সাম্প্রদায়িকতা মানুষের আন্তরিক উপলব্ধি নয়, বহিরাগতদের স্বার্থগত জুলুম

মোঃ আব্দুর রাজ্জাক
Published : 1 Nov 2016, 06:19 PM
Updated : 1 Nov 2016, 06:19 PM

সম্প্রতি ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে ফেইসবুকের একটি স্টাটাসকে কেন্দ্র করে কতিপয় অশিক্ষিত ও কুশিক্ষিত মানুষ হিন্দু মন্দিরে হামলা চালিয়েছে। এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চলছে বড়ই তোলপাড়। বলার অবকাশ রাখে না যে চিন্তাশীল মানুষ মাত্রই এ ঘটনার তীব্র নিন্দা করবেন। এক হিন্দু যুবক তার ফেইসবুক স্টাটাসে নাকি পবিত্র কাবা ঘরের উপর শীবের মূর্তি বসিয়ে দিয়েছেন। আর এই জঘন্য কাণ্ডের জন্য কতিপয় মুসলামন একত্রিত হয়ে হিন্দুদের মন্দিরে হামলা চালিয়েছেন।

কেন রে বাবা! দুনিয়ায় এত সব কিছু থাকতে তুই কাবা ঘরকে বেছে নিলি কেন? আর তার উপর শীবের মূর্তিই বা বসালি কেন? কি তোর স্বার্থ, কি তোর ভাবনা, কি তোর আনন্দ কিংবা আহম্মকি?
বলা বাহুল্য যুবক রসরাজকে পুলিশ ঘটনার পরে গ্রেফতার করেছে। আর রসরাজ বলেছে যে এটা তিনি করেনি। তার ফেইসবুক আইডি হ্যাক করে হয়তো অন্য কেউ এটা করতে পারে।

রসরাজ নিজে করুক বা তার আইডি কেউ হ্যাক করে তাকে বিপদে ফেলার জন্যই করুক, আর কাবার অবমাননা আসল হোক বা না হোক(কাবা ঘরের আসল স্থানে তো নয়ই, কেবল একটা ছবির উপর অন্য একটা ছবি বসিয়ে দেয়া হয়েছে,) বিষয়টি যে একটি আসল টানাপোড়েন তৈরি করেছে তাকে কোন সন্দেহ নেই। কেবল একটি মাত্র ছবির কারসাজির জন্য রসরাজের আপন রস শুকাতে শুরু করেছে । আর তার জন্য তার গোটা জাতের মানুষ তাদের ধর্মস্থান নিয়েই ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে।

আমি ঘটনার উভয় প্রে্ক্ষিতেই দারুণ ঘৃণা, ক্ষোভ আর প্রতিবাদ জানাই। আমি অন্য ধর্মের উপর হামলাকারীদের নিজ ধর্মের উপর সম্পূর্ণ ইমানদার বলে ভাবতেই পারি না। আমি হিন্দু সম্প্রদায়ের কোন ব্যক্তিকে এখন পর্যন্ত মুসলমানদের পবিত্র কাবা ঘর নিয়ে কোন বিরূপ মন্তব্য কিংবা বিরূপ ধারণা পোষণ করতে দেখিনি। কারণ মুসলমানদের মক্কা-মদিনার মতো হিন্দুদেরও পবিত্র স্থান রয়েছে যেখানে তারা নিয়মিত গমন করে। তাই ধর্মপ্রাণ হিন্দু মাত্রই অন্য ধর্মের পবিত্র স্থানগুলোর গুরুত্ব অনুভব করতে পারেন। একই ভাবে ধর্মপ্রাণ মুসলমানও হিন্দু কিংবা অন্যধর্মের পবিত্র স্থানগুলোর প্রতিও শ্রদ্ধাশীল হবেন।

আমার অভিজ্ঞতা মতে, মুসলমানদের মধ্যে যারা শুধু ধর্মের কিছু কিছু আচার পালন করেন, কিন্তু ধর্মের মূর রচনাগুলো, যেমন কোরআন ও সুন্নাহর উপর খুবই অগভীর জ্ঞানের অধিকারী ভিন ধর্মের প্রতি তারাই বেশি খড়্গহস্ত হয়।

ধর্ম মানুষের ইতিহাসের সমান বয়সী। এমন কোন সমাজ ছিল না, এখনও নেই এবং, আমি বিশ্বাস করি, ভবিষ্যতেও থাকবে না যেখানে মানব হৃদয় একজন অতিপ্রাকৃত সর্বোচ্চ শক্তির আধার কোন অতিপ্রাকৃত সত্তার কল্পনা করবেন না। ধর্ম মানুষের জীবন ধারনের জন্য হয়তো অপরিহার্য কোন উপাদান নয়। কিন্তু ধর্ম মানুষের উচ্চতর চিন্তার যে কেন্দ্র জুড়ে অবস্থান করে সেটাও তো কেউ অস্বীকার করতে পারেন না।

ক্ষুধার অস্তিত্ব যেমন খাদ্যের অস্তিত্বকে প্রমাণ করে, তেমনি সৃষ্টির আদিকাল থেকে সর্বশ্রেষ্ঠ জীব মানুষের মনে যে একজন সৃষ্টি কর্তার জন্য আকুতি আছে, সেই আকুতিই প্রমাণ করে একজন স্রষ্টা আছেন। তবে এই স্রষ্টাকে নিয়ে মানুষের মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন আচার বিচার চালু রয়েছে যেগুলোর সমষ্টিকে আমরা ধর্ম বলে আখ্যায়িত করি। আমি মানি বা না মানি, তাতে ধর্মের অবলুপ্তি ঘটবে না। আবার আমি স্রষ্টাকে মানি বা না মানি, তাতে স্রষ্টা অস্তিত্বহীন হয়ে পড়বে না।

তাই মানুষ তার নিজ ধর্মকে সব কিছুর ঊর্ধ্বে স্থান দেয়। কেউ যখন তার কাছ থেকে ধর্মকে কেড়ে নেয়ার চেষ্টা করে, তখন মানুষ তার সীমার মধ্যে সর্বোচ্চ প্রতিরোধ করে। প্রতিরোধে ব্যর্থ হলে তার চোখে জল আসে, সে অশ্রু বর্ষণ করতে থাকে। যারা তার কাছ থেকে তার ধর্ম কেড়ে নেয় তাদের বিরুদ্ধে তার স্রষ্টাকেই বিচার দেয়। আমি অন্যের ধর্মকে অশ্রদ্ধা করলেও ধার্মিকের ধর্মানুভূতি সামান্যতমও কমে না, বরং অনেক সময় বহুগুণে বৃদ্ধি পায়।

এ সম্পর্কে একটা বাস্তব অভিজ্ঞতা বর্ণনা দেবার লোভ সংবরণ করতে পারছি না। ২০০৫ সালের ঘটনা। তখন সারা দেশের এক জাতীয় মোল্লা কাদিয়ানীদের অমুসলিম ঘোষণা করার জন্য তৎকালীন সরকারকে বড় মাপের চাপ দিচ্ছিল। তারা যে সব শহরে কাদিয়ানী আছে, সেখানে গিয়ে কাদিয়ানীদের মসজিদ ঘেরাও করা শুরু করল। এক পর্যায়ে তারা বগুড়া শহরের একটি কাদিয়ানী মসজিদের উপর আক্রমণ চালানোর ঘোষণা দিল। সারা দেশ থেকে হাজার হাজার মোল্লা এসে বগুড়া শহর ভেসে যাওয়া শুরু করল।

আমি রাজশাহী আরআর এফ থেকে তখন বগুড়া জেলা পুলিশকে সহায়তা করার জন্য ডিআইজির নির্দেশে যাই। আমার ডিউটি পড়ে কাদিয়ানী মসজিদের খুব কাছে, মানে ইনার কর্ডনে। ঐ দিন ছিল শুক্রবার। আমাদের সামনে খুব কাছাকাছি দুটো মসজিদ ছিল। একটি কাদিয়ানীদের অন্যটি স্থানীয়দের। সারা শহরে এত উত্তেজনা। উত্তেজনা কাদিয়ানী মসজিদটিতেও। কিন্তু আমাদের সামনে যে সাধারণ মুসলমানদের স্থানীয় মসজিদ আছে সেখানে কোন উত্তেজনা নেই। বরং তাদের আশেপাশে হাজার হাজার অপরিচিত মানুষ ও নিরাপত্তার জন্য বিপুল সংখ্যক পুলিশ দেখে তারা বিস্ময়াবিভূত হয়ে পড়েছে।

জুম্মার নামাজ শেষ হলে স্থানীয় লোকজন তাদের নিজ নিজ বাসাবাড়িতে চলে গেল। কিন্তু এ সময় বাইরে থেকে আসা যুদ্ধাংদেহী কয়েক হাজার মোল্লা কাদিয়ানী মসজিদের কাছে এল আমাদের ইনার কর্ডন ভাঙ্গার জন্য। কিন্তু আমাদের অনুরোধে ও যুদ্ধসাজে তারা তা ভাঙ্গতে পারল না।

তাদের সাথে আমাদের বোঝা পড়া হল। তারা দুই তিনজন মাত্র একটা ব্যানার নিয়ে কাদিয়ানী মসজিদের কাছে যাবে। মসজিদের গায়ে ব্যানারটা লাগিয়ে দিয়ে আবার চলে আসবে এবং শান্তিপূর্ণভাবে স্থান ত্যাগ করবে। ব্যানারে লেখা ছিল,'ইহা কাদিয়ানীদের উপাশনালয়। ইহাকে কেউ মসজিদ বলিয়া ভুল করিবেন না' বলা বাহুল্য স্থানীয় লোকদের মধ্যে যারা কাদিয়ানীদের অনুসারী নয়, তারা কোন দিনই এই মসজিদে যায় না। তবে তারা এ মসজিদের উপর কোন ব্যানার সাঁটানোর কথা চিন্তা করেননি। তারা সহঅবস্থানেই ছিল।

মোল্লারা যখন কাদিয়ানী মসজিদের গায়ে ব্যানার সাঁটাতে ব্যস্ত ও আমরা ব্যস্ত মোল্লাদের সহিংস হওয়া ঠেকাতে ঐ সময় মসজিদের তত্ত্বাবধানকারী কাদিয়ানী সম্প্রদায়ের লোকজন একে অপরকে জড়িয়ে ধরে অঝোর ধারায় কাঁদতে ছিল। তাদের কান্নার রোলে আসেপাশের পরিবেশ যেন ভারি হয়ে আসছিল।

আর মজার ব্যাপার হল, মোল্লারা বলছিল, এরা অমুসলিম, এরা নাপাক । এদের শরীরে শরীর লাগলে তাদের শরীরও নাকি নাপাক হয়ে যাবে। এ মোল্লারা প্রায় সবাই বহিরাগত। বহিরাগতদের দাপটে স্থানীয়রা তখন বাড়ির ভিতর। যারা পাশাপাশি অবস্থান করছে, কোন সমস্যা হচ্ছে না, যারা দূরের তারাই নাকি এদের শরীরের ছোঁয়ায় নাপাক হচ্ছে। এর সরল অর্থ হল, সাম্প্রদায়িকতা স্থানীয় বিষয় নয়, এটা বাইরে থেকে চাপিয়ে দেয়া বিষয়।

ধর্মের ইতিহাস বলে, মানুষ তার জীবনের সব কিছু খোয়াতে রাজি আছে, কিন্তু ধর্ম বা জাত খোয়াতে রাজি হয়না। আমার বন্ধুটি সামান্য কথাচ্ছলে যে কত বড় নির্মম পরিহাস করেছেন, সেটা হয়তো তিনি বুঝছেন না। যারা মানুষের ধর্মীয় আবেগকে মূল্য দিতে জানে না, তারা তাদের নিজ ধর্মের প্রতি কতটুকু আস্থাশীল তা নিয়ে আমার প্রশ্ন আছে।

মহানবী(স) যদি অন্য ধর্মের মানুষের প্রতি সহনশীল না হতেন, আরব ভূখণ্ডে কোন ইহুদি বা খ্রিস্টানের অস্তিত্ব থাকত না। কিন্তু এটা ঐতিহাসিক সত্য যে মহানবীর জীবদ্দশায় আরব ভূখণ্ডে হাজার হাজার অমুসলীম ছিল, ছিল খ্রিস্টান ও ইহুদি যারা মহানবীর মদিনা সনদের আওতায় নিজেদেরকে একটি বৃহত্তর মুসলিম রাষ্ট্রের অমুসলিম নাগরিক ছিলেন, এবং সুখেই ছিলেন। কিন্তু সাম্প্রদায়িকতা এমন একটি আমদানী করা সার্বজনীন বিষয় যে অনেক মুসলিম রাষ্ট্রে এখন অমুলিমগণ নিজেদের নিরাপদ মনে করছে না।

ধর্মের প্রকৃত পাঠ আমাদের নেই কিংবা এতে ঘাটতি আছে বলেই আমরা অমুসলিমদের অন্তরে ভীতি তৈরি করছি যা ইসলাম কোনভাবেই সমর্থন করে না।হিন্দুদের মন্দির নিয়ে মুসলমানদের কি নীতি হওয়া উচিত তার উদারহণ এ ভারতীয় উপমহাদেশেই আছে। মুহাম্মদ বিন কাশিমের সিন্ধু বিজয় থেকে শুরু করে সর্বশেষ মুঘোল সম্রাটদের শাসন পদ্ধতি পর্যন্ত সব স্থানেই সহনশীলতার হাজারও উদাহরণ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।

ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলমানদের অভিযানের প্রাথমিক পর্যায়ে যখন মোহাম্মদ বিন কাসিম সিন্ধু দখল করেন, তখন যুদ্ধের সময় কিছু মন্দির ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। সেই সময় বাগদাদের খলিফা ছিলেন হাজ্জাজ ইবনে ইউসুফ। সিন্ধু বিজয়ের পর সেখানকার সকল শাসন হাতে নিয়েই মোহাম্মদ বিন কাসিম খলিফার কাছে পত্র লিখলেন, তিনি হিন্দুদের মন্দিরগুলো ঠিক করে দিবেন কিনা এবং নতুন মন্দির নির্মাণের অনুমতি দিবেন কি না। খলিফা সোজা উত্তর দিলেন, সিন্ধু এখন মুসলমান রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত। হিন্দুরা মুসলিম রাজ্যের নাগরিক। খিলাফতের সকল অংশেই সব ধর্মের লোকই তাদের নিজ নিজ ধর্ম নিঃসঙ্কোচে পালন করবেন। খলিফার নির্দেশনা মতো সিন্ধুতে ভাঙ্গা মন্দিরগুলো পুনর্গঠিত হল, আরো নতুন নতুন মন্দির প্রতিষ্ঠিত হল। আমরা কি এ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করব না?

ব্রাহ্মণবাড়িয়াসহ যেসব স্থানে হিন্দুদের উপাশনালয় কিংবা প্রতিমার উপর আঘাত হানা হয়েছে, কিংবা অন্য কোন ভাবে অমুসলিমদের উপর আঘাত এসেছে সেখানে ক্ষতিগ্রস্ত অমুসলিমদের উপর আঘাত হানার জন্য স্থানীয় ব্যক্তিরা নয়, বরং বহিরাগত স্বার্থান্ধরাই মূল ধ্বংসের কাজটি করেছে। শত শত বছর ধরে হিন্দু মুসলমান একে অপরের প্রতিবেশি হয়ে একে অপরের সুখে-দুখের অংশীদার হয়ে বসবাস করছে তাই শুধু ধর্মের দোহাই দিয়ে কেউ তার প্রতিবেশিকে, খেলার সাথীকে কিংবা সহপাঠীদের আক্রমণ করতে পারে না। তাই আক্রমণ করার জন্য বাইরের লোকের প্রয়োজন হয়। আর এ বহিরাগতদের আশ্রয় প্রশ্রয় বা ধর্মান্ধতার উন্মাদনাদান করে কতিপয় স্বার্থন্ধ মানুষ যারা ধর্মের কিছু আচার পালন করেন, কিন্তু ধর্মকে সঠিকভাবে জানেন না।

ব্রাহ্মণবাড়িয়র ঘটনায় আরো উপলব্ধি করা যায় যে রসরাজ দাবী করছেন যে তার ফেইসবুক একাউন্ট হ্যাক করে বা অন্য কোনভাবে তার দখল গ্রহণ করে কাজটা অন্য কেউ করেছে। তার মানে হচেছ দেশে সাম্প্রদায়িক সম্পীতি নষ্ট করার জন্য এমন একটি গোষ্ঠী তৎপর রয়েছে যারা হিন্দু-মুসলমান কারুরই সুহৃদ নয়, তারা মোটা দাগের দুর্বৃত্ত। তাই এদের সম্পর্কে সবারই সচেতন থাকা উচিৎ।