এসপি বাবুলের জন্য আমাদের কী সান্ত্বনা আছে?

মোঃ আব্দুর রাজ্জাক
Published : 5 June 2016, 08:36 PM
Updated : 5 June 2016, 08:36 PM

দক্ষিণ সুদানের স্থানীয় সময় ভোর সাড়ে পাঁচটার দিকে ঘুম থেকে উঠে বরাবরের মত বিডিনিউজ টুয়েন্টি ফোর ডট কম ব্লগে পরখ করছিলাম আমার পাতাগুলো। প্রত্যেক পাতার শেষ দিকে দেয়া থাকে ঐ অনলাইন পত্রিকার খবরের শিরোনামগুলো। বরাবরের মতোই চোখ রেখেছিলাম শিরোনামগুলোতে। কিন্তু প্রথম খবরটিতেই আটকে গেল চোখ। চট্টগ্রামে এসপি বাবুল আখতারের স্ত্রীকে দুর্বৃত্তরা গুলি করে হত্যা করেছে। নিজের চোখকেই যেন বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। একি আমাদের ২৪ তম বিসিএস ব্যাচের বাবুলের স্ত্রীরই হত্যার খবর, না অন্য কারও। বুকের ভিতরটা কেমন যেন মোচড় দিয়ে উঠল।

খুললাম মূল পত্রিকা। পড়লাম সবটুকু। তবে তখনও খবরটি ছিল সামান্যই। আরো কিছু পরে পাওয়া গেল বিস্তারিত। হ্যা, ইনি আমাদের সেই চৌকস বাবুলেরই স্ত্রী। এখন মরহুম। সনত্রাসীগন কর্তৃক নির্মমভাবে নিহত।

প্রতিদিনের মতো তিনি তার ৭ বছরের ছেলেকে স্কুলের বাসে তুলে দেয়ার জন্য চট্টগ্রাম নগরীর জিইসি মোড়ে আসেন। সেখানেই সন্ত্রাসীরা তার কাছ থেকে বাচ্চাটাকে আলাদা করে। এরপর তাকে কোপাতে থাকে। তিনি মাটিতে পড়ে যান এবং সন্ত্রাসীগণ তাকে গুলি করে দ্রুত ঘটনাস্থল থেকে সরে পড়ে।

অবুঝ সন্তানের সামনে মায়ের খুন হওয়ার অনুভূতি কেমন তা আমি জানি না। কিন্তু আমার নিজের বাচ্চাদের মুখ যখন এসপি বাবুল আখতারের বাচ্চাগুলোর সাথে মিলিয়ে দেখি তখন ভিতর থেকে কান্না চলে আসে। নিজেকে প্রবোধ দিতে পারি না।

বাবুল আখতারের স্ত্রী যে তার স্বামীর কর্মকাণ্ডের বিপরীতে সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর প্রতিহিংসার শিকারে পরিণত হয়েছেন, সেটা সহজেই অনুমান করা যায়। কেউ কেউ বলেন, অনুমান না, এটা জানা কথা যে বাবুল আখতার জঙ্গি-সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে যে অভিযান পরিচালনা করেছেন, তার এ সামান্য কয়েক বছর আইন প্রয়োগ পেশায় তিনি যা যা করেছেন, তার সবগুলোর জন্যই সন্ত্রাসীগণ তার উপর ক্ষ্যাপা ছিল। তাই তার উপর হামলার একটা আসঙ্কা হয়তো ছিল।

কিন্তু পুলিশ পেশার সাথে সম্পূর্ণ সম্পর্কহীন তার নির্দোষ স্ত্রীর উপর সন্ত্রাসীগণ এ জঘন্য হামলা চালাবে, নিষ্পাপ শিশুর সামনে তার জননীকে হত্যা করবে এমনটি ভেবেছিল কে?

পেশাগত ও ব্যক্তি জীবনে এসপি বাবুল আখতার একজন সৎ, সজ্জন, নিষ্ঠাবান ও মেধাবী মানুষ। পুলিশ সম্পর্কে আমাদের সমাজের বিশ্বাস ও পূর্বসংস্কারগুলো অবশ্য একজন পুলিশ অফিসারকে এমনরূপে দেখতে অভ্যস্ত নয়। তাই তো গণমাধ্যম ও সোসাল মিডিয়ায় বাবুলের প্রসংশা করে যখন খবর ও স্টাটাস বর্ষণ চলে তখন আমার ম্যাজেন্জারে একজন লেখক বন্ধু জানতে চেয়েছিলেন, এসপি বাবুল আসলে কি এমন সৎ, নিষ্ঠাবান ও পারঙ্গম অফিসার? আমি তাকে প্রত্যুত্তরে লিখলাম– বাবুল আমার তিন ব্যাচ জুনিয়র। তাই সে আমাকে সেলুট করে। কিন্তু মাঝে মাঝে তার সততা, নিষ্ঠা আর সাফল্য দেশে মনে হয়, আমি আগেই তাকে সেলুটটা মেরে দেই। He is just a wonder boy of Bangladesh Police. আমর সেই বন্ধুটি অবাক হয়ে এ হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে কিছু লেখার অঙ্গীকার করলেন।

বাবুলের চাকরির বড় অংশটাই কেটেছে চট্টগ্রাম অঞ্চলে। কখনো চট্টগ্রাম জেলায়, কখনও কক্সবাজার জেলায় আবার কখনও বা চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশে তিনি কর্মরত ছিলেন। চট্টগ্রামের হাটহাজারি সার্কেলের এএসপি হিসেবে তিনি এতটাই জনপ্রিয় ও নির্ভরযোগ্য ছিলেন যে তাকে সেখান থেকে একবার অন্যত্র বদলি করার পর, সেই আদেশ বাতিল করে পুলিশ কর্তৃপক্ষকে সেই সার্কেলেই পোস্টিং দিতে হয়েছিল। না, বাবুল কোন তদবির বা কর্তৃপক্ষের উপর কোন চাপ সৃষ্টি করে নি। কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে একটি পোস্টিং প্লেসে থেকে যাওয়ার লোক সে নয়। তার কাছে সব পোস্টিংই সমান, সব কর্মস্থলেই সে সাফল্য লাভ করতে পারে। তাই, তদবির বা ক্ষমতার জন্য নয়, জনদাবিকে সম্মান দেখিয়েই পুলিশ কর্তৃপক্ষ তা করেছিল।

সম্প্রতি পদোন্নতি পেয়ে বাবুল আখতারের পোস্টিং হয়েছে পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সে। মাত্র তিন দিন আগেই তিনি চট্টগ্রামের ভাড়ার বাসায় স্ত্রী-সন্তান রেখে ঢাকায় আসেন। এসময় তার পরিবার কি ভেবেছিল, যে তার অনুপস্থিতিই তাদের জন্য কাল হয়ে যাবে? বাবুল আখতারের নাবালক সন্ত্রানদের বিশ্বাস বাবুল তাদের সাথে থাকলে সন্ত্রাসীগণ তাদের মাকে হত্যা করতে পারত না। তাদের বাবা সন্ত্রাসীদের প্রতিহত করতেন।

হ্যাঁ, এ বিশ্বাস অমূলক নয়। আমার সন্তানগণ আমার প্রতি এ ধারণা পোষণ করে বলে মনে হয় না। কারণ ১৫ বছরের এ পুলিশ পেশায় আমার কোন সাহসিকতার পুরস্কার নেই। তাই আমার সন্তানগণ আমাকে একজন সৎও নিষ্ঠাবান পুলিশ অফিসার মনে করলেও আমাকে সাহসী পুলিশ অফিসার হিসেবে বিশ্বাস নাও করতে পারে। কিন্তু বাবুলের তিন তিনটি সাহসীকতার পুরস্কার আছে। তার কর্তব্য নিষ্ঠা, মেধাবী ও সাহসীকতাপূর্ণ কর্মকাণ্ডের বাৎসরিক আমলনামা হাতে নিলে তাকে পুরস্কার না দিয়ে পারা যায় না।

হ্যাঁ, বাবুলের স্ত্রীর হত্যাকাণ্ডে বাবুলে সাহসিকতার এমন গান গাইছে কেন, সেটা অনেকেই প্রশ্ন করতে পারেন। কিন্তু তার স্ত্রীর হত্যাকাণ্ডটি যে বাবুলের সাহসিকতার প্রতিক্রিয়া বা প্রতিশোধ স্বরূপই। কি অপরাধ করেছিলেন, সেই গৃহবধু যে তার স্বামীকে ভালবেসেছিলেন, তাকে নিয়ে শুধু গর্বই করতেন? এ স্ত্রীলোকটি তো আমারও ফেইসবুক ফ্রেন্ড নয়, তার কোন লেখাও আমার চোখে পড়েনি। তিনি কোন একটিভিস্টও ছিলেন না। তিনি যে রীতিমত ধর্মপ্রাণ ও পর্দানশীল মহিলা ছিলেন, সেটাতো তার নিহত হওয়াকালীন পরিহিত পোশাক দেখলেই বোঝা যায়। তবে তার প্রতি যাদের আক্রশ, যারা তাকে নির্মমভাবে হত্যা করল, তারা বাবুলের জন্যই তাকে হত্যা করেছে, সে বিষয়ে কোন সন্দেহ আছে কি?

পেশাগত জীবনে বাবুল হাজারও আমজনতার বন্ধু। মাঠ পর্যায়ে দায়িত্ব পালনকালে তিনি কেবল চিহ্নিত সন্ত্রাসীই গ্রেফতার করেননি, কেবল যোগসূত্রহীন ডজন ডজন অপরাধ উদ্ঘাটনই করেননি, তিনি অসহায় মানুষকেও নির্দিধায়, নির্ভয়ে, নিঃস্বার্থভাবে সেবা দিয়ে যান। তার প্রত্যেকটি কর্মস্থলে তাই তার হাজার হাজার গুনগ্রাহী আমজনতা রয়েছে। পুলিশের সেবাপ্রার্থী মানুষটি একবার বাবুলের টেবিলের সামনে যায়, যে ভুক্তভোগী বাবুলকে একবার তার ভোগান্তির কথা বলেন, তারা আর কোন দিন বাবুলকে ভোলেন না। একইভাবে তার সহকর্মীদের প্রতিও এমন কথা খাটে।

আমি বাবুলের সাথে কোন দিন কাজ করিনি। তবে নানাভাবে বাবুলের সেবা নিয়েছি। তিন বছর পুলিশ সংস্কার কর্মসূচিতে কাজ করতে গিয়ে তার কর্মক্ষেত্রে আমাকে কযেকবার করে যেতে হয়েছে। আমাকে একজন সিনিয়র হিসেবে বাবুল যে সম্মান দেখিয়েছে, সেটা মনে রাখার মতো। আমার লিখিত বইগুলো বাবুল স্বেচ্ছায় ক্রয় করে তার অধীন অফিসারদের মাধ্যমে বিতরণ করেছে। তবে এগুলো কেবল আমার প্রতি অনুগ্রহ করার জন্যই ছিল না, এটা এজন্য করেছিল যে বইগুলো তার অফিসারদের পড়া দরকার ছিল।

বাবুল সারা পুলিশ বাহিনীর জন্য একজন অনুসরণীয় সান্তনা। কিন্তু এখন বাবুলের জন্য পুলিশের কী সান্ত্বনা আছে? তার এ ক্ষতি কিভাবে পূরণ সম্ভব? বাবুলকে এক বছরের মাথায় আর একটা পদোন্নতি দিলে কি তার এ ক্ষতিপূরণ হবে? তার বাচ্চাদের জন্য কেটি খানিক টাকা বরাদ্দ করলে কি তারা সান্ত্বনা পাবে?

আজ বাবুল তাদের যেসব সহকর্মীদের জাড়িয়ে ধরে কাঁদছেন, তাদের কাছে বাবুলের জন্য দুটোমাত্র প্রদেয় বস্তু আছে। প্রথমটা হর অজস্র ফোটা চোখের জল। কিন্তু যতই চোখের জল আমরা ফেলি না কেন, সেটা কি বাবুল কিংবা তার নিষ্পাপ বাচ্চাগুলোর ফেলান চোখের জলের সমপরিমাণ হবে? তার বুকের বেদনাকি অন্যের বুক দিয়ে অনুভব করা যাবে? না তা অসম্ভব।

এখন থাকে দ্বিতীয় বস্তুটি। সেটা কি? এটা হল, বাবুলের স্ত্রীর হত্যাকারী ব্যক্তি ও গোষ্ঠীদের এমনভাবে শনাক্ত করা যাতে তাদের যথাযথ বিচারে দোষী সাব্যস্ত করে শাস্তি নিশ্চিত করা যায়।

আমি বলব না, বাবুলের স্ত্রীর ক্ষেত্রে যা ঘটেছে তার ফলে গোটা বাংলাদেশ পুলিশের সদস্যদের পরিবার ভীত, সন্ত্রস্ত। না, এটা কখনই নয়। কেবল বাংলাদেশ পুলিশেই নয়, গোটা বিশ্বের পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের পরিবার পরিজন যে কোন সময় যে কোন অনাকাঙ্খিত পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত থাকেন। সরকারের মাধ্যমে জনগণ পুলিশকে ঝুঁকি ভাতা দেন। বাবুলের স্বর্গীয় স্ত্রী প্রমাণ করে দিয়েছেন যে কেবল পুলিশ সদস্যরাই নয়, তাদের পরিবার পরিজনও ঝুঁকির মধ্যে আছেন। যারা নিরন্তর ঝুঁকির মধ্যে থাকেন, তাদের ভীতু হবার কি আছে? তারা বস্তুত ও কার্যত সারাক্ষণই সাহসী।

পেশার পরিবেশ ও ঝুঁকির ধরনই তাদের অন্যান্য নাগরিকদের চেয়ে সাহসী করে তোলে। বাবুলের স্ত্রী তার মৃত্যুর মাধ্যমে বাংলাদেশের পৌনে দুই লাখ পুলিশের পরিবারের সাড়ে পাঁচ লাখ সদস্যকে কেবল সতর্কই করে যাননি, সচেতন করেও গেছেন, করে গেছেন তাদের আরো এক ধাপ সাহসী।( ০৫ জুন, ২০১৬. ইউএন হাউজ, জুবা, দক্ষিণ সুদান)