অন্য দেশে, অন্য মিশনেঃ গোমা শহর, আফ্রিকান বিশ্বযুদ্ধ

মোঃ আব্দুর রাজ্জাক
Published : 26 Dec 2016, 06:42 AM
Updated : 26 Dec 2016, 06:42 AM

পূর্ব প্রকাশিতের পর

অবশেষে গোমা শহরে
দুপুর পৌনে বারটার দিকে আমরা গোমা বিমান বন্দর থেকে বের হলাম। আমাদের গন্তব্য সাত/আট কিলোমিটার উত্তর-পূর্ব দিকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ইন্জিনিয়ারিং কোম্পানির মুনিগি ক্যাম্প। বিমান বন্দর থেকে বের হয়েই অপেক্ষাকৃত প্রসস্থ রাস্তা। রাস্তাটা পরিচ্ছন্নই মনে হল। আমাদের সাথে কোন কঙ্গোলিজ কারেন্সি নেই। একই সাথে একটি সিম কার্ডও কিনতে চাইলাম। রাস্তার পাশে সারি সারি মানি ইক্সচেন্জ এর দোকান। এরা একই সাথে মোবাইল ফোনের সিম কার্ডও বিক্রয় করে। আমাদের সাথের সেনা সদস্যরা এখান থেকে মোবাইলের ব্যালান্স কিনলেন। কিন্তু এখান থেকে তারা স্থানীয় মূদ্রা কিনতে নিরুৎসাহিত করলেন।

গোমা হল ডিআর কঙ্গোর ২৬ টি প্রদেশের অন্যতম উত্তর কিভু প্রদেশের রাজধানী ও পূর্বাঞ্চলের প্রথান শহর। বৃহৎ হ্রদাঞ্চলের অন্যতম হ্রদ কিভুর উত্তর পাড়ে অবস্থিত এ শহরটি রুয়ান্ডার সাথে সীমান্ত শেয়ার করেছে। কিভু হ্রদের উত্তর পাড়ের অন্য শহর জিসেনি হল রুয়ান্ডার সীমান্তে। দুই শহরের মধ্যবর্তী দূরত্ব মাত্র এক কিলোমিটার। সমুদ্র সমতল থেকে এ শহর ১৬৭৬ মিটার উঁচুতে। তার মানে আমাদের দেশের সর্বোচ্চ চূড়া তাডিং ডঙের চেয়েও এর উচ্চতা সাতে তিনশ মিটার বেশি। ২০০২ সালে সর্বশেষ বার এ শহর নাইরোগোঙ্গো আগ্নেয়গিরি অগ্নুৎপাতে লাভার নিচে ঢাকা পড়ে। প্রচণ্ড গতিতে গড়িয়ে চলা তরল পাথর, ছাই-ভস্ম আর অন্যান্য খনিজে শহরের বাড়িঘর প্রায় ১২ থেকে ১৪ ফুট নীচে ঢাকা পড়ে। ঐ সময় যদিও প্রাণহানি হয়েছিল একশরও কম লোকের কিন্তু প্রায় কয়েক লাখ লোককে পাশ্বর্বর্তী গিন্সে শহরে স্থানান্তরিত করতে হয়েছিল।

কঙ্গো-যুদ্ধে গোমার গুরুত্ব
গোমা শহরটি রুয়ান্ডা ও ডিআর কঙ্গো উভয়ের জন্যই বেশ গুরুত্বপূর্ণ। রুয়ান্ডার তুতসি-হুতু বিরোধ থেকে শুরু করে জঘণ্যা জাতিগত নিশ্চিহ্নকরণ যজ্ঞ থেকে শুরু করে দুই দুইটি কঙ্গো যুদ্ধের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল এ গোমা শহরটি। রুয়ান্ডার জাতি-বিদ্বেষী হুতু সরকারের হোতারা ১৯৯৪ সালে প্রতিপক্ষ তুতসি গোষ্ঠীর কাছে পরাজিত হয়ে এ গোমা শহরেই আশ্রয় নিয়েছিল। এখান থেকে তারা কঙ্গোর মবুতু সেসেসেকু সরকারের সহায়তায় রুয়ান্ডার ডেমোক্রাটিক ফ্রন্ট সরকার ও স্থানীয় তুতসী সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে তাদের জঘন্য অভিযান চালাত। এই তুতসি-বিদ্বেষীদের সায়েস্তা করতেই এক সময় রুয়ান্ডার পল কাগামের সরকার উগান্ডা সরকারের সাথে জোট বেঁধে কঙ্গো ১৯৯৬ সালে অভিযান শুরু করে। মিত্র হিসেবে তারা বেছে নেয় কঙ্গোর বিদ্রোহী নেতা লরা কাবিলাকে। মাত্র ছয় মাসের ব্যবধানে মোবুতু সরকারের পতন ঘটে। ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন বিদ্রোহী নেতা লরা কাবিলা।

কিন্তু পরে লরা কাবিলার সাথে রুয়ান্ডানদের মতানৈক্য ঘটলে কঙ্গোর রাজধানী কিনশাসা থেকে রুয়ান্ডা তাদের সৈন্য প্রত্যাহার করে। কিন্তু তাদের স্বজাতী তুতসিদের সুরক্ষার জন্য গোমায় তাদের নিজেদের অনুগত একটি বিদ্রোহী গ্রুপ তৈরি করে। অন্যদিকে গোমার উত্তর দিকে বুনিয়া এলাকাকে কেন্দ্র করে উগান্ডাও একই ধরনের বিদ্রোহী গ্রুপ তৈরি করে নিজেদের আধিপত্য বজায় রাখার চেষ্টা করে।

প্রথম কঙ্গোযুদ্ধ
কঙ্গোর পূর্বাঞ্চলীয় এলাকাগুলোতে গড়ে ওঠে প্রায় বিশটিরও বেশি বিদ্রোহী গ্রুপ যারা কেন্দ্রের লরা কাবিলার সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে নিজেদের স্বাধীন রাখার চেষ্টা করে। এসব গ্রুপের লালন-পালন করতে থাকে রুয়ান্ডা, উগান্ডা ও বুরুন্ডি। অন্যদিকে কিনশাসা সরকারকে সমর্থন করে সেখানে সৈন্য পাঠাতে থাকে উত্তরের ফরাসিভাষী দেশ চাঁদ এবং দক্ষিণাঞ্চলীয় দেশ জাম্বিয়া, নামিবিয়া, এমনকি কঙ্গোর সাথে অভিন্ন সীমান্তহীন দূরের দেশ জিম্বাবুয়ে ও এঙ্গোলার মতো দেশগুলো।

দ্বিতীয় কঙ্গোযুদ্ধ ও শান্তিরক্ষা মিশন
ডিআর কঙ্গোকে ঘিরে ১৯৯৮ সালে শুরু হ্ওয়া এসব শক্তির সম্মিলিত যুদ্ধকে বলা হয় দ্বিতীয় কঙ্গোলিজ যুদ্ধ বা প্রথম আফ্রিকার বিশ্বযুদ্ধ। প্রায় পাঁচ বছর স্থায়ী দ্বিতীয় কঙ্গোযুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধ ও যুদ্ধের প্রতিক্রিয়ার ফলে কঙ্গোর প্রায়  ৫৪ লাখ আদম সন্তান মৃত্যুবরণ করে।এ যুদ্ধ বন্ধ করে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য বিশ্ব সম্প্রদায়ের নানাবিধ প্রচেষ্টায় শেষ পর্যন্ত ২০০৩ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার সানসিটিতে একটি সমন্বিত চুক্তির মাধ্যমে আফ্রিকার প্রথম বিশ্বযু্দ্ধের অবসান ঘটে। ইতোমধ্যেই ২০০১ সালে যুদ্ধের প্রধান খেলোয়ার প্রেসিডেন্ট লরা কাবিলা আততায়ীদের হাতে নিহত হয়েছিলেন। তার স্থলে রাষ্ট্রপতি হয়েছিলেন তার পুত্র জোসেফ কাবিলা। এ চুক্তির ফলে প্রেসিডেন্ট জোসেফ কাবিলা একটি অন্তর্বর্তীকালীন ঐক্যমতের সরকার গঠন করেন যেখানে পূর্বাঞ্চলীয় গেরিলা গ্রুপগুলোকেও অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

কঙ্গোর সরকার ও বিদ্রোহী গ্রুপগুলোর মাঝে যুদ্ধ বিরতির মাধ্যমে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য জাতিসংঘ প্রথম থেকেই প্রচেষ্টা চালিয়ে আসছিল। এ লক্ষে তারা ১৯৯৯ সালেই মাত্র ৯০ জন অফিসারের সমন্বয়ে একটি পর্যবেক্ষণ মিশন শুরু করে। ঐ সময় এ মিশনের নাম ছিল United Nations Observer Mission in the Democratic Republic of the Congo ফরাসি ভাষায় যার নাম ছিল, Mission de l'Organisation de Nations Unies en République Démocratique du Congo সংক্ষেপে MONUC. কিন্তু ক্রমান্বয়ে এ মিশনের ব্যাপকতা বাড়থে থাকে। তাই ২০০০ সালে এর ম্যান্ডেটেও ব্যাপক পরিবর্তন আনা হয়। পর্যবেক্ষণ থেকে শুরু করে বি্দ্রোহীদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনে শক্তি প্রয়োগের নীতিও অনুসরণ করা হয়। তখন এর নাম দেয়া হয়, The United Nations Organization Stabilization Mission in the Democratic Republic of the Congo যা ফরাসি ভাষায় নাম হয় Mission de l'Organisation des Nations unies pour la stabilisation en République démocratique du Congo" বা MONUSCO. বর্তমানে কঙ্গোর এ মিশনে প্রায় বাইশ হাজার ইউনিফর্মধারী শান্তিরক্ষীর অনুমোদন রয়েছে যাদের মধ্যে ঊনিশ হাজারের বেশি সেনা ্ও এক হাজারের বেশি হল পুলিশ। বাংলাদেশ সেনা সরবরাহের ক্ষেত্রে দ্বিতীয় ও পুলিশ সরবরাহের ক্ষেত্রে প্রথম স্থানে রয়েছে।(চলবে–)

পঞ্চম কিস্তি