নেপালি ছায়াছবি ‘ঝোলা’ এবং আমাদের ঝোলার খবর

মোঃ আব্দুর রাজ্জাক
Published : 4 April 2016, 06:00 PM
Updated : 4 April 2016, 06:00 PM

নেপালি ভাষা শেখার কৌশল হিসেবে কিছু কিছু নেপালি ছায়াছবি দেখেছি। নাটক বা ছায়াছবির সংলাপগুলো রপ্ত করলে ভোষা শেখার কাজটা অনেকটাই সহজ হয়। কোন পরিস্থিতিতে কোন কথা বলতে হবে, কিভাবে বলতে হবে নাটক বা সিনেমার সংলাপগুলো লক্ষ করলেই তা অতি সহজে আয়ত্ব করা যায়।

ইতোমধ্যে বেশ কয়েকটি নেপালি ছায়াছবি দেখেছি। আমার মতে এগুলো সবই ছিল বাণিজ্যিক দিক দিয়ে ভাল। কিন্তু অাজ দেখলাম 'ঝোলা' নামের একটি ছবি। ছবির বিষয়বস্তু কি নামটা দেখে প্রথমে বোঝার উপায় ছিল না।

গল্পের শুরুতেই দেখা গেল একজন ছা-পোষা কেরানি তার অফিস থেকে সাইকেলে করে বাসায় ফিরছেন। পথে এক স্থানে মানুষের জটলা দেখে তিনি জানতে চান কি ঘটেছে সেখানে। তাকে এক জন পথিক জানাল, রাস্তার উপর পড়ে থাকা একটি ঝোলার মধ্যে নাকি বোমা আছে। ঝোলার স্থানটি পুলিশ কর্ডন করে রেখেছে। উত্তেজনা চলছে সারা শহরে।

ছা-পোষা কেরানি বাসায় এসে দেখেন একই ধরনের একটি লাল ঝোলা তার বাসার ঘরের কোন এক স্থানে ঝুলছে। তিনি তার স্ত্রীর কাছ থেকে জানতে চান এ ঝোলা তিনি কোথায় পেলেন। স্ত্রী উত্তর দিলেন একজন বৃদ্ধা সেটা এখানে ছেড়ে গেছেন। বৃদ্ধার কোন বাড়িঘর নেই।

এরপর কৌতুল বসত তিনি ঝোলাটি খুলে জিসিনপত্রগুলো দেখতে থাকেন। পেয়ে যান প্রাচীন হস্তলিপির একটি কাগজ। তার স্ত্রী মনে করেছিলেন হয় তো এটা ঝোলাওয়ালীর পরিবারিক কোষ্টী হবে। কিন্তু না। কেরানি কাগজের লেখাটি পড়ে যা পেলেন তা ভারতীয় উপমহাদেশের এক ভয়াবহ কুসংস্কারাচ্ছন্ন প্রথার কিছু খন্ডচিত্র। এই লেখায় একজন পুরুষ লিখছেন তার পরিবারের কথা তার সংসারের কথা। তার বাবার কথা যে কিনা তার মাকে রেখে মৃত্যু বরণ করেছিল। তাই তার মায়ের ভাগ্যেও জুটেছিল সহমরণের সামাজিক ও ধর্মীয় আদেশ। কিন্তু অলৌকিকভাবে তার মা বেঁচে যান যার আদ্যোপান্তের সাক্ষী এই লোকটি।

তার বাবার চল্লিশ বছ বয়সে অল্প বয়সী তার মা কাঞ্চিকে বিয়ে করেন তার বৃদ্ধ বাবা। তিনি এতই বৃদ্ধ ও অসুস্থ ছিলেন যে তার মার ঔরসে তিনিই প্রথম ও শেষ সন্তান। এর পর তার বাবার মৃত্যু হলে তার মাকে সামাজিক, ধর্মীয় ও প্রচলিত রীতি অনুসারে তার বাবার চিতার সাথেই দাহ করার ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু সময়টা ছিল রাত। স্থানটি ছিল একটি পাহাড়ী ঝরনার কাছে। সকল রীতি পালন করে চিতায় আগুন লাগান হয়। আগুন ধীরে ধীরে সতীরর শরীরে লাগতে থাকে। এ সময় রীতি অনুসারে দাহকারী জনতা ও পুরোহিত চিতার বিপরীত দিকে মুখ করে থাকে। রাতের অন্ধকারে এ সুযোগ কাঞ্চি পাহাড়ী ঝরনার তলে হ্রদ পেরিয়ে একটি গুহায় গিয়ে আশ্রয় নেন। তার শরীরে কোন কাপড় চোপড় নেই। কারণ বস্তুহীনা হয়েই চিতায় উঠতে হয়।

কয়েকদিন পর কাঞ্চির নাবালক ছেলে তার হারানো গরুর খোঁজে জঙ্গলে ঢোকে। এক সময় সে চলে আসে শ্মশানের কাছাকাছি। মনে পড়ে যায় তার জীবন্ত দগ্ধ মায়ের কথা। সে চিতার আসেপাশে আনমনে খুঁজতে থাকে তার মা কাঞ্চিকে।

পাহাড়ি গুহার কাছে এসে পৌঁছে বালক। সন্ধ্যার অাঁধারে গুহার মধ্যে একটি নারীমূর্তি দেখতে পায় সে। বালক ভাবতে থাকে- এই নারী মূর্তি নিশ্চয়ই তার মা। তবে সে নিঃসন্দেহ হতে পারে না সে। তাই অদম্য কৌতূহল নিয়ে পরদিন সূর্যের আলোতে সেই গুহার কাছে যায়। সে দেখতে পায় ওটা সত্যি সত্যিই তার মা। সন্তানকে কাছে পেয়ে স্নেহময়ী মা তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে। তবে বালককে সাবধান করে দেয়, একথা যেন কাউকে না বলে। কারণ কাঞ্চির বেঁচে থাকার খবর জানাজানি হলে তাকে আবার চিতায় ওঠান হবে।

বালক বাড়ি ফিরে ঘটনাটি তার চাচীর কাছে বলে। চাচী কাঞ্চির জন্য কাপড়-চোপড় ও খাবার পাঠায়। খাবার খেতে খেতে অদূরে শ্বাশানে আবার লাশ পোড়ার বাদ্যযন্ত্রের করুন সুর শুনতে পায়। কাঞ্চি ও নাবালক ছেলে আড়াল থেকে দেখে তারই মতো অন্য এক যুবতী মেয়েকে স্বামীর চিতায় জ্বালান হচ্ছে। কিন্তু যুবতী চিতা থেকে উঠে প্রাণ বাঁচানোর জন্য দৌড় দিলে জনতা তাকে ধাওয়া করে আর পাথব নিক্ষেপ করে।যুবতী পাথরের আঘাতে অন্য একটি পাথরের উপর প্রাণ হারায়। তখন তার লাশটি আবার চিতায় চড়ান হয়।

ইতোমধ্যে কাঞ্চির কাছে তার জা ও ছোট দেবর চলে আসেন। কাঞ্চি ও তার নাবালক ছেলেকে কিছু পাথেয় দিয়ে গ্রাম ত্যাগ করার অনুরোধ করে তারা। কারণ কাঞ্চি এখনও জীবীত আছে- এ খবর জানতে পারলে গ্রামবাসী তাকে পুনরায় জীবন্ত জ্বালিয়ে দিবে। শুধু তাই নয়, এই কাঞ্চির অসামাজিক ও অধর্ম জন্য গোটা পরিবারকেই সামাজিক নির্যাতন সইতে হবে। এরপর কাঞ্চি তার নাবালক সন্তানকে নিয়ে অজানার উদ্দেশ্যে পাহাড়ি পথ পাড়ি দিতে শুরু করে।

এ পর্যায়ে ছবির কাহিনী আবার ফিরে আসে সেই কেরানির কাছে। দেখা যায় সে পুরাতন হস্তলিপিটি হাতে নিয়ে চোখের জল মোছে।তারপরে আমরা দেখি কেরানি তার ড্রয়িং রুমে মহাপুরুষদের ছবি সাজিয়ে রাখছেন যার মধ্যে সবচেয়ে দৃশ্যমান রূপে রাখা হয়েছে নেপালের সতীদাহ প্রথার বিরুদ্ধে সংগ্রামকারী মহাপুরুষ চন্দ্র সুমাস্যেরের ছবিটি। তার বৃদ্ধ মা জানতে চায় কেন সে এত বড় বড় মানুষের চেয়ে চন্দ্র সুমাস্যেরের ছবিটিকে এত দাম দিচ্ছে। তখন কেরানি তার বিধবা মাকে বলে, মা, তুমি যে আমার বাবার মৃত্যুর পরেও জীবীত আছ, সেটা এই লোকটির জন্যই। জানা যায় নেপালে সতীদাহ প্রথা ১৯২০ সাল পর্যন্ত প্রচলিত ছিল।

এই নেপালি ছবিটি ২০১৪ সালে মুক্তি পায়। মূল গল্পটি কৃঞ্চ ধারাবাসীর একই নামের একটি উপন্যাস থেকে নেয়া হয়েছে। ছবির নায়িকা গরিমা পান্টা ২০১৪ সালে শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী হিসেবে সার্ক ফিলম ফেস্টিভালের পুরস্কার জিতেছেন। আবার ৮৭ তম একাডেমি পুরস্কারের জন্য শ্রেষ্ঠ বিদেশি ছবি ক্যাটাগরিতে এটাকে ইতোমধ্যেই তালিকাভূক্ত করা হয়েছে।

ইতোমধ্যে আরো কিছু নেপালি ছায়াছবি আমি দেখেছি যেগুলোর মধ্যে বাণিজ্যিক মানের মারদাঙ্গা ও রোমান্টিক ছবিও আছে। আমার কাছে মনে হয়েছে নেপালি ছায়াছবির মান আমাদের বাংলাদেশের হাল আমলের ছায়াছবির চেয়ে ভাল। হতে পারে আমার ধারণা ভুল। কিন্তু আমাদের দেশের দর্শকরা যে পারতপক্ষে বাংলাদেশি বাংলা ছবি দেখতে সিনেমা হলে যান না কিংবা টেলিভিশনেও তেমন দেখেন না, সেটা তো সঠিক। (02 এপ্রিল 2016 শনিবার)