ঢাকাই মসলিনঃ বাস্তবের রূপকথা

মোঃ আব্দুর রাজ্জাক
Published : 6 Feb 2017, 05:07 PM
Updated : 6 Feb 2017, 05:07 PM

বাল্যকালে একটি পাঠ্য বইয়ে পড়েছিলাম, ঢাকার সোনার গাঁয়ের তৈরি মসলিন কাপড় এত বেশি মিহি হত যে সত্তর হাত লম্বা একটি মসলিন শাড়ি নাকি কয়েক ভাঁজ করে একটি আংটির ভিতর দিয়ে বের করা যেত। তবে মসলিন সম্পর্কে আমার জ্ঞান তখন ঐ পর্যন্তই সীমাবদ্ধ ছিল।

বাঙালিরা তাদের হাজার বছরের ইতিহাস-ঐতিহ্যের যে সামান্য কিছু বিষয় বা বস্তু নিয়ে গর্ববোধ করত এবং এখনও করে তাদের মধ্যে প্রধানতম হল মসলিন কাপড়। ফুটি কার্পাস তুলা থেকে তৈরি এ কাপড় তার সূক্ষ্ণতার জন্যই সারা বিশ্বে বিখ্যাত ছিল। ভারতের মুঘল রাজপরিবার তো বটেই এমনকি ব্রিটিশ রাজরানীদেরও নাকি প্রথম পছন্দের কাপড় ছিল ঢাকাই মসলিন।

'মসলিন' শব্দটি খাঁটি বাংলা নয়। কিন্তু এটি কোন ভাষা থেকে কিভাবে এসেছে তা নির্ণয় করাও কঠিন। তবে দুজন ইংরেজ ভাষাবিদের দাবি অনুসারে 'মসলিন' শব্দটি এসেছে ইরাকের উত্তরাঞ্চলীয় ব্যবসাকেন্দ্র মসুলের নাম থেকে।  মুসলমান শাসন আমলে মধ্যপ্রাচ্যের সাথে ভারতের যোগাযোগ ছিল অত্যন্ত নিবিড়। ভারতের স্থাপত্যকলার অধিকাংশ শিল্পীই এসেছিল মধ্যপ্রাচ্যের ইরান বা ইরাক থেকে। ব্যবসা কেন্দ্র হিসেবে তখনও মসুলের বেশ সুনাম ছিল। আর তখন মসুলেও সূক্ষ্ণ কাপড় তৈরি হত। তাই মসুল থেকে ঢাকায় কাপড়ের কারিগরগণের আসা কিংবা ঢাকা থেকে মসুলে যাওয়া অসম্ভব ছিল না। মসলিন বলতে বাঙালিরা বোঝাত ঢাকার আশেপাশে তৈরি হওয়া সকল প্রকার সূক্ষ্ণ শ্রেণির কাপড় বা শাড়িকে। তাই মসুল আর সূক্ষ্ণ কাপড় এ দুইয়ের যোগসূত্র দিয়ে মসলিন শব্দটি চালু হয়েছে। তবে নামে যাই হোক মানে এ কামে যে এ কাপড় অতি উচ্চমানের ও পৃথিবীতে আবিষ্কৃত বা তৈরিকৃত মিহিতম কাপড়গুলোর অন্যতম ছিল তার সাক্ষ্য ইতিহাসই দেয়; বাঙালিদের আলাদা ভাবে দাবি করতে হয় না।

কিন্তু আদতে কত মিহি ছিল এ কাপড়? ইতিহাস ও সাহিত্যপাঠে জানা যায়, ঢাকায় প্রায় ২৮ ধরনের মসলিন তৈরি হত। এ সবের মধ্যে সবচেয়ে মিহি ছিল 'ঝুনা' মসলিন ও  'আব-ই-রওয়ান' মসলিন। ঝুনা শব্দটি এসেছে হিন্দি থেকে আর আব-ই-রওয়ান হল একটি ফারসি শব্দ। এ দু ধরনের মসলিনই মোঘল দরবারে বিশেষত অন্দর মহল বা হেরেমে বহুল ব্যবহৃত হত। রাজপুত্র ও সম্রাটগণ মসলিন ব্যবহার করতেন শিরোস্ত্রাণ তৈরি করতে আর রাজকণ্যা ও মহিষীগণ ব্যবহার করতেন গরমকালের ফ্যাশন হিসেবে। ২০ গজ লম্বা ও ১ গজ চওড়া একটি মসলিন কাপড়ের ওজন হত ২০ তোলার মতো। ৫০ মিটার লম্বা এক প্রস্থ মসলিন কাপড়কে একটি সাধারণ দিয়াশলাই/ম্যাচ বাক্সের মধ্যে অনায়াসেই ভাঁজ করে রাখা যেত।

গ্রীষ্ম মওসুমে মুঘল সাহজাদী জেব-উন-নেসা মসলিন কাপড়ের জামা পরে তার পিতা সম্রাট আওরঙ্গজেব এর দরবারে উপনীত হন। মেয়ের পরনে পাতলা কাপড় দেখে সম্রাট লজ্জিত হয়ে ক্ষেপে যান। তিনি রাজকুমারীকে প্রশ্ন করেন, মুঘল সাম্রাজ্যের কী এতই দূরবস্থা যে রাজকুমারীর শরীর কাপড়ের অভাবে বেআব্রু হয়ে আছে? রাজকুমারী জেব-উন-নেসা সম্রাটকে জিজ্ঞাসা করলেন, কি হয়েছে জাঁহাপনা? আমি তো যথাযথ কাপড়ই পরিধান করেছি? সম্রাট বললেন, তবে কাপড় ভেদ করে তোমার শরীর দেখা যাচ্ছে কেন? রাজকুমারী বললেন, এ কাপড় অতি মিহি জাঁহাপনা। তবে কেন এক প্রস্ত না পরে দুই প্রস্থ পরলে না? রাজকুমারী বললেন, তাই তো করেছি জাঁহাপনা! আমি তো এক প্রস্ত নয়, দুই প্রস্ত নয়, আমি তো সত্তর প্রস্ত কাপড় পরেছি? দেখুন তাহলে। কোন কাপড় কত পাতলা বা সূক্ষ্ণ হলে পর পর সত্তুর পর্দা দিলেও সম্রাটের চোখে তা এক প্রস্থের চেয়েও পাতলা মনে হত!

কথিত আছে বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার নবার আলীবর্দী খানের দরবারে ছিল আব-ই-রওয়ান জাতের মসলিনের কদর। ফারসি ভাষায় আব-ই-রওয়ান এর অর্থ হল সকালের শিশির। যদি সকালের শিশির ভেজা ঘাসের উপর এ কাপড় বিছিয়ে দেয়া যেত তবে ঘাসের শিশিরের সাথে এটা এমনভাবে একাকার হয়ে যেত যে কোনটা কাপড় আর কোনটা ঘাস বোঝাই যেত না। বাংলার সুবেদার থাকার সময় আলীবর্দী খাঁ তার জন্য তৈরি এক প্রস্থ মসলিন কাপড় ঘাসের উপর শুকাতে দিয়েছিলেন। এ স্থানের কিছু দূরে ঘাস খাচ্ছিল একটি গাভী। সে ঘাস খেতে খেতে মসলিনের কাছে এসে ঘাস ও কাপড়ের মধ্যে পার্থক্য বুঝতে না পেরে ঘাসের সাথে সাথে গোটা কাপড়টিই খেয়ে ফেলল। আলীবর্দী খাঁ এর শাস্তি স্বরূপ গাভীর মালিককে ঢাকা থেকেই বের করে দিয়েছিলেন।

কিন্তু সে রামও নেই, সে অযোধ্যাও আর রইল না। মুঘলদের পরাজিত করে বাংলা দখল করল ব্রিটিশ বেনিয়ারা। রাজ্য ক্ষমতা দখলের পূর্বেই তারা বুঝতে পেরেছিল যে তাদের বিলিতি শাড়ীর একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী হল ঢাকার মসলিন। তাই তারা মসলিনকে চিরতরে দূর করে দিতে চাইল। প্রথমেই তারা মসলিন কাপড়ের উপর অত্যধিক শুল্ক বা ট্যাক্স চাপিয়ে দিল। বিলেত থেকে আমদানী করা কাপড়ের উপর শুল্ক ছিল ২-৪%। কিন্তু মসলিনসহ দেশি কাপড়ের উপর তারা ট্যাক্স বসাল ৭০-৮০%। তাই দেশে যেমন বিলিতি কাপড় সুলভ হল, একই সাথে ব্যয়বহুল হয়ে উঠল মসলিনসহ দেশি কাপড়। প্রতিযোগিতায় তাই মসলিন টিকতে পারছিল না। কিন্তু তারপরও টিকেছিল মসলিন।

এবার ইংরেজ শাসকগণ নিষেধাজ্ঞা জারি করল মসলিন তৈরির উপর। তাদের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করেও চলল মসলিনের উৎপাদন। তখন ব্রিটিশরাজ চড়াও হল মসলিনের কারিগরদের উপর। তারা মসলিন কারিগরদের ধরে ধরে তাদের হাতের আঙ্গুল কেটে দেয়া শুরু করল যাতে গোপনে গোপনে তারা মসলিন তৈরি করতে কিংবা এর নির্মাণকৌশল অন্যদের শিক্ষা দিতে না পারে। আর এভাবেই একদিন বাঙালিরা হারিয়ে ফেলল তাদের গর্বের মসলিন তৈরির প্রযুক্তিজ্ঞান। বর্তমানে মিরপুরের একমাত্র জামদানিই মসলিনের দূর সম্পর্কিত শ্রেণি হিসেবে টিকে আছে।

ইংরেজগণ এদেশে এসে একটি সম্পূর্ণ নতুন যুগের সূচনা ও বিকাশ ঘটিয়েছিলেন বলে ইতিহাসে স্থান করে নিয়েছেন। সারা বিশ্বেই তারা ছড়িয়ে দিয়েছিলেন আধুন জ্ঞান-বিজ্ঞানের আলোকবর্তিকা। কিন্তু একই সাথে তারা সারা পৃথিবী থেকে অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর ঐতিহ্যের নিদর্শনগুলোকেও যে ধ্বংস করে নিজেদের ব্যবসায়িক স্বার্থ সিদ্ধ করেছিলেন, ঢাকার মসলিন শিল্প ধ্বংসের কাহিনীই তার উজ্জ্বল  দৃষ্টান্ত। (০৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭, রংপুর, বাংলাদেশ)।

সূত্রঃ হাজার বছরের বাঙালি নারী/মাহমুদ শামসুল হক/ পাঠক সমাবেশ(২০০০)/ উইকিপিডিয়া।