অন্য দেশে, অন্য মিশনেঃ সারি নদী ও বুদানা জলপ্রপাত

মোঃ আব্দুর রাজ্জাক
Published : 11 Dec 2016, 09:39 AM
Updated : 11 Dec 2016, 09:39 AM

পূর্ব প্রকাশিতের পর
কিস্তি-১,কিস্তি-২

২২ নভেম্বর, ২০১৬। মঙ্গলবার ডিআর কঙ্গোর প্রথম সকাল)

সকাল ছয়টায় ঘুম থেকে উঠলাম। রুম থেকে বের হয়ে দেখি পূর্বাকাশে সূর্য অনেকটা উপরে উঠেছে। ব্যানব্যাটের এ ক্যাম্পটি একটি অনুচ্চ মালভূমির উপর অবস্থিত। পূর্ব দিকে আনত হয়ে এ মালভূমি শহরের দিকে গেছে। শহরটা ক্যাম্প থেকে বেশ নিচুতে। শহরের পূর্ব দিকে পাহাড় শ্রেণি। সূর্য পাহাড় শ্রেণি ছেয়ে উপরেই উঠেছে। তাই মনে হল এখানে অতি তাড়াতাড়ি ভোর হয়। গতকাল এক সৈনিক বলেছিল, এখানে সকালের সূর্য দেখতে বেশ মনোরম। কিন্তু সেই মনোরম সূর্য দেখার সৌভাগ্য আজ হল না।


গতকাল এনটেবে থেকে গোসল করে এসেছিলাম। রাতে গোসল করা হয়নি। আমি সাধারণত কোন ভ্রমণের শেষে ঘুমানোর আগেই এককার গোসল করে নেই। ইউএন মিশনের এধরনের স্থাপনায় গোসল করার জন্য ঠাণ্ডা-গরম দু ধরনের পানির ব্যাবস্থাই থাকে। তাই গোসলটা বেশ আরামদায়কই হয়। কিন্তু সকালে উঠে একটু লেখালেখিতে ব্যস্ত থাকায় গোসলটা করা হল না। তাছাড়া আমার সাথে কোন সবান নেই। মনে হয়েছিল যেখানে থাকব, সেখানে এটাচ বাথরুমে হয়তো সাবান থাকবে। কিন্তু এখানে এটাচ বাথও নেই, নিজের কাছে সাবানও নেই। চাইলে তারা সাবানও সরবরাহ করত। কিন্তু সংকোচবসত চাইনি।

নাস্তা করতে গেলাম সকাল সাড়ে আটটায়। সেনাবাহিনীর নিয়ম-নিষ্ঠতার নিরিখে নাস্তার টেবিল এ সময় ফাঁকা হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু শান্তিরক্ষা মিশনে অফিসারগণ হয়তো একটু রিলাক্স থাকতে চান। তাই নাস্তার টেবিলে বেশ কয়েকজন অফিসারকে পেলাম। আমাদের হোস্ট লে. কর্নেল জাহিদকেও নাস্তার টেবিলে পাওয়া গেল। নাস্তায় ছিল পরাটা, সবজি ও ডিমের মামলেট ও ভাজি। সেনাবাহিনীর বাবুর্চিগণ অত্যন্ত দক্ষ। ইতোপূর্বে বহুবার তাদের আতিথ্য গ্রহণ করেছি। সব সময় তাদের সরবরাহ করা খাবারগুলোকে স্বাদে অপূর্ব মনে হয়েছে। আজও তার ব্যতীক্রম হল না।

বুদানা পানি বিদ্যুৎ প্রকল্প
নাস্তার পর রওয়ানা হলাম আমাদের এনড্রোমে ক্যাম্প থেকে পশ্চিম দিকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরে একটি জলপ্রপাত ও বিদ্যুৎ প্রকল্প দেখতে। আমাদের সাথে গেলেন ক্যাপ্টেন রেজওয়ান কাদির। কিন্তু গাড়িতে উঠে প্রথম পরিচয়েই রেজওয়ান বললেন, তিনি আসলে সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন নন। তিনি হলেন, ফরাসী ভাষার অনুবাদক বা দোভাষী। এ মিশনে রেজওয়ানের মতো আরো তিনজন দোভাষী আছেন, যারা ফরাসি ভাষায় স্থানীয় মানুষের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করেন। কারণ স্থানীয়রা ইংরেজি বোঝে না। তাই টহল থেকে শুরু করে স্থানীয় নেতাদের সাথে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অফিসারদের আনুষ্ঠানিক/অনানুষ্ঠানিক মিটিং গুলোতেও দোভাষীর কাজ করেন। দোভাষী রেজওয়ান জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স-মাস্টার্স ডিগ্রি করে ঢাকার আলিয়াস ফ্রাসেঁ থেকে ফ্রেন্স ভাষায় ডিপ্লোমা করেছেন। এর পর বাংলাদেশ আর্মিতে তিন বছরের জন্য চুক্তিতে নিয়োগ পেয়েছেন। তিনি প্রায় তিন বছর থেকে ডিআর কঙ্গোতে বাংলাদেশ আর্মির সাথে কাজ করছেন।

যেহেতু শান্তিরক্ষা মিশনে সেনাবাহিনীর সাথে কাজ করতে হলে তাকে সেনাবাহিনীর সদস্য হতে হয়, তাই তাকে এখানে ক্যাপ্টেনের rank দেয়া হয়েছে। তিনি নিয়মিত সেনাবাহিনীর পোশাক পরছেন, বিধিমত সেলুট করতেও পারেন, সেলুট গ্রহণ করতেও পারেন। তবে আমার একটু খটকা লাগল যে তিন বছর পর যখন তার চাকরি শেষ হবে কিংবা ফরাসিভাষী মিশন শেষ হবে তখন তিনি দেশে ফেরত গিয়ে বেকার হয়ে পড়বেন। আর ঐ সময় তার সরকারি চাকরি করার বয়সও থাকবে না। তাই আমি তাকে পরামর্শ দিলাম, তিনি দেশে ফিরে একটি ভাষা শিক্ষার স্কুল খুলতে পারেন যেখানে ফ্রেন্সসহ অন্যান্য ভাষা শিক্ষা দেয়া হবে। অবশ্য ক্যাপ্টেন রেজওয়ান সরকারি চাকরি পছন্দ করেন না বলে জানালেন।

মাত্র আধা ঘন্টার ড্রাইভে আমরা জলবিদ্যুৎ প্রকল্প এলাকায় পৌঁছিলাম। ফটকে একজনমাত্র কর্মচারি বসে আছেন। রাস্তায় একটি লোহার পাইপ ফেলে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করা হয়েছে। আমাদের দোভাষী রেজওয়ান গিয়ে কর্মচারি বা গার্ডকে ফরাসী ভাষায় একটি অনুরোধপত্র দেখালেন। অমনি লোহার পাইপ উপরে উঠল। আমরা গাড়ি নিয়ে ভিতরে ঢুকলাম।

বাংলাদেশের কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের নিরাপত্তা ব্যবস্থার মতো কড়া কড়ি তো দূরের কথা এখানে কোন নিরাপত্তার বালাইয়েই নেই। স্থানীয় লোকজন অবাধে এখানে ঢুকছে, বের হচ্ছে। প্রকল্পের ভিতর তাদের আবাদ-সুবাদও রয়েছে। কেউ কেউ বাঁধের উপর দিয়ে পায়ে হেঁটে ওপারের পাহাড়ে যাচ্ছে, আসছে।

শারি নদী
একটু দূরে গাড়ি রেখে আমরা শারি নদীর উপর নির্মিত বাধেঁর উপর গেলাম। অতি সরু পাহাড়ী নদী দুই পাহাড়ের মাঝ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। সামান্য দূর থেকেও বোঝা যাবে না যে এখানে কোন নদী আছে। অথচ কাছে গিয়ে দেখা গেল কি প্রচণ্ড স্রোত এ নদীতে। বাংলাদেশের কাপ্তাই বাঁধের স্পিল ওয়েতে যে পানির চাপ পড়ে এখানে তার চেয়ে অনেক বেশি চাপ পড়ছে। প্রচণ্ড গতিতে গর্জন করে পানি নিম্ন দিকে প্রবাহিত হচ্ছে। বাঁধটি অত্যন্ত সংকীর্ণ। নিচের কংক্রিটের উপর লোহার পাত দিয়ে যাতায়াতের পথ তৈরি করা হয়েছে।

এ সারি নদীর নামটা কোত্থেকে এল তা আমরা জানতে পারিনি। তবে এটা হয়তো কোন ফরাসি শব্দ হবে। আমাদের বাংলা ভাষার রূপকথার সুখ-সারি পাখির নামের মতো বলে নামটা মনে রাখা সহজ হল। উৎপত্তিস্থল হয়তো বেশি দূরে কোথাও নয়। কারণ এখানে অদূরে কোন হ্রদ থাকার কথা ইন্টারনেটের কোথাও নেই, আমাদের সাথে পুরাতন লোকরাও তা বলতে পারেন না। তবে পাহাড়ের উপর থেকে ঝরে পড়া অসংখ্যা ঝরনার মিলিত স্রোতই হয়তো এই নদী। ইন্টারনেট ঘেঁটে যা জানলাম তাতে মনে হল এ নদী পশ্চিম দিকে গিয়ে ইতুরি নদীতে পড়েছে। আর ইতুরি নদী গিয়ে পড়েছে সেই বিখ্যাত কঙ্গো নদীতে। তার মানে হল কঙ্গো নদীর উপনদীর একটি উপনদী হল এই শারি নদী।

জলপ্রপাত ও টারবাইন রুম
বাঁধ থেকে ছবি ও ভিডিও চিত্র নিয়ে আমরা আমাদের গাড়ির কাছে ফিরে এলাম। দেখি গাড়ির কাছে দুটো ছেলে বাচ্চা এসে বিস্কুট বিস্কুট বলে আবেদন নিবেদন করছে। ওদের ফরাসি ভাষা আমাদের মধ্যে কেবল দোভাষী রেওযানই বোঝে। ওদের নাম জানতে চাইলাম দোভাষীর মাধ্যমে। কিন্তু নামগুলো কঙ্গোলিজ ভাষার মনে হল। তাই মনে রাখতে পারিনি। কেবল এ বাচ্চা দুটো নয়, রাস্তায় যত মানুষের সাথেই দেখা হয়, কেবল প্রাপ্ত বয়স্ক পুরুষ মানুষ ছাড়া সবাই আমাদের কাছ থেকে বিস্কুট চায়। এমনকি স্কুলের পথে চলা কিশোরী মেয়েরাও।


গাড়িতে চড়ে আমরা প্রায় গেটের কাছে এসে ডান দিকে মোড় নিয়ে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে উত্তর দিকে গেলাম। কিছুদূর গিয়ে পাওয়া গেল বিদ্যুৎ প্রকল্পের আসল স্থান টারবাইন এলাকা। এখানে এসে বুঝতে পারলাম, আমরা ইতোপূর্বে যে বাঁধটায় গিয়েছিলাম ওটা ছিল রীতিমত পাহাড়ের উপরে। এই নদী এই টারবাইন এলাকায় এসে উপর থেকে প্রচণ্ড গতিতে নিচে পড়ছে। এটা হল এই নদীর পানির জল প্রপাত। ইতোপূর্বে ঝরনা দেখেছি। কিন্তু আমার জীবনে দেখা এটাই প্রথম জল প্রপাত। এ জলপ্রপাতের নাম সম্ভবত 'বুদানা জল প্রপাত'। কারণ এ জলপ্রপাতটাকে ঘিরেই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রটি নির্মিত হয়েছে। প্রকল্পটির নাম হল বুদানা প্রকল্প। বাঁধের কাছ থেকে ভিন্ন পথে টারবাইন ঘোরানের জন্য যে পানিটুকু আলাদা করা হচ্ছে তা টারবাইন রুমের মধ্যে নেয়া হচ্ছে দুটো বড় বড় পাইপের মধ্য দিয়ে। প্রায় ৬০/৭০ ফুট উঁচু থেকে এ পাইপ দুটোতে পানি ঢুকছে। তা এসে পড়ছে টারবাইনের ব্লেডের উপর। এই পানির তোড়েই টারবাইনের ব্লেডগুলো ঘুরে তা আবার মুল জেনারেটরকে ঘোরাচ্ছে।

আমরা কথা বললাম এ প্রকল্পের প্রধান প্রকৌশলী মাহিন্দ্রের সাথে। নামটা ইন্ডিয়ান ইন্ডিয়ান মনে হলেও এটা আসলে কঙ্গোলিজ নাম। জানলাম, প্রকল্পটি তৈরি করেছে দক্ষিণ আফ্রিকা। যে পয়েন্ট থেকে টারবাইনের দিকে পাইপে করে পানি আসছে সেই পয়েন্টেই কংক্রিটের দেয়ালে লেখা আছে ১৯৪০। মানে এ সালেই হয়তো এটা তৈরি হয়েছিল। প্রধান প্রকৌশলী বলেন, তিনটি টারবাইনে এখানে মাত্র ১০ মেঘাওয়াট বিদ্যুৎ তৈরির ক্ষমতা আছে। তবে বর্তমানে দুটো টারবাইন চালিয়ে মাত্র ৫ মেঘাওয়াট বিদ্যুৎ তৈরি হচ্ছে। এ দিয়ে বুনিয়া শহর ও প্রায় ৬০ কিমি দূরবর্ত মুংগালা শহরে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়।

কত সরল নিরাপত্তা!
প্রাকৃতিক অবকাঠামো ও যন্ত্রপাতির সংখ্যা দেখে আমার মনে হল, এ বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি তৈরি করতে অত্যন্ত কম খরচ হয়েছে। আর এর পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণ খরচও কম। নিরাপত্তা ব্যবস্থার বালাই নেই। গেইটে একজন মাত্র দারোয়ান। আর টারবাইন এলাকায় কাজ করছে চার/পাঁজন লোক।
আমরা জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বলে হয়তো দ্রুতই আমাদের এ প্রকল্প পরিদর্শনের সুযোগ ঘটেছে। কিন্তু আমাদের দেশের কাপ্তাই বিদ্যুৎ প্রকল্প পরিদর্শন তো আমাদের অনেকের পক্ষেই সম্ভব নয়। আমি কলেজে পড়াকালীন একবার শিক্ষা সফরে গিয়ে কাপ্তাই জল বিদ্যুৎ প্রকল্প দেখার চেষ্টা করেছিলাম।

আমাদের সাথে ছিলেন আমাদের একজন সম্মানিত শিক্ষক। কিন্তু আমাদের প্রথম ফটক থেকেই বিদায় নিতে হয়েছিল। কর্তব্যরত ব্যক্তিরা বললেন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পূর্বানুমোদন ব্যতীত এটা দেখার সুযোগ নেই। এর পর একটি গোয়েন্দা সংস্থায় কাজ করতে গিয়ে বাঁধ পর্যন্ত গিয়েছি। তারও অনেক পরে ২০১০ সালে এসে এটা পরিদর্শনের সুযোগ পেয়েছিলাম। আর তাও ছিল পুলিশের সিনিয়র অফিসার হওয়ার সুবাদে।

কঙ্গো নদীতে জলবিদ্যুতের অপার সম্ভাবনা
বলাবাহুল্য, কঙ্গো নদী ডেমোক্রাটিক রিপাবলিক অব কঙ্গোকে প্রায় তিন দিক থেকে ঘিরে প্রবাহিত হচ্ছে। এর উৎপত্তিস্থল হল জাম্বিয়ায়। সেখানে এর নাম জাম্বেসি নদী। জাম্বেসি জলপ্রপাত থেকে এর উৎপত্তি হলেও এর সাথে ৪,৭০০ কিলোমিটার ব্যাপী এর পথ চলার মাঝে এর সাথে যুক্ত হয়েছে হাজারও নদী, ঝরণা ও জলপ্রপাত। এ নদী ও তার উপনদীগুলোর উপর বর্তমানে ৪০টি জলবিদ্যুৎ প্রকল্প রয়েছে। আর এ নদীদে জলবিদ্যুৎ তৈরির জন্য যে প্রকৃতিক অবকাঠামো রয়েছে সেগুলোকে কাজে লাগিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদান করা হলে তার পরিমাণ হবে সারা পৃথিবীর মোট উৎপাদিত জলবিদ্যুতের শতকার ১৩ ভাগ। আর এ দিয়ে গোটা উপ-সাহারা আফ্রিকায় বিদ্যুতের চাহিদা মেটানো সম্ভব।

( চলবে—)