ঘুরে এলাম তানজানিয়া (৫ম কিস্তি- মসলা সফর)

মোঃ আব্দুর রাজ্জাক
Published : 1 July 2016, 06:44 PM
Updated : 1 July 2016, 06:44 PM

১৮ মে, ২০১৮। জানজিবারে এসেছি বেড়াতে। হোটেলে থেকে আরাম আয়েস করার জন্য নয়। কিন্তু আমি এখানে সঙ্গিহীন। আর এ সময়টি পর্যটনের জন্য মন্দার মওসুম। এসময় পর্যটকের সংখ্যা থাকে সবচেয়ে কম। তাই অন্যদের সাথে ভাগাভাগি করে দর্শনীয় স্থানে ভ্রমণ করা অনেকটাই অসম্ভব। হোটেলের লবিতে একটি চার্টে ডলফিন ড্রাইভ, প্রিজন আইল্যান্ড ভ্রমণ, সিটি টুর, ইস্টকোস্ট টুর ইত্যাদির জন্য একজন বা দুইজনের ভাড়ার হিসেব দেয়া আছে। এখানে কোন সাটল বাসের ব্যবস্থা নেই। তাই ট্যাক্সি করে এককভাবে যেতে হবে। এগুলোর কোনটির খরচই ৩৫ ডলারের কম নয়।তবে একটি মাত্র টুর আছে যেখানে সাটল বাসের ব্যবস্থা আছে। দাম মাত্র জনপ্রতি ১৫ ডলার। এটার নাম হল স্পাইস টুর। মি এটার নাম দিলাম, সমলা সফর।আমি গতকালই তা বুক করে রেখেছিলাম।

সকাল নয়টার সময় আমি হোটেল লবিতে নামলাম। দেখি টুরে যাবার জন্য একটি সুইডিস পরিবারও প্রস্তুত। হ্যান্স নামের সাদা চামড়ার এ ভদ্রলোক তানজানিয়ায় মিশনারীর চাকরি করে। তিনি এখানেই থাকেন। তার পরিবার এখানে বেড়াতে এসেছে। তার স্ত্রী পিয়ারের সাথে আছে দুই ছেলে। জানতে পারলাম তাদের নাকি আরো দুটো ছেলে যাছে যাদের মধ্যে একজন বর্তমানে নেপালে আছে। কিছুদনি আগেক সে বাংলাদেশে ছিল। অল্প সময়ের মধ্যেই হ্যান্স ও তার পরিবারের সাথে আমার হৃদ্যতা হল।


জানজিবার হল মসলার দ্বীপ। তাদের মসলা উৎপাদন ও রপ্তানির ইতিহসা প্রায় শত বছরের্ ইন্দোনেশিয়ার মালাক্কা দ্বীপের পরেই মসলার জন্য এ দ্বীপের খ্যাতি। এখানে বড় বড় মসলার খামার আছে। এগুলো সরকারি, সেবরকারি উভয় খাতেই আছে। পর্যটন এলাকা হওয়ায় এসব মসলার খামার ভ্রমণ করাও একটা বৈদেশিক মূদ্রা কামানোর ওসিলা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

একজন ভদ্রলোক এলেন আমাদের নেয়ার জন্য। আমরা তার সাথে গলির ভিতর দিয়ে হাঁটতে থাকলাম। একটু পরে ওরা আমাদের একটি ছোট ট্রাভেল এজেন্সির অফিসে নিয়ে গেল। অফিসটি অত্যন্ত ছোট। আমাদের অফিসের বাইরে রাস্তার ধারে পাটি পেতে বসতে দিল। স্থানীয় জানজিবারিয়ানগণ নাকি এভাবেই পাটির উপর অতিথিদের বসতে দেয়। এখানে বসেই আমি ছবি তোলার প্রক্রিয়া শুরু করে দিলাম। হ্যান্সের ছেলে সাইমনের হাতে স্মার্ট ফোন দিয়ে ওকে ছবি তোলা ও ভিডিও করার অপশনগুলো দেখিয়ে দিলাম। বেশ চালাক চতুর ছেলেটি। অল্প সময়ের মধ্যেই সে সব রপ্ত করে নিল। এর পর সেআমার জন্য বেশ কয়েকবার ক্যামেরাম্যানের কাজ করেছে।

অল্প পরেই একটি মাইক্রোবাস এলে আমরা তাতে উঠে পড়লাম। এখানে একটি ছোট মেয়ে বাচ্চাসহ এক আমেরিকান কৃঞ্চাঙ্গ মহিলা আমাদের সাথে যোগ দিল। বাচ্চাটির নাম অত্রি। মহিলার নাম লিস্টার। সে নাকি মিয়ামীতে একটি বিউটি পারলার চালায়। তার সাথে একজন কেনিয়ান পুরুষ রয়েছে। সে তার কেমন যেন আত্মীয় হয়। বুঝতে পালাম, সে বা তার পরিবার কেনিয়া থেকে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমিয়েছিল কোন সময়। তার গায়ের রংটা অনেকটা রেড ইন্ডিয়ানদের মতো। কেবল মাথার চুলের আকাল ছাড়া আমার চেয়েও সে ফর্সা। আর বাচ্চাটা তো কোঁকড়া চুল নিয়ে অনেকটাই স্বেতাঙ্গ চেহারা লাভ করেছে। পরবর্তীতে এই আমেরিকান লিস্টারের সাথে বেশ খাতির জমেছিল।

অত্যন্ত চমৎকার একটা ভ্রমণ। মাত্র ১৫ ডলারের বিনিময়ে ওরা একটি মসলার ফার্মে নিয়ে গেল। সেখানে নানা জাতের মসলার গাছ/চারা দেখাল। অনেক ফল খাওয়াল। একই সাথে মসলার স্বাদও নিলাম। দারুচিনি, এলাচ, লং, জয়ফল, জায়ত্রীসহ নানা ধরনের মসলা। এর সাথে ছিল নানা প্রকর ওষুধি গাছ। এটাকে ওরা মসলার দ্বীপ বলে কিন্তু অধিকাংশ মসলাই বাইরে থেকে আসা। ইউরোপ, আমেরিকা এবং সিংহভাগ্ এসেছে এশিয়া থেকে। আর এশিয়ার সেই অঞ্চলটা যে মালাক্কা সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই।

সফর শুরু হল নারকেল বাগান দিয়ে। আমাদের গাইড নারকেলের উৎপত্তিসহ গুনাগুণ বর্ণনা করল। তার পর কাসাভা খেত। কিন্তু এগুলো আমার জন্য ছিল এক ঘেয়েমিপূর্ণ। তবে একটু পরেরই শুরু হল মজাদার ভ্রমণ।

ছোট ছোট এলাচ হলুদের গাছের মতো গাছের গোড়া থেকে কচুর লতির মতো বের হয়। সেই লতিতে ছোট ছোট ফুল ফোটে। সেখানেই ধরে এ ছোট সাদা এলাচ। এগুলোর চারা রোপন থেকে শুরু করে প্রক্রিয়াজাতকরণ সব কিছুতেই মহা ঝামেলা। আর ফলন হয় সামান্যই। তাই তো এগুলো এত দামি।

লং গাছে এই মাত্র ফুল আসছে। কিন্তু এগুলো এত দামি যে চাষিরা ইচ্ছা করলেও সরকার ছাড়া আর কারো কাছে তা বিক্রয় করতে পারে না। এ ব্যবসার পুরোটাই সরকার নিয়ন্ত্রণ করে।

আদার গুণাগুণ বর্ণনা করে, আমাদের বাগান থেকে কাঁচা আদা খাইয়ে নিল হলুদ বনে। এখানেও চলল গুণাগুণ বর্ণনা। হলুদ নাকি ক্যানসার প্রতিরোধ করে। এক নরওজিয়ান লেডি তো হলুদ নিয়ে খাওয়া শুরু করল। সে মনে করেছে এগুলো আদার মতোই একটা কিছু হবে। কিন্তু অল্প পরেই বুঝল, হলুদ আদার মতো চিবিয়ে স্বাদ নেবার কোন বস্তু নয়। হলুদের কাজ হল তরকারীতে আকর্ষণীয় রঙ তৈরি করা।

দেখলাম ভেনিলা লতা। এদের ডালে সিমের মতো ফল ধরে। সেই ফল থেকেই তৈরি করে ভেনিলার সেন্ট বা এসেন্স যেগুলো আমরা চকোলেট, পেসট্রি কিংবা আইসক্রিমে ব্যবহার করি। কোকা গাছ দেখান হল। কাঁঠালের মতো এগুলো কাণ্ডে কাণ্ডে ধরে আছে। শুকনো হরিতকির মতো আকার। এই প্রথম কোকা গাছের গোড়ায় বসে কোকা স্পর্শ করে দেখলাম।

কামরাঙ্গা, জাম্বুরা, মাল্টা গ্রেইপস ফ্রুটসহ আরো কিছু ফল ওরা বাগান থেকে পেড়ে খাওয়াল আমাদের। কামরাঙ্গা খাইয়ে অনেকে মন্তব্য করল, এটাই তাদের জীবনে প্রথম জাম্বুরা খাওয়া। রুটি ফলের গাছ দেখলাম। আগে ভেবেছিলাম, হয়তো বা রুটির মতো কোন ফল হবে। কিন্তু এগুলো ডাউয়া ফলের মতো। তবে সবজির মতো রান্না করে খায়। আমি খাইনি।(ইউটিউব লিঙ্ক)

এক ফাঁকে আমাদের নিয়ে যাওয়া হল একটি মসলা প্রক্রিয়াজাতকরণ কেন্দ্রে। এখানে মসলা থেকে না না প্রকার সেন্ট বা এসেন্স তৈরি করা হয়েছে। ভেনিলা এসেন্স, লিমন গ্রাসের তেল, কালো জিরার তেল। তামও সস্তা। আমি একটি ভেনিলা এসেন্স কিনলাম। এ কেন্দ্রের উঠানে চাষ করা হয়েছে গোল মরিচ। আমাদের দেশের সিলেট অঞ্চলের খাসিয়া পানের মতো এগুলো গাছ বেয়ে বেয়ে উঠেছে। পিপুলের পাতার মতো পাতা। মরিচও ধরে তেমন করে। এগুলো গাছ থেকে তুলে জড়ো করা তারপর প্রক্রিয়াজাত করাও শ্রম সাপেক্ষ। এখানে একটি রামবুতানের গাছে লোমস লোমস রাম বুতান ধরে আছে। রামবুতানের গাছ ও পাতা লিচুর পাতার মতো। অনেকে বলল, এটাকে নাকি লিচুও বলা হয়। কিন্তু আমি বিষয়টিতে দ্বিমত পোষণ করে লিচুর সাথে এর পার্থব্য বুঝিয়ে দিলাম।

অন্যএক স্থানে আমাদের প্যাকেট করা মসলা কেনার জন্য নিয়ে যাওয়া হল। ছনের চালা দেয়া একটি বাংলাঘরে প্যাকেট করা জিরা, গোল মরিচ, গুড়া আদা, হলুদ ইত্যাদি বিক্রয় করা হচ্ছে। আমি প্রতি প্যাকেট তিন হাজার শিলিং দরে জিরা ও গোল মরিচের তিনটি প্যাকেট কিনলাম। খুচরা মূল্যেও বাংলাদেশের চেয়ে অনেক কম দাম।

দুপুরে আমাদের নিয়ে যাওয়া হল একটা গ্রামের বাড়িতে। একটি গ্রাম্য মধ্যবিত্ত বাড়ির মতো বাড়ি। সামান্যই আসবাব পত্র আছে ঘরে। এ বাড়িতে আমাদের গার্হস্থ্য পরিবেশে দুপুরের খাবার খাওয়ান হল। পোলাও, নারকেলের দুধ দিয়ে তৈরি করা টমেটো ও আলুর তরকারি, ছিল একটি শাক। গোটা খাবারটাই স্থানীয় মসলা দিয়ে রান্না করা। ঘরের মেঝেতে পাটিতে বসে খেলাম। মাগো!!কী চমৎকার রান্না। আজ ছয় দিন হল ভ্রমণে আছি। জান্জিবারের স্থানীয় মসলা দিয়ে রান্না করা এ নিরামিস খাবার আমার কাছে অমৃতসম মনে হল। মনে হল, এক সপ্তাহ পরে কিছু একটা তৃপ্তিসহ খেলাম। যদি বাইরের হোটেলে এ খাবারটি খেতাম তবে ১৫ ডলারই খরচ করতে হত।(You Tube Link)

ও হাঁ কিছু মসলা কিনলাম। প্রতি প্যাকেট তিন হাজার শিলিং করে। এগুলো বউয়ের হাতে দিব। তাকে গর্ব করে বলব, আমি তোমাকে এত ভালবাসি যে জান্জিবার থেকে জিরা নিয়ে এসেও খাইয়েছি। হা হা হা।

কৃতদাসদের গোপনগুহা
দুপুরের খাবারের পর আমাদের নিয়ে যাওয়া হল একটি প্রাচীন গুহা দেখাতে। এ গুহাটি ফুংগুনি সমুদ্র সৈকতে কাছাকাছি। এখানে নাকি দাসদের রাখা হত। ইয়ামেনি আরবগণ জানজিবার দখল করলে, আরব ব্যবসায়ীগণ শুরু করে দাস ব্যবসা। তবে এ ব্যবসায় কেবল আরবগণই নয়, প্রত্যেক দেশের ব্যবসায়ীগণই ভাল লাভ করেছে। এক সময় দাস বলতে আফ্রিকান ক্রীত দাসকেই বোঝান হত। কিন্তু ইংরেজগণ জানজিবারসহ তানজানিয়া দখল করলে দাস ব্যবসার বন্ধ করে দেয়া হয়। কিন্তু ব্যবসায়ীরা তখনও গোপনে গোপনে এ ব্যবসা করত। সরকারের ভয়ে তারা দাসদের লুকিয়ে রাখার জন্য এই গুহা ব্যবহার করত। ঊনবিংশ শতাব্দূর প্রায় পুরোটাই দাস ব্যবসা চলেছে। জানজিবারির ৬৫-৯০ শতাংশ মানুষকেই কোন না কোনভাবে দাস হয়ে রপ্তানী হতে হয়েছিল।

গুহাটা তেমন গভীর নয়। কোরাল পাথরের মাঝখানে অবস্থিত। উঠা নামার জন্য একটি সিঁড়িও আছে। তবে এটা দাস ব্যবসায়ারা নয়, পরবর্তীতে ইংরেজ সরকার তৈরি করেছিল। কারণ এ অঞ্চলে খাবার পানির তীব্র অভাব ছিল। এ গুহার মধ্যে স্বাদু পানি পাওয়া যেত। এ পানি সংগ্রহের সুবিধার জন্যই এ সিঁড়ির ব্যবস্থা। গুহার মূল স্থান থেকে একটি সুড়ং পথ সমুদ্য তীরে গিয়ে লেগেছে। মূলত এ পথেই দাসদের এখানে নিয়ে আসা হত। গুহায় প্রবেশ ফি দুই হাজার সিলিং। গুহাটি যার জমির উপর সেই জমির মালিক পাবে এক হাজার ও সরকার পাবে এক হাজার। একটি মেয়ে এ ফি সংগ্রহ করছে।

ফুংগুনি সমুদ্র সৈকত
গুহা দেখার পরে আমাদের পাশেই একটি ছোট সমুদ্র সৈকতে নিয়ে যাওয়া হল। এখানে সময় পাব এক ঘন্টা। এর মাঝে সমুদ্রে গোসল করা যাবে, সৈকতে রৌদ্রস্নান করা যাবে। আমাদের আগেই একদল সাদা চামড়ার যুবক সৈকতে গোসল করা শুরু করেছে। আমাদের সাথের সাদারাও নেমে গেল জলে। কিন্তু আমি নামলাম না। আমার সাথে গোসল করার মতো পোশাক ছিল না। আমি সমুদ্র সৈকতটা ঘুরে ঘুরে দেখলাম আর সেলফি মোডে স্মার্ট ফোনে ভিডিও করলাম। এক স্থানে বাঁশের তৈরি একগুলো মাছ ধরার যন্ত্র দেখলাম। এদের আকৃতি হৃদপিণ্ডের মতো। আমাদের দেশের ভাইড় বা জঙ্গাই এগুলো তবে আকৃতিতে ভিন্ন। আকারেও বেশ বড়। জোয়ারের সময় এগুলোতে রসি লাগিয়ে সমুদ্রে ফেলে দেয়া হয়। জোয়ারের পানি নেমে যাওয়ার সময় এগুলোতে বড় বড় মাছ আটকা পড়ে।

তীরের একটি বার বা মদের দোকানে গেলাম। একটি বড় রেইনট্রির গাছের এক দিকে দোকানের মতো ডায়েস তৈরি করা হয়েছে। গাছের গুড়তে আংটা বসিয়ে সেই আংটার ভিতর মদের বোতল প্রদর্শন করা হচ্ছে। এখানে আছে ফ্রিজও। প্রচণ্ড পিপাসা পেয়েছিল। আমি দেড় লিটারের একটি পানির বোতল কিনলাম। এখানে পানির দাম আর বিয়ারের দাম সমান। উভয়েরই দাম দুই ডলার করে। এক ঘন্টার মাথায় আমাদের বাসে ফিরে আসার সংকেত দেয়া হল। আমরা হোটেলে ফিরলাম বিকেল সাড়ে চারটার দিকে। ভালই কাটল আজকের দিনটি।(ইউটিউব লিঙ্ক)