অন্য দেশে, অন্য মিশনেঃ বুনিয়া থেকে গোমা

মোঃ আব্দুর রাজ্জাক
Published : 7 Jan 2017, 01:16 AM
Updated : 7 Jan 2017, 01:16 AM

পূর্ব প্রকাশিতের পর

বুনিয়া থেকে গোমা

২৩ নভেম্বর, ২০১৬, বুধবার। সকালের নাস্তা সেরে সোয়া আটটার মধ্যেই আমাদের বিমান বন্দরের দিকে রওয়ানা হতে হল। পিছনে পড়ে রইল ইন্দ্রোমো ক্যাম্প আর এ ক্যাম্পের বাংলাদেশি সেনা অফিসারদের আতিথ্য। আমাদের মূল হোস্ট ছিলেন লে. কর্নেল জাহিদ। কিন্তু এ ব্যাটালিয়নসহ আশেপাশের অন্যান্য ইউনিটের অফিসারগণও আমাদের যথেষ্ঠ আদর- আপ্যায়ন করেছেন। প্রত্যেকের কাছ থেকেই উঞ্চ অভ্যর্থনা পেয়েছি। এখানে পৌঁছার আগে আমরা কাউকেই চিনতাম না, জানতাম না। কিন্তু আমাদের প্রতি তাদের আচরণে মনে হয়েছে, আমরা তাদের অনেক দিনের চেনা।

ইদ্রোমো ক্যাম্প থেকে বিমান বন্দরে যাত্রাপথে পড়ে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর ইউনিট 'ব্যানএয়ার'। এটা এয়ারপোর্টের সাথে লাগা। কিন্তু আমাদের হাতে অল্প সময় থাকার জন্য আমরা এ ইউনিটের ভাইদের আতিথ্য গ্রহণ করতে পারিনি। আমার বন্ধু ইউং কমান্ডার আসাদ মালি মিশন থেকে তার সহকর্মী ইউং কমান্ডার মুনিমকে আমাদের কথা বলেছিল। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য যে তাকে আমরা ফোনেও যোগাযোগ করতে পারিনি।

আমাদের হাতে মুভমেন্ট অব পার্সোনেল (এমওপি) থাকলেও সেটা তৈরি করা হয়েছিল দক্ষিণ সুদানের মিশন (আনমিস) থেকে। তাই ফ্লাইট সিডিউলে আমাদের নাম ছিল না। তবে কথা হল, এ বিমান বন্দরের প্রশাসনিক কাজগুলো করছে আমাদের বিমান বাহিনীর সদস্যরাই। তাছাড়া আমাদের সাথে ব্যানব্যাটের একজন জেসিও ছিলেন। তিনিই ওদের ম্যানেজ করার দায়িত্ব নিলেন। অল্প সময়ের মধ্যে আমাদের নাম সিডিউলে উঠল। আমরা বিমানের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম। কিছু পরে বিমান বন্দরে আসলেন বিগ্রেডিয়ার জেনারেল রফিক। তিনি উত্তরের বিগ্রেডের অধিনায়ক। তিনি একটি ইউনিট পরিদর্শনে যাবেন। তাই আমাদের সহযাত্রী।

বাঙালি দেখলেই বাঙালিরা বাঙালি বনে যায়
এখানে বাংলাদেশি এক মুভকন স্টাফের আচরণে আমি বেশ মনঃকষ্ট পেলাম। বিগ্রেড কমান্ডার যদিও আমাদের সাথে একই বিমানে ভ্রমণ করছিলেন তবুও তার মর্যাদা আর আমাদের সাধারণ শান্তিরক্ষীদের মর্যাদা তো এক নয়। তার জন্য রয়েছে আলাদা অপেক্ষাগার। আমরা সাধারণ অপেক্ষাগারে বসে থাকতেই বিগ্রেডিয়ার রফিক অপেক্ষাগারে ঢুকলেন। গত পরশু তার সাথে বুনিয়ার ব্যানব্যাটে একটি ডিনার পার্টিতে তার সাথে আমাদের পরিচয় হয়েছিল। অতি ভদ্র, ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মাটির মানুষ এই ঊর্ধ্বতন সেনা অফিসারটি। অপেক্ষাগারে ঢুকেই তিনি আমাদের কুশল জিজ্ঞাসা করলেন। তাকে নিয়ে যাওয়া হাচ্ছিল ভিআইপি অপেক্ষাগারে। কিন্তু আমরা ভাবলাম, হয়তো তাকে বিমানের ওঠানোর জন্যই নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। তাই আমরাও তার সাথে সাথে যাওয়া শুরু করলাম।

একটু দূরে গিয়ে বিমান বাহিনীর মুভকনের স্টাফ রাগত স্বরে বললেন, 'এই কোথায় যান? আগের জায়গায় যান'। মানে সাধারণ অপেক্ষাগারে বসেন। আমরা অনেকটাই আহম্মক বনে গেলাম। আমাদের বললেই হত যে বিগ্রেডিয়ার সাহেব ভিআইপি লাউঞ্জে যাচ্ছেন। তখন আমরা নিজ থেকেই আমাদের ওজন বুঝে পিছুটান দিতাম। অযথা রাগারাগির কি দরকার ছিল, ভাই?

এরপর বিমানে উঠতে যাওয়ার সময় আমাদের ঐ বাংলাদেশি স্টাফ বললেন, 'এ-ই দেখান, আপনার এমওপি, দেখান? ভদ্রলোক আমার সাথে এমনভাবে কথা বলছিলেন যেন আমি এ বিমান বন্দরে ভুলক্রমে এসে পড়েছি। কিন্তু তিনি বুঝলেন না যে শান্তিরক্ষা মিশনে যারা আসেন তারা রাম-রহিম-যদু-মধুর মতো একদম সাদা মাটা মর্যাদার লোক নন। তারা বড় অফিসার না হলেও সরকারি কর্মচারি, হয় সশস্ত্রবাহিনীর, নয়তো পুলিশের।

আর মজার বিষয় হল, আমার সাথী অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মুহিউদ্দিনকে তিনি 'স্যার' সম্বোধনই করছিলেন। আমি অপেক্ষাগারে বই পড়তে ব্যস্ত থাকার ফাঁকে মুহিউদ্দিন হয়তো পরিচয় দিয়েছিল, তাই তার জন্য এই বাড়তি কদর। কিন্তু আমি ছিলাম অপরিচিত। তাই আমার জন্য পাপ্য যতটুকু তার চেয়েও কম। আমি ঐ স্টাফকে বললাম, 'আগের জন অতিরিক্ত এসপি, আর আমি হলাম বাংলাদেশ পুলিশের এসপি'। কিন্তু ওতেও তার ভাবান্তর হল না। কারণ এর পর বিমানে ওঠার সময়ও তার সাথে দেখা হয়েছিল। ভেবেছিলাম, তিনি বিমানে ওঠার পূর্বে হয়তো একটা কিছু বলবেন। কিন্তু তখনও তাকে বিব্রত হতে দেখিনি।

বলা বাহুল্য, বাঙালিরা বিদেশের মাটিতে এসে যে একদম অভদ্র বনে যান তা নয়। তারা অন্যান্যাদের সাথে ভদ্র আচরণই করেন। বিমানের চেক-ইন চেক-আউট, অপেক্ষা, প্রতীক্ষা ইত্যাদি সব স্থানেই অন্যান্য দেশের নাগরিকদের মতো সমান তালে ভদ্রতা প্রদর্শন করেন। কিন্তু যথনই তাদের কাছে বাঙালি চেহারার কেউ এসে পড়েন, তখনই তারা স্বভাবসুলভ বাঙালি আচরণ শুরু করে। আমার অভিজ্ঞতামতে পৃথিবীর অনেক সংস্কৃতিতে মুখ ফুটে দুঃখ প্রকাশ করা কিংবা ধন্যবাদ দেয়ার নিয়ম নেই। আমাদের সমাজেও পূর্বে এমনটি করা হত বলে মনে হয় না। ছোট কালে আমরা কাউকে গ্রামগঞ্চে এমনকি স্কুলেও মুখ ফুটে ধন্যবাদ বলতে শুনিনি। এই ঘটা করে ধন্যবাদ দেয়া আর দুঃখ প্রকাশ করার রীতি যে ইংরেজদের কাছ থেকে এসেছে সেটা আমি মনে প্রাণে বিশ্বাস করি। কিন্তু মুখ ফুটে না বললেও আমাদের সংস্কৃতিতে এগুলো যে একেবারেই নেই, তা কিন্তু নয়। মানুষের আচরণ, মুখের ভাবভঙ্গি ইত্যাদিই বলে দেয় কে দুঃখিত, আর কে কৃতজ্ঞ। যা হোক, ঐ বাংলাদেশি ভাইয়ের আচরণ তার সংগঠনের সামগ্রিক আচরণের প্রতিনিধিত্ব করে না। কারণ এর পূর্বে ও পরে তাদের কাছ থেকে আমরা যে আচরণ পেয়েছি কিংবা সাধারণভাবে পেয়ে থাকি সেটা অবশ্যই প্রশংসনীয়।

গোমা থেকে বুনিয়া- টিউবের মধ্যে আকাশ ভ্রমণ
আমাদের ১৯ সিটের বিচ ক্রাফটি গোমার উদ্দেশ্যে বুনিয়ার আকাশে উড়ল সকাল পৌনে নয়টায়। বুনিয়া থেকে গোমা আকাশ পথে ৩৭৭ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে। বিচ ক্রাফ্টে ভ্রমণের অভিজ্ঞতা পূর্বে বেশি হয়নি। ২০০৮ সালে সুদান মিশনে কাজ করার সময় সর্ব প্রথম এ ধরনের এয়ার ক্রাফ্টে ভ্রমণ করেছিলাম। কিন্তু এ কঙ্গো ভ্রমণকালে বিচ ক্রাফ্ট ঐ যে পিছু নিয়েছে সেখান থেকে আর নিষ্কৃতি পাচ্ছি না। জুবা থেকে এনটেবে আসলাম ১৫ সিটের বিমানে, এনটেবে থেকে বুনিয়ায় ঐরূপ বিমানেই। আর এই বুনিয়া থেকে গোমায় যাচিছ ঠিক একই ধরনের বিমানে।

আজকের বিচ ক্রাফটির গঠন একটু আলাদা। বিমানে উঠেই মনে হল, আমরা যেন একটি টিউবের ভিতর প্রবেশ করছি। আমরা বিমান থেকে নিচের দৃশ্যাবলীর ছবি তুলব বলে সর্বশেষ আসনে বসলাম। এখান থেকে সামনে পাইলট ও কো-পাইলটকে দেখা যাচ্ছে। মনে হচ্ছে একটি গোলাকার পাইপের ভিতর বসে আমরা আকাশ ভ্রমণে বের হয়েছি।

গোমা বিমানবন্দর
গোমায় এসে অবতরণ করলাম সকাল ১০:৫০ মিনিটে। জৌলুস না থাকলেও আফ্রিকান পরিমাপে বেশি বড়সহ এ বিমান বন্দরটি। কিছু কিছু বাণিজ্যিক বিমান এখানে ওখানে দেখা গেলেও এয়ারপোর্টে দাঁড়ানো ও উঠা নামা করা বিমানগুলোর প্রায় সবই জাতিসংঘের কোন না কোন সংস্থার।

বিমান বন্দরের বাইরে এসে কিছুক্ষণ অপেক্ষা। আমাদের জন্য বিমান বন্দরে গাড়ি পাঠানোর কথা ছিল মেজর রাজির। তিনি গোমার ব্যান-ইন্জিনিয়ার কোম্পানির অফিসার। তার সাথে আমাদের সরাসরি কথা হয়নি। আমাদের কন্টিনজেন্ট কমান্ডার এআইজি মাহবুব স্যারই তার সাথে যোগাযোগ করেছেন। আর আমরা যখন বুনিয়া থেকে রওয়ানা দেই তখনও ব্যান ব্যাট এর ডেপুটি কমান্ডার লে. কর্নেল জাহিদও তাদের বলে দেয়ার কথা। তবে কোথায় যেন একটা কমিউনিকেশন গ্যাপ হয়ে গেছে। তাই এসব সংবাদ সঠিক সময়ে সঠিক লোকের কাছে পৌঁছেনি। তাই আমরা গোমা বিমান বন্দরে আমাদের নিতে আসার কোন ব্যক্তিকেই পেলাম না।

বাংলাদেশ মিলিটারি পুলিশের একজন মেজর এই সময় বিমান বন্দরে এলেন। তিনি এসেছেন তারই কোম্পানির অন্য অফিসারদের নেয়ার জন্য। আমরা তার কাছে আমাদের সমস্যার কথা বললে তিনি মেজর রাজির সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হলেন। আমার সাথী অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মহিউদ্দিন অনেকটাই অধৈর্য হয়ে পড়ল। কিন্তু যেখানে আমরা কেবলই অতিথি সেখানে অধৈর্য হবার কিছু নেই।

অবশেষে ব্যানএমপির মেজর সাহেব বললেন, 'যদি আমি মেজর রাজি বিংবা ব্যান ইনজিনিয়ারিং ইউনিটের কাউকে না পাই তবে আমি আপনাদের সাথে করে আমাদের ইউনিটে নিয়ে যাব। আপনারা সেখান থেকে যোগাযোগ করতে পারবেন'। বলাবাহুল্য, এ আশ্বাস আমাদের জন্য ছিল অনেক বড় শান্তনা। কারণ এ শহরে ইউএন সহকর্মীদের সহায়তা না পেলে নির্ধারিত গন্তব্যে পৌঁছান প্রায় অসম্ভব।

কিন্তু আমাদের ব্যানএমপির ক্যাম্পে যেতে হল না। অল্প সময়ের মধ্যে ব্যান ইনজিনিয়ার কোম্পানির মুনিগি ক্যাম্প থেকে সিনিয়র ওয়ারেন্ট অফিসার ওজিওর সাহেব একটি জীপ নিয়ে আসলেন এক কর্পোরালকে নিতে। ব্যানএমপির মেজর সাহেব আমাদের তাদের সাথেই ট্যাগ করে দিলেন। মেজর রাজির ক্যাম্পে যাবার জন্য একটি সুব্যবস্থা হওয়া আমরা বেশ স্বস্তি পেলাম। কারণ এ শহরে প্রাইভেট যানের প্রচলন খুবই কম। আমাদের সেনাবাহিনীর কোন না কোন ইউনিটের সহায়তা ছাড়া এক স্থান থেকে অন্যস্থানে যাতায়াত করা আমাদের মতো অভ্যাগতদের জন্য বড়ই মুশকিল।

এর মাঝে এক বিমান থেকে অবতরণ করলেন আমাদের কিনশাসার মহিলা ফর্মড পুলিশ ইউনিটের কমান্ডার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আয়েশা সিদ্দিকা। অতিরিক্ত পুলিশ সুপার হলেও আয়েশার ঘাড়ে পুলিশ সুপারের ব্যাজ পরান হয়েছে। দেশের ভাবমূর্তি ও ইউনিটের কমান্ড কন্ট্রোলের জন্যই তাকে এ ইউনিটের জন্য চলতি দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। এখানে অপ্রত্যাশিতভাবে আয়েশাকে পেয়ে যাব, সেটা ভাবতেও পারিনি। ইতোপূর্বে আমাদের পরিকল্পনা ছিল উগান্ডার এনটেবে থেকে আমরা সরাসরি কিনশাসায় গিয়ে আমাদের কঙ্গো ভ্রমণ শুরু করব। কিন্তু ভিসা জটিলতার কারণে আমাদের সে যাত্রায় খান্ত দিতে হয়েছিল। এ যাত্রায় আমরা তাই কিনশাসার পরিবর্তে বুনিয়াকেই আমাদের ভ্রমণের প্রথমপদে রেখেছিলাম।

কঙ্গোর উদ্দেশ্যে যাত্রা করার পূর্বে আমি আয়েশাসহ কয়েকজনকেই মেইল দিয়েছিলাম। কিন্তু অন্যান্য স্থান থেকে সেই মেইলের উত্তর পেলেও আয়েশার কাছ থেকে কোন উত্তর পাইনি। বিষয়টির আয়েশাকে স্মরণ করিয়ে দিলেন আমার সফর সঙ্গী অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মুহিউদ্দিন। তবে আয়েশা আমাদের মেইল পায়নি বলে জানাল। যাহোক, আয়েশাকে পেয়ে সুবিধা হল, সে কিনশাসায় তার ইউনিটকে আমাদের সফর সম্পর্কে যাবতীয় নির্দেশ দিয়ে রাখল যার ফলে কিনশাসায় অবতরণ করে আমাদের কোন অসুবিধা হয়নি। (চলবে–পঞ্চম কিস্তি)