ঘুরে এলাম তানজানিয়া (প্রথম কিস্তি-নাইরোবি থেকে দারুস সালাম)

মোঃ আব্দুর রাজ্জাক
Published : 4 June 2016, 05:34 PM
Updated : 4 June 2016, 05:34 PM

দারুস সালাম এর পথে
দক্ষিণ সুদানে এটা আমার দ্বিতীয়শান্তিরক্ষা মিশন। প্রথমবার এখানে ছিলাম ২০০৮/০৯ সালে। তখন দক্ষিণ সুদান ছিল সুদানের অংশ। তাই আমাদের বিমান অবতরণ করত সুদানের রাজধানী খার্তুমে। কিন্তু ২০১১ সালে দক্ষিণ সুদান স্বাধীন হলে মিশন এলাকার সাথে বহির্বিশ্বের যোগাযোগ শুরু হয়ে উগান্ডার এনটেবে ও কেনিয়ার নাইরোবি হয়ে। যেহেতু নাইরোবি ও এনটেবেতে জুবা থেকে ফ্রি ইউএন ফ্লাইট আছে, তাই উগান্ডা ও কেনিয়া ভ্রমণ করা শান্তিরক্ষীদের জন্য অনেকটাই বিনামূল্যেই হয়।


এবারের মিশনের প্রথম ছুটিটা কাটিয়েছিলাম বাংলাদেশেই। কিন্তু দ্বিতীয় ছুটিতে কেনিয়ার মাসাইমারা আর পার্শ্ববর্তী দেশ তানজানিয়া ভ্রমণের পরিকল্পনা নিয়েছিলাম। আমার সাথে মাসাইমারা ভ্রমণের সময় আরো তিনজন বাংলাদেশি শান্তিরক্ষী ছিলেন। তানজানিয়ায় যাবার কথা ছিল আমার মিশনের রুমমেইট ইন্সপেক্টর মোহাম্মদ সবদুল হোসেন মোল্লার। কিন্তু শেষ দিকে তিনি পিছুটান দিলেন। কারণ হিসেবে দেখালেন, তানজানিয়ার ভিসা পাওয়া কঠিন। কয়েক জন বাংলাদেশি কিছুদিন আগে কেনিয়া থেকে তানজানিয়া ঢুকতে গিয়ে ফিরে এসেছেন। তাই তিনি ভিসা ছাড়া বৃথা চেষ্টা করবেন না।

কিন্তু আমি ১১ দিনের ছুটি নিয়ে চারদিন কেনিয়া ভ্রমণ করে বাকি এক সপ্তাহ জুবায় বসে কাটাতে চাইলাম না। পণ যখন করেছি, তখন সাথে কেউ থাকুক, আর নাই থাকুক, আমি তানজানিয়ায় যাবই। নাইরোবি থেকে তানজানিয়া সীমান্তে গিয়ে যদি ভিসা না পাই তো ফিরে আসব। তবে আমার বিশ্বাস ছিল আমাকে ফিরে আসতে হবে না। আমার কাছে আছে সরকারি পাসপোর্ট। আমি একজন পুলিশ অফিসার। সর্বোপরি আমি একজন শান্তিরক্ষী, ইউএন কর্মচারী। তাই আমাকে ভিসা না দেয়ার কোন কারণ নেই। মাত্র দুমাস আগে আমাদের অন্য দুজন বাংলাদেশি পুলিশ সহকর্মী তানজানিয়া ঘুরে এসেছেন। ওদের ভাষ্য মতে প্রথমে ওরা একথা সে কথা বলে কিছু সময় বসিয়ে রাখে। পরে ভিসাটা দিয়ে দেয়।

ভ্রমণ পরিকল্পনা
মাসাইমারা থেকে নাইরোবি ফিরলাম ১৫ মে, ২০১৬ তারিখের বিকেলে। রাত্রিযাপনের জন্য সানরাইজ নামের একটি হোটেলে উঠলাম। একটু জিরিয়ে নিয়ে চললাম ট্রাভেল এজেন্ট ডেভিডের অফিসে। ডেভিড আমাকে ছয় রাতের তানজানিয়া ভ্রমণের একটা খসড়া পরিকল্পনা তৈরি করে দিল। পরিকল্পনা অনুসারে আমি ১৬ মে সকালে নাইরোবি থেকে বাসযোগে যাব দারুস সালাম। সেখানে এক রাত থেকে পরদিন যাব জান্জিবার। জান্জিবারে দুই রাত থেকে ফিরে আসব দারুস সালামে। দারুস সালামে দুরাত থেকে চলে আসব কিলিমানজারো পর্বতমালার কাছাকাছি মোসি শহরে। মোসিতে একরাত থেকে পরদিন ফিরব নাইরোবিতে। অর্থাৎ সবচে দূরে তানজানিয়ার দ্বীপ প্রদেশ জানজিবার ঘোরা শুরু হবে প্রথমে। তারপর ক্রমান্বয়ে আমি নাইরোবির দিকে অগ্রসর হতে থাকব।


আমার অন্য সহকর্মীগণ চলে গেছেন কেনাকাটা করতে। আমি চললাম ডেভিডের অফিস হয়ে বাস স্টান্ডে। মডার্ন কোস্ট নামের একটি বাসের টিকেট করলাম। নাইরোবি থেকে দারুস সালাম প্রায় এক হাজার একশ কিলোমিটার। ভাড়া নিল প্রায় ৩৫ ডলার। বাস ছাড়বে আগামীকাল সকাল ছয়টায়।

টিকিট করে ফিরে এলাম হোটেলে। কিন্তু সারারাত ঘুম হয়নি। একদিকে নরম বিছানার যন্ত্রণা, অন্যদিকে করিডোরের উজ্জ্বলতম লাইট। এর বাইরেও ছিল আগামী সফরের উত্তেজনা। এক সময় বমি বমি লাগল। বাথরুমে গিয়ে প্রাকৃতিক কর্ম সারার পর শেষ পর্যন্ত বমিই করে বসলাম। প্রথম রাতে তেমন কিছুই খাইনি। তবে অন্যান্য সহকর্মীদের সাথে এক হোটেলে একটা ফান্টা খেয়েছিলাম। আমার মনে হয়, এসিডিটির কারণ সেটাই।

১৬ মে, ২০১৬ তারিখ। নাইরোবি থেকে দারুস সালাম এর উদ্দেশ্যে আমার বাস ছাড়বে সকাল ছয়টায়। রিপোর্ট করতে হবে তারও আধাঘন্টা আগে, মানে সাড়ে পাঁচটায়। সেক্ষেত্রে আমাদের সকাল পাঁচটায় হোটেলের পাঠ চুকাতে হবে। আমি সাড়ে চারটার দিকে তৈরি হয়ে হোটেলের লবিতে গেলাম। তখন নাস্তা তৈরি হচ্ছিল। রিসিপশন থেকে বলা হল, নাস্তা রেডি। আমি চাইলে খেতে পারি। কিন্তু নাস্তায় মিষ্টি আলু ভিন্ন আমার খাওয়ার মতো অন্য কিছু পেলাম না।

হোটেল থেকে বাসস্টান্ড মাত্র পাঁচ/সাত মিনিটের পথ। এত অল্প দূরত্বের জন্য টেক্সিভাড়া করা বিলাশিতা। আর নাইরোবির রাস্তায় ঢাকার রাস্তার মতো রিকসা জাতীয় যানবাহন নেই। তাই বোচকা পেটরা নিয়ে হেঁটেই রওয়ানা দিতে হল। আমার সাথে উরুগুয়ে ও প্যারাগুয়ের দুজন শান্তিরক্ষীও আছেন। ওদের সাথে পরিচয় হয়েছিল গত শুক্রবার মাসাইমারা ভ্রমণের সময়। আমার সাথে ছিল কুইকরান ব্যাগের বাইরেও একটি ছোট ট্রলি ব্যাগ। ওটার ওজন দশ কেজির মতো হবে। ওটা হাতে নিয়ে হাঁটাও কষ্টকর ছিল। তাই মাঝে মাঝে মাথায় ও ঘাড়ে নিয়ে চলতে হচ্ছিল।

বাস ছাড়ল
টিকিট ও পার্সপোর্ট দেখে আমাদের বাসে উঠান হল। সবাই বলেছিল বাসগুলো বেশি বিলাশবহুল। কিন্তু বাসে উঠে তা মনে হল না। প্রথম দিকের ছয়টি সিট ভিআইপি স্টাইলে তৈরি করা হয়েছে। এখানে একটু হাতপা ছেড়ে দিয়ে শোয়া যেতে পারে। কিন্তু অন্য সিটগুলো আমাদের দেশের দূরপাল্লার সাধারণ গাড়িগুলোর সিটের চেয়ে তেমন উন্নতমানের নয়। বরং একটু নিম্নমানেরই হবে।

আমার পাশের সিটে বসেছে এক কালো তরুণী। আলাপ করে জানলাম তার নাম ক্যাথারিন। সে একজন তানজানিয়ান। কিন্তু উগান্ডার কাম্পালায় সে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভূগোল নিয়ে পড়াশোনা করে। এজন্য সে বাংলাদেশ সম্পর্কে অনেক কিছুই জানে। ভাবলাম, ওর সাথে আলাপে আলাপে কিছুটা সময় কাটবে। তবে ঐ বালিকা গত রাতে কাম্পালা থেকে বাসে রওয়ানা দিয়ে এখন নাইরোবি হয়ে দারুস সালামের পথে। তার চোখে তন্দ্রাচ্ছন্ন ভাব। তাই আমার সাথে আলাপে তেমন বেশি আগ্রহী বলে মনে হল না। তারপরও আমি তাকে বেশ কিছুক্ষণ জাগিয়ে রাখলাম।

নাইরোবি শহরটি যখন আমাদের বাস ছাড়ছিল তখনও ছিল অনেকটাই অন্ধকার। এক স্থানে মনে হল দূরে কোথাও আগুন লেগেছে। কিন্তু ভালো করে লক্ষ করে দেখি এটা আসলে ঊষার আভা। আমাদের বাস চলছিল উঁচু দিয়ে। তাই দূরের নিচু উপত্যকায় সকালে সূর্যের আভাকে আগুনের মতোই মনে হচ্ছিল।

নামাঙ্গা ইমিগ্রেশন পোস্ট
প্রায় ঘন্টা দুয়েক পর আমাদের গাড়ি নামাঙ্গা ইমিগ্রেশেন চেকপোস্টে এসে পড়ল। এখানে প্রথমে কেনিয়া থেকে বের হওয়ার জন্য ডিপারচার কাউন্টারে গিয়ে পাসপোর্টে বহির্গমনের সিল মারতে হয়। কেনিয়ায় ঢোকা ও বের হওয়া আমাদের জন্য অত্যন্ত সহজ। এ দেশটা এক দিক দিয়ে মিশন এলাকা। কারণ এখানে মিশনের লগ বেইজ রয়েছে। এখানে আসাযাওয়ার জন্য শান্তিরক্ষীদের ফ্রি ফ্লাইট রয়েছে। দক্ষিণ সুদান থেকে নাইরোবি আসতে আমাদের কোন বিমানভাড়া লাগে না। এয়ারপোর্ট থেকে বের হলেই বিনা পয়সায় পাসপোর্টে ওরা ভিসা লাগিয়ে দেয়।

কেনিয়ান এলাকা থেকে যেতে হবে তানজানিয়ান এলাকায়। এটা রাস্তার ওপারে এটকু উঁচুতে। কিন্তু নতুন অবস্থায় সব কিছুই ধাঁধার মতো মনে হয়। এর ফাঁকে জুটে গেল কিছু দালাল। তারা একবার এদিকে দেখায়, অন্যবার ওদিকে। একজন এসে আমাকে একটু দূরে একটা পোস্টে নিয়ে গিয়ে বলল, এখানে নাকি পঁঞ্চাশ ডলার ফি দিতে হবে। আমি কোন টাকাপয়সা দিতে অস্বীকার করলাম। কিন্তু তারা আমাকে জোরাজোরি করতে শুরু করে। আমি একবার তাদের কাছ থেকে রিসিট দেখতে চাইলাম। তারা সেটা দেখাতে পারল না। বললাম, আমার দু বন্ধু কিছুক্ষণ আগেই গেছে। কই দেখাও তারা কোথায় টাকা দিয়েছে। এর মাঝে একজন লোকের উদয় হল। সে বলল, তুমি দেরি করছ। আমাদের গাড়ি ছেড়ে যাচ্ছে। তোমার জন্যই সবার দেরি হচ্ছে। এ বলে সে আমার হাত থেকে একশ ডলারের নোটটা নিয়ে পোস্টের লোকটার কাছে থাকা একটা নো্টের সাথে বদল করল। আমি বেশ বুঝতে পারলাম। কিন্তু এই বদল করাটাই যে আমার সাথে তাদের প্রতারণা কৌশলের চূড়ান্ত রূপ ছিল সেটা বুঝেছি আরো এক দিন পরে। ওটা আসলে আমার একশ ডলারের নোটটা নিয়ে আমার হাতে একটি জাল ডলারের নোট গুঁজিয়ে দেয়র কৌশল ছিল। আমি এখানে কোন টাকা পয়সা দেইনি। কিন্তু তারা আমার আসল নোট নিয়ে আমাকে জাল নোট ধরিয়ে দিয়েছে।

ভিসা বিড়ম্বনা
এবার এসে পড়লাম তানজানিয়ার ইমিগ্রেশনে। এখানে দুটো ফর্ম পুরণ করতে হয়। একটি হল সাধারণভাবে কোন দেশে ঢুকলেই পুরণ করা জরুরি। অন্যটি হল ভিসার জন্য আবেদন। ভিসা পেতে এখানে ৫০ ডলার ফি দিতে হয়। আমার সাথের উরুগুয়ে-প্যারাগুয়েনরা অল্পতেই ভিসা পেয়ে গেল। কিন্তু বিপত্তি ঘটল আমার ক্ষেত্রে।

বাংলাদেশের সাথে তানজানিয়ার কূটনৈতিক সম্পর্ক নামকা ওয়াস্তে। এখানে আমাদের কোন দূতাবাস নেই। পার্শ্ববর্তী কেনিয়া থেকেই এর সাথে আমাদের কূটনৈতিক সম্পর্ক রক্ষিত হয়। ইতোপূর্বে জেনেছিলাম যে বাংলাদেশিদের জন্য তানজানিয়ায় ঢোকা একটু কষ্টকর। আমাদের দুই এডিশনাল এসপি প্রায় মাস দুয়েক আগে তানজানিয়া সফর করে গিয়েছিল। তারা আমাকে বলেছিল, প্রথমে ওরা ভিসা দিতে গড়িমসি করে। অনেক্ষণ বসিয়ে রাখে। এটা ওটা বলে। জানতে চায় তুমি পূর্বে ভিসা নাওনি কেন? কিন্তু পরে তারা ভিসা দিয়ে দেয়।

আমি একই ভরসায় তানজানিয়া ভ্রমণে গিয়েছি। কিন্তু এখানে এসে দেখি ওরা এত বেশি কড়াকড়ি শুরু করেছে যে আমাকে হয়তো ফিরেই যেতে হবে। প্রথমে ওরা আমার কাছে দেশের চিঠি চাইল। পরে বলল, ঠিক আছে তাহলে ইউএন থেকে আনা একটা চিঠি দাও যাতে তারা তোমার জন্য ভিসা দেয়ার অনুরোধ করেছে। আমি ওয়েব সাইটে গিয়ে দেখেছিলাম বাংলাদেশসহ কয়েকটি দেশের নাগরিকদের ভিসার জন্য নাকি কি রেফারেন্স লাগে। ওটাকে ওরা রেফারেল ভিসা বলে। কিন্তু রেফারেল ভিসাটা যে কি সেটা বুঝতে পারিনি।

ইমিগ্রেসনের ছোট কর্মচারী অবশেষে আমাকে একজন বড় কর্মচারীর কাছে পাঠালেন। সাদা পোশাকের এই ভদ্রলোক আমাকে বোঝাতে শুরু করল। দেখ, তোমাদের দেশের সাথে আমাদের অন এরাইভ্যাল ভিসা প্রদানের কোন চুক্তি নেই। তাই তুমি নাইরোবিতে ফিরে যাও। সেখানে গিয়ে আমাদের দূতাবাসে দরখাস্ত কর। সাথে সাথেই ভিসা পেয়ে যাবে। আমি বললাম, এতে তো আমার একদিন চলে যাবে। আর আমার অন্য সহকর্মীদের তো তোমরা ভিসা দিয়েছিলে। তাই একটু চেষ্টা কর। যাতে আমি তোমাদের এই সুন্দর দেশটা একটু ঘুরে দেখতে পারি। কিন্তু সে আমাকে পাত্তা দিল না।

এর পর আর একজন পুলিশ অফিসার এল। আমি তাকে বললাম, দেখ আমি একজন পুলিশ অফিসার। আমি শান্তিরক্ষা মিশনে কাজ করছি যেখানে তোমার দেশের অনেক পুলিশ অফিসার আমার সাথে কাজ করে। আমি মোবাইলে দুজন পুলিশ অফিসারের সাথে আমার ছবিও দেখালাম। বললাম, ওরাও আমাকে তো বলেছিল যে এখানে এলেই তোমরা আমাকে ভিসা দিবে। কিন্তু তারপরও ইমিগ্রেসন পুলিশের মন গলল না। শেষ পর্যন্ত এমনই হল যে আমাকে গাড়ি থেকে জিনিসপত্র নামিয়ে নাইরোবিতে ফিরে আসার উদ্যোগ নিতে হল। গাড়ির কনডাকটরকে বললাম, দেখো অন্য কোন উপায় করা যায় কি না। দরকার হলে আমি বাড়তি ফি দিব।

এ মুহূর্তে আমাকে একজন নিম্ন পদস্থ পুলিশ অফিসার ডাক দিল। ইমিগ্রেশনের ভিতর অন্য একজন সার্জেন্ট গোছের পুলিশ অফিসার বলল, আস আমি তোমাকে সাহায্য করব। এই বলে সে আমার কাছ থেকে পাসপোর্টটা নিয়ে প্রসেস করা শুরু করল। তবে সে আকার ইঙ্গিতে বোঝাতে চাইল যে এর জন্য তাকে বকসিস দিতে হবে। আমি একশ ডলারের একটা নোট তাকে দিলাম। মনে মনে ভাবলাম, যদি বেটা ৫০ ডলার সরকারি ফিসের বাইরেও তোরা পঁঞ্চাশ ডলার অতিরিক্ত রাখিস, আমি তাতেও রাজি।

কিন্তু না, সে আমাকে পঁঞ্চাশ ডলার ফেরত দিল। তবে তখনও আকারে ইঙ্গিতে বোঝাতে চাইল যে তাকে বকশিস দেয়া দরকার। কিন্তু আমি তাকে বললাম, দেখ তুমি আমাকে বেশ সাহায্য করেছ। তোমার গল্প তাই আমি সবার কাছে করব। এমনকি আমার মিশনের সহকর্মীদের কাছেও তোমার সাহায্যের কথা তুলব। কিন্তু তোমাকে যদি আমার ঘুষ বা বকশিস দিতে হয়, সে কথাও তখন উঠবে। তুমি কি চাও যে এক জন পুলিশ হয়ে অন্য একজন পুলিশের ঘুষ গ্রহণের কাহিনী আমি অন্যদের কাছে বর্ণনা করব? আমার কথা শুনে মনে হলে হল, সে কিছুটা লজ্জা পেয়েছে। আমি তাকে ধন্যবাদ দিয়ে বাসে ফিরে আসলাম। আমার কাছে এটা পরম পাওয়া মনে হল।

তানজানিয়ায় ঢুকলাম
একমাত্র আমার ছাড়া সবার ভিসাই সঠিক সময়ে প্রসেস করা হয়েছিল। তাই আমার জন্য গাড়ির যাত্রীদের কমপক্ষে পৌনে এক ঘন্টা অপেক্ষা করতে হয়েছি। তাই ভেবেছিলাম, আমাদের দেশের যাত্রীদের মতো আমাকে না ওরা কতটাই গালাগালি দিচ্ছে। কিন্তু যতটুকু মনে করেছিলাম, ততোটুকু নয়। এ রুটের যাত্রীদের কাছে এ ধরনের ভিসা বিড়ম্বনা নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। তাই কেউ আমাকে কোন কথা শোনাল না। আমরা দারুস সালামের উদ্দেশ্যে আবার রওয়ানা দিলাম।

আমাদের সন্ধ্যা নাগাদ দারুস সালাম পৌঁছার কথা থাকলেও তা সম্ভবত হবে না। কারণ বাসের গতি তেমন ভাল না। সবচেয়ে বড় কথা হল, বাসের সার্ভিসও ভাল না। এখন পর্যন্ত আমরা প্রায় পাঁচ ঘন্টার মতো গাড়িতে আছি। কোন স্থানে খাওয়ার জন্য গাড়ি থামান হল না। আর তাদের পক্ষ থেকেও কোন খাবার দেয়া হল না। আমি কন্ডাকটারকে বললে সে জানাল, হাঁ নাইরোবি থেকে আমাদের পানি ও নাস্তা দেয়ার কথা। কিন্তু আজ সেটা তারা দেয়নি। আমি আশ্চর্ষান্বিত হলাম। কোন কোম্পানির গাড়িতে যদি এমন কোন বিধান থাকে যে পথে যাত্রীদের নাস্তা দেয়া হবে, তাহলে হটাৎ করে সেটা বন্ধ হবার কথা নয়। কিন্তু আমার কথায় তো কোন কাজ হবে না। আমি একজন বিদেশি পর্যটক মাত্র। আমাদের খাবার ও পানি ছাড়াই যাত্রা চলছে।

দুপুরের খাবার মাত্র কলা
মোসি নামক স্থানে গাড়ি কিছুটা থামল। এখানে একটা শপিং মলের সামনে দাঁড়িয়ে আমাদের বলা হল মাত্র ১০ মিনিটের বিরতি। আমরা কেবল বাথরুমের কাজটুকু করতে পারব। কিন্তু পথে পিপাসার পানি না পেলে পেটের ভিতর প্রস্রাব পয়দা হবার কারণ নেই। আমি দ্রুত বাথরুম থেকে বের হয়ে বাইরে ফুটপাতে খাবারের খোঁজ করলাম। কিন্তু কিছু বলা ছাড়া আর কিছু পেলাম না। কলা বিক্রয় করছেন এক বৃদ্ধ মহিলা। সে আবার ইংরেজি বোঝে না। তাই যাত্রীদের মধ্যে একজন মধ্যস্থতা করল। একডজন কলা কিনলাম তিনহাজার শিলিং দিয়ে। ভাগ্যিস গাড়ির কন্ডাকটার আমাদের ডলার বা কেনিয়ান শিলিং পরিবর্তন করে তানজিনিয়ান শিলিং কেনার সুযোগ দিয়েছিলেন। আমি সামান্য কিছু শিলিং পরিবর্তন করেছিলাম। তবে এক ডজন কলা নিয়ে খাওয়া সম্ভব নয়। তাই প্যারাগুয়ে-উরুগুয়েদের বললাম আমার সাথে ভাগাভাগি করতে। আমার এক হাজার আর ওদের দুই হাজার মিলে এক ডজনের মতো কলা হল। এগুলো ছিল সবরি কলা। বাসে এসে আমার সাথে থাকা ছোট ছোট বিস্কুটের প্যাকেট ওদেরও দিলাম। আমিও নিলাম। তবে পানি নেই। কলা আর বিস্কুট দিয়ে পানি ছাড়াই দুপুরের খাবার হয়ে গেল।

কিলিমানজারো পাহাড়ের কোল ঘেঁসে চলা
চলতে চলতে বিরক্তি ধরে গেছে। তবে মোসি থেকে শুরু হল হাতের বাম দিকে কিলিমানজারো পাহাড়ের শ্রেণি। হাতের ডান দিকে পড়ল উপত্যকা। প্রায় সাড়ে চার ঘন্টা ধরে আমাদের বাসটি কিলিমানজারো পর্বত শ্রেণিকে বাম দিকে রেখে চলল। পাহাড়ের কোল ঘেঁসে চলছে আমাদের বাস। পাহাড়গুলোকে একটি চেয়ে অন্যটিকে উঁচু মনে হচ্ছিল। দক্ষিণ সুদানের মতো ল্যাংটা নয় পাহাড়গুলো। সবুজের সমারোহ সবখানে। তবে এগুলোকে দুর্গম মনে হল না। হয়তো চেষ্টা করলে এগুলোতে আরোহণ করা যাবে। পাহাড়ের পাদদেশে গড়ে উঠেছে গ্রাম। চার চালার টিনের ঘর। দেয়ালগুলো মাটির তৈরি। তবে অনেক স্থানে তিন চালার বাড়িও দেখলাম। কিছু কিছু বাড়ি বেশ মনোরম করে তৈরি করা। রাতার ডান দিকের উপত্যকার ভূমি অনেকটাই উর্বর মনে হল। ভুট্টা, সূর্যমুখী এবং অনেক স্থানে গমের আবাদও আছে। মাইলের পর মাইল ডান দিকে অনুন্নত উপত্যকা।

বিকালের দিকে একটি হোটেলে আমাদের গাড়ি থামল। নাম হল লিভারপুল হোটেল। কিন্তু হোটেলটি তেমন উন্নত নয়। বাংলাদেশের ঢাকা-রংপুর বা ঢাকা-চিটাগাং রোডের পাশের হোটেলগুলো এর চেয়ে বহুগুণে উন্নত। হয়তো যাত্রীবাহি বাসের স্বল্পতার জন্যই এমন দুর্দশা হোটেলগুলোর। এখানে মুরগী ভাজি, ভাত ইত্যাদি পাওয়া যা। কিন্তু তারা ডলার নেয় না। আর আমার সাথে যে তানজিনিয়ান শিলিং আছে তাতে পেটপুরে খাওয়ার মতো কোন কিছুই কেনা সম্ভব নয়। আমি অগত্য দুই হাজার শিলিং দিয়ে পানির বোতল কিনলাম একটা। কারণ পেটে দানা না পড়লেও কয়েক দিন বাঁচা যাবে। কিন্তু পানি ছাড়া বাঁচা সম্ভব নয়।

আনারস নয় বোঙ্গার বাগান
আবার চলল গাড়ি। কোন সময় দারুস সালাম পৌছিঁব তা কারো কাছ থেকেই সঠিকভাবে জানা যাচ্ছে না। সবাই উল্টাপাল্টা কথা বলে। এ সময় জানালার পাশ দিয়ে দেখলাম একগুলো আনারসের বাগানের মতো। কিন্তু একটু ভাল করে লক্ষ করলাম। এগুলো আসলে আনারস নয়। এগুলো হল এক প্রকার কাঁটার ঝাড়। এগুলোকে আমরা স্থানীয় ভাষায় বলতাম বোংগা। সাধারণত ক্ষেতের বেড়ার জন্য ক্ষেতের আলে এগুলো রোপন করলে এদের ঘৃতকুমারীর পাতার মতো পাতার শীর্ষভাগের কাঁটার জন্য গরু-ছাগল ও মানুষও প্রবেশ করতে পারত না। তবে এগুলোর পাতা থেকে যে পাটের মতো আঁশ পাওয়া যায় সেটা তখনও আমরা জানতাম। আমি নিজেও এগুলো থেকে আঁস বের করে ছোটবেলায় রসি তৈরি করেছি। এ রসি পাটের রসির চেয়ে অনেক বেশি টেকসই হয়। কিন্তু এগুলোর বাণিজ্যিক চাষ আমাদের কল্পনায় আসেনি।

আমার পাশের তানজানিয়ান বালিকাকে জিজ্ঞাস করলাম, এগুলোর স্থানীয় নাম কি। কিন্তু সে আগাগোড়াই একটা শহুরে মেয়ে। আবাদ-সুবাদের সে কিছুই জানে না। তরে তার এক বন্ধু বলল, এগুলোর স্থানীয় নাম ' সাইসল'। আমি পরে নেট ঘেঁটে দেখলাম, এগুলোর বোটানিক্যাল নাম হল Agave sisalana। তার মানে এরা সঠিক নামটিই বলে। তবে বাংলাদেশে এগুলোর প্রমিত বাঙালি নাম কি তা আমি নিজেও জানি না। এই তানজানিয়ার কিলিমানজারো পাহাড়ের পাদদেশে এই বোঙ্গারই বাণিজ্যিক চাষ করা হচ্ছে। হাজার হাজার একর জায়গা জুড়ে এর চাষ হচ্ছে। এক স্থানে দেখলাম একটি কারখানা আছে যেখানে এই আঁস ছড়ান ও প্রক্রিয়া জাত করা হয়।

আরো পরে বিস্তারিত জানলাম। এগুলো কেবল আফ্রিকাতেই নয়, দক্ষিণ আমেরিকাতেও চাষ করা হয়। তবে পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি আবাদ হয় ব্রাজিলে। আর দ্বিতীয় স্থানে আছে তানজানিয়া। বাংলাদেশে পাট দিয়ে যা যা তৈরি করা যায়, এখানে সাইসল দিয়ে তার সবই তৈরি করা হয়। তবে একটি বাড়তি উৎপাদন হল বিদ্যুৎ। তানজানিয়ার উৎপাদিত সাইসলে প্রায় ২-৫% বায়ো টেকনোলোজিতে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়।

আমাদের বেড়ার বোঙ্গা যে এতটা উপকারী উদ্ভিদ তা তানজানিয়ায় না আসলে জানতেই পারতাম না। তবে পাটের বিকল্প যে এগুলোর কোনটাই নয়, সেটা হলফ করে বলতে পারি।কিন্তু আফ্রিকার অনুর্বর উচ্চভূমিতে তো আর পাট চাষ সম্ভব নয়, তাই এই সাইসল বা বোঙ্গাই তাদের শেষ ভরসাস্থল।কারণ যে ঘরে মানুষ জন্মায় সেটা নির্মান থেকে শুরু করে যে কবরে মানুষ যায়, সেখানে পরিবহনের জাকলাখানা তৈরি করতেও রসির দরকার যা মূলত পাট বা সাইসল থেকেই আসে।

হোটেল রঙ্গুয়ে প্যালেস
দারুস সালাম পৌছিতে আমাদের বাজল রাত দশটার মতো। ঐ সময় আমার চোখ ঘুম ঘুম করছিল। তবে বুঝতে পারছিলাম শহরটা কম বড় নয়। বেশ সিমসাম মনে হচ্ছিল। রাস্তার দুই পাশে বিজলিবাতিগুলোও মনোরম ছিল। বাসে যাত্রী ওঠা ও নামানোর জন্য রাস্তা রপাশে বিশেষভাবে তৈরি টিকিট কাউন্টার ও যাত্রী বিশ্রামাগার আছে। শহরে ঢোকার অল্প পরেই আমাদের গাড়ি খালি হয়ে গেল। শেষ পর্যন্ত আমরা তিন শান্তিরক্ষী বাসের সবশেষ গন্তব্যে নেমে পড়লাম।

এবার আসল রাত্রি যাপনের বিষয়। আমরা কোন হোটেল বুক করিনি। কোনটা ভাল, আর কোনটা মন্দ সেটা বাছ বিচারের সময় সেটা ছিল না। আমরা চাইছিলাম একটি মোটামুটি কম দামের ভাল হোটেল। একজন দালালের আবির্ভাব হল। সে আমাদের কাছের একটি হোটেলে নিয়ে গেল। হোটেলের নাম রোঙ্গুয়ে প্যালেস। প্যালেস শব্দের অর্থ রাজ প্রাসাদ । কিন্তু নামের বাহার যাই হোক এ হোটেল রাজ প্রসাদ ছিল না।

আমাদের সিঙ্গেল রুমের ভাড়া নিল ৪০ ডলার করে। কিছু করার ছিল না। আমার সাথের উরুগুয়ে-প্যারাগুয়ানরা এটাই পছন্দ করল। প্রত্যেকই সিঙ্গেল রুম নিলাম। আমাকে দেয়া হল ৬ তলার একটি রুম। কিন্তু সেখানে এসিটা ভাল ছিল না। রুমে গন্ধও ছিল। এখন চলছে টুরিজমের জন্য মন্দা সময়। তাই হোটেলগুলোর সিট প্রায় ফাঁকা থাকে। আমরা দরকষাকষি করলে হয়তো এটা ত্রিশ ডলারে নামিয়ে আনতে পারতাম। কিন্তু সেটা করা হয়নি। আমি অভিযোগ জানানোর জন্য ইন্টারকম খুঁজলাম। একটা ফোন আছে। কিন্তু সেটা মৃত। তাই বাধ্য হয়ে নিজেই রিসিপশনে এসে অভিযোগ দিলাম। ওরা বলল, একজন ইলেকট্রিসিয়ান আসবে। কিন্তু সে এলা না। তাই পুনর্বার গিয়ে তাদের রুম টা পরিবর্তনের অনুরোধ করলাম।

এখন আট তলার একটি রুমে উঠলাম। এসি সঠিক পেলাম বটে। কিন্তু রুমের গন্ধটা আগেরটার চেয়েও উৎকট মনে হল। আমি কিছু এয়ার ফ্রেসনার দিতে বললাম। ওরা বলল, স্টকে নেই। কি আর করা যাবে। গন্ধের মধ্যেও ক্লান্ত শরীরে ঘুমিয়ে পড়লাম।