অন্য দেশে, অন্য মিশনেঃ গোমা থেকে মুশিকি

মোঃ আব্দুর রাজ্জাক
Published : 17 Jan 2017, 05:40 AM
Updated : 17 Jan 2017, 05:40 AM

মেজর রুজিনার নেতৃত্বে কনভয়

২৩ নভেম্বর বিকেল সাড়ে তিনটার দিকে আমরা গোমার মুনিগি ব্যানইনজিনিয়ার ক্যাম্প থেকে মুশিকির দিকে রওয়ানা দিলাম। আমাদের কনভয়ের নেতৃত্ব দিলেন মেজর রুজিনা। মেজর রুজিনা আর্মির ইডুকেশন কোরের অফিসার। তিনি বাংলায় অনার্স মাস্টার্স সম্পন্ন করে সেনাবাহিনীর শর্টকোর্সে প্রবেশ করেছেন। অত্যন্ত মিশুক একজন মহিলা অফিসার। যদিও মুশিকিতে পৌঁছার পূর্বে তার সাথে আমাদের মিথস্ক্রিয়া কমই হয়েছিল, মুসিকিতে পৌঁছে তার সাথে আরো বেশি মেশার সুযোগ হল। তার বাড়ি হচ্ছে শরিয়তপুর জেলার নরিয়া থানায়।

ভাবতেও অবাক লাগে যে মাত্র ২০০১ সালে মহিলাদের বাংলাদেশ সশস্ত্রবাহিনীর সাধারণ কোরসমূহে ভর্তি করা শুরু হয় যারা ২০০৩ সালে নিয়মিত কমিশন লাভ করেন। অথচ এর এক যুগ পরেই সেনাবহিনীর মহিলা অফিসারগণ ডিআর কঙ্গোর এই মুশিকি ক্যাম্পেও দায়িত্ব পালন করছেন।

মুশিকি হল গোমা শহর থেকে ত্রিশ কিলোমিটার পশ্চিম দিকে একটি ছোট পাহাড়ী উপত্যকা অঞ্চল। একে শহর বলা ভুল হবে। কারণ এখানে একটি বাজার থাকলেও সেটা গ্রাম্য পরিবেশের বাইরে উঠতে পারেনি। কিন্তু রাস্তা মাত্র ত্রিশ কিলোমিটার হলেও এর অর্ধেকটি হল পাহাড়ের উঠতি পথ। মাত্র এক ঘন্টারও কম সময় গাড়ি চালিয়ে আমরা সাকে নামক স্থানে উপস্থিত হলাম। এ সাকে শহরের পরেই শুরু হয়েছে পাহাড়ী রাস্তা যে রাস্তা বেয়ে কেবল উপরের দিকেই উঠতে হয়। সাকে থেকে মুশিকির সরাসরি দূরত্ব হয়তো মাত্র পাঁচ/ সাত কিলোমিটার হবে। কিন্তু পাহাড় বেয়ে ঘুরে ঘুরে উঠতে আট/দশ কিলোমিটারের মতো যেতে হয়।


সাকে থেকে শুরু হল পাহাড়ের গা বেয়ে উপরে ওঠা। পাহাডর চড়তি পথে ওঠার অভিজ্ঞতা আমার নতুন নয়। কিন্তু এ পাহাড় সেই পাহাড় নয়। যদি গোমা শহরের উচ্চতা ১৫৩০ মিটার হয় সেটাও আমাদের দেশের সর্বোচ্চ পর্বত শৃঙ্গের চেয়েও বেশি। আর আমরা মুশিকির যে পাহাড়ে যাব তার উচ্চতা ২১০০ মিটিারের বেশি। তার অর্থ হল আমাদের প্রায় ৬শত মিটার উঁচু উঁচু পাহাড় ডিঙ্গাতে হবে।

তখন বিকেল। সূর্য অস্তগামী। তবে আমাদের গাড়ি ঘন ঘন দিক পরিবর্তন করায় সূর্যকে বিভিন্ন দিক থেকে অনুভব করতে পারছিলাম। অস্তগামী সূর্যের লাল রঙ সবুজ পাহাড়ের গায়ে লেগে অনেক স্থানে রংধনুও তৈরি করছিল। মনে হল, রাস্তার কোন এক স্থানে নেমে উপর থেকে নিচের পাহাড়ের ফসলের ক্ষেতগুলো প্রাণ ভরে দেখি। কিন্তু সন্ধ্যা সমাগত। আর নিরাপত্তার নিয়মানুসারেই পথে দাঁড়ানো সম্ভব নয়।

গায়ে পানি দিলে কেন?

পাহাড়ে উঠতে শুরু করার পূর্বে সাকে শহরের কাছে এক চেকপোস্টের সামনে আমাদের জিপটা একটু থামল। সাথে সাথে ছুটে এল কিছু যুবক-যুবতী। তার চিৎকার করে ফরাসি ভাষায় কি বলল, আমরা বুঝলাম না। তবে গাড়ির ড্রাইভার ঠিকই বুঝল। গাড়ি থামার সময় রাস্তার পানি নাকি ছিটকে এক যুবতীর গায়ে গেছে। এখন সেই নোংরা পানি পরিষ্কার করার জন্য সে টাকা চায়। টাকা দিতে না চাইলে সে গাড়ির গ্লাসে থাপ্পড় দেয়া শুরু করল। তখন ড্রাইভার সাথে রাখা একটি ফলের জুসের প্যাকেট তাকে দিয়ে কোন রকমে ছাড়া পেল। ড্রাইভার জানাল, এখানকার কিছু মানুষ এভাবেই নানা ছুতোয় শান্তিরক্ষীদের কাছ থেকে টাকা খসাতে চেষ্টা করে।

আর উঠতি পথ বলে এ সামান্য রাস্তা পার হয়ে ব্যান ইনজিয়ার কোম্পানির হেডকোয়ার্টাসে পৌঁছিতে আমাদের প্রায় দেড় ঘন্টা সময় অতিবাহিত হল। পাহাড়ের উপর দিয়ে গাড়ি নিয়ে ওঠা যদিও আমার জন্য নুতন অভিজ্ঞতা নয়। কিন্তু এ স্থানের উঁচু উঁচু পাহাড় বেয়ে ওঠার দৃশ্য সত্যিই চমৎকার! দুইটি পাহাড় শ্রেণির মধ্যবর্তী উপত্যকায় একটি ছোট পাহাড়ী ঝরনাতুল্য নদীকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে মানুষের বসতি। পাহাড়গুলো অত্যন্ত উর্বর। সব পাহাড়ের গায়েই ফসলের ক্ষেত। পড়ন্ত বেলায় পাহাড়ের গায়ে ফসলের ক্ষেতে রোদ পড়ে একটি অপরূপ দৃশ্যের সৃষ্টি করেছিল যা চোখে না দেখলে বিশ্বাস করার মতো নয়।

(চলবে–)