অন্যদেশে অন্য মিশনেঃ অবশেষে কঙ্গোর মাটিতে

মোঃ আব্দুর রাজ্জাক
Published : 6 Dec 2016, 11:29 AM
Updated : 6 Dec 2016, 11:29 AM

২১ নভেম্বর, ২০১৬। সোমবার (আশা- নিরাশার দোলাচলে বাংলা হাউজ ত্যাগ)

দক্ষিণ সুদানের জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশন (UNMISS) এবং ডেমোক্রাটিক রিপাবলিক অব কঙ্গোর শান্তিরক্ষা মিশন (MONUSCO) দুটোই জাতিসংঘের ডিপার্টমেন্ট অব পিস কিপিং (DPK) এর অধীন পরিচালিত হলেও দুটো মিশনই সম্পূর্ণ পৃথক। তবে পূর্বেই বলেছি, এ দুটিসহ মোট চারটি মিশনেরই পশ্চাৎভূমি হল উগান্ডার এনটেবে শহরে। এসব মিশনে কোন শান্তিরক্ষীর আগমন ঘটলে তাদের আত্মীকরণ শুরু হয় এনটেবের বেইজ ক্যাম্প থেকেই।

কিন্তু পৃথক মিশন হলেও এক মিশন থেকে অন্য মিশনে ছুটি কাটানোর জন্য শান্তিরক্ষীগণ সহজেই যাতায়াত করতে পারেন। এজন্য কেবল ভ্রমণাকাঙ্খীদের বিমানের সিডিউল বা মেনুফেস্টোতে নির্ধারিত পদ্ধতিতে নাম নিবন্ধন করলেই হয়। আমরা দক্ষিণ সুদান থেকে যাবতীয় কাজ সমাপ্ত করেছিলাম। কঙ্গো মিশনের ফ্লাইট সিডিউলে আমাদের নামও চলে এসেছিল। কিন্তু কি কারণে যে মেনুফেস্টোতে আমাদের নাম তোলা হয়নি তা বোঝা যাচ্ছে না।

গতকাল রাতেই জানতে পেরেছিলাম যে এনটেবে-বুনিয়া রুটের কোন ফ্লাইটের ম্যানুফেস্টোতেই আমাদের নাম নেই। তবে ইন্ট্রানেটে আমাদের নাম দেখানো হয়েছিল। ইউএন এর প্রাধিকার তালিকায় আমাদের অবস্থান তিন নম্বরে। অর্থাৎ আমাদের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ আরো দুই ক্যাটাগরির শান্তিরক্ষী আছেন। তাই তাদের কাউকে স্থান করে দিতেই শেষ পর্যন্ত আমাদের নাম তালিকা থেকে বাদ দেয়া হতে পারে। মনটা স্বাভাবিক কারণেই দমে গেল। তবে কি, শেষ পর্যন্ত ফিরেই যেতে হবে?

তবে আশার বিষয় হল, ইউএন ফ্লাইটে এ ধরনের অনেক লোকই থাকে যারা শেষ পর্যন্ত তাদের যাত্রা বাতিল করেন। তাই বিমান ছাড়ার আগেই, মানে চেক-ইন এর শেষ মুহূর্তে কিছু আসনে তালিকা বহির্ভূত যাত্রী নেয়া হয়। আমরা ঐ আশায় প্রায় সকাল এগারটার দিকেই বিমান বন্দরে গিয়ে হাজির হলাম। কিন্তু বুনিয়াগামী প্রথম ফ্লাইটটির চেক-ইন ছিল ১২ টা থেকে দুপুর একটা পর্যন্ত। আমরা এ সময়টা চেক-ইন কাউন্টারের কাছেই বসে থাকলাম। মুভকনের লোকজন বললেন, 'আপনারা দুপুর একটা পর্যন্ত অপেক্ষা করেন, ভাগ্য ভাল হলে ব্যবস্থা হতেও পারে'।

প্রায় দুপুর একটার দিকে খবর হল যে আমরা যেতে পারব। কিন্তু আমাদের কাগজপত্রগুলো হাতে নিতেই আরো দুজন যাত্রী এসে হাজির। তারা তালিকাভুক্ত হওয়ায় আমাদের আশা ক্ষীণতর হয়ে এল। কিন্তু না, আমাদের ভাগ্য শেষ পর্যন্ত সুপ্রসন্নই ছিল। দেখা গেল, আমাদের দুজনের স্থান হওয়ার পরও ১৯ আসনের বিমানটিতে আরো কয়েকটি আসন খালি থাকবে।

স্টারন ও টারন
এক ঘন্টা এনটেবে এয়ারপোর্টে বসে থেকে আমরা দুপুর দু'টার সময় বিমানে উঠলাম। এটাও ক্ষুদ্রাকার সৈকত বিমান। তবে গতকাল জুবা থেকে আসার সময় যে ১৫ সিটের বিমানটিতে এসেছিলাম এটা তার চেয়ে বড় ও আসনসহ অন্যান্য ব্যবস্থাদি ভাল।

এ বিমানে মাত্র দুজন ক্রু। একজন পাইলট, অন্যজন কোপাইলট। বিমান মাটি ছেড়ে আকাশে ওড়ার আগেই বাধ্যতামূলক যাত্রীদের নিরাপত্তা বিষয়ক ব্রিফিং দিতে হয়। ব্রিফিং এ পাইলট তার ক্রুদের সাথে যাত্রীদের পরিচয় করিয়ে দেন, বিমানের নিরাপত্তা বিষয়গুলো ব্যাখ্যা করেন। বিমানটি কত উঁচু দিয়ে উড়াল দিবে, গন্তব্যে পৌঁছুতে কত সময় লাগবে, কোথাও যাত্রা বিরতি বা রিফিউয়েলিং করবে কিনা, জরুরি পরিস্থিতিতে কি করতে হবে, কোথায় কোথায় জরুরি বহির্গমন পথ আছে, ইত্যাদি বিষয় ব্যাখ্যা করা হয়।

পাইলটের নাম স্টার্ন। সে শুরু করল এভাবে—'হ্যালো, আমার নাম হচ্ছে স্টার্ন আর আমার কোপাইলটের নাম টারন।' আমরা শুনলাম, আমার নাম স্টার্ন, ওর নাম স্টার্ন। কানাডিয়ান কুইবেকি পাইলটের অদ্ভূত উচ্চারণে প্রায় সব যাত্রীই বুঝল, দুজনের নামই এক। একজন বলে বসল, দুজনেরই কি এক নাম? সবাই হো হো করে হেসে উঠল। পাইলট তখন ধীরে ধীরে বলল, আমার নাম স্টারন আর ওর নাম হল টারিন।

ডোঙ্গু: কঙ্গোর মাটিতে পা পড়ল
ডোঙ্গু হল ডিআর কঙ্গোর উত্তর-পূর্ব দিকে দক্ষিণ সুদানের সীমান্তবর্তী একটি ছোট শহর। কঙ্গোর ২৬ টি প্রদেশের মধ্যে অন্যতম হল হাতু উয়েলে। মানে উয়েলে নদীর উজানভূমি। ডোঙ্গু এ হাতু উয়েলে প্রদেশেরই একটি শহর। এটা উগান্ডার এনটেবে থেকে প্রায় ৯০০ কিলোমিটর উত্তর-পশ্চিমে। কিন্তু আমাদের গন্তব্য স্থল হল ডিআর কঙ্গোর বুনিয়া শহরে এনটেবে থেকে যার সরাসরি দূরত্ব হবে প্রায় সাড়ে ছয়শ কিলোমিটারের মতো। কিন্তু সরাসরি বিমান থাকায় আমাকে এ বাড়তি পথ ঘুরতে হচ্ছে।

প্রায় এক ঘন্টা ২৭ মিনিটের মাথায় আমরা ডোঙ্গুতে পৌছিঁলাম। আমরা ভেবেছিলাম, হয়তো আমাদের এখানে বিমানে বসেই থাকতে হবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমাদের নামতে বলা হল। ডোঙ্গু বিমান বন্দরে নেমেই দেখি আমাদের বিমান বাহিনীর সদস্যরা এয়ার ট্রাফিকিং এর কাজ করছেন। ওদের দেখে মনে হল, বিদেশে এলেও আমাদের ভাইদের কাছেই এসেছি। তাদের কাজকর্ম দেখে ডোঙ্গু বিমান বন্দরকে বড় আপনই মনে হল।

আমরা ডোঙ্গু বিমান বন্দরের মুভকনে গিয়ে বসলাম। কিন্তু সেখানে গিয়ে পরিবেশটাকে আরো আপন মনে হল। মুভকনে যারা বসে আছেন তাদের প্রায় সবাই বাংলাদেশ বিমান বাহিনী ও সেনাবাহিনীর সদস্য। এখানে পরিচয় হল লে. কর্নেল আরিফ এর সাথে। একটু গভীর আলাপে জানা গেল তিনি আমার ব্যাচমেইট এআইজি (ইউএন ডেস্ক) রফিকের খালাত ভাই। তার মানে নৈকট্য আরো বাড়ল। এক ফাঁকে ডোঙ্গুতে আমরা ছোটখাট প্রাকৃতিক কর্মটুকু সম্পাদন করলাম। সামান্য পরেই বিমানে ওঠার জন্য ডাক পড়ল। বিমানে উঠে দেখা গেল সামান্য কয়েকজন ছাড়া যাত্রীদের সবাই বাংলাদেশি। মনে হল, বিমানটি বাংলাদেশিদের জন্যই রিজার্ভ করা হয়েছে।

শেষ পর্যন্ত বুনিয়া- পাসপোর্টে ভিসার সিল
বুনিয়া বিমান বন্দরে এসে পৌঁছিলাম স্থানীয় সময় চারটার দিকে। তবে আমার ঘড়ি তখনও উগান্ডার সময় নির্দেশ করছিল। দ্রুত সময় পরিবর্তন করে নিলাম। ঘড়ির সময় একঘন্টা পিছিয়ে দিলাম।

বুনিয়া মাটি স্পর্শ করেই মনে হল যেন একটা শান্তির জায়গায় এসে পড়েছি। চার দিকে সুনসান নিরবতা। পড়ন্ত বিকালের নরম রোদ। একটু বাতাসও বইছিল। মুভকনের সামনে কয়েকটা আমগাছ দেখলাম। গাছে বেশ মুকুল এসেছে। মাটি বাংলাদেশের মাটির মতোই উর্বর মনে হল।

মুভকনে ঢোকার আগেই দেখা হল আমার র্যাব মেইট লে. কর্নেল ইকবালের সাথে। গতকালই তার সাথে এনটেবের বাংলা হাউজে অনেক দিন পর দেখা হয়েছিল। তিনি বুনিয়া বিগ্রেডের বিগ্রেড অফিসে জি-২ হিসেবে কাজ করেন। এনটেবে থেকে এসেছেন অন্য একটি ফ্লাইটে। বুনিয়ায় আজ সর্বমোট তিনটি ফ্লাইট এসেছে। ওনারা আমাদের পরে রওয়ানা দিয়েছিলেন। কিন্তু আমরা উজানে শহর ডোঙ্গু হয়ে দক্ষিণের শহর বুনিয়ায় আসায় কিছু সময় বেশি ব্যয় করেছিলাম। তাই আমাদের পরে ছাড়া বিমানটি আমাদের বিমানের আগেই বুনিয়া এসে পৌঁচেছে।


বুনিয়া মুভকনে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন ক্যাপ্টেন রাজিব। তিনি লে. কর্নেল জাহিদের পক্ষে আমাদের আনার জন্য বিমান বন্দরে এসেছেন। বুনিয়ার বাংলাদেশ ব্যাটালিয়নের দ্বিতীয় কমান্ডার হলেন লে. কর্নেল জাহিদ। আমরা মূলত তার আতিথ্যেই এখানে দুই রাত থাকব।

আমার খুব চিন্তা ছিল যে ভিসা ছাড়া আমাদের হয়তো কঙ্গোতে ঢুকতে দেয়া হ বে না। বিভিন্ন মারফতে জানা যাচ্ছিল যে ভিসা ছাড়া এখানে আসা যাবে না। আবার এমনও খবর ছিল যে ইউএন পরিচয়পত্রধারীদের জন্য আসামাত্রই ভিসা দেয়া হয়। আমরা ইতোপূর্বে কঙ্গো ভ্রমণের যে পরিকল্পনা করেছিলাম, তাতে নির্ভর করেছিলাম আমাদের মহিলা ফর্মড পুলিশ ইউনিটের অফিসারদের সহযোগিতার উপর । কিন্তু যেমন আমাদের জন্য ভিসা বা অন্য কোন ব্যবস্থার আয়োজন করতে পারেননি, তেমনি আমাদের বিনা ভিসায় কিনশাসায় যাবার পরামর্শও দেননি। তাই এ যাত্রায় আমার সফরসঙ্গী অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মহিউদ্দিন কিনশাসা ভ্রমণকে মাঝখানে রেখে প্রথমেই বুনিয়াকে নিযে এসেছিল। এরপরও আমার মন থেকে সংশয় দূর হয়নি।

কিন্তু না, কোন জায়গায়তেই সমস্যা হয়নি। এনটেবে বিমান বন্দরে আমাদের গন্তব্য স্থান জেনেই ওনারা খালাস। আর বুনিয়া বিমান বন্দরে ইমিগ্রেশনের একজন স্থানীয় ভদ্রলোক বসে আছেন আমাদের পার্সপোর্টে সিল মারার জন্য। আমাদের দেরি হচ্ছে মনে করে সেই ভদ্রলোক মুভকন থেকে চলে গিয়েছিলেন। তাই পরে আমাদের পাসপোর্টগুলো নিয়ে একজন তার অফিসে চলে গেল। কোন জটিলতা নেই। অল্প পরেই সিল মেরে নিয়ে এল।

ওহ! কি মজার বিষয়! দক্ষিণ সুদানে ইউএন শান্তিরক্ষীদের ঢুকতে পদে পদে কতই না বাঁধা বিপত্তির সৃষ্টি করা হয়। কিন্তু এ দেশে আসা মাত্রই কোন ফি ছাড়াই পাসপোর্টে সিল পড়ে গেল। এ সিলটিই ভিসা। পাশপোর্টটি হাতে ফেরত পেয়ে মনে মনে আশ্বস্ত হলাম। একবার যখন কঙ্গোতে ঢুকে পড়েছি, তখন আর আটকাবে কে?

ইন্দ্রোমো ক্যাম্প
বুনিয়া বিমান বন্দর থেকে প্রায় দুই কিলোমিটার দূরে ব্যানব্যাট ক্যাম্পটি। এর নাম হল ইন্দ্রোমে। আয়তনে বিশাল বড়। বাংলাদেশ ছাড়াও এখানে মরক্কো ও নেপালের সেনা ব্যাটালিয়ন আছে।

লে. কর্নেল জাহিদ সাহেব আমাদের তার ক্যাম্পে স্বাগত জানালেন। আমার থাকার ব্যবস্থা হল ১৫ নম্বর কক্ষে। প্রিফ্যাপ বা করিমেক দিয়ে তৈরি কন্টেইনারে থাকার ব্যবস্থা। রুমে এসি তো আছেই, আছে একটি টেলিভিশনও। সবচেয়ে বড় সুবিধা হল, এখানে একটা টেবিল আছে যাতে আমি ল্যাপটপ রেখে লিখতে পারছি।

এখানে এসেই ইন্টারনেটের সুবিধা পেলাম। গোটা ব্যাটালিয়ন ওয়াই-ফাই এর আওতায় আছে। আমাদের দুটো আইপির জন্য পাসওয়ার্ড দেয়া হল। পাসওয়ার্ড পেয়েই সোমার সাথে যোগাযোগ করলাম। তবে আমার ফোনে একটু গন্ডগোল দেখা দিয়েছে। ম্যাসেঞ্জার খুললেই স্পিড কমে যায়। অন্য দিকে ইমও তে ম্যাসেজ যায়, ছবি যায় কিন্তু অডিও-ভিডিও প্রকার কলই করা যায় না।

অল্প পরেই লাঞ্চ খাওয়ার ডাক পড়ল। বিলম্বিত লাঞ্চ কেবল আমাদের জন্যই নয়, এ ব্যাটালিয়নটির রোটেশন হচ্ছে। মানে পুরাতন ব্যাটালিয়নটির পরিবর্তে নতুন একটি ব্যাটালিয়ন আসছে। পুরাতন শান্তিরক্ষীদের অর্ধেক অংশ দেশে ফেরত গেছে। তাদের পরিবর্তে নতুন এক দল এসেছে। এ দলের অফিসারগণও আমাদের সাথেই এয়ারপোর্ট থেকে এসেছেন। তাই তাদের নিয়েই বিলম্বিত লাঞ্চ। গরুর মাংম আর মুরগীর রেজালা অমৃতের মতো লাগল। খাবার পরে আইসক্রিম পরিবেশন করা হল। আইসক্রিমের্ সাথে কাজু বাদাম, কাঠ বাদাম ও কিছু ক্রিমও যোগ করা হয়েছে। চমৎকার স্বাদ!

বিকালের বুনিয়া দর্শন
দুপুরের খাবার বিকালে খেয়ে আমরা ক্যাম্পের চারদিকটা দেখতে বের হলাম। উত্তরপূর্ব দিকটার ঢালুতে শহর দেখা যাচ্ছে। সূর্যের বিপরীত দিকে হওয়ায় চমৎকার দেখাচ্ছিল শহরটা। এখানে সবুজ ঘাসের মাঠ, মাঠের পরে রাস্তা আর রাস্তার পরেই ঢালুতে শহরটি। শহরটির পূর্ব দিকে আবার উঁচু পাহাড়।


বুনিয়া শহরটি একটি মালভূমির উপরে অবস্থিত। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে এর উচ্চতা প্রায় সোয়া কিলোমিটারের মতো। ভাবলে অবাকই লাগছে। বাংলাদেশের সর্বচ্চো পর্বত শৃঙ্গ তাজিংডং এর উচ্চতা ১,২৮০ মিটার। সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে ঢাকার উচ্চতা হল মাত্র ৪ মিটার। সর্ব উত্তরের পঞ্চগড়ের উচ্চতা হল ৭৭ মিটার আর বুনিয়া শহরের উচ্চতা হল সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১,২৭৭ মিটার। এর অর্থ হল এ স্থানটি আমাদের দেশের সর্বচ্চো পর্বত শৃঙ্গের প্রায় সমান। এ উচ্চ স্থানে বায়ুর চাপ কম। বায়ুর চাপ কম হওয়ার জন্য শরীরে কিছু জটিলতা দেখা দেয়। এদের মধ্যে আছে শ্বাস কষ্ট, কান/মাথা ব্যথা, ক্ষুধামন্দা, এমনকি শরীর ফুলে যাওয়াও। তবে এ সব জটিলতা ১,৫০০ মিটার উপরে উঠলে দেখা দিতে পারে। কিন্তু আমরা হলাম ভাটির দেশের মানুষ। আমরা বাস করি ৪ মিটার উঁচুতে। তাই সোয়া কিলোমিটার উঁচুতে উঠে কানে অনেকটাই চাপ বোধ করছি।

বুনিয়া শহরের অবস্থান
বিশাল আকৃতির দেশ হল ডেমোক্রাটিক রিপাবলিক অব দি কঙ্গো, সংক্ষেপে ডিআর কঙ্গো। আয়তনের দিক থেকে এটি আফ্রিকার দ্বীয় বৃহত্তম ও বিশ্বের একাদশ বৃহত্তম দেশ। বাংলাদেশের প্রায় ১৬ গুণ বড়। মোট ২৬টি প্রদেশে নিয়ে এ দেশটি। বুনিয়া শহরটি হল ইতুরি প্রদেশের রাজধানী। শহরের আয়তন প্রায় ৫৮ বর্গ কিলোমিটার। আর লোক সংখ্যা তিন লাখ ৬৬ হাজার। তাই সমগ্র ডিআর কঙ্গোর তুলনায় এ শহরটি বেশ ঘন বসতি সম্পন্ন। বিষুব রেখা থেকে মাত্র এক ডিগ্রি উত্তরে হওয়া এখানে বর্তমানে শীতকাল শুরু হয়েছে। তবে এই শীত বাংলাদেশের শীত নয়।

বুনিয়া ডিআর কঙ্গোর রাজধানী কিনশাসা থেকে উত্তর পূর্ব দিকে ৩,২৪৬ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। কিন্তু এর সাথে রাজধানীর ভাল সড়ক যোগাযোগ নেই। রাজধানীর সাথে যোগাযোগের সহজতম উপায় তাই বিমান ভ্রমণই। তবে বুনিয়া থেকে উগান্ডা ও রুয়ান্ডা বেশ কাছে। মাত্র ৪০ কিলোমিটার পূর্বেই উগান্ডার সীমান্ত।

ডিনার পার্টি
দুপুরের খাবারের সময়ই আমাদের বলা হয়েছিল যে রাতের খাবার হবে সাড়ে আটটায়। কিন্তু এখানে যে বিগ্রেড কমান্ডার যোগ দিবেন বা তার সৌজন্যেই এ আয়োজন তা বলা হয়নি। কিন্তু সন্ধ্যায় যখন আমি ল্যাপটপ নিয়ে বসেছি, তখন একজন সৈনিক এসে খবর দিল যে ডিনারে বিগ্রেড কমান্ডার আসবেন। তার মানে হল, সঠিক সময়ে উপস্থিত থাকতে হবে ও সঠিকভাবে পোশাক আসাক পরতে হবে। কিন্তু সমস্যা হল আমি সাথে জুতো না নিয়ে কেডস নিয়েছি। ডিনার পার্টিতে যাই পরা যাক, কেডস পরা সমীচীন হবে না। তাই আমি চামড়ার স্যান্ডেলের সাথে প্যান্ট আর একটা হাফশার্ট পরলাম। ফুলশার্ট পরতে পারছি না। কারণ এতে শার্ট ইন-করতে হবে। আর স্যান্ডেলের সাথে শার্ট ইন-করে পরলে ভাল দেখাবে না। তাই এভাবেই থাকলাম।

সময় মতো গোল ঘরে উপস্থিত হলাম। পরিচয় হল অনেক অফিসারের সাথে। ডিনারে গিয়ে দেখলাম, বিষয়টি ততোটা ফর্মাল নয়। তবে আমিসহ অন্য ইউনিটের আরো দু একজন অফিসার স্যান্ডেল পরেছিলেন। খাবারের ম্যানুতে ছিল ফ্রাইড রাইস, চিকেন ফ্রাই, মাছ, গরুর মাংস ও গরুর মগজ। ভাতের পাশাপাশি পরাটাও ছিল। আমি ভাত না খেয়ে পরাটাই খেলাম। ডিনারটি ছিল চমৎকার!

ডিনারের পর গল্পগুজবে কেটে গেল ঘন্টা খানেক। বিগ্রেড কমান্ডার জনাব রফিকুল ইসলাম চলে গেলে আমরাও ভ্রমণের ক্লান্তির সুবাদে সহজেই ছাড়া পেলাম। বলা হল, আগামীকাল আমাদের বুনিয়া শহরটি ঘুরে দেখান হবে। সেই সাথে নিয়ে যাওয়া হবে একটি জল বিদ্যুৎকেন্দ্র পরিদর্শন করতে। জল বিদ্যুৎ প্রকল্পের ভিতর একটি মনোমুগ্ধকর জল প্রপাতও নাকি আছে । জলপ্রপাত দেখা হলে যাওয়া হবে একটি নিকটবর্তী ক্যাম্পে যেখান থেকে হ্রদ এলবার্টের সৌন্দর্য উপভোগ করা যাবে। ( চলবে–)