অন্য দেশে, অন্য মিশনেঃ মুনিগি ক্যাম্প ও নাইরোগোঙ্গো

মোঃ আব্দুর রাজ্জাক
Published : 8 Jan 2017, 06:25 PM
Updated : 8 Jan 2017, 06:25 PM

পূর্ব প্রকাশিতের পর/ ষষ্ঠ কিস্তি

মুনিগি ক্যাম্প
বিমান বন্দরের বাইরের সড়কটি বেশ পরিষ্কার। কিন্তু একটু পরেই শুরু হল পাথরের উপর দিয়ে চলাচল। সামনে নাইরোগোঙ্গো জীবন্ত আগ্নেয়গিরি চোখে পড়ছে। আমাদের ড্রাইভার জানাল গোটা শহরটাই এমনি পাথরে ভরা। এখান থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরে নাইরোগোঙ্গো আগ্নেয় পর্বতের অগ্নুৎপাতের ফলে প্রবাহিত লাভা থেকেই এসব পাথরের তৈরি। চাইনিজ একটি কোম্পানি পাথর পরিষ্কার করে পথ তৈরি করছে।

মুনিগি ক্যাম্পের নিরাপত্তার দায়িত্ব দক্ষিণ আফ্রিকার সেনাবাহিনীর উপর। বস্তুত এখানে দক্ষিণ আফ্রিকার সেনা ব্যাটালিয়নের থাকার স্থানেই বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানির জন্য থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। দক্ষিণ আফ্রিকান সেনাবাহিনীর সেন্ট্রি ফটক খুলে দিলে আমরা ভিতরে প্রবেশ করলাম।

পূর্বেই বলেছি, গোমায় অবস্থিত কোন সেনা ইউনিটের কাউকেই আমরা চিনি না। আমরা গাড়ি থেকে নেমেই একটু দূরে দাড়িওয়ালা একজন মেজর কে ফোনে আলাপরত অবস্থায় দেখতে পাই। এনি হলেন মেজর হাবিব। তিনি আমাদের স্বাগত জানালেন। তিনি এই ক্যাম্পের সিনিয়রতম অফিসার।

আলাপ শুরু হল মেজর হাবিবের সাথে। অল্পতেই এ সেনা কর্মকর্তা আমাদের আপন করে নিলেন। পরিচয়ের শুরুতেই তিনি গর্বের সাথে বললেন, তিনিও পুলিশ পরিবারের সন্তান। তার বাবা মির্জা শরাফত আলী সাব-ইন্সপেক্টর পদে পুলিশে ভর্তি হয়ে সর্বশেষ এএসপি পদে পদোন্নতি পেয়ে কিছু দিন আগে অবসরে গেছেন। তিনি পুলিশ অফিসারদের কোলে-পিঠেই মানুষ হয়েছেন।

একটু পরেই বোঝা গেল, মির্জা শরাফত আলীর বাড়িও রংপুরের মিঠাপুকুরের শানের হাটে। তার পরিবার থাকতেন রংপুরের কেরানী পাড়ায়। আরো মজার বিষয় হল মেজর হাবিবের বাবা দিনাজপুর পুলিশ কোর্টে ২০০৩ সালে প্রবেশন অবস্থায় আমার শিক্ষাগুরু ছিলেন।

মেজর হাবিবের কাজের টেবিলে বসেই গোমা শহর ও তার পাশের জীবন্ত আগ্নেয়গিরি নাইরোগোঙ্গো সম্পর্কে মজার মজার তথ্য দিলেন মেজর হাবিব। তার তথ্য থেকে বোঝা গেল তিনি এ সম্পর্কে ভাল পড়াশোনা করেন।

কর্মে শীর্ষে ব্যান-ইঞ্জিনিয়ার

তখন দুপুরের খাবারের সময় হয়ে এল। আমাদের জন্য খাবার চলে এলো। এখন আমাদের সাথে দেখা হল মেজর রাজির। যদিও তারই সূত্র ধরেই আমাদের এ ক্যাম্পে আসা, তবুও ততক্ষণ পর্যন্ত আমরা তার দেখা পাইনি। এজন্য তিনি দুঃখ প্রকাশ করলেন। এ সময় আরা আরো কয়েকজন সেনা কর্মকর্তার সাথে পরিচিত হলাম। সবাই মিলে দুপুরের খাবার খেলাম। খাবারের ফাঁকে মেজর হাবিব তার ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানির কার্যক্রমের বর্ণনা দিলেন। কোন মিশন এলাকায় সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানির সেনা সদস্যরা মূলত অবকাঠামো সুবিধা তৈরিতে নিয়োজিত থাকেন। শান্তিরক্ষীদের জন্য ব্যারাক তৈরি থেকে শুরু করে তারা রাস্তাঘাট এমনকি স্থানীয় অধিবাসীদের জন্য স্কুল কলেজ ও খেলার মাঠ পর্যন্ত তৈরি করে দেন। কালের প্রবাহে একদিন মিশন এলাকা থেকে সকল বিদেশি চলে আসে। কিন্তু পিছনে রেখে আসেন তাদের কিছু কাজ, কিছু স্থায়ী কীর্তি। এসব কীর্তির সিংহভাগই হল ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানির সদস্যদের তৈরি।

গোমা এলাকায় দক্ষিণ আফ্রিকা, উরুগুয়ে, চায়না, ইন্দোনেশিয়া, নেপাল ও বাংলাদেশের ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানির সদস্যরা কাজ করে। প্রতি ছয় মাসে এ ছয়টি দেশের প্রকৌশল সেনাদের কর্মকাণ্ডের মূল্যায়নের র‌্যাংকিং হয়। গত এপ্রিল-সেপ্টেম্বর/২০১৬ এর মূল্যায়নে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্যরা প্রথম স্থান অধিকার করেছিল। এজন্য একটি সার্টিফিকেট তারা পেয়েছেন যা ক্যাম্পের এক স্থানে ঝুলান আছে। মেজর হাবিব জানালেন, তাদের কোম্পানির সদর দফতর হল এখান থেকে প্রায় ত্রিশ কিলোমিটার পশ্চিমে পাহাড়ের উপরে মুশিকি নামক স্থানে অবস্থিত। হেডকোয়ার্টার ছাড়াও তাদের আরো পাঁচটি এমন ধরনের ক্যাম্প আছে যেগুলো আরো বেশি দূরবর্তী ও দুর্গম এলাকায় অবস্থিত। সব মিলে তাদের কোম্পানিতে ১৬ জন অফিসার ও ১৮০ জন অন্যান্য পদের সেনাসদস্য রয়েছে।

নাইরাগোঙ্গো দর্শন

আমরা যখন মুনিগি ক্যাম্পে এসে পৌছেঁছিলাম তখন আকাশ ছিল মেঘাচ্ছন্ন। কিন্তু দুপুরের খাবার পর আকাশ একটু পরিষ্কার হলে তাবুর বাইরে বের হয়ে মেজর হাবিব আমাদের ডাকলেন উত্তর পূর্ব দিকের আগ্নেয়গিরি পর্বত নাইরাগোঙ্গো দেখানোর জন্য। এ স্থান থেকে এ আগ্নেয় পর্বতটির দূরত্ব প্রায় ২০ কিলোমিটার। কিন্তু আমাদের দাঁড়ানোর স্থান থেকে পাহাড়টি ১,৭৯৪ মিটার উঁচু হওয়ায় (সমুদ্র সমতল থেকে প্রায় ৩, ৪৭০ মিটার) তা আমাদের খুব কাছেই মনে হচ্ছিল। একটু হালকা বৃষ্টিও হচ্ছিল তাই আমরা স্পষ্ট দেখতে পেলাম পাহাড়ের উপর একটি ধোঁয়ার রেখা উপরের দিকে উঠে যেন মেঘের সাথে মিশেছে। আসলে এ আগ্নেয়গিরিটি জীবন্ত হলেও তা থেকে কিন্তু লাভা উদগীরণ হচ্ছে না। বরং এর দুই কিলোমিটার ব্যাসের গভীর জ্বালামুখে রয়েছে ফুটন্ত লাভার একটি হ্রদ। এ হ্রদ থেকে প্রতিনিয়ত কার্বন ডাই অক্সাইড সম্মৃদ্ধ জলীয় বাষ্প বের হয়। রাতের বেলায় এ ফুটন্ত লাভা থেকে উত্থিত আভা জ্বালামুখটিকে রঙিন করে রাখে। তাই রাতের বেলায় এর রূপ থাকে ভিন্ন প্রকার।

আফ্রিকার এই অঞ্চলটি হ্রদ আর আগ্নেয়গিরি দিয়ে ভরা। পৃথিবীর ভূ-ভাগের অভ্যন্তরে অবস্থিত দুটো প্লেটের মধ্যবর্তী জায়গায় এ স্থানটি অবস্থিত হওয়ায় এখানেই আগ্নেয়গিরির সমারোহ। উগান্ডা, রুয়ান্ডা ও ডিআর কঙ্গোর মধ্যবর্তী এ অঞ্চলে নাইরাগোঙো ছাড়াও আরো বেশ কয়েকটি আগ্নেয়গিরি রয়েছে। এসব মিলে গড়ে উঠেছে তিন দেশেরই একটি অভিন্ন টুরিস্ট অঞ্চল। উগান্ডা অঞ্চলে এর নাম মাহিয়াঙ্গা ন্যাশনাল পার্ক, রুয়ান্ডায় ভলক্যানো ন্যাশনাল পার্ক ও ডিআর কঙ্গোর দিকের অংশের নাম হল ভিরুজ্ঞনা ন্যাশনাল পার্ক। এ অঞ্চলটি আগ্নেয়গিরির বাইরেও একটি বাড়তি আকর্ষণ হর মাউন্টেন গরিলা। অনন্য প্রজাতির এ গরিলাদের কেবল এ আগ্নেয় পর্বত এলাকায় দেখা যায়।

নাইরাগোঙ্গো আগ্নেয়গিরির প্রথম অগ্নুৎপাত কবে হয়েছিল তার কোন রেকর্ড নেই। তবে ১৮৮২ সাল থেকে শুরু করে ২০০২ সাল পর্যন্ত এ থেকে ৩৪ বার অগ্নুৎপাত হয়েছে। ২০০২ সালের অগ্নুৎপাতের ফলে এর পদতলের গোমা শহরটি এর লাভায় ঢেকে গিয়েছিল। ঐ সময় গোমা শহরের প্রায় চার লাখ লোককে পার্শ্ববর্তী রুয়ান্ডান শহর গিসেনিতে সরিয়ে নেয়া হয়েছিল। আর কার্বন-ডাই অক্সাইড সম্মৃদ্ধ গ্যাসে নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে প্রায় দেড়শত লোকের প্রাণহানি হয়েছিল। গলিত লাভা শহর অতিক্রম করে নিকটস্থ কিভু হ্রদে পড়ে হ্রদের পানিকে বিষাক্ত করে তুলেছিল। ১৯৯০ এর দশকে জাতিসংঘ যে কয়েকটি আগ্নেয়গিরিকে গবেষণার জন্য তালিকাভুক্ত করেছিল (ডিকেড ভলক্যানো) নাইরাগোঙ্গো হল তাদের অন্যতম।

আমরা মুনিগি ক্যাম্পের যে স্থানে দাঁড়িয়ে আছি সেটাও এই আগ্নেয়গিরি লাভা দিয়ে তৈরি। গরম লাভা ঠাণ্ডা হয়ে যে পাথর তৈরি হয়েছে সেই পাথর দিয়ে স্থানীয় লোকজন আবার তাদের বাসাবাড়ি ও রাস্তাঘাট তৈরির কাজ করছে। আমরা এ স্থান থেকে আগ্নেয়গিরির কিছু ছবি তুললাম আর ভিডিও চিত্র নিলেন মেজর হাবিবই।

মুশিকির প্রলোভন
খাবারের এক ফাঁকে মেজর রাজি জানালেন যে তাদের হেডকোয়ার্টার মুসিকি হল পাহাড়ের উপর অবস্থিত। এটা গোমা শহর থেকে ত্রিশ কিলোমিটার পশ্চিমে। মুসিশির প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করার মতো। এটাকে অনেকে কঙ্গোর সুইজারল্যান্ড বলে অবিহিত করেন। তাই আমাদের তিনি মুসিকি ভ্রমণের জন্য পাঠাবেন। এটা আজ হলে ভাল হয়। তবে আগামীকাল সকালে গিয়ে দেখে শুনে দুপুরের খাবার খেয়ে রওয়ানা দিলে বিকালে এসে আবার কিনশাসার বিমান ধরা যাবে। মুশিকি শহরের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের বর্ণনা করেছিলেন এ কোম্পানির প্রধান লে. কর্নেল তারেক। তার সাথে ইতোপূর্বে আমাদের দেখা হয়েছিল উগান্ডার এনটেবের বাংলা হাউজে। তাই মুশিকি শহর ভ্রমণের প্রস্তাবে আমরা যারপর নেই খুশি হলাম। মেজর রাজি জানালেন, তিনি চেষ্টা করছেন যাতে আজই আমাদের মুশিকি পাঠান যায়। তাই তিনি মেজর রুজিনার নেতৃত্বে একটি সেনাদল প্রস্তুত করার ঘোষণা দিলেন। তাই আমাদের দ্রুত তৈরি হতে হবে। চলবে–