অধম সমাজও উত্তম পুলিশ খোঁজে

মোঃ আব্দুর রাজ্জাক
Published : 21 Dec 2016, 05:33 PM
Updated : 21 Dec 2016, 05:33 PM

ভাল হোক আর মন্দ হোক, পুলিশ সম্পর্কে কোন খবরই আমার চোখকে ফাঁকি দিতে পারে না। আজ অনলাইনে পত্রিকা পড়তে পড়তে হটাৎ একটি শিরোনামে চোখ আটকে গেল। 'কচুয়ায় নিজের টাকায় লাশবাহী গাড়ি ছাড়িয়ে দিলেন ওসি'। ভিতরের গল্প পড়ে জানা গেল, বাঘেরহাট জেলার কচুয়া থানার অফিসার-ইন-চার্জ জনাব কবিরুল ইসলাম মাওয়া ফেরিঘাটের ফেরি ভাড়া দিতে অপারগ এক ব্যক্তির লাশবাহি গাড়ির ফেরিভাড়া নিজ পকেট থেকে বিকাশের মাধ্যমে পরিশোধ করে ঘাট থেকে লাশবাহী গাড়ি ছাড়িয়ে নেয়ার মত মহৎ কাজ করেছেন। ব্যাগের হাতের কচুয়া উপজেলার আন্ধারমানিক গ্রামের জনৈক মাহমুদ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে তার মৃত বাবার লাশ নিয়ে একটি অ্যাম্বিউল্যান্সে করে বাড়ি ফিরছিলেন। কিন্তু ফেরি পারাপারের জন্য তার কাছে অর্থ ছিল না। এ অর্থ পরিশোধ করতে না পারার জন্য বিআইডাব্লিউটিসির কর্মচারীগণ লাশবাড়ি অ্যাম্বিউলেন্সটি মাওয়া ঘাটে আটকে রাখে। অন্য কোন উপায় না দেখে মাহমুদ তার নিজ এলাকার অফিসার-ইন-চার্জের কাছে ফোন করে বিপদ থেকে উদ্ধারের অনুরোধ করেন। ওসি নিজ পকেট থেকে বিকাশের মাধ্যমে সেই ভাড়া পরিশোধ করলে ভুক্তভোগী তার বাবার লাশ নিয়ে বাড়ি ফিরে তাকে কবরস্থ করেন।

বলাবাহুল্য, পুলিশেরও ইন্সপেক্টর আছে, বিআইডব্লিউটিসিরও ইন্সপেক্টর আছে। একটি লাশবাহি গাড়ি ফেরিভাড়া দিতে অপারগ। তাই ফেরিঘাটের কর্মচারিগণ গাড়িটি আটকিয়ে রাখে। চাইলে বিআইডাব্লিউটিসির কর্তারা বিশেষ বিবেচনা করে এ গাড়ির ভাড়া না নিয়েই ছেড়ে দিতে পারতেন।কিন্ত তারা সেটা করেননি। লাশবাহি একটি গাড়িকে এভাবে ছেড়ে দিলে বিআইডাব্লিউটিসির কর্তারা মানবিক কাজই করতেন। আর এ মানবিক কাজে বিআইডব্লিউটিসির ইন্সপেক্টর তার সংস্থার সমর্থনও পেতেন। কিন্তু তিনি সেটা করেননি।

অন্যদিকে কচুয়া থানার অফিসার ইনচার্জকে এ ভুক্তভোগী ফোন করেছিলেন এ আশায় যে ওসির অনেক ক্ষমতা । তিনি বললেই ঘাটের কর্মকর্তারা তার কথা শুনবেন। কিন্তু ক্ষমতাবানদের সব ক্ষমতা যে সব স্থানে সব সময় খাটে না, সেটা তো ঐ লাশের মালিক জানতেন না। কিন্তু নিজ এলাকার একজন নাগরিক যখন অনেক দূরে গিয়েও অফিসার-ইন-চার্জকে বিপদে পড়ে স্মরণ করেছেন, সেই নাগরিকটির সমস্যাটার একটা সমাধান তো ওসিকে করতেই হবে। হয়তো এই বিবেচনায় ওসি প্রথমে ঘাটের কর্তাদের অনুরোধ করেছেন, পরে যখন অনুরোধে কাজ হয়নি, তারা অর্থের বিনিময়টুকুকেই তাদের ক্ষমতার শেষ বিন্দু মনে করেছেন, ওসি তখন নিজ পকেট থেকেই সেই ফেরি ভাড়া পরিশোধ করেছেন, রেহাই দিয়েছেন তার নিজ এলাকার একজন দরিদ্র মানুষকে।

মজার ব্যাপার হল, বিআইডা্ব্লিউটিসির ইন্সপেক্টর কচুয়া থানার ওসির এ কর্মকাণ্ডের প্রশংসা করে মন্তব্য করেছেন যে এতে পুলিশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয়।

আমার কথা হল, দেশে হাজারও সরকারি সংস্থা, বিভাগ রয়েছে। এসব বিভাগ কোন না কোনভাবে জনগণকে সেবা দিয়ে যাচ্ছে। এসব সংস্থার মধ্যে পুলিশ একটিমাত্র সংস্থা যা  আইন প্রয়োগ, শান্তিরক্ষা, অপরাধ দমন, প্রতিরোধ ইত্যাদি ক্ষেত্রে জনগণকে সেবা দিচ্ছে। বলাবাহুল্য, এসব আইনি সেবার পাশাপাশি পুলিশকে এমন সব সেবা দিতে হয় যেগুলোর জন্য আইনি তাগিদ নেই। কিন্তু তাৎক্ষণিকভাবে এসব সেবা দানের জন্য সরকারের অন্যকোন সংস্থার অনুপস্থিতির জন্যই তা পুলিশের ঘাড়ে এসে পড়ে। সরাসরি পুলিশের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে না, অথচ পুলিশ ভিন্ন সেই সব সেবা তাৎক্ষণিকভাবে দেবার জন্য অন্য কোন ব্যাক্তি বা প্রতিষ্ঠান হাতের কাছে নেই— এমন সব পরিস্থিতিতে সেবা নিতে নিতে জনগণ মনে করে, এটা বুঝি পুলিশেরই দায়িত্ব। নিজের দায়িত্ব নয়, অথচ দায়িত্বটি পালন করা হচ্ছে– এমন কোন সেবা যদি সংগত কারণেও পুলিশ দিতে না পারে, জনগণ মনে করে, পুলিশ দায়িত্বহীন,কাণ্ডজ্ঞানহীন ও অমানবিক।

এখন প্রশ্ন হল, যে কাজটি করে বিআইডাব্লিউটিসির ইন্সপেক্টর খোদ তারই সংস্থার ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করতে পারতেন, সেটা না করে তিনি পুলিশের একজন ওসির উপর তা চাপিয়ে দিলেন। তাহলে কি অন্যসব সরকারি সংস্থার ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হওয়ার দরকার নেই? ভাবমূর্তি উজ্জ্বল কেবল পুলিশেরই করতে হবে?

এ প্রসঙ্গে ইউনিসেফের মিনা কার্টন সিরিজের নারী-পুরুষ সাম্য রক্ষার একটি ডায়ালোগ মনে পড়ে। প্রাসঙ্গিক হওয়ায় লেখনির শেষ প্রান্তে তা উল্লেখ করতে চাই।

মিনা ও রাজু ভাইবোন। মিনা মেয়ে। সে রাজুর চেয়ে বড়। উভয়েই সংসারের নানা কাজে সহায়তা করে। তবে মিনা বড় হওয়ায় সে রাজুর চেয়ে অনেক বেশি কাজ করে। যেমন সে গরু সামলানো থেকে শুরু করে গাছের মগ ডালের পাকা আমটি পর্যন্ত পেড়ে আনতে পারে। কিন্তু খাওয়ার সময় দেখা গেল আমের বড় অংশটি যাচ্ছে রাজুর কাছে। ডিমের অংশ পড়ে মিনার পাতে। কিন্তু একটি পুরো ডিম যাচেছ রাজুর পাতে। মিনার চেয়ে রাজু কেন বেশি পাচ্ছে এটা মিনা জানতে চাইলে তার দাদী বলে, রাজু ছেলে মানুষ। সে বড় হচ্ছে। তাই তার বেশি বেশি খাওয়া দরকার। কিন্তু মিনাও যে বড় হচ্ছে সেটা দাদীর চোখে পড়ে না। ওদের বাবা যখন বলে, মা, রাজুর পাশাপাশি তো মিনাও বড় হচ্ছে।মিনারও কি বেশি বেশি করে খাওয়া দরকার নেই? দাদী তখন সেই আবহমান বাঙালির ডায়োলগটি দেয়, মিনা হল মেয়ে মানুষ। তাই তার না খেলেও চলবে। এটা তো এ সমাজেরই নিয়ম। সমাজে তো এমনটিই হয়ে থাকে।

আমাদের সমাজেরও একই নিয়ম। কেবল পুলিশকেই ভাল হতে হবে। পুলিশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করতে হবে। সমাজের তাবৎ সংস্থা তাবৎ বিভাগ ও প্রতিষ্ঠানগুলোর অসততা, অমানবিকতা ও অসাফল্যের বিপরীতে কেবল পুলিশকেই সৎ, মানবিক যোগ্য ও সফল হতে হবে। অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য এ সমাজের কোন মাথা ব্যাথা নেই। আমাদের অসৎ সমাজ সৎ পুলিশ প্রত্যাশা করে, অমানবিক সমাজ মানবিক পুলিশ খোঁজে। সমাজ বলে, আমি অধম, তাই বলে পুলিশ উত্তম হইবে না কেন?