শান্তিরক্ষীর দিনলিপিঃ যুদ্ধ মানে যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা

মোঃ আব্দুর রাজ্জাক
Published : 19 Feb 2017, 02:05 AM
Updated : 19 Feb 2017, 02:05 AM

ক্ষিণ সুদানের রাজধানী জুবা শহর। এখানে অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু (আইডিপি) শিবিরের শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষা করাই আমার বর্তমান দায়িত্ব। এখানে কমিউনিটি পুলিশিং সেকশনে দায়িত্ব পালন করছি প্রায় এক বছর যাবৎ। এ এক বছরে  মানুষের অনেক দুর্গতি দেখেছি। কিন্তু আজকের এক মা ও তার চার সন্তানের দুর্গতি আমাকে পরিপূর্ণভাবে ব্যথিত করে তুলল।

মহিলার নাম সারটি গিলা। বয়স ২৮ বছর। সাথে বাচ্চা আছে চারটি। এই বয়সে তিনি কত সন্তানের মা তা অবশ্য জানি না। তবে চারটি সন্তান সাথে থাকলেও ধারণা করা যায়, তিনি এর চেয়ে বেশি সন্তানের জননী। কারণ যুদ্ধ, খরা, অনাহার, অবহেলা আর স্বাস্থ্য সেবায় প্রবেশ কষ্টকর হওয়ায় এদেশ শিশু মৃত্যুহার অত্যন্ত বেশি। মহিলার বাস যে স্থানে সেই স্থানে প্রতি ১,০০০ জীবন্ত জন্মগ্রহণকারী শিশুর মধ্যে ১৫১ জন এক বছর বয়সের আগেই মারা যায়। তার মানে ১০০ জনের মধ্যে ১৬ জনই মারা যায়। (বাংলাদেশে এই হার প্রতি হাজারে ৫২ জন মাত্র) তাই এ চারটির বাইরেও তার জন্ম দেয়া সন্তান রয়েছে যারা হয় আজ বেঁচে নেই, কিংবা পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। অবশ্য বেঁচে না থেকে ওরা ভালই করেছে। নইলে ওদের এ মায়ের সাথে নিদারুণ কষ্ট সহ্য করতে হত।

কাকওয়া জনগোষ্ঠীর সদস্য সারটির বাড়ি ছিল দক্ষিণ সুদানের রাজধানী জুবা থেকে দক্ষিণ-পশ্চিমে প্রায় ১৭০ কিলোমিটার দূরে ইয়া-ই শহরে। এ শহরটি উগান্ডা ও ডিআর কঙ্গোর সীমান্তে। এ অঞ্চলে 'কাকওয়া' সম্প্রদায়ের বাস। আফ্রিকার কশাই বলে পরিচিত উগাণ্ডার সেনা-স্বৈর শাসক ইদি আমিন দাদাও একই ট্রাইবের লোক ছিলেন। কিন্তু সে গল্প ভিন্ন।

দীর্ঘ অর্ধশত বছর ধরে উত্তরের বিরুদ্ধে আন্দোল ও যুদ্ধ করে দক্ষিণ সুদান স্বাধীন হয়েছিল ২০১১ সালে। স্বাধীনতার মাত্র অল্পদিন আগে স্বাধীনতার রূপকার জন গ্যারাং এক হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় নিহত হন।

জন গ্যারাং ছিলেন দক্ষিণ সুদানের ৬২টি জাতিগোষ্ঠীর মানুষের কাছে ঐক্যের প্রতীক। তার মৃত্যুতে সেই সময় জাতিগত ঐক্যে তেমন কোন প্রভাব পড়েনি। প্রায়াত নেতার হাল ধরেন দল ও সেনাবাহিনীর সর্বাধিনায়ক সালভাকির মায়ারদিত। কিন্তু তিনি জন গ্যারাঙ্গের মতো ঐশ্বরিক নেতৃত্বগুণের অধিকারী নন। তাই স্বাধীনতার দু'বছরের মাথায়, ২০১৩ সালে প্রেসিডেন্ট সালভা ক্ষির ও প্রথম ভাইস প্রেসিডেন্টে রিয়াক ম্যাচারের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি হলে দেশে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। দেশের একটি সেনাবাহিনী ভেঙ্গে হয়ে যায় দুটো। রাষ্ট্রপতি সালভা ক্ষির সংখ্যাগরিষ্ঠ ডিংকা জাতিগোষ্ঠীর সদস্য। তাই তার অনুগত সৈনিকদের অধিকাংশই তার গোত্রের। অন্যদিকে ভাইস প্রেসিডেন্ট রিয়াক ম্যাচার দ্বিতীয় বৃহত্তম জাতিগোষ্ঠী নুয়ের সম্প্রদায়ের হওয়ায় তার সৈন্যদের অধিকাংশই নুয়ের সম্প্রদায়ের।

যে রাজনৈতিক দলের ব্যানারে দক্ষিণ সুদান স্বাধীকার আন্দোল করেছিল তার নাম ছিল এসপিএলএম (South Sudan Liberation Movement)। আর এ দলের অধীন যে সেনাবাহিনী ছিল তার নাম ছিল এসপিএলএ (South Sudan Liberation Army)। কিন্তু গৃহযুদ্ধের ফলে দল ও সেনাবাহিনী দুটোই খণ্ডিত হল। রাষ্ট্রপতি সালভা ক্ষিরের সাথের আর্মি ও দলের নাম একই থাকল। কিন্তু বিরোধীদের নাম হল এসপিএলএম-ইন-অপজিশন (SPLM-IO)। এই এসপিএলএম ও এসপিএলএম-আইও ফোর্সের মধ্যে ধুমছে যুদ্ধ চলল দীর্ঘ দুই বছর।

যুদ্ধের শুরুতেই লক্ষ লক্ষ বেশামরিক মানুষ তাদের বাড়িঘর ছেড়ে প্রাণ বাঁচাবার জন্য নিকটস্থ জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনের ফিল্ড অফিসগুলোর ক্যাম্পাসে আশ্রয়গ্রহণ করে। যারা প্রাণের ভয়ে পালিয়ে এসেছে তাদের পিছনে অব্যহতভাবে তাড়া করে চলল সেনা সদস্যরা। আশ্রয়প্রার্থীদের সামান্য কিছু ছাড়া প্রায় সবাই বিরোধীদল মানে রিয়াক ম্যাচারের জাতিগোষ্ঠী নুয়ের সম্প্রদায়ের লোক। এসব লোকের পারিভাষিক নাম হল আইডিপি (Internally Displaced Persons)। এই আইডিপিদের রক্ষা করার জন্যই জাতিসংঘের এত বড় আয়োজন, আমাদের মতো শান্তিরক্ষীদের শান্তিরক্ষাহেতু প্রবাস যাপন।

অনেক কাঠখড়ি পুড়িয়ে ২০১৫ সালের নভেম্বরে উভয় পক্ষ একটি শান্তিচুক্তিতে উপনীত হয়। কিন্তু সেই চুক্তি বাস্তবায়নের শুরুতেই ২০১৬ সালের জুলাই মাসে তা আবার  ভেঙ্গে পড়ে। আবার শুরু হয় গৃহযুদ্ধ। সরকারি বাহিনী (এসপিএলএ) ও বিরোধী বাহিনী এসপিএলএ-আইও ফোর্সের মধ্যে যুদ্ধ চলতে থাকে রাজধানী জুবাসহ সকল গুরুত্বপূর্ণ সকল শহর ও কৌশলগত গ্রামগুলোতে।

গল্পের শুরুতেই পরিচয় করিয়ে দেয়া সারটি গাই এর শহর ইয়া-ইতেও চলে অনেক বারের যুদ্ধ। কিন্তু গত জানুয়ারিতে শুরু হওয়া যুদ্ধে তিনি হারিয়ে ফেলেন তার স্বামীসহ পরিবার অন্যান্য সদস্যদের।

ইয়া-ই শহরটি বর্তমানে সরকারি বাহিনীর দখলে। এসপিএলএ সৈন্যরা ফ্রিস্টাইলে ঘুরে বেড়াচ্ছে সবখানে। কিন্তু বন্দী হয়ে গেছে ঐ অঞ্চলের সাধারণ মানুষ। যুদ্ধের ফলে বাড়িঘর ছেড়ে জঙ্গলে আশ্রয় নিয়েছে সকলে। পরাজিত যোদ্ধাদের মধ্যে যারা বেঁচে ছিলেন তারা পালিয়েছে শহর ছেড়ে। কিন্তু বিজয়ী সৈন্যরা অত্যাচার শুরু করেছে স্থানীয় বেসামরিক জনগণের উপর। নারী-শিশু-বৃদ্ধ কেউ তাদের আক্রোশ থেকে রেহাই পায় না।

যুদ্ধের পহেলা শিকার হয় নারী, শিশু ও বৃদ্ধরা। বৃদ্ধ আর শিশুরা দ্রুত মরে যায়। কিন্তু যুবতী নারীরা বেঁচে থাকে অনেক দিন। তাদের বাঁচিয়ে রাখা হয়। কারণ বিজীত-বিজয়ী উভয়েরই জন্য নারী দরকার। সৈন্যদের রান্নাবান্না থেকে শুরু করে যৌন চাহিদা মেটানোর জন্যই নারীদের দরকার। যৌন চাহিদার বিষয়টি পৃথকভাবে বোঝাবার দরকার নেই। কিন্তু রান্নার বিষয়টি একটু ব্যাখ্যা করা দরকার। দক্ষিণ সুদানের পুরুষরা রান্না করে না, করতে পারে না। কারণ রান্না করার মতো একটি ফালতু কাজের জন্য এ দেশে বিধাতা পুরুষদের পাঠান না। তাদের পাঠান হয় যুদ্ধ করার জন্য। তাই নারী ভিন্ন পুরুষদের রান্না করা এখানে এক প্রকার সামাজিক পাপ।

আফ্রিকা অঞ্চলে যুদ্ধের একটি ভিন্ন মাত্রা হল জাতিগত নিশ্চিহ্নকরণ। এক জাতিগোষ্ঠী অন্য জাতিগোষ্ঠীর চেয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়া ও সম্পদ জব্দ করার জন্য বিজয়ীরা বিজিতদের আবাল-বৃদ্ধ-বণিতাকে হত্যা করে। দক্ষিণ সুদানের গৃহযুদ্ধেও এর প্রতিফলন ঘটছে।

আজ (১৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭) হতে চারদিন আগে ইয়া-ই শহরের কাছের একটি গ্রাম থেকে জুবার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিয়েছিল গল্পের শুরুতে পরিচয় করিয়ে দেয়া সারটি গাই। তিনটি বাচ্চা তার হাঁটতে পারে। চতুর্থটি কোলে, এখনও দুধ খায়। কিন্তু মায়ের দুধের বাট ধরে সে বৃথায় চোষে। অনাহারে মায়ের বুকে কোন দুধই নেই।

গৃহত্যাগের প্রাক্কালে সারটির সাথে আরও অনেকগুলো পরিবার ছিল তাদের। কিন্তু তাদের সাথে এত ছোট বচ্চা ছিল না। তাই প্রথম দিন শেষে তারা সারটিকে ফেলে সামনে চলে এসেছে। তারা কোথায় গেছে সেটাও সে জানে না। কারণ, এখানে কেউ কারও খবর রাখে না। সবার জীবন আলাদা, তাই বাঁচতেও হয় আলাদা ভাবে।

পরপর চারদিন ধরে হেঁটেছে সারটি ও তার নাবালক তিন সন্তান। সাথে একটি কাপড়ের ব্যাগে কিছু কাপড়। বাচ্চাটির সাথে ব্যাগটিও তাকে বহন করতে হত। রাস্তার পাশে রাত হত। রাতে তারা পথ চলতে পারত না। পথের পাশের বাড়িঘরগুলোও শূন্য । সবাই যুদ্ধের ফলে গৃহত্যাগী। পথের পাশের গাছতলাই ছিল তার ঘুমানোর স্থান। হয়তো পথে কোন স্থানে তারা পানি পেয়েছে। কিন্তু খাবার জোটেনি কেথাও। কোলের শিশুটি মায়ের দুধ চুষেছে। এতে হয়তো পানির কাজ হয়েছে। তাই সেটাকে কিছুটা টলটলে লাগছে। কিন্তু অন্য তিন সন্তানের পেটে কিছু নেই। আর কিছু আশ্চর্য এদের আচরণ! ক্ষুধার জ্বালা সইতে সইতে তারা এখন আগাগোড়াই খিদাসহ্য হয়ে গেছে।

পিওসি-১ এর হ্যাংগার-৫ এ তাদের সাথে আমাদের টিমের দেখা। আমার সাথে ইন্ডিয়ান পাঞ্চাবী সহকর্মী দিবেন্দর চন্দ্র সিং ওলাক। দুই সহকর্মীতে দুপুরের খাবারের জন্য কিছু টাকা দিলাম পরিবারটিকে। কিনে দিলাম কয়েক প্যাকেট বিস্কুটও। বিস্কুট পেয়ে ছেলেগুলো গপ গপ করে খেতে লাগল যেন প্যাকেটসহ গিলে ফেলবে। সারটির পরিবারের মতো হাজার হাজার পরিবার দক্ষিণ সুদানে গৃহছাড়া; পরষ্পর বিচ্ছিন্ন। যুদ্ধের অভিশাপে স্বামী বিচ্ছিন্ন হয়েছে স্ত্রীর থেকে। স্ত্রী হয়তো তার মাত্র কয়েকটি সন্তানকে কাছে রাখতে পেরেছেন। অন্যরা হয় নিহত হয়েছে নয়তো বেঁচে থাকলেও তারা মাতৃছাড়া।

গৃহযুদ্ধের ফলে দক্ষিণ সুদানের এক কোটি ২০ লাখ মানুষের মধ্যে ৩৫ লাখই গৃহছাড়া। এদের মধ্যে ১৫ লাখ পার্শ্ববর্তী দেশ উগান্ড, কেনিয়া, ইথিওপিয়া ও সুদানে আশ্রয় নিয়েছে। আর দেশের মধ্যেই বাস্তু ছেড়ে হয় পালিয়ে বেড়াচ্ছে নয়তো জাতিসংঘের সিভিলিয়ন প্রটেকশন সাইট (পিওসি) এ আশ্রয় গ্রহণ করেছে বিশ লাখের মতো মানুষ। কেবল সরকারের পক্ষেরই ১০,৬৫৯ জন সৈন্য নিহত হয়েছে। আহত বা চিরতরে পঙ্গু হয়ে গেছে প্রায় ২০ হাজারের মতো সরকারি সৈন্য।

দীর্ঘ সাড়ে পনের মাস ধরে এখানে শান্তিরক্ষার কাজ করছি। কিন্তু প্রতিদিনই উপলব্ধি করেছি দক্ষিণ সুদানিজদের কাছ থেকে শান্তি ক্রমান্বয়ে দূরে সরে যাচ্ছে।

যুদ্ধ মানে, যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা

যুদ্ধ মানে, আমার প্রতি তোমার অবহেলা।

এই 'যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা' আর 'অবহেলা' বন্ধ না হলে শান্তি আসবে কিভাবে?

(১৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭; ইউএন হাউজ, জুবা, দক্ষিণ সুদান)