টিভি সিরিয়াল সুলতান সুলেমানঃ  নিজেদেরই উচ্চতায় উঠতে হবে

মোঃ আব্দুর রাজ্জাক
Published : 19 Jan 2017, 09:14 PM
Updated : 19 Jan 2017, 09:14 PM

সুলতান সুলেমান সম্পর্কে প্রথম জানতে পারলাম বাংলাদেশের বেসরকারি টেলিভিশন আর্টিস্টদের প্রতিবাদের খবর থেকে। জানলাম, বেসরকারি টেলিভিশন,দীপ্ত টিভি নাকি তুর্কি ভাষায় নির্মিত বিশাল কলেবরের একটি ধারাবাহিকের বাংলা ডাবিং প্রচার করছে। এ ধারাবাবিহক এতটাই জনপ্রিয়তা পেয়েছে যে দর্শকরা দীপ্ত টিভির দিকে ঝুঁকে পড়েছে। আর এ বিদেশি সিরিয়ালের বাংলা ডাবিং এর সাফল্য অন্যান্য টেলিভিশনগুলোকেও  তারাও অনুরূপ বিদেশি সিরিয়ালের বাংলা ডাবিং প্রচারে উৎসাহিত করেছে। আর এটা যদি হয় তো আমাদের দেশের যারা নাটক তৈরি করেন, নাটকে অভিনয় করে দু'মুঠো পেটের ভাত জোগাড় করেন তারা বেকার হয়ে পড়বেন। আর এ ভয় থেকেই তারা প্রতিবাদ করছেন যে বাংলাদেশের টিভিগুলোতে যেন বিদেশি সিরিয়াল প্রচার করা না হয়। কিন্তু তারা নিজের স্বার্থের কথা প্রকাশ্যে না বলতে পেরে দেশিয় সংস্কৃতি রক্ষার ভূয়া ধূয়া  তুলে বিক্ষোভে নেমেছে। খবরে যা পড়লাম, এদের হোতা নাকি নাট্যকার ও অভিনেতা মামুনুর রসিদ। তার মতে,  'বিদেশি ভাষার সিরিয়াল এনে এক অশুভ ব্যবসা চলছে। এসব সিরিয়ালের উপাদানগুলো আমাদের ধর্মীয়, সামাজিক মূল্যবোধবিরোধী।' মামুনুর রশীদের মতো ধর্ম নিরপেক্ষ ঘরানার নাট্যকারও কেবল নিজেদের শ্রেণিস্বার্থ সংরক্ষণের জন্য আজ ধর্ম রক্ষার ধোঁয়া তুলছেন।

https://www.youtube.com/watch?v=ydorC0UQPEs

সুলতান সুলেমান প্রচারের বিরোধীদের বিক্ষোভের খবর পড়তে গিয়েই আমি এ সিরিয়াল সম্পর্কে জানতে পারলাম। এ ঘটনা ছিল প্রায় মাস খানেক আগের। তখনই চেয়েছিলাম এ সিরিয়ালটা ইউটিউব থেকে দেখার জন্য। কিন্তু ঐ সময় ওটা খুঁজে পাইনি। আজ আমার রুমমেইট অতিরিক্ত পুলিশ সুপার তাহিয়াত এটা খুঁজে বের করল। শুনলাম এটার নাকি এখন পর্যন্ত টিভিতে ২০০ পর্বেরও বেশি প্রচারিত হয়েছে। সে নিজেও দেখা শুরু করেছিল ৬০ পর্বের পরে গিয়ে। যাহোক, আমি ইউটিউবে গিয়ে কয়েকটি পর্ব ডাউনলোড করে দেখলাম। চমৎকার একটি ধারাবাহিক।

সুলতান সুলেমান অটোম্যান সাম্রাজ্যের দশম ও সবচেয়ে দীর্ঘ স্থায়ী সুলতান ছিলেন। ১৫২০ থেকে ১৫৬৬ সাল পর্যন্ত প্রায় ৪৬ বছর ছিল তার শাসনকাল। এ শাসনকালে তিনি যেমন ইউরোপ, এশিয়া ও আফ্রিকার অর্ধাংশ ব্যাপী তার রাজ্য বিস্তার করেছেন, তেমনি অটোমান সাম্রাজ্যকে ধর্মীয় আইনের বেড়া জাল থেকে বের করে এনে নিজের দেয়া স্বকীয় আইনেও প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। তাই তো সুলেমানের  আর এক নাম হল কানুনিক বা আইনপ্রণেতা।

শুনলাম, এ সিরিয়ালটি নিয়ে নাকি খোদ তুরস্কেও ব্যাপক বিতর্ক আছে। বিতর্ক আছে গোঁড়া মুসলিমদের মধ্যেও। এ সিরিয়ালে একজন মুসলমান শাসকের এমন সব কার্যাবলী দেখান হয়েছে যা ইসলামে সমর্থনীয় নয়। অন্যদিকে তুর্কিদের অনেকে বলছে, এখানে অটোমান সাম্রাজ্যের ইতিহাস বিকৃত করা হয়েছে। এটা দেখলে তুরস্কের তরুণ সমাজের কাছে তাদের ঐতিহ্যের শাসকদের সম্পর্কে ভুল বার্তা চলে যাবে। কিন্তু এত সব সমালোচনা আর বিরোধীতার পরেও সুলতান সুলেমান তুরস্কসহ অন্ত ১৭০টি দেশের টিভিগুলোতে একটি জনপ্রিয় সিরিয়াল।

এখন পর্যন্ত সাত-আটটি পর্ব দেখলাম। হয়তো ধীরে ধীরে সবগুলোই দেখব। আর আমাদের দেশীয় শিল্পী, কলাকুশলী, নির্মাতা, অর্থদাতা বা পরিচালকদের উদ্দেশ্যে বলতে চাই, এই উন্মুক্ত বিশ্বে এক স্থানে তৈরি করা পণ্য যদি প্রতিযোগিতায় টিকতে পারে তবে তা অল্প সময়ের মধ্যেই সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। সংস্কৃতির স্বকীয়তা এখন ঘরের দরোজা বন্ধ করে রক্ষা করা যাবে না। প্রচার মাধ্যম এখন আর মাত্র কতিপয় ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান এমনকি সরকারের দখলেও নেই। এ ইন্টারনেট আর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বিশ্বে চাহিদার বিপরীতে পণ্য সরবরাহ হবেই। সেটা কেবল টিভি সিরিয়াল বলেই নয়, এমনকি নিষিদ্ধ মাদকের ক্ষেত্রেও সত্য। তাই, সুলতান সোলেমানকে জোর করে বন্ধ করা নয়, একে উন্মুক্ত করে দিয়ে এর মতোই জনপ্রিয় সিরিয়াল তৈরি করুন। দেখবেন আপনাদের সিরিয়ালও বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ছে। উচ্চমান আর জনপ্রিয়তার বিপরীতে নিজেদের মানকে উচ্চতায় পৌঁছানোর চেষ্টা করতে হবে। গায়ের জোরে রাস্তার বিক্ষোভ দিয়ে তা প্রতিহত করা যাবে না। বড়কে ছেঁটে ফেলে ছোট করে নিজের অনুচ্চতায় নামিয়ে আনা  নয়, নিজেদেরই উচ্চতায় উঠতে হবে।

(১৮ জানুয়ারি, ২০১৭, ইউএন হাউজ, জুবা, দক্ষিণ সুদান)

ছবিঃ ইন্টারনেট