস্টেবল রয়েছে। এ শহরের লোক সংখ্যা ১ কোটি ৪০ লাখ ৩১ হাজার ৮৩০ জন।

নিউইয়র্ক সিটি পুলিশ বা NYPD এর অনুমোদিত বর্তমান জনবল ৩৪ হাজার ৬০০ জন। তবে এর বাইরেও সেখানে প্রায় হাজার দশেকের মতো অক্সিলারি ফোর্স, ভলান্টিয়ার ইত্যাদি রয়েছে। এ শহরের আয়তন ১,২১৪ বর্গ কিমি, লোকসংখ্যা- ৮৪ লাখ, ৫ হাজার।

শিকাগো পুলিশ ডিপার্টমেন্টের সদস্য সংখ্যা ১২ হাজার ৭৬৬ জন। এ শহরের জনসংখ্যা- ২৭ লাখ ১৪ হাজার ৮৫৬ জন, আয়তন- ৬০৬ বর্গ কিমি। টোকিও মেট্রোপলিটন পুলিশের সদস্য সংখ্যা ৪৫ হাজার ৮০০। দিল্লি শহরের জনসখ্যা- ২ কোটি ১৭ লক্ষ ৫৩ হাজার ৪৮৬ জন, আয়তন ৩,৮৪০ বর্গ কিমি, দিল্লি পুলিশের সদস্য সংখ্যা ৮৪,৫৩৬ জন।

প্রতিষ্ঠার শুরুতেই ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের গঠন যেমন সরল ছিল তেমনি অপেক্ষাকৃত কম জটিল ছিল এর অধীক্ষেত্রের অপরাধ সংগঠন ও তা দমন প্রক্রিয়া। কিন্তু এ ৪১ বছরে সব কিছুই জটিল আকার ধারণ করেছে। ক্রমবর্ধমান অপরাধ ও সেগুলোর সংগঠন প্রক্রিয়ার জটিলতার বিপরীতে ডিএমপি ক্রমান্বয়ে নিজেদের যুগোপযুগী করে তুলেছে। এর মাঝে তাদের লোকবল থেকে শুরু করে লজিস্টিক বৃদ্ধি যেমন হয়েছে, তেমনি বৃদ্ধি পেয়েছে এ সংগঠনের অফিসারদের অপরাধ দমন ও প্রতিরোধ সংক্রান্ত দক্ষতাও। স্থানীয়ভাবে গড়ে ওঠা ছোটখাট অপরাধী গ্রুপ থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক সংযোগ সম্পন্ন কোন সন্ত্রাসী গ্রুপকে মোকাবেলার মতো দক্ষতাও তারা অর্জন করেছে। কিন্তু এতদসত্বেও এ সংগঠনের দক্ষতা বৃদ্ধির যথেষ্ঠ সুযোগ রয়েছে যা হয়তো অদূর ভবিষ্যতেই অর্জিত হবে।