অন্য দেশে, অন্য মিশনেঃ বাংলাদেশ মিলিটারি পুলিশ ক্যাম্পে তাবুবাস

মোঃ আব্দুর রাজ্জাক
Published : 25 Feb 2017, 11:29 AM
Updated : 25 Feb 2017, 11:29 AM

ব্যানএমপি ক্যাম্পে আমাদের অভ্যর্থনা জানালেন মেজর সাকিল। অত্যন্ত প্রাণবন্ত স্বভাবের অফিসার তিনি। প্রথমে চলল পরিচয় আর কুশল বিনিময়ের পালা। আমরা ইতোপূর্বে একে অপরকে জানতাম না। অথচ আমরা আজ তার অতিথি। এমনকি তার সাথে এর পূর্বে আমাদের কোন কথাও হয়নি। এখানে অতিথি হওয়ার বিষয়টি ঠিক করেছিলেন ব্যান ইনজিনিয়ার মুশিকি ক্যাম্পের ডেপুটি কমান্ডার মেজর মাহমুদ। অথচ স্বদেশিকতার কী মহিমা! মেজর সাকিলের আচরণে মনে হচ্ছিল আমরা যেন তার কত দিনের পরিচিত আত্মীয়।

মেজর সাকিলের এ ক্যাম্পটি অত্যন্ত ছোট। একটিমাত্র ফটকে একজন সেন্ট্রি আছে। একটি তাবুতে তার অফিস, অন্যটিতে তার থাকার ব্যবস্থা। তার বাস-তাবুতে তিনটি খাট আছে। একটিতে তিনি থাকেন, অন্য দুটি অতিথিদের জন্য। মূলত এখানে অতিথিদের জন্য একটি মাত্র বেডই ছিল। দুই বেডের আলাদা আলাদা সাইজ দেখেই বোঝা যায়, আমরা দুজন হওয়ায় একটি খাট সংগ্রহ করা হয়েছে। তাবুতে একটি ছোট ফ্রিজ, একটি টেলিভিশন ও একটি ডাইনিং টেবিল আছে।তাবু, কিন্তু আধুনিক জীবনোপকরণের প্রায় সব জিনিসই আছে।

বৈকালিক নাস্তা সেরে চলল গল্পগুজব। এর ঘন্টা দুয়েক পরেই রাতের খাবার পরিবেশন করা হল। সাদা ভাত ও খাসির মাংস। তবে খাবারের সাথে বাড়িতি আকর্ষণটি ছিল মেজর সাকিলের নিজ হাতে তৈরি পিলি-আঁচার। স্থানীয় কঙ্গোলিজগণ মরিচকে বলেন পিলিপিলি। পিলিপিলি দিয়ে তারা এক প্রকার আঁচার তৈরি করেন। খেতে চমৎকার! না এ আঁচার আমাদের দেশে মরিচ দিযে তৈরি পরিচিত আঁচার নয়।এটার স্বাদ অনেকটাই ভিন্ন।

মেজর শাকিলের পিলিপিলি রিসপি

আমাদের অনুরোধে মেজর সাকিল তার পিলিপিলি-আঁচারের রন্ধন কৌশলটি বর্ণনা করলেন। প্রথমেই কাঁচাপাকা কিছু মরিচ ধুয়ে নিয়ে শক্ত কোন কিছু দিয়ে থেতলান হল। এবার থেতলানো মরিচগুলোর সাথে কিছু তেল (তিনি সানফ্লাওয়ার তেল ব্যবহার করেছেন) মিশিয়ে ব্লেন্ডার মেশিনে আচ্ছামত ব্লেন্ড

করা হল। অন্য একটি পাত্রে সানফ্লাওয়ার তেল গরম করা হল। এবার গরম তেলের উপর ব্লেন্ড করা মরিচ ঢেলে দিয়ে জ্বাল দেয়া অব্যহত রাখা হল। যখন মরিচ ও তেলের রঙ মধুর রঙের মতো হয়ে এল, তখন পিলিপিলি আচার তৈরি হয়ে গেল।

প্রায় এক বছর আগে আমার রুয়ান্ডার সহকর্মী মার্গারেট আমাকে একটি ড্রোপার বোতলে এক প্রকার মরিচমিশ্রিত তৈল-তরল দিয়েছিল। ভাতের উপর ড্রপার দিয়ে একটু মিশিয়ে খেলে ভিন্ন ধরনের স্বাদ পাওয়া যায় ঐ মরিচ মেশান তেলের। মেজর সাকিলের পিলিপিলি আচার খেয়ে আমার মার্গারেটের কথা মনে পড়ল। আসলে ডিআর কঙ্গোর এ এলাকাটি রুয়ান্ডার সীমান্তে অবস্থিত।  গোমা থেকে মাত্র এক কিলোমিটার দূরে হল গিনসে বন্দর। আর এ সাকে ও মুশিকি অঞ্চলে বহুসংখ্যক রুয়ান্ডান নাগরিক বা রুয়ান্ডান বংশোদ্ভূত কঙোলিজ বাস করেন। তাই এ পিলিপিলি যে আমার রুয়ান্ডান বান্ধবী মার্গারেটর দেয়া সেই তৈল-মরিচ তরলেরই অপরেশোধিত রূপ, এ বিষয়ে আমার আর সন্দেহ রইল না।

জীবনের দ্বিতীয় তাবুবাস

আমার স্মরণকালের এটা ছিল আমার দ্বিতীয় তাবুবাস। ২০০৮ সালের নভেম্বরের দিকে সুদানের দারফুর মিশনে বাংলাদেশ ফর্মড পুলিশ ইউনিটের নিয়ালা ক্যাম্পে প্রথম তাবুতে বাস করেছিলাম। হ্রদ কিভুর পাড়ে সক্রিয় আগ্নেয়গিরি নাইরোগঙ্গার পাদদেশে আগ্নেয়গিরির ছাই ও পাথরের উপর বাংলাদেশ মিলিটারি পুলিশের এই ছোট তাবুতে ঘুম ভাঙ্গল সকাল সাড়ে পাঁচটায়। পূর্ব দিকে জীবন্ত আগ্নেয়গিরির উপর দিয়ে সূর্যের লাল আভা দেখা যাচিছল। কিন্তু তখনও আমি ছাড়া এ ক্যাম্পের অন্য কেউ ঘুম থেকে ওঠেনি। এর আগের রাতে ছিলাম পাহাড়ের উপরে। ঐ পাহাড়ের উচ্চতা ছিল সমুদ্র সমতল থেকে প্রায় ২,২০০ মিটার। আজ এ কিভু হ্রদের সমতলে রাত কাটালাম যার উচ্চতা সমুদ্র সমতল থেকে ১,৪৬০ মিটার। এর অর্থ আমি বাংলাদেশের নিরিখে এখনও তাজিংডং এর চূড়া থেকে ১৮০ মিটার উপরে আছি।

কিভু হ্রদের ইতিবৃত্ত

কিভু হ্রদটির আয়তন প্রায় ২,৭০০ বর্গ কিলোমিটার। এর সর্বোচ্চ দৈর্ঘ ৮৯ কিলোমিটার আর সর্বোচ্চ প্রস্থ ৪৮ কিলোমিটার। গভীরতার দিক দিয়ে এটি পৃথিবীর দশম স্থানীয় যার সর্বোচ্চ গভীরতা ৪৮০ মিটার। হ্রদের পূর্ব দিকের ৪০% পড়েছে রুয়ান্ডায় আর পশ্চিমের ৬০% গণপ্রজাতন্ত্রী কঙ্গোতে। হ্রদের উত্তর দিকে দুটো বড় বড় শহরের মধ্যে গোমা পড়েছে কঙ্গোতে আর গিনসে পড়েছে রুয়ান্ডায়। দুই শহরের মাঝের দূরত্ব মাত্র এক কিলোমিটার। আমরা এ্খন সাকে শহরে রয়েছি যা  হ্রদের উত্তরে কিন্তু গোমা শহর থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটার পশ্চিমে।

হ্রদ কিভু হল পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়ংকর ঝুঁকিপূর্ণ হ্রদ। এ হ্রদদের তল দেশে মিথেন ও কার্বন ডাই অক্সাইড গ্যাসের অত্যন্ত বড় রিজার্ভ রয়েছে। মিথেন গ্যাস হল আমাদের বাসাবাড়িতে রান্নার কাজে ব্যবহৃত গ্যাস। আর কার্বন ডাই অক্সাইড হল একটি মরণাস্ত্র। এটা অক্সিজেনের বিপরীত। অক্সিজেন মানুষকে বাচিয়ে রাখে, আর কার্বন-ডাই-অক্সাইড মানুষকে হত্যা করে।

মাত্র ২০ কিলোমিটার দূরে জীবন্ত আগ্নেয়গিরি নাইরোগঙ্গার অগ্নুৎপাত সংক্রান্ত কিয়ার জন্য এখানে কার্বন ডাই অক্সাইড গ্যাসের একত্রিকরণ হয়েছে। আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাত কিংবা অন্য কোন কারণে ভূমিকম্প হলে হ্রদরে গভীর থেকে মিথেন গ্যাস প্রচণ্ড গতিতে উপরে উঠে আসবে। একই সাথে আকাশে উৎক্ষিপ্ত হবে কার্বন ডাই অক্সাই। এই দুই মিলিত গ্যাসের যৌথ কার্যকলাপেই সৃষ্টি হবে সুনামি। এর ফলে হ্রদের পানিসহ আশেপাশের পাহাড়পর্বত, গাছপালা, বাড়িঘর ওলটপালট হয়ে যাবে। তখন বিশাল এই হ্রদের তীরে বসবাসকারী প্রায় ১০ লাখ মানুষ নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে।

পাশের নাইরোগঙ্গা আগ্নেয়গিরিটির সর্বশেষ অগ্নুৎপাত ঘটেছিল ২০০২ সালে। তখন এর পাদদেশের গোমা শহরটি ফুটন্ত লাভার ১২/১৪ ফুট নিচে ঢাকা পড়েছিল। ঐ সময় যদিও প্রাণহানী ছিল অল্পকজন, কিন্তু শহরটির প্রায় পুরোটাই ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। প্রায় কয়েক লাখ লোককে  পার্শ্ববর্তী গিনসে শহরে স্থানান্তরিত করা হয়েছি। ভাগ্য ভাল ছিল যে ঐ সময় এ কিভু হ্রদের তলদেশে কোন প্রভাব পড়েনি। যদি পড়ত তাহলে হয়তো আমাদের আজকের এ ভ্রমণ কোনভাবেই সম্ভব হত না। এ স্থানটি হত একটা মৃত্যুপুরি।

আমরা সাকে শহরের যে স্থানটিতে অবস্থান করিছি তা আগ্নেয়গিরির লাভা থেকে তৈরি। ২০০২ সালে এ স্থানের সন্নিকটস্থ নাইরোগোঙ্গো আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাত হলে ফুটন্ত লাভা গড়াতে গড়াতে এসে হ্রদের পানিতে পড়ে। সেই গরম লাভা ঠান্ডা হয়ে হ্রদের কিছু অংশ ভরাট হয় যায়।  গতকাল রাত হতে সকাল পর্যন্ত সাকে শহরে আমাদের  অবস্থান প্রায় ১৪ ঘন্টার মতো হল। যদিও নিশ্চিন্তে রাতটি কাটালাম, তবুও মনে মনে ভয় ছিল, যদি আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাত ঘটে, যদি হ্রদে সুনামি শুরু হয়, নিচ থেকে উঠে আসে মিথেন ও কার্বন ডাই অক্সাইড, আর উত্তর দিকের উঁচু ভূমি থেকে নেমে আসে জলন্ত লাভা, তাহলে হয়তো নিজেদের রক্তমাংসের দেহগুলোর সাথে সাথে কঙ্গো ভ্রমণের আনন্দগুলোও নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে চিরকালের জন্য।

সকালের আবহাওয়া বেশ মেঘলা। এ গোমা শহর তথা কিভু হ্রদের আশাপাশের আকাশ কখন রোদ উঠে আর কখন বৃষ্টি হয় তা বলাই মুসকিল। তবে নিকটস্থ আগ্নেয়গিরি থেকে উৎপন্ন গ্যাসের ফলে আকাশ প্রায়ই মেঘাচ্ছন্ন থাকে। সকালে প্রাতঃকর্ম সেরে আমি বের হলাম কিভু হ্রদটার পাড়ে হাওয়া খেতে। আমাকে ফটকের বাইরে যাওয়া দেশে আমাদের মিলিটারি পুলিশের সেনা সদস্যগণ অনেকটাই ইতস্তত করছিল। কারণ এখানে একা একা চলাফেরা করা নিরাপদ নয়। তবুও আমি কিছুটা ঝুঁকি নিয়ে বাইরে বের হলাম। হ্রদের পাড়ে নেপাল ও ব্রাজিলের সেনা ইউনিট আছে। জানতে পারলাম ব্রাজিলের ই্‌উনিটটির পুরোটাই কমান্ডোদের দ্বারা গঠিত। এ এলাকায় জাতিসংঘ বাহিনী অনেকটাই প্রতিরোধমূলক শান্তিরক্ষার কাজও করে। তখন কমান্ডোদের দ্বারা অভিযান পরিচালনার দরকার পড়ে। তাই এ ব্রাজিলিয়ান কমান্ডোদের রিজার্ভ রাখা হয়েছে।

যুদ্ধশিশু মেদেলু

হ্রদের পাড়ে কিছু অল্প বয়সী বালককে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম। তাদের সাথে কিছু ছবিও তুলতে চাইলাম। কিন্তু তাদের হাতে মোবাইল সেট দিতে সাহস পেলাম না। ইতোপূর্বে শুনেছিলাম যে এ শহরটিতে বেশ চুরি-ছিনতাই হয়। তবে অল্প পরেই মনে হল, ওদের হাতে মোবাইল দিয়েই ছবি তুলি, দেখি কি হয়। কিছুই হল না। আমি এ অপরিচিত ছেলেগুলোকে দিয়ে বেশ কিছু সুন্দর সুন্দর ছবি তুললাম।

অল্প পরে একটি চটপটে চরিত্রের ছেলে আসল। বয়স ১৪/১৫ হবে। নাম হল মেডেলু। চটপটে হলেও ছেলেটার চোখেমুখে জড়িয়ে আছে বিষন্নতা। অবশ্য এ এলাকাটাই বিষন্ন মানুষদের। যুদ্ধের পরিণতি এরা সর্বাঙ্গ ও সর্ব অন্তকরণ দিয়েই অনুভব করছে। কথা বলে জানতে পারলাম, মেদেলু একজন এতিম বালক। সংসারে আপন বলতে তার একটি মাত্র ভাই আছে। প্রায় দ্বিতীয় কঙ্গোযুদ্ধে তার গোটা পরিবার নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। তার ভাই আর সে পরবর্তীতে এতিমখানায় আশ্রয় পায়। মেদেলুর একটু লেখাপড়াও আছে। আবার সে ফেইসবুকও চালায়। আমাকে তার ফেইসবুক আইডি দিয়ে তার সাথে তোলা ছবিগুলো তাকে পাঠিয়ে দেয়ার অনুরোধ করল। আমি তা অবশ্য করেছি। মেদেলুর সাথে আমার এখন ফেইসবুকে কথা হয়, কুশল বিনিময় চলে।

সকালের নাস্তা খেয়ে মেজর সাকিল তার গাড়িতে আমাদের নিয়ে কিভু হ্রদের পাড়ে একটু ভ্রমণের উদ্দেশ্যে বের হলেন। আমরা আগ্নেয়গিরির লাভা-ভস্ম মাড়িয়ে অনেক দূর পর্যন্ত গেলাম। হ্রদের পানিতে তেমন মাছ নেই।পানিতে তরলায়িত মিথেন গ্যাসের পরিমাণ মাত্রাতিরিক্ত হওয়ায় এ লেকে সব ধরনের মাছ বাঁচতে পারে না।  তবে মলা মাছের মতো কিছু মাছ পাওয়া যায়। স্থানীয় মাঝিরা ক্যানু নৌকা দিয়ে হ্রদের গভীরে গিয়ে কারেন্ট জাল পাতিয়ে এ ছোট ছোট মাথ ধরছে। আমরা ক্যানু নৌকায় চড়ে কিছুদূর যাওয়ার চেষ্টা করলাম। কিন্তু এ নৌকায় ভ্রমণ তো দূরের কথা তীর-ছাড়া হয়ে টিকে থাকাই মুসকিল।

আমাদের যেতে হবে গোমা থেকে কিনশাসায়। কিন্তু জাতিসংঘের বিমানের মেনুফ্টো বা তালিকায় আমাদের নাম নেই। তাই সকাল সকাল বের হলাম গোমা শহরের উদ্দেশে। সাকে ছেড়ে আসার পূর্বে মেজর শাকিলের সাথে চলল আর এক দফা ছবি তোলার পালা। একটি এসকর্টসহ তিনি আমাদের গোমা শহরের দিকে বিদায় দিলেন।

চলবে–