অন্য দেশে অন্য মিশনে: দুই হাজার মিটার উচ্চাতার মুশিকি বাজার

মোঃ আব্দুর রাজ্জাক
Published : 20 Jan 2017, 02:04 AM
Updated : 20 Jan 2017, 02:04 AM

পূর্ব প্রকাশিতের পর (১০ম কিস্তি)

প্রচণ্ড ঠান্ডা উপেক্ষা করে পর দিন ২৩ নভেম্বর সকালে ঘুম থেকে উঠলাম। বাথরুমের পানি বরফের মতো ঠাণ্ডা মনে হল। পূর্ব দিকে দুই পাহাড় শ্রেণির মধ্য দিয়ে সূর্য উঁকি দিয়েছে। চার দিক হালকা কূয়াশা আছে। পাহাড়ের ঢালুতে ঘাসের উপর জমে আছে সাদা সাদা পানিকণা। গত কাল গোধূলিতে এ মুশিকি উপত্যকার ব্যান-ইন্জিনিয়ার ক্যাম্পকে যতটা সুন্দর মনে করেছিলাম বর্তমানে এটা তার চেয়ে অনেক বেশি সুন্দর ও সজিব লাগছে।

                                                                                                                                                                         তবে এ সুন্দর আবহাওয়া বেশিক্ষণ স্থায়ী হল না। অল্প পরেই আকাশে মেঘ দেখা দিল। মেঘ বলতে এখানে আলাদা বলে কিছু অবশ্য নেই। কারণ এর উচ্চতার জন্য দূর থেকে তাকালে আমরা যে পুরোটাই মেঘের ভিতর অবস্থান করছি সেটা বোঝ যেতন। অল্প পেরেই শুরু হল বৃষ্টি। তবে এ বৃষ্টি আমাদের দেশের বর্ষাকালের মতো তুমুল বৃষ্টি নয়। ঝির ঝির বৃষ্টিকে এক পাশে গিয়ে রান্না ঘরের দিকে গেলাম। দেখলাম রান্নার কাজে ব্যস্ত সৈনিকদের সাথে কিছু স্থানীয় কঙ্গোলিজও কাজ করছে। এদের একজনের নাম হল স্যামসাং। সে আবার ইতোমধ্যে বাংলাও শিখে ফেলেছে।

সকালের নাস্তা সেরে আমরা আসেপাশের এলাকা দেখতে বের হলাম। তবে আমাদের দৌড় মাত্র দেড় থেকে দুই কিলোমিটার দূরের মুশিকি বাজার পর্যন্তই সীমাবদ্ধ। এর বাইরে পথ থাকলেও তা গাড়ি চলার উপযুক্ত নয়। আর আমাদের সাথের সেনা স্কটের প্রতি কড়া নির্দেশ ছিল, আমরা যেন এ মুশিকি বাজার ছেড়ে দূরে কোথাও না যাই।

মুটান্ডা ফল

মুশিকি বাজারটি আমাদের দেশের পার্বত্য অঞ্চলের গ্রাম্য বাজারের মতোই মনে হল। বাজারে ফলমূল উঠেছে। আকারে দেশি মুরগির ডিমের মতো সিঁদুর রাঙা এক প্রকার ফল দেখলাম।

গত আগস্টে রুয়ান্ডা ভ্রমণে গিয়ে এগুলোর স্বাদ নিয়েও দেখেছি। রুয়ান্ডানরা এগুলোকে বলে চিনিমোরো। কিন্তু মুশিকি বাজারে এগুলোর নাম বলল মুটাণ্ডা। কিন্তু পরে জানলাম এগুলোর ইংরেজি নাম হল টামারিলো বা ট্রিটমেটো। আফ্রিকা, দক্ষিণ আমেরিকাসহ ভুটান, নেপাল, দার্জিলিঙেও নাকি এ ফলগুলো জন্মে। অনেকটা বেগুনের গাছের মতো গাছ। আমি খেয়ে দেখেছি। স্বাদ অনেকটা টক-মিষ্টির সমাহার। কিন্তু স্বাদ যাই হোক পাকা ফলের রঙটা দারুণ মনোলোভা।

তবে চোখে পড়ার মতো দৃশ্য হল মোটর সাইকেল। এখানে মোটর সাইকেল ভাড়া চালান হয়। ভাড়ায় চালিত মোটর সাইকেল অবশ্য গোটা আফ্রিকারই একটি সাধারণ দৃশ্য। রাস্তাঘাটের অপ্রতুলতার সাথে মানুষের সংখ্যা স্বল্পতাও এর জন্য দায়ী। পাহাড়ি পথে চার চাকার গাড়ির চেয়ে দুই চাকার যান অত্যন্ত উপযোগী। একটি মোটর সাইকেল ছেলে-মেয়ে, বাচ্চা-বুড়ো ভাগাভাগি করে বসে। আর এরা চালায়ও ভূতের মতো। যে রাস্তায় একটি মোটর সাইকেল একজন চালককে নিয়েই চলা মুসকিল সেখানে দুইজন এবং অনেক ক্ষেত্রে তিনজন যাত্রী নিয়েও এরা ভূতের মতো তীব্র গতিতে।

এ মুশিকি উপত্যকা হল পশুপালন ক্ষেত্র। তাই মুশিকি বাজারটি গরুর দুধ প্রক্রিয়াজাত করার কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠেছে। দুধ প্রক্রিয়াজাত বলতে এখানে দুধ থেকে মাখন তৈরির ব্যবস্থাই বোঝায়। কারণ এখানে দুধকে গুঁড়ো দুধে পরিণত করা তো দূরের কথা পাস্তুরিত করার কথাও কল্পনা করা যায় না। প্রথমত এখানে সেই বাজার নেই, দ্বিতীয়ত সেই প্রযুক্তিও নেই। আফ্রিকা অঞ্চলে তাই গরু মাংসের জন্যই কেনা বেচা হয়, দুধের জন্য নয়।

বাজারের সাথে কিছু ছোট ছোট ঘরে দুধ থেকে মাখন তৈরি করা হয়। এজন্য এসব ঘরে মাখন ও ঘি এর তীব্র গন্ধ নাকে আসল। মাখনের কান অত্যন্ত ভাল জেনে আমাদের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার দুই কেজি মাখন কিনল। প্রতি কেজির দাম তিন ডলার করে। গোল গোল ঢিমা করে মাখন সংরক্ষণ করা হয়েছে। ওরা বলল, এ মাখন অনেক দিন রেখে দেয়া যায়। কিন্তু আমাদের যাত্রাপথে কখন কোথায় থাকব সেটার কোন ঠিক নেই। অধিকন্তু এই মাখন একবার গলা শুরু করলে এর তীব্র গন্ধে কেবল নিজরই নয় সহযাত্রীদেরও মেজাজ বিগড়ে যাবে বলে আমি মাখন কেনা থেকে বিরত থাকলাম।

মুশিকি বাজার থেকে একটু উপরে পাহাড়ের উপরে এসে গোটা উপত্যকাকে মন ভরে দেখলাম। এত সুন্দর করে বিধাতা এ পাহাড়, পাহাড়ের উপর ঘাস ও মাঝে মাঝে ছোট ছোট গাছ সৃষ্টি করেছেন তা ভাবাই মুসকিল। ক্যাম্পে ফেরার পথে আমরা একটি ছোট ব্রিজের কাছে থামলাম। আমাদের সেনা সদস্যরা বললেন, অল্প কিছুদিন আগেই এ ব্রিজটি তারা তৈরির কাজ শেষ করেছেন। এমন শত শত ব্রিজ তারা তৈরি করেছেন যেগুলো শুধু শান্তি মিশনের অপারেশনকে চালু রাখতেই অবদান রাখছে না, এগুলো স্থানীয় মানুষের জীবনযাত্রাকেও সহজতর করে দিয়েছে। ব্রিজ-কালভার্ট রাস্তা তৈরি ছাড়াও বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রকৌশল কোরের সদস্যরা স্থানীয়দের জন্য স্কুল, খেলার মাঠ এমনকি কমিউনিটি সেন্টার পর্যন্ত তৈরি করে দিচ্ছেন। ব্রিজটির এক দিকে বাংলাদেশের পতাকা আঁকা রয়েছে। ব্রিজের উপর বসে আমরা ছবি তুললাম, ভিডিও করলাম।

বাংলাদেশি সেনাদের বিনামূল্যে চিকিৎসাদান

মুশিকি বাজার থেকে ক্যাম্পে ফেরার পথে তোরণের পাশেই চোখে পড়ল সেনা ডাক্তারদের স্থানীয়দের জন্য চিকিৎসা দেবার দৃশ্য।চিকিৎসাসেবা দানরত প্রাইভেট (সৈনিক) মাহফুজ জানাল, তারা সপ্তাহে সোমবার ও বৃহস্পতিবার স্থানীয়দের জন্য বিনামূল্যে চিকিৎসাসেবসহ অষুধ সরবরাহ করে থাকেন। প্রতিদিন তারা প্রায় ২০০ জন করে মানুষকে চিকিৎসা দিয়ে থাকে। অধিকাংশ রোগীই নানা ধরনের ব্যথা নিয়ে ক্যাম্পে হাজির হয়। স্থানীয় মানুষ ইংরেজি বোঝে না। ডিআর কঙ্গোর এ অঞ্চলে রুয়ান্ডান ভাষাও প্রচলিত। তবে সাধারণ মানুষ লিঙ্গালা ভাষায় কথা বলতে অভ্যস্ত। একটু শিক্ষার আলো যাদের আছে তারা ফ্রেন্স ভাষাই মূলত ব্যবহার করে।

স্থানীয়দের সাথে ভাষার দুর্বুদ্ধতা দূর করতে তাই স্থানীয়ভাবে তারা জামারি নামের এক যুবককে দোভাষী হিসেবে কাজে নিয়োগ করেছে। সপ্তাদে দুই দিন চিকিৎসার তারিখ ধার্য থাকলেও যে কোন দিন জরুরি মুহূর্তে তারা মানুষকে চিকিৎসা সেবা দিয়ে থাকে। যেমন গতকাল আমরা এ ক্যাম্পে ঢোকার মুহূর্তেই দুজন মোটর সাইকেল্ আরোহীকে আহত অবস্থায় দেখেছিলাম। (চলবে–)