পুলিশের কার্যক্রম বিশ্লেষণে আমরা কতটুকু বস্তুনিষ্ঠ ও স্বার্থ নিরপেক্ষ?

মোঃ আব্দুর রাজ্জাক
Published : 1 Dec 2016, 06:43 PM
Updated : 1 Dec 2016, 06:43 PM

পুলিশিং বিষয়টিকে আমজনতা অতি সরল করে ভাবতে অভ্যস্ত হলেও এটা তার স্বগুণেই জটিল। পুলিশিং তা এক কথায় প্রকাশ করা গেলেও পুলিশের কাজ কি সেটা কিন্তু সহস্র বাক্যেও পরিষ্কার করা যায় না। যারা পুলিশকে অতি সরল কাজের কাজী ভাবেন, তাদেরও যদি পুলিশের দায়িত্বগুলোর একটি তালিকা তৈরি করতে বলা হয়, তিনি কযেক ঘন্টা নয়, কয়েক দিনেরও সে তালিকা সম্পূর্ণ করে দিতে পারবেন না।


সাধারণ মানুষের সাধারণ রাস্তায় অবাধ চলাফেরা নিয়ন্ত্রণ করা থেকে শুরু করে, পুলিশ তার কার্যক্রমের মাধ্যমে নাগরিকদের জীবন-মরণ পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। তাই পুলিশিং হল একটি সর্বব্যাপী কার্যক্রম। যে মানুষ কোনদিন পুলিশের শরণাপন্ন হবে না বলে প্রতীজ্ঞা করে, অপঘাতে মৃত্যু ঘটে তার লাশটিও শেষ পর্যন্ত পুলিশের সিদ্ধান্তের অধীন হয়ে পড়ে। এমতাবস্থায়, পুলিশের কার্যাবলী নিয়ন্ত্রণ তথা পুলিশকে সামলানোর বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এই সামলানোর বিষয়টিকে আমরা যদি আমজনতার অগভীর বিশ্বাসের নিরিখে বিচার করি, আর বলে দেই, পুলিশকে শেকল পরাও, তার অস্ত্র কেড়ে নাও, বিনা তদন্তে পুলিশ সদস্যদের চাকরিচ্যূত কর কিংবা বিনাবিচারে তাদের ফাঁসি দিয়ে দাও তাহলে তাহলে সেই জুতা আবিষ্কারের মতো আমাদের সুপারিসের উপর বিসর্গ আর চন্দ্র বিন্দুর পাহাড়ই শুধু জমবে, কোন কাজের কাজ হবে না।

আমার এ নিব্ধের সূত্রপাত পুলিশের কিছু চলমান কার্যক্রমের উপর নানাবিধ সমালোচনার প্রতিক্রিয়া স্বরূপ। নানা প্রচার মাধ্যমে গোবিন্দগঞ্জের সাঁওতালদের সাথে পুলিশের সংঘর্ষ, নাসির নগরে হিন্দুদের উপর রাজনৈতিক প্রভাবের হামলার ঘটনা এবং তারও পরে ময়মনসিংহের ফুলবাড়ি কলেজকে সরকারি না করার সরকারি সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে শিক্ষক-কর্মচারী-ছাত্রদের আন্দোলনের এক পর্যায়ে একজন শিক্ষকের মৃত্যু হওয়া নিয়ে নিয়মিত প্রচার মাধ্যম থেকে শুরু করে সামাজিক যোগাযো মাধ্যম পর্যন্ত সব স্থানেই পুলিশকে তুলোধুনো করা হচ্ছে। এসব তুলোধুনোর মাধ্যমে পুলিশিং নিয়ে আমাদের সমাজের ভাবনাগুলো জনসম্মুখে প্রকাশ পাচ্ছে বলে আমি পুলিশ সদস্য হিসেবে অত্যন্ত খুশি। কারণ যে বিষয়ের উপর জনগণ আগ্রহ বাড়িয়ে দেয়, সে বিষয়টি নিয়ে সরকার সমাজ সবাই কাজ করতে উৎসাহী হয়।

পুলিশ নিয়ে বা কোন না কোনভাবে পুলিশকে স্পর্শ করে এ ব্লগের সাম্প্রতিক পোস্টগুলো হল, পুলিশের হাতে শিক্ষক খুন , শিক্ষাগুরুর মর্যাদা রক্ষা হোক , পুলিশকে সামলাবে কে?

আমি ব্যক্তিগতভাবে এসব পোস্ট তন্ন তন্ন করে পড়েছি এবং এ বিষয়ের উপর আমার মতামত জানিয়েছি। ঐসব নিবন্ধের অনেক পাঠক তাদের মন্তব্যের মাধ্যমে ঐসব পোস্টের কাছে আমাকে কামনা করেছেন। আর করবেনই তো। কারণ, আমি তো এসব লেখনিতেই নিজেকে ব্যস্ত রেখেছি।

কোন পুলিশি অ্যাকশনের সমালোচনা করার ক্ষেত্রে সবাই একটা কথা স্বীকার করেন যে বল প্রয়োগ করে জনতা ছত্র ভঙ্গ করা থেকে শুরু করে জীবন ও মাল রক্ষার জন্য চরম বল প্রয়োগে পুলিশের প্রাণ হরণের আইনি বৈধতা ও দায়িত্ব রয়েছে। কিন্তু প্রশ্নটা তোলা হয়, এই বলে যে পুলিশের একশনে যাওয়াটা যৌক্তিক ছিল কি না। বা পুলিশ তার দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে যতটুকু বল প্রয়োগ করেছে, ঘটনটা কি সেই রূপ বা সেই মাত্রার বল প্রয়োগের চূড়ান্ত সীমায় পৌঁচেছিল? বলা বাহুল্য, সম্প্রতি নব্য জেএমবির আত্মঘাতি গ্রুপগুলোর সাথে কয়েকটি অভিযান ভিন্ন অন্য কোন কার্যক্রমেই পুলিশের কার্যক্রমকে সঠিক বলে আমাদের সচেতন মহল ছাড়পত্র দেয়নি। আর ঐসব জঙ্গিবিরোধী অভিযানের ক্ষেত্রেও রাজনৈতিক বিবেচনায় নানাবিধ বক্তব্যও প্রচার মাধ্যমে এসেছে। তাই বলছি, পুলিশের কার্যক্রমকে চুলচেরা বিচার যারা করেন তারা শেষ পর্যন্ত তাদের মতামত পুলিশের বিরুদ্ধেই দিয়ে থাকেন।

এর নানাবিধ কারণ আছে। এসবের মধ্যে আছে প্রচার মাধ্যমের একপেশে খবর প্রকাশ, সাংবাদিকতায় নৈতিকতার অনুপস্থিতি এবং পুলিশের বিরুদ্ধে মানুষের একটি সাধারণ অভক্তি, অবিশ্বাস ও বিরক্তি। কারণ ঐতিহাসিকভাবে বাংলাদেশ পুলিশ জনগণের একটি বিরূপ মূল্যায়ন লাভ করে আসছে যার ফলে, যে দেখতে নারী, তার চলন তো বাঁকাই হবে। লর্ড কর্ন্ওয়ালিসের সময় থেকে শুরু করে অদ্যাবধি পুলিশের কার্যক্রমে যে নেতিবাচক ধারণা মানুষ সাধারণ অভিজ্ঞতায় পেয়ে আসছে তা কি আর দু একটি ঘটনায় বা দু চারজন পুলিশ অফিসারের সদ্ব্যবহার বা সতকর্মের ফলে পাল্টে দেয়া যাবে?


আমি পুলিশি অ্যাকশনগুলোকে আন্দোলনকারী বা বিক্ষোভকারীদের আচরণের প্রতিক্রিয়া হিসেবেই দেখতে অভ্যস্ত।তবে কোন কোন ঘটনায় যে পুলিশের অদক্ষতাপ্রসূত বাড়াবাড়ি থাকে না, তা কিন্তু নয়। এটা আমি যে একজন পুলিশ সদস্য সেই জন্যই, তা কিন্তু নয়। কারণ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় আমি এরশাদবিরোধী আন্দলনকে কেবল কাছে থেকেই দেখিনি, সেখানে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণও করেছি। ঐ সময় আমি দেখেছি ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে জনবিক্ষোভ কিভাবে পুলিশের উপর দিয়ে গড়াগড়ি যায়।

পুলিশ সরকারের দৃশ্যমান অংশ হওয়ায় সরকারের বিরুদ্ধে পুঞ্জিভূত সকল ক্ষোভের বলির পাঁঠা হয় পুলিশ। আমার এই হাতে ছাত্রজীবনে কতবার যে পুলিশের উপর ইঁট ছুড়েছি তার হিসেব নেই। কিন্তু ঐ সময় ভেককুলের উপর বালকদিগের প্রস্তর নিক্ষেপ ক্রীড়ার অনুরূপে এরশাদের পুলিশের উপর ঢিল ছোড়ার আনন্দভিন্ন অন্য কিছুর কল্পনা করিনি। কিন্তু ঐ ঢিলই যখন নিজের উপর এসে পড়া শুরু করল, তখন ঘটনাগুলোকে ভিন্নভাবে বিশ্লেষণ করা জরুরি হয়ে পড়ল। তাই আমার এ মূল্যায়ন একাধারে একজন পুলিশ সদস্য ও একজন সাধারণ নাগরিকের মূল্যায়ন বলেই দাবি করব। বস্তুত পুলিশ সদস্যদের দায়িত্বের পরিধি ও গণ্ডি আবর্ত যা তাতে তারা নিজেরা যতটুকু না পুলিশ, তারচেয়েও বেশি মানুষ বলেই আমার ধারণা। তাই সশস্ত্রবাহিনীর সদস্যরা যেমন স্বকীয় ব্যক্তিত্ব বিসর্জন দিয়ে তার রেজিমেন্টাল স্রোতে মিশে যেতে পারে, পুলিশের ক্ষেত্রে সেটা সম্ভব্ও নয়, কাম্যও নয়। যাকোহ এ পর্বে আমি কিছু বাস্তব ঘটনার বিবরণ দিতে চাই।

ঘটনা-১ লাশ আন্দোলনে গতি সঞ্চার করে– এই সত্যটি হয়তো যে কেউ স্বীকার করবেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে তো এমনি দেখেছি, জাতীয় রাজনীতির ক্ষেত্রে এটা উপলব্ধিও করেছি। পাঠতের নিশ্চয়ই মনে আছে সরকারিকরণের জন্য আন্দোলনের এক পর্যায়ে শিক্ষকগণ শাহবাগের কাছে রাস্তা অবরোধ করে। আর ঐ রাস্তাটা যে ভিআ্ইপি রোড সেটা সবাই জানেন। এমতাবস্থায় শিক্ষকদের রাস্তা থেকে সরানোর জন্য পুলিশকে শক্তি প্রয়োগ করতে হয়, জলকামানের পানি ব্যবহার করতে হয়, পেপার স্প্রে এবং লাঠি চার্জ করতে হয়।

আন্দোলনের সময় এক জামালপুর থেকে আসা এক শিক্ষক অসুস্থবোধ করায় নিজের ইচ্ছায় স্বব্যবস্থায় জামালপুর চলে যান। সেখানে রাত্রিবেলায় বাসায় তার স্বাভাবিক মৃত্যু হয়। কিন্তু এ মৃত্যুকে পুলিশের একশনের ফল হিসেবে প্রচার করে আন্দোলনকারীগণ ফায়দা লুটতে থাকে। স্থানীয় শিক্ষক নেতারা শিক্ষকের লাশটিকে ঢাকায় নিয়ে আসার জন্য ঐ মৃত শিক্ষকের পরিবারকে নানা ভাবে চাপ সৃষ্টি করে ও প্রলোভন দেখাতে থাকে। পরে অবশ্য শিক্ষকের পরিবার তাতে রাজি হয়নি। এ লাশ যাতে ঢাকায় নিয়ে আসতে না পারে, তার জন্য স্থানীয় এসপিকে বড়ই গলদঘর্ম হতে হয়েছিল।

ঘটনা-২
গোবিন্দগঞ্জের মহিমাগঞ্জ চিনিকলের অব্যবহৃত কৃষিজমির মালিকানাকে কেন্দ্র করে স্থানীয়দের বিরোধ বহুদিনের। কিন্তু সম্প্রতি যা ঘটেছে তার সাথে স্থানীয় রাজনীতির যোগসাজস আছে। আর যেখানে রাজনীতি আছে, সেখানে পুলিশনীতি অকার্যকর, অচল ও কৈফিয়তহীন। কিন্তু এ ঘটনা ঠেকাতে গিয়ে পুলিশকে গুলি ছুড়তে হয়েছিল কেন, সেটা ভেবে দেখার গরজ কেউ বোধ করেননি। সবাই আহত, নিহত সাঁওতালদের নিয়েই ব্যস্ত। আর এখানে পুলিশকে এমনভাবে চিত্রায়িত করার চেষ্টা চলেছে যেন সাঁওতালদের দমন করলে আমাদের পুলিশ সদস্যরা চিনিকলের জমির মালিক বনে যাবে।

তবে সামাজিক প্রচার মাধ্যমগুলোতে কেবল যে পুলিশের গুলিতে আহত সাঁওতালদের ছবি দেখা গেছে তা কিন্তু নয়, এর সাথে সাথে সাঁওতালদের ছোড়া তীর ও বল্লমের আঘাতে পুলিশ সদস্যরা কিভাবে আহত হয়ে হাসপাতালে গোঙ্গাচ্ছে তারও ছবি আছে। এসব ছবি দেখলে যে কেউ বুঝতে পারবেন, যারা বুঝতে চান, যে সেখানে গুলি চালানোর পরিবেশ তৈরি হয়েছিল। আর পুলিশ আত্মরক্ষার জন্যই সেটা করেছে। আর আত্মরক্ষার জন্য আত্মা হননের যে আইনী বিধান আছে সেই বিধানই পুলিশকে রক্ষা করার জন্য যথেষ্ঠ।

আর বক্তব্য বাড়াব না। পুলিশ সমাজের এমন ধরনের কাজে নিয়োজিত যার পরষ্পরবিরোধী দুটো দিক আছে। আছে লাভ-ক্ষতি, ন্যায়-অন্যায়ের দিক। কিন্তু এই পরষ্পর বিরোধী কর্মের মূল্যায়নে এখন পর্যন্ত আমরা সঠিক মাপকাঠি যেমন তৈরি করতে পারিনি, তেমনি বস্তুনিষ্ঠ বিশ্লেষণ ও নিরপেক্ষ মানসিকতার সন্ধান পাইনি। যেখানেই পুলিশকে মারাত্মক বল প্রেূয়োগ করতে হয়েছে সেখানেই পুলিশের নির্দয় সমালোচনা হয়েছে। ঘটনার একটি দিককে সব সময় গৌণ করে দেখা হয়েছে। উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য যে সিদ্ধান্ত পুলিশকে মুহূর্তের মধ্যে নিতে হয়েছে, সেই সিদ্ধান্তকে বছরের পর বছর বিশ্লেষণ করে হয়তো পুলিশের বিরুদ্ধে মতামত দেয়া যায়। কিন্তু মুহূর্তের সিদ্ধান্তকে মুহূর্তের মধ্যেই বিশ্লেষণ শেষ করে গণমাধ্যম, বুদ্ধিজীবী কিংবা ব্লগারদের পুলিশের বিরুদ্ধে কলমধারণটা কতটা সঠিক সেটা ভেবে দেখা দরকার।