আবার প্রমাণিত হল- পুলিশ খোদ সমাজেরই ভিকটিম

মোঃ আব্দুর রাজ্জাক
Published : 10 March 2016, 07:27 PM
Updated : 10 March 2016, 07:27 PM

খবরে প্রকাশ শিরিন আক্তার শিলা নামে একজন নারী ২০ জানুয়ারি, ২০১৬ বাদি হয়ে যাত্রাবাড়ি থানার ওসিসহ পাঁচ পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে ঢাকার ২ নম্বর নারী ও শিশু নির্যাতন ট্রাইব্যুনালের বিচারক শফিউল আজমের আদালতে শ্লীলতাহানীর মামলা করেছিলেন। বিজ্ঞ ট্রাইবুনাল মামলাটির বিচার বিভাগী তদন্তের ভার দিয়েছিলেন বিজ্ঞ মহানগর হাকিম জনাব এসএম মাসুদ জামান এর উপর । তার দাখিল করা বিচার বিভাগীয় তদন্ত প্রতিবেদন থেকে বিডিনিউজ২৪.কম খবর প্রকাশ করেছে যে বিচার বিভাগীয় তদন্তে যাত্রাবাড়ী থানার ঐ পাঁচ পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায়নি।

তবে এ প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে বাদী নারাজি দিয়েছেন। তাই বলা যায়, এখনও ঐ পুলিশ সদস্যগণ অভিযোগ থেকে রেহাই পাননি। নারাজির প্রেক্ষিতে অধিকতর অনুসন্ধান হতে পারে। সেখানে প্রতিবেদন ভিন্ন রকমও হতে পারে। তাই তদন্তাধীন বিষয়ে আমরা বেশি কিছু বলব না। তবে পুলিশের বিরুদ্ধে নারীদের শ্লীলতাহানী বা হয়রানি বিষয়ক এ ঘটনার আলোকে আমরা কিছু মন্তব্য করতেই পারি।

প্রথমেই ধরে নেয়া ভাল যে পুলিশ ধোয়া তুলসির পাতা নয়। তাদের অনেক দোষ আছে, ত্রুটি আছে, তাদের মধ্যে আছে অপরাধ প্রবণতাও। কিন্তু বাংলাদেশ পুলিশের সদস্যগণ যে লুচ্চা সেটা আমি মানতে রাজি নই। কারণ, আমাদের পুলিশ আমাদের বৃহত্তর সমাজেরই অংশ। সমাজের সকল দোষ-গুণই তাদের আছে। আমি ব্যক্তিগতভাবে বিশ্বাস করি, আমাদের দেশের মানুষ সাধারণভাবে নারীদের সম্মান করে। যদিও অপরাধের বিভিন্নমাত্রা রয়েছে এবং অন্যান্য সমাজের মতো আমাদের সমাজেও অপরাধ নানা মাত্রায় সংঘটিত হয়, তবু্ও সামান্য কিছু অপরাধী ছাড়া আমাদের সমাজের প্রায় সকল মানুষই তাদের যৌন আচরণে সংযত।

এমতাবস্থায়, থানা পুলিশ নারীদের ইচ্ছাকৃতভাবে হেনস্তা করে বলে আমি মনে করি না। যদি কোথাও এমন খবর পাওয়া যায় সেটা বৃহত্তর সমাজেরই আচরণের প্রতিফলন। থানার ওসি থেকে শুরু করে কনস্টবল পর্যন্ত দ্রৌপদীর বস্ত্র হরণের মতো কোন কর্ম পুলিশ সদস্যরা করেছে বলে আমার জানার মধ্যে নেই। কারণ দ্রৌপদীর বস্ত্রহণের ঘটনা ঘটেছিল উত্তর ভারতে; বাংলায় নয়। বাঙালিরা এধরনের দোষে দুষ্ট নয়।

থানার পুলিশও বাঙালি। তারাও বাঙালি মানসিকতা ধারণ করে। অন্যদিকে তারাও মুসলমান। মুসলমান চরিত্রের গুণগুলোও তাদের আছে। তাদেরও মা আছে, বোন আছে, ভাতিজি আছে ভাগনি আছে। তাই তাদের পক্ষে দলগতভাবে তো নয়ই, বিচ্ছিন্নভাবেও দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ সম্ভব নয়।অবশ্য ব্যতীক্রম যা আছে, সেটা নিয়মেরই অংশ।

ইতোপূর্বেও এধরনের একটি ঘটনা আদালতে গিয়েছিল। পুরাণ ঢাকার আদালত পাড়ায় এক মা ও তার তালাকপ্রাপ্তা মেয়ের শ্লীলতাহানীর জন্য পুলিশকে দোষারোপ করা হয়েছিল। ( দৈনিক প্রথম আলো, ৩০ এ্রপ্রিল, ২০১২)। বিষয়টি এমন অবস্থায় গিয়েছিল যে মহামান্য হাইকোর্ট পর্যন্ত এটা নিয়ে সরকারকে একটি উচ্চ পর্যায়ের কমিটি করে তা অনুসন্ধানের আদেশ দিযেছিল, যে কমিটিতে কোন পুশি সদস্য ছিল না। কিন্তু কমিটি তাদের তদন্তে প্রকাশ্য দিবালোকে হাজার হাজার মানুষ, আইনজীবীর সামনে মা ও মেয়ের শ্লীলতাহানীর বিষয়টি সত্য বলে বিশ্বাস করতেও পারেননি, প্রমাণ করতেও পারেননি।(দৈনিক প্রথম আলো, ২০ জুলাই, ২০১২)।

কিন্তু তাৎক্ষণিকভাবে সেই সময় নারী নেত্রীগণ থানা পুলিশকে নিয়ে এমন ধরনের বাড়াবাড়ি করেছিলেন , সেটা কেবল পুলিশ এবং বাংলাদেশ পুলিশ বলেই হজম করেছে। একজন নারী নেত্রী সূত্রাপুর থানায় গিয়ে উপস্থিত অফিসারদের এমনভাবে চাপ দিতে থাকেন যে, যে অপরাধ তারা করেননি, সেটা তাদের প্রকারান্তরে স্বীকার করতে হয়েছিল। অর্থাৎ পুলিশ নয়, নারী অধিকার কর্মীরাই পুলিশের কাছ থেকে মিথ্যা স্বীকারোক্তি আদায় করেছিলেন।

যাত্রাবাড়ি থানা পুলিশের বিরুদ্ধে শ্লীলতাহানীর অভিযোগটি এমন সময় এসেছিল, যখন পুলিশের বিরুদ্ধে পর পর বেশ কিছু অসদাচারণের অভিযোগ বিভিন্ন স্থান থেকে এসেছিল। তাই এটার বিচার বিভাগীয় তদন্তের ফলে পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ কিছুটা হলেও হালকা হল। বলাবাহুল্য একই ধরনের আরো কিছু অভিযোগ এখনও মূলতবী রয়েছে যেগুলো সত্যের চেয়ে অসত্য হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি ।

রাজধানীর আদাবর থানার একজন অফিসারের বিরুদ্ধে এক গৃহবধুর (যাকে পত্রিকাগুলো বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী হিসেবে চালিয়ে দিয়েছেন) অভিযোগটি পুলিশ কর্তৃক অনুসন্ধানে প্রমাণিত হয়নি। কিন্তু যেহেতু এ তদন্ত পুলিশই করেছে, তাই অনেকের কাছেই তা বিশ্বাসযোগ্য হয়নি। যদি সেই মহিলা আদালতে মামলা করেন আর তার বিচার বিভাগীয় তদন্ত দেয়া হয়, হয়তো তার পরিণতিও একই রকম হবে। কারণ কল্পিত দোষারোপ বিজ্ঞ আদালত বা বিচারক নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে বিচার করবেন, সস্তা আবেগ কিংবা পিতৃপ্রদত্ব পূর্ব সংস্কার দিয়ে নয়।

কিন্তু পুলিশের বিরুদ্ধে আনীত অভিজগুলোর বিপরীতে একটি অত্যন্ত কষ্টের বিষয় হল, অভিযোগ পুলিশ কর্তৃকত তদন্তে কিংবা বিচার বিভাগীয় তদন্তে প্রমাণিত না হলেও সংশ্লিষ্ট পুলিশ অফিসারগণ কিন্তু বিভাগীয় ব্যবস্থা থেকে রেহাই পাননি।

প্রত্যেকটি ঘটনায় সংশ্লিষ্ট পুলিশ অফিসারদের ভাগ্যে জুটেছে তাৎক্ষণিক প্রত্যাহার, বদলী এবং অনেক ক্ষেত্রে বরখাস্ত হওয়ার মতো শাস্তি। আমাদের সমাজ তথা সমাজের সদসরা নিজে বিচার চায়, কিন্তু যারা তাদের বিচারের কাছাকাছি নিযে যেতে পারে, সেই পুলিশের প্রতি সুবিচার দিতে চায় না। মানুষ চায় পুলিশের যেন বিনা বিচারেই শাস্তি হয়। আর পুলিশ কর্তারাও মিডিয়া ট্রায়ালে তাৎক্ষণিক সাড়া দিয়ে অভিযুক্ত পুলিশ অফিসারদের উপর একটা বিভাগীয় অবিচার করে বসেন যার কোন প্রতিকার নেই।

পুলিশ এ সমাজকে অপরাধমুক্ত করা, সমাজের সদস্যদের সার্বক্ষণিক সেবা দেয়া, তাদের বিপদে আপদে এগিয়ে আসা এমনকি বেওয়ারিস লাশের অভিভাবক্ত পর্যন্ত স্বীকার করে। কিন্তু পুলিশের বিপদে সমাজ কোন দিনই সহানুভূতিশীল হয় না। তাই সমাজের মানুষ হয় অপরাধের শিকার, আর পুলিশ হয় সমাজের শিকার।
Police: The Victim of the Society. কথাটি যে আসলেই সত্যি তা আবারও প্রমাণিত হল।

(১০ মার্চ, ২০১৬, ইউএন হাজউ, জুবা, দক্ষিণ সুদান)