জঙ্গি তৎপরতা মোকাবেলায় কয়েকটি হাইব্রিড টিপস

মোঃ আব্দুর রাজ্জাক
Published : 15 June 2016, 07:43 PM
Updated : 15 June 2016, 07:43 PM

২০০৫ সালের ১৭ আগস্টের দেশব্যাপী এক যোগে বোমা হামলার মধ্য দিয়ে দেশের চরমপন্থী ইসলামী জঙ্গিরা যে প্রকাশ্য ধ্বংসাত্মক কার্যক্রম শুরু করেছিল, কিছু সময় তা স্তিমিত বা সুপ্ত থাকলেও সেটা যে একটা নির্দিষ্ট গতিতে চলছেই সেটা আর অস্বীকার করার উপায় নেই। জেএমবি/জেএমজেবি, হরকাতুল জেহাদ ইত্যাদি নামের চরমপন্থী দলগুলোর শীর্ষ নেতারা হয় ফাঁসিতে ঝুলেছে কিংবা ফাঁসির রায়ের দ্বারপ্রান্তে আছে। কিন্তু পুলিশের সফল কার্যক্রমের ফলে প্রথম সারির নেতারা একে একে গ্রেফতার হয়ে বিচারের মুখোমুখী হওয়ার পরক্ষণেই তাদের পরবর্তী সারির নেতারা প্রথম সারিতে চলে এসেছে। এ থেকে প্রমাণিত হয়, জঙ্গিদের নেতৃত্ব ও মোটিভেশনের মাত্রা আমাদের অনুমানের চেয়েও বেশি শক্তিশালী।

দেশে টার্গেট কিলিং এর একটা ছক যে জঙ্গিরা সুচারুরূপে এঁকে ফেলেছে তার আলামত অনেক আগ থেকেই পাওয়া যাচ্ছিল। দেশের বিভিন্ন স্থানে জঙ্গি আস্তানার সন্ধান লাভ , গোপন আস্তানায় বোমার সরঞ্জাম স্তুপীকৃত করা, কোন কোন আস্তানায় বোমা বিস্ফোরণ, কিছু কিছু সন্ত্রাসী ঘটনার ধরনে এটা প্রমাণিত যে জঙ্গিরা একটা পুলিশ-প্রুফ প্রোগ্রাম তৈরি করেছে যা তারা বাস্তবায়ন করেই ছাড়বে।

২০০৫ সালের ১৭ আগস্টের পর থেকে এখন পর্যন্ত জঙ্গিদের বিরুদ্ধে পুলিশের অভিযান ও ব্যবস্থাগ্রহণের কার্যকারিতাকে আমরা কোনভাবেই ছোট করে দেখতে পারি না। সফল তদন্তের মাধ্যমে বিচারিক প্রক্রিয়ায় দেশের শীর্ষ জঙ্গি নেতাদের ইতোমধ্যেই ফাঁসি দেয়া হয়েছে। পুলিশের সামগ্রিক তদন্ত ব্যবস্থা আরো পেশাদার ও আধুনিকায়নের পদক্ষেপ হিসেবে ইতোমধ্যেই পুলিশ বুরো অব ইনভেস্টিগন (পিবিআই) নামের পৃথক তদন্ত সংস্থা তৈরি হয়েছে। কেবল জঙ্গি বিষয়ক তদন্ত, গবেষণা, তথ্য সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও তা কার্যক্ষেত্রে ব্যবহারের দীর্ঘমেয়াদী পদক্ষেপ হিসেবে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশে একটি কাউন্টার টেররিজম ইউনিটও তৈরি করা হয়েছে। যদিও এ ইউনিটটি বর্তমানে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের নিয়ন্ত্রণাধীন থাকবে, তবে একে শিঘ্রই সারা দেশব্যাপী কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য একটি পৃথক ও স্বয়ংসম্পূর্ণ ইউনিট হিসেবে যাত্রা শুরু করতে পারে বলে অনুমান করা যায়।

অবশ্য এ ইউনিটটি তৈরির পূর্ব থেকেই ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ বেশ কিছু গোয়েন্দা আস্তানা থেকে জঙ্গিদের বোমা প্রস্তুতকালীন গ্রেফতার করেছে। অনেক স্থান থেকে পরিত্যাক্ত অবস্থায় বোমা তৈরির সরঞ্জাম উদ্ধার করা হয়েছে। তালিকাভুক্ত জঙ্গিদের গ্রেফতার করা হয়েছে, নেতৃত্বের প্রথম সারিতে আসার সাথে সাথেই তাদের শীর্ষ নেতাদের গ্রেফতার করা হয়েছে। বলা চলে ডিএমপির প্রতিরোধাত্মক একক তৎপরতার কারণে জঙ্গিরা তেমন কোন বড় ধরনের ধ্বংসাত্মক কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারেনি।

তবে এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে জঙ্গিদের কঠিন প্রোগ্রামিং পুলিশের প্রতিরোধাত্মক কৌশলগুলোকে কোন না কোনভাবে এড়িয়ে গিয়ে কিছু হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। কিন্তু আমাদের প্রচারমাধ্যম ও দেশবাসীর কাছে পুলিশের প্রতিরোধাত্মক কার্যক্রমগুলোর কোন পরিসংখ্যান বা প্রচার না থাকায় তারা মনে করছেন যে জঙ্গিরা এত দূর অগ্রসর হল, কিন্তু পুলিশ বা সরকারের অন্যান্য আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো কিছুই করতে পারল না।

এ ধরনের প্রশ্ন করা অবশ্য একদম অস্বাভাবিক নয়। কারণ অপরাধ নিয়ে যারা কাজ করেন, তারা ভালভাবেই জানেন, অপরাধ পরিসংখ্যানে সংঘটিত অপরাধের হিসাবই কেবল আসে। কিন্তু কয়টি অপরাধ প্রতিরোধ করা হয়েছে তার কোন হিসেব থাকে না। কোন স্থানে অপরাধ সংঘটিত না হলে কিংবা বিশৃঙ্খলা না ঘটলে বা মোটামুটি শান্তিপূর্ণ অবস্থা বিরাজ করলে এই শান্তিপূর্ণ স্থিতাবস্থার পিছনে যে পুলিশের নিরন্তর পরিশ্রম রয়েছে সেটা আমজনতার চোখে ধরাই পড়ে না। অথচ অপরাধ সংঘটিত হওয়ার সাথে সাথেই মানুষ মনে করে, পুলিশ কোন কাজই করছে না।

আমার আশঙ্কা, দেশের জঙ্গিরা ইতোমধ্যেই দেশের প্রায় সবগুলো জেলাতেই তাদের তালিকা অনুসারে হত্যাকাণ্ড চালানোর জন্য অপারেটর নিয়োগ সম্পন্ন করেছে। তাই এদের গ্রেফতার কিংবা অন্য কোনভাবে বিরত রাখা না হলে তারা তাদের লক্ষ পূরণ করবেই। এমতাবস্থায়, কোন না কোন ধরনের স্বল্প মেয়াদী বিশেষ অভিযান অবশ্যই জরুরি। কিন্তু সনাতনী অভিযানগুলো হয়তো কয়েক দিন এদের কিছুটা সময় বিরত রাখতে পারবে, কিন্তু এদের কার্যকরভাবে দমন করার জন্য কেবল সনাতনী কৌশলগুলো সম্পূর্ণরূমে সফল হবে না। কিছু দিন পরে তারা আবার তাদের প্রোগ্রাম অনুসারে হত্যাকাণ্ড চালাতেই থাকবে। তাই তাদের নিষ্ক্রিয় করার জন্য সনাতনী পুলিশি ব্যবস্থার বাইরেও কিছু কিছু বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার। নিম্নে আমার প্রেসক্রিপশন তুলে ধরছি। আমার প্রেসক্রিপশনটি কমিউনিটি পুলিশিং ও সনাতনী পুলিশিং এর মিশ্রণ। তাই এটাকে অনেকটা হাইব্রিড কৌশলও বলা যেতে পারে।

আমার প্রেসক্রিপশনটাকে একবাক্যে বলতে বললে বলব কমিউনিটি পুলিশিং কার্যক্রমকে সত্যিকার অর্থে জোরদার করা। তবে কিছু কিছু কাজ বিশেষভাবে করা উচিৎ। প্রথমেই আসবে জঙ্গি দমনের কাজে সাধারণ মানুষকে সম্পৃক্ত করা। এজন্য জনগণের সহায়তায় দেশের প্রত্যেক জেলায় এই প্রোগ্রামকৃত জঙ্গিদের শনাক্ত ও গ্রেফতারের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। প্রত্যেক জেলা ও মেট্রোপলিটন এলাকার শহর ও শহরতলীতে স্থায়ীভাবে কিছু পুলিশ সদস্যকে সাদা পোশাকে নিয়োগ করা যেতে পারে। এরা পালাক্রমে সার্বক্ষণিকভাবেই তাদের নির্ধারিত অঞ্চলে থাকবে। তাদের কাজ হবে প্রতিটি মানুষের সাথে কথা বলা, প্রতিটি বাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানসহ ছাত্র মেস ইত্যাদি পরিদর্শন করা। যেহেতু এত অফিসার সংগ্রহ করা সম্ভব হবে না, তাই জেলার বিশেষ রিজার্ভ(এসএএফ) এবং ওর্ডিনারি রিজার্ভের (থানা ফাঁড়ি) শিক্ষিত চৌকশ কনস্টেবলদের সামান্য ব্রিফিং দিয়েই এ কাজের জন্য উপযুক্ত করে তোলা যেতে পারে।

কাজটি কেন্দ্রীয়ভাবে জেলার বিশেষ শাখার মাধ্যমে মনিটর করা যেতে পারে। তবে প্রত্যেক থানাকে পৃথক পৃথকভাবে এ ব্রিফিংকৃত কনস্টেবলদের ভাগ করে দেয়া যেতে পারে। প্রাত্যহিক ভিত্তিতে এসব নব নিযুক্ত কনস্টেবলদের কাছ থেকে প্রতিবেদন সংগ্রহ করে তা পর্যালোচনা করা যেতে পারে। কাজটি অবশ্যই পুলিশ সুপারের পক্ষে জেলার বিশেষ শাখার ইন-চার্জ (এসএসপি/অতিরিক্ত এসপি) করতে পারেন। যেহেতু সব সিদ্ধান্ত পুলিশ সুপারে মাধ্যমেই আসবে তাই এই কাজের ফলাফল তাৎক্ষণিকভাবে পুলিশ সুপারকে জানাতে হবে।

মেট্রোপলিটন এলাকায় কমিউনিটি পুলিশিং কার্যক্রমকে সত্যিকার অর্থেই শক্তিশালী করতে হবে। ঢাকা মেট্রোপলিটনে ইতোমধ্যেই বিট পুলিশিং চালু করা হয়েছে। প্রত্যেক বিটের দায়িত্বে আছে এক বা একাধিক পুলিশ কর্মকর্তা। এসব কর্মকর্তার অধীন পর্যাপ্ত সংখ্যক অফিসার পদায়ন করতে হবে। আর একটি বড় বিষয় হল, এসব পদে বাছাইকৃত অফিসারদেরই নিয়োগ করতে হবে। তাদের কাজগুলো কি হবে সেটা তাদের বিশেষ ব্রিফিং বা কর্মশালার মাধ্যমে বুঝিয়ে দিতে হবে। এজন্য প্রত্যেক মেট্রোপলিটনের কমিউনিটি পুলিশিং ইউনিটিগুলোতে দক্ষ অফিসার পদায়ন করে এগুলোর কার্যক্রম কাঙ্খিতমানে পৌঁছাতে হবে। প্রয়োজনবোধে এসব ইউনিটের জন্য সারা দেশ থেকে বিশেষ কৌশলে অফিসার বাছাই করা যেতে পারে। পুলিশ কর্মকর্তাদের বুঝতে হবে, জঙ্গি দমনের জন্য ইতোমধ্যেই সনাতনী কায়দায় অনেক কাজ হয়েছে। কিন্তু সেগুলো জনগণকে আস্বস্থ করার মতো তেমন ফল বয়ে আনতে পারেনি। তাই তাদের সনাতনী পুলিশিং কৌশলের পাশাপাশি কমিউনিটি পুলিশিং কার্যক্রমকেও নিরীক্ষার মধ্যে আনতে হবে।

সনাতনী ব্যবস্থার মধ্যে জেলার বিশেষ শাখাকে শক্তিশালী করতে হবে। এটা জেলার ক্ষেত্রে পুলিশ সুপারদের উপরই নির্ভর করে। কারণ ডিআইওদের বিশেষ শাখা কর্তৃক পদায়ন করা হলেও কনস্টেবলসহ অন্যান্যদের পদায়ন করেন স্বয়ং পুলিশ সুপারই। তাই এই গোয়েন্দা শাখাটিকে নিজের মতো করে সাজাতে পুলিশ সুপারের কোন সমস্যা হবার কথা নয়।

বিশেষ শাখার ক্ষেত্রে বিশেষ সমস্যা হল, এ শাখাটিকে কোন পক্ষ থেকেই যথাযথ গুরুত্ব দেয়া হয় না। তাই এখানে অপেক্ষাকৃত অদক্ষ লোকদের পদায়ন করার একটা প্রবণতা লক্ষ করা যায়। কিন্তু অবস্থার প্রেক্ষিতে এখন এটাকে উপেক্ষা করাটা আত্মঘাতী হবে। যদি বিশেষ শাখার ইতিহাস বলে প্রতিষ্ঠার শুরুতেই এখানে সবচেয়ে চৌকশ অফিসারদের পদায়ন করা হত। ব্রিটিশ-বঙ্গীয় পুলিশে এটিই ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শাখা। সারা দেশ/প্রদেশ থেকে বাছাই করা অফিসারদের এনে এখানে পদায়ন করা হত। কিন্তু কালের প্রবাহে এ শাখাকে আমরা অনেকটা অথর্ব করে রেখেছি। দেশব্যাপী সন্ত্রাসী ও জঙ্গি হামলা বা কার্যক্রমের বিস্তার প্রমাণ করে পুলিশের বিশেষ শাখাকে উপেক্ষা করা কোন ক্রমেই উচিৎ নয়।

দেশের অনেক জেলায় দু তিন মাসের মাথায় একই কায়দায় মন্দিরের পুরোহিত হত্যা করা হয়েছে। যদি ঐসব জেলার বিশেষ শাখার দক্ষ তৎপরতা থাকত তবে এই জঙ্গি অপারেটরদের প্রথম ঘটনার পরপরই শনাক্ত করা যেত। যদিও প্রথম ঘটনার পর কিছু জঙ্গিকে গ্রেফতার করা হয়েছিল বলে প্রচারিত হয়েছে, কিন্তু দ্বিতীয় ঘটনা প্রমাণ করে তারা হয় সেই জেলার প্রোগ্রামকৃত জঙ্গি অপারেটরের গায়ে হাতই দিতে পারেনি কিংবা একাধিক জঙ্গি অপারেটরের মধ্য থেকে দু একজনকে গ্রেফতার করলেও অন্যরা এখনও তাদের ধরা ছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেছে।

জঙ্গি অপারেটরদের নির্মূল করতে হলে কেবল পুলিশি কার্যক্রম কোনভাবেই যথেষ্ঠ নয়। জঙ্গি কার্যক্রমটি ফৌজদারি অপরাধ হলেও এর সাথে জড়িত আছে রাজনীতি। কথিত রাজনৈতিক আদর্শকে সামনে রেখেই জঙ্গিরা সামনে অগ্রসর হচ্ছে। তাই বিষয়টিকে মোকাবেলার জন্য পাল্টা রাজনৈতিক তৎপরতা চালাতে হবে। আর এ কাজটি করতে হবে রাজনীতিবিদদেরই। আমার কৌশলগুলো যেহেতু পুলিশি দৃষ্টিকোণ থেকেই রাখছি, তাই এর রাজনৈতিক দিকটি নিয়ে বেশি আলোচনার অবকাশ নেই। তবে এটাকে উপেক্ষা করা হলে, অন্য কোন কৌশলই কার্যকরী ও স্থায়ী সমাধান আনতে পারবে না বলেই আমার বিশ্বাস। ( ১৩ জুন, ২০১৬, ইউএন হাউজ, জুবা , দক্ষিণ সুদান)