তথাকথিত শীতবস্ত্র বিতরণঃ কবে বন্ধ হবে দারিদ্র্য প্রদর্শনের এ নির্লজ্জতা?

মোঃ আব্দুর রাজ্জাক
Published : 9 Jan 2017, 06:58 PM
Updated : 9 Jan 2017, 06:58 PM

প্রতি বছর শীতকাল এলেই আমাদের দেশের এক শ্রেণির তথাকথিত গরীবে নেওয়াজ শীতার্তদের মাঝে গরম কাপড় বিতরণ শুরু করেন। এ কাজে সরকার নয়, কিছু কিছু ব্যক্তি, সংগঠন ও অর্থলগ্নী বা লাভজনক প্রতিষ্ঠানই অগ্রগণ্য। তাদের শীত বস্ত্র বিতরণের ঘটা দেখলে মনে হয়, দেশের মানুষ শীতে কাঁপতে কাঁপতে মৃতপ্রায়। কিন্তু তাদের শীতবস্ত্র কেনার সামর্থ্য নেই। তাই এ মৃত্যুপদযাত্রী আদমগুলোকে কবরে যাওয়ার পূর্বে তাদের একটু স্বস্তি দেয়া তাদের একান্ত কর্তব্য। বৈধ-অবৈধ অর্থ কামান এসব নব্য ধনীদের ভাবখানা এমন যে শীত এলেই শীতার্ত মানুষকে বাঁচানোর জন্য তাদের অন্তরাত্মা সদ্যজাত শিশুর মতোই কেঁদে ওঠে। আর তাদের বিতরণ প্রক্রিয়া দেখলে মনে হয়, এদের চেয়ে গরীব-দরদী এ জগতে আর কেউ নেই। মানবাধিকার যদি কেউ রক্ষা করেন, তো এরাই।

কিন্তু আসলে কি তাই? আমি বিষয়টিকে ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখি। আমি মনে করি এই একবিংশ শতাব্দীতে বাংলাদেশের মানুষের শীতার্ততা বাস্তবতার চেয়েও আনুষ্ঠানিকতায় বেশি। কেন? আমার যুক্তিগুলো নিম্নরূপ-

১. চরম দারিদ্র্য এখন বিগত:
বিষয়টি নিয়ে হয়তো বিতর্ক উঠতে পারে। কেউ কেউ আমাকে সরকারের দারিদ্র্য কমানোর দাবির প্রতি সমর্থন দেয়ার জন্য দলবাজ বলতেও হয়তো ছাড়বেন না। কিন্তু সরকারি বা বেসরকারি জরিপের ডাটাগুলোর চেয়েও এ ব্যাপারে আমার কাছে বেশি সত্য হল, আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা। আমার অভিজ্ঞতায় দেশে আর চরম দারিদ্র্য নেই।

আমাদের বাল্যে ১৯৭০ এর দশকে আমাদের দেশে নানা কারণে দারিদ্র্যের চরম বিকাশ ঘটেছিল। এ সময় আমি গ্রামের অনেক মানুষকেই ভূখা থাকতে দেখেছি। সে সময় মানুষ কচু-ঘেচু, কিংবা কাঁচা কলা পুড়ে খেয়ে দিনানিপাত করার অবস্থাতেই ছিল। আমি অনেক পরিবারকে গমের রুটির সাথে মিষ্টি আলু সিদ্ধ খেয়ে কোন রকম রাত পার করতে দেখেছি। এ বিষয়টি আমাদের এলাকায় এমন প্রচার পেয়েছিল যে যারা এ দুটো বস্তু (রুটি ও মিষ্টি আলু) খেয়ে জীবনযাপন করত তাদের বলা হত রেকর্ড ও ব্যাটারি খাওয়া পার্টি । রুটি হল গ্রামোফোন রেকর্ডের মতো। আর মিষ্টি আলু হল ড্রাই সেল ব্যাটারির মতো। তাই ব্যাটারি আর রেকর্ডের ব্রান্ড পেয়েছিল এ দুটো বস্তু।

কন্তিু কালের প্রবাহে তিল তিল করে হলেও আমরা আমাদের দেশের পূঁজি গঠন করেছি। ইঞ্চি ইঞ্চি করে হলেও আমরা সামনের দিকে এগিয়েছি। তাই দারিদ্র্য ক্রমান্বয়ে দূরে সরে যেতে শুরু করে। যারা অর্থনীতির ছাত্র কিংবা পণ্ডিত তারাই এ এগিয়ে যাওয়াটা ব্যাখ্যা করতে পারবেন। কিন্তু আমি কেবল উপলব্ধির কথাই বলছি।

আমাদের এলাকায় মানে রংপুরের দক্ষিণাঞ্চলে গত শতাব্দীর ৮০ এর দশক থেকে চরম দারিদ্র্য কমতে শুরু করে। আর বর্তমানে চরম দারিদ্র্য বলতে যা বোঝায় সেটা নেই বললেই চলে। কৃষি উৎপাদানে অগ্রগতি, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি, তথ্যের অবাধ প্রবাহ এবং সর্বোপরি গার্মেন্টস কারখানায় কাজ করার সুযোগ সারা দেশের মতো রংপুর অঞ্চলের সাধারণ নারী পুরুষদের নগদ টাকা উপার্জনকারী শ্রমিকে রূপান্তরিত করেছে। এর বাইরেও রয়েছে শিক্ষার হার বৃদ্ধির সাথে সাথে সরকারি বেসরকারি দফতে যুবকদের কর্মসংস্থান ও বিদেশ গমন।

যদি ক্ষুদ্র পরিসরেও ব্যাখ্যা করি তাহলে দেখব রংপুর অঞ্চলের মঙ্গাপীড়িত মানুষগুলো আর নিজেদের মাঝে মঙ্গা লালন করেন না। আমাদের বাল্যকালে আশ্বিন-কার্তিক মাস ছিল মঙ্গার মাস। ঐ সময় মানুষের হাতে কোন কাজ কাম থাকত না। কাজ কাম বলতে কৃষি জমিতে কামলা খাটাই বোঝাত। এর বাইরে কোন কাজ যে আছে মঙ্গাপীড়িত মানুষ সেটা জানতই না।

কিন্তু বর্তমানে তারা মঙ্গার সময় কৃষি শ্রমিকের জন্য অবস্থা সম্পন্ন কৃষকদের কাছে আগাম শ্রম বিক্রয় না করে রিকসা  চালাতে যায়, দূরবর্তী স্থানে ইঁটের ভাটায় মাটি কাটতে যায়। রংপুরের মানুষ সিলেটে গিয়ে রিকসা চালাচ্ছে, চট্টগ্রামের মিরের সরাইতে ইঁটের ভাটায় কাজ করছে– এমন তথ্য আমাদের বাল্যকালে অবিশ্বাস্য ছিল। কিন্তু বর্তমানে এটা সবার জানা কথা। এটা এখনও আস্বীকার করি না যে কৃষিজমিতে যখন কাজ থাকে না, তখন উত্তরাঞ্চলের খেটে খাওয়া মানুষগুলোর ক্রয় ক্ষমতা কমে। কিন্তু এটা সম্পূর্ণরূপে তিরোহিত হয় না যা অতীতে মানে গত শতাব্দীর সত্তুর ও আশির দশকে হত। তাই শীত কালে গরম কাপড়ের অভাবে দরিদ্র মানুষ শীতে মরণাপন্ন হয়েছে হয়েছে– এমন খবর কেবল অসত্যই নয় বরং তা হলুদ সংবাদিকতার দোষেও দুষ্টু।

২.গরম কাপড়ের সহজলভ্যতা

অতীতে দেশে শীতের কাপড় সহজলভ্য ছিল না। আমাদের বাল্যে রংপুর অঞ্চলে গরম কাপড় আর শীতের কাপড়ের মধ্যে তেমন কোন পার্থক্য দেখতে পাওয়া যেত না। যে কাপড় আমরা গরম কালে পরতাম, শীতকালেও কম বেশি তাই পরতাম। রাতের বেলা কাঁথা বা লেপ গায়ে দিতাম । অনেকের থাকত চাদর। একটি চাদর গায়ে জড়িয়ে যেন সারা দুনিয়াই ঘোরা যেত। অবস্থা সম্পন্নদের থাকত কাশ্মিরি উলের তৈরি কিংবা রেশমের তৈরি সাল। আর যারা নিতান্তই দরিদ্র তাদের পাতলা সুতি বস্ত্রই শীতকালের পোশাক ছিল। কিন্তু আশির দশকের পূর্বেই বাংলাদেশে পুরাতন শীত বস্ত্র আসতে শুরু করে। এসব শীত বস্ত্র ছিল যেমনি সস্তা তেমনি আরামদায়ক। কিন্তু মানুষের ক্রয় ক্ষমতা কম থাকায় সে পুরাতন কাপড় যা আমাদের এলাকায় বলত 'নিলামী কাপড়' কেনার সামর্থ্যই ছিল না। তাই অনেক মানুষ শীতার্ত থাকত। কিন্তু মানুষের ক্রয় ক্ষমতা বৃদ্ধির সাথে সাথে গরম কাপড়ের সুলভতা শীতার্ততার সংজ্ঞাই পাল্টিয়ে দিয়েছে। বর্তমানে শীতের গরম কাপড় একটি লুঙ্গি এমনকি মহিলাদের একটি ব্লাউস বা পেটিকোটের চেয়েও সস্তা। তাই যে লোকগুলোর বছরের অন্য সময়গুলোতে লুঙ্গি বা শাড়ির অভাবে উলঙ্গ থাকে না, তারা যে নিজ উপার্জনেই শীতের পোশাকও কিনতে পারবেন, নিতান্ত পাগল না হলে এ যুক্তি যে কেউ মেনে নেবেন।

৩. ভিক্ষাদানের ঘটা দেশকে ছোট করে
কোন জাতির জন্য ভিক্ষাদান ও ভিক্ষাগ্রহণ উভয়েই অবমাননাকর। কোন সমাজে যখন মানুষ ভিক্ষাদানে ব্রতি হন, তখন প্রমাণিত হয় যে ঐ দেশে ভিক্ষাগ্রহণের মানুষের অভাব নেই। কিন্তু নিজেদের প্রাচুর্য প্রদর্শন ও দয়াদাক্ষিণের সস্তা কর্মকাণ্ড যে আমাদের দেশ ও সমাজ সম্পর্কে বিশ্বসমাজে একটি ভুল সংবাদ প্রেরণ করছে সেটা কি আমাদের নব্য ধনী আর মেকি দরদীগণ বুঝতে পারছেন? দেশের পত্রপত্রিকায় যখন আমাদের শীতবস্ত্র বিতরণ ও এক শ্রেণির মানুষের তা সোৎসাহে তা গ্রহণের সচিত্র খবর প্রচারিত হয় তা ক্রমান্বয়ে বিদেশি ও আন্তর্জাতিক প্রচার মাধ্যমগুলোতেও ছড়িয়ে পড়ে। আর এ কৃত্রিম শীতার্ততার খবর পড়ে বিদেশের মানুষ মনে করে, হায়, বাংলাদেশটি এতই গরীব যে ঐ দেশের মানুষ শীতে মারা পড়ছে। আর সরকারি কিনা দারিদ্র্য দূরিকরণে সাফল্য দাবি করছে!

জানি আমার এ মতামতকে অনেকেই উড়িয়ে দিবেন। অনেকে আমাকে শীতার্ত মানুষগুলোর প্রতি মমত্বহীনতার বদনাম দিবেন। কিন্তু আমার এ উপলব্ধি যে নিরেট অভিজ্ঞতাজাত তার সপক্ষে একটি ছোট ঘটনা বলে এ নিবন্ধের ইতি টানব।

২০০২ সালের ঘটনা। পুলিশের শিক্ষানবিশ কাল শেষ করে সবেমাত্র মাঠে কাজ শুরু করেছি। আমার কর্মস্থল ছিল রাজশাহীর রেঞ্জ রিজার্ভ ফোর্সে। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা বগুড়া সফর করছেন। তার নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করার জন্য আমি রাজশাহী থেকে বগুড়ায় এসেছি। পরপর তিনদিন প্রধানমন্ত্রীর সফর ছিল। প্রথম দুই দিন তেমন শীত ছিল না। কিন্তু তৃতীয় দিন অসম্ভব শীত পড়ল। আমার ডিউটি পড়েছে রাতের পালায় বগুড়া সার্কিট হাউজে। ঐ রাতে প্রধানমন্ত্রী নিজেই রাতের বেলা শীতার্তদের মাঝে শীতবস্তু বিতরণ করবেন।

এ কথা শুনে সার্কিট হাউজের সামনে শতশত কাপড় প্রত্যাশী নারীপুরুষ ও শিশু অপেক্ষা শুরু করল। মানুষগুলোর শরীরে স্বল্প পরিমাণে পোশাক আছে। কিন্তু সন্ধ্যা নামার সাথে সাথে তারা তাদের শরীরের ঊর্ধ্বাংশ বস্ত্রহীন করা শুরু করে শীতে কাঁপতে থাকল। এমনকি অনেকে দুগ্ধজাত শিশুর শরীর থেকেও কাপড় সরিয়ে নিল। সন্ধ্যার পর প্রধানমন্ত্রী সার্কিট হাউজ থেকে বের হলেন। তবে সার্কিট হাউজের গেইটে না থেমে চলে গেলেন সোজা শহরতলীতে। শহরতলীতে যেখানে মানুষ শীতের কাপড় পাবার প্রত্যাশা না করেই তাদের মতো করে হয় দোকানে বা ফুটপাতে শুয়ে আছেন, প্রধানমন্ত্রী এসব মানুষকে শীতবস্তু দিয়ে অনেক রাতে সার্কিট হাউজে ফিরে বিশ্রামে গেলেন।

কিন্তু গেইটের কাছে বসে থাকা কৃত্রিম-শীতার্ত মানুষগুলোকে কিছুতেই সরান গেল না। তারা প্রায় শেষ রাত পর্যন্ত কাপড়রে আশায় খালি গায়ে সার্কিট হাউজের গেটের কাছে বসে থাকলেন। মাঝে মাঝে তারা পুলিশ বেষ্ঠনী ভেঙ্গে সার্কিট হাউজে প্রবেশের চেষ্টা করে পুলিশের মৃদু লাঠিচার্জ হজম করল। শেষ পর্যন্ত যখন তাদের বিশ্বাস হল যে প্রধানমন্ত্রী আসলে তাদের কাপড় দেয়ার জন্য বের হবেন না, তখন তারা প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশ্যে গালমন্দ শুরু করল। এরপর তাদের ব্যাগে রাখা কিংবা অদূরে দাঁড়ানো পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকে সন্ধ্যা রাতে খুলে ফেলা শীতের পোশাকগুলো তড়িঘড়ি করে গায়ে দিয়ে ভাগা শুরু করল। তাহলে বুঝুন আজ থেকে ১৫ বছর পূর্বেও শীতের কাপড়ের লোভে মানুষ কিভাবে শীতার্ত সাজত।

তাই বর্তমানে শীতার্ততা সম্পূর্ণ কৃত্রিম নয়কি? আর যারা ঘটা করে শীতবস্ত্র বিতরণ করে  সোশ্যাল মিডিয়া ভরিয়ে দিচ্ছেন, তারা কি জাতি হিসেবে বিশ্ববাসির কাছে আমাদের হেয় করছেন না?