জনৈকা জীবন আরা’কে নির্যাতনের অভিযোগ এবং মাদক ব্যবসার অপরাধ সমীকরণ

মোঃ আব্দুর রাজ্জাক
Published : 21 April 2017, 07:08 AM
Updated : 21 April 2017, 07:08 AM

যেকোন সরকারি সংস্থার হেফাজত, তা কারাগার হোক কিংবা পুলিশের হাজতখানাই হোক, একটি নিরাপদ স্থান বলেই বিবেচিত হয়। অনেক দাগী চোর বা ডাকাত বিক্ষুব্ধ জনতার হাত থেকে বাঁচার জন্য ভোঁ দৌড় দিয়ে থানার মধ্যে প্রবেশ করে স্বেচ্ছায় আলামতসহ গ্রেফতার পর্যন্ত হওয়ার নজির স্থাপন করেছে। কারণ, পাবলিকের হাতে পড়ে ব্যাকরণহীন পিটুনি খেয়ে অক্কা পাওয়ার চেয়ে থানার দারোগার দু'চার ঘা বেতের বাড়ি খাওয়া তার জন্য অপেক্ষাকৃত কল্যাণকর বলেই সে মনে করে। কিন্তু এ নির্ভরতার প্রতীক পুলিশই যদি গ্রেফতারকৃত বা হেফাজতে থাকা ব্যক্তিদের ব্যাকরণহীনভাবে নির্যাতন করেন, সেটা যেকোন বিচারেই একটি গুরুতর অপরাধ। পুলিশের এমন আচরণ কোন ভাবেই মেনে নেয়া যায় না।

আমাদের পুলিশ প্রবিধান থেকে শুরু করে ফৌজদারি আইন ও বিধিতে তাই হেফাজতে থাকা ব্যক্তিদের নিরাপত্তার বিষয়টিকে সবিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। কিন্তু তারপরও পুলিশের বিরুদ্ধে হেফাজতে নির্যাতনের অভিযোগ ওঠে। এজন্য তদন্ত হয়, অনুসন্ধান হয়, দোষীদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ও ফৌজদারি উভয় প্রকার শাস্তির ব্যবস্থাই করা হয়। পুলিশ বিভাগে কর্মরত ব্যক্তিদের উপর তাই একটি সূক্ষ্ণ সূতায় বাঁধা তরবারী (Sword of Damocles) সারাক্ষণই ঝুলতে থাকে। এই তরবারি কখন যে কার ঘাড়ের উপর পড়বে তা কেউ বলতে পারে না। বলা বাহুল্য, পুলিশের নিম্ন পদস্থ কর্মচারিগণই এ তরবারির সমূহ শিকার।

সম্প্রতি কক্সবাজার থানা পুলিশের বিরুদ্ধে একটি গুরুতর অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে। জীবন আরা নামের  কথিত এক নারী উদ্যোক্তা  সংবাদ সম্মেলনে দাবী করেছেন যে কক্সবাজার থানা পুলিশ তাকে ও তার স্বামীকে পরিকল্পিতভাবে ইয়াবা ব্যবসায়ী বানিয়ে তাদের গ্রেফতারপূর্বক মামলা দিয়েছে। আর এ মামলায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য থানায় এনে তাকে তদন্তকারী কর্মকর্তা নির্যাতন করেছেন। দারোগার দাবি নাকি ছিল ৩০ লাখ টাকা। এ টাকা না পাওয়ার জন্যই তার উপর যে নির্যাতন করা হয়েছে। তার স্তন ও গোপনাঙ্গে  বৈদ্যুতিক শক দেয়া হয়ে। এতে অজ্ঞান হলে তার শরীরের আরও কয়েক স্থানে গরম তারের ছ্যাঁকা দেয়া হয়েছে।

বড়ই গুরুতর এ অভিযোগ! থানা হাজতে আসামীদের জিজ্ঞাসাবাদের নামে শারীরিক শাস্তি বা তৃতীয় মাত্রার ডোজ দেয়ার বিষয়টি কাররই অজানা নয়। কিন্তু কোন আসামীর গোপনাঙ্গে বৈদ্যুতিক শক বা গরম তারের ছ্যাকা দেয়ার বিষয়টি আরো বেশি গুরুতর। আর সেই আসামী যদি হয় নারী, তবে এমন আচরণ কোনভাবেই ক্ষমার যোগ্য নয়। বর্তমান যুগেও কোন পুলিশ অফিসার যদি থানা হাজতে এমন পশুবৎ নির্যাতনের দুঃসাহস করেন, আর একটি থানায় কর্মরত অফিসার-ইন-চার্জসহ অর্ধশত পুলিশ অফিসার যদি তা বরদাস্ত করেন তাহলে কেবল তদন্তকারী বা জিজ্ঞাসাবাদকারী কর্মকর্তাই নয় সকল শ্রেণির অফিসার-ফোর্সই এর সহযোগী হবার দোষে দোষী।

'আমাদের সময়'  পত্রিকার অনলাইন ভার্সনে যতটুকু পড়লাম, তাতে মনে হল, বিষয়টি কেবল জেলার পুলিশ প্রধান নয়, তারচেয়েও ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নজরে দিয়েছেন অভিযোগকারিনীই। পুলিশ সুপার ড. ইকবাল হোসেন বিষয়টি আমলে নিয়ে একজন অতিরিক্ত পুলিশ সুপারকে এর তদন্তের ভারও অর্পণ করেছেন। আশা করি ঐ ভূক্তভোগী নারী তার বিরুদ্ধে কৃত অপরাধের সঠিক বিচার পাবেন এবং সংশ্লিষ্ট পুলিশ অফিসারগণ তাদের অপকর্মের জন্য উচিৎ শাস্তি পাবেন।

তবে বিষয়টিকে একটু ভিন্নভাবে বিশ্লেষণের দাবীও রাখে। এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে কক্সবাজার জেলা হল দেশের ভয়ংকর মাদক দ্রব্য ইয়াবা বা এম্পিথিটামিন চোরাকারবারী ও পরিবহনের প্রধানতম রাস্তা। এ রুট দিয়ে প্রতিনিয়তই মায়ানমার থেকে ইয়াবা ঢুকছে। এ ইয়াবা ব্যবসার সাথে যে কত বড় বড় লোকজন জড়িত আছে, সেটা বর্তমানে ওপেন সিক্রেট। এই ওপেন সিক্রেটের শৃঙ্খলে যে কথিত নারী উদ্যোক্তা জীবন আরা ও তার পরিবার কোনভাবেই সম্পর্কযুক্ত নয়, এটা তো আমরা নিশ্চয়তাসহ বলতে পারি না। তাই জীবন আরার প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে তাকে নির্যাতনকারী পুলিশ অফিসারদের উচিৎ শাস্তি দাবী করলেও জীবন আরাকে আমরা 'ধোয়া তুলশির পাতা' বলতে পারি না।

অপরাধ, অপরাধ সংঘটন প্রক্রিয়া ও অপরাধ থেকে অর্জিত সম্পদের দিকে দৃষ্টি দিলে দেখা যাবে অবৈধ মাদক ব্যবসা হল পৃথিবীর সবচেয়ে লাভজনক অপরাধ। অবৈধ অর্থের লোভে এ অপরাধের সাথে সমাজের উঁচু তলার ক্ষমতাশালী ব্যক্তিগণ থেকে শুরু করে রাস্তার ভিক্ষুকটি পর্যন্ত নানাভাবে সম্পৃক্ত থাকে। বিষয়টি এতই সরল যে উদাহরণ দিয়ে সময় ক্ষেপণ বাহুল্যমাত্র।

আমার অভিজ্ঞতামতে মাদক ব্যবসার মুনাফাভোগীদের অপরাধ-পথের কাঁটা দূর করার প্রধানতম পদ্ধতিগুলো নিম্নরূপ:

১. উৎকোচের মাধ্যমে পুলিশসহ আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে হাত করা। এক্ষেত্রে তারা ব্যক্তি অফিসার থেকে শুরু করে গোটা সংগঠন সম্ভব না হলেও সংশ্লিষ্ট ইউনিটটিকে হাত করার চেষ্টা করে। বলা বাহুল্য, এক্ষেত্রে মাদক ব্যবসায়ীদের সাফল্য ঐতিহাসিক ও সার্বজনীন। তারা যুক্তরাষ্ট্রের এফবিআই থেকে শুরু করে বাংলাদেশের বিপিআইকে পর্যন্ত ক্রয় করার সামর্থ্য রাখে। আমাদের বাংলাদেশের কক্সবাজার এলাকার মাদক ব্যবসার সাম্প্রতিক ইতিহাস পর্যালোচনা করলে মাদক ব্যবসায়ীদের উৎকোচ সাফল্য সকলেরই চোখে পড়বে।

২. সংশ্লিষ্ট অফিসারদের বদলী করে পথ সুগম করা। কোন ইউনিটকে সন্তোষজনকভাবে ম্যানেজ করতে না পারলে সাধারণত মাদক ব্যবসায়ীগণ মাদকের বিরুদ্ধে সর্বাধিক সক্রিয় অফিসারগুলোকে অন্যত্র বদলীর চেষ্টা করে। এ বিষয়টি সাধারণত বহির্বিভাগীয় চাপ কিংবা একই বিভাগের ঊর্ধ্বতনদের হাত করে করা হয়ে থাকে। এ বিষয়েও তাদের সাফল্য নিশ্চিত। কারণ প্রতিনিয়তই বদলীর প্রক্রিয়ায় সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতনরা বহির্বিভাগীয় চাপকে কমানোর কৌশল হিসেবে পথের কাঁটা দূর করতে সহায়তা করতে পারে।

৩. তৃতীয় পথটি একটু জটিল। এক্ষেত্রে মাদক ব্যবসায়ীরা সক্রিয় অফিসারটির বিরুদ্ধে নানা ধরনের অপবাদ দিয়ে তাকে এমনভাবে ব্যতীব্যস্ত করে তোলে যে তার ঐ ইউনিটে চাকরি করা দুরুহ হয়ে ওঠে। এসব অপবাদের মধ্যে নির্যাতন, উৎকোচ গ্রহণ, নৈতিক স্খলন, বিশেষ করে নারী সংক্রান্ত ঘটনার অভিযোগ ইত্যাদি দিয়ে সংশ্লিষ্ট অফিসারকে তার নিজ ঊর্ধ্বতন কর্তৃকপক্ষ ও জনসম্মুখে হেয় করে তোলে। এর ফলে অফিসারটি অকাল বদলী থেকে শুরু করে বিভাগীয় এমনকি ফৌজদারি মামলার মুখোমুখী পর্যন্ত হয়।

৪. সর্বশেষ পথটি হল মাদক ব্যবসায়ীদের ব্যবসাকে অলাভজনক ও কঠিন করে তোলা অফিসারটিকে সরাসরি হত্যা করা। বাংলাদেশের অপরাধ জগতে এমন ঘটনা খুব বেশি না হলেও বহির্বিশ্বে এমন ঘটনা অহরহই ঘটে।

উপরিউক্ত বিষয়গুলো কক্সবাজার থানা পুলিশ বিশেষ করে জীবন আরার মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা মানস বড়ুয়ার ক্ষেত্রে ঘটেছে কি না সেটাও খতিয়ে দেখা দরকার। জীবন আরার ভাষ্য মতে থানায় নির্যাতনের ফলে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে কারাগারে নেয়া হয়। কিন্তু থানায় পুলিশ হেফাজত থেকে কোন আসামীকে সরাসরি কারাগারে ফেরত পাঠানোর কোন সুযোগ নেই। যে আদালত কোন আসামীকে পুলিশ হেফাজত বা রিমান্ডে পাঠাবেন, জিজ্ঞাসাবাদ শেষে আসামীকে সেই আদালতেই পাঠাতে হবে। কোন আসামী পুলিশ হেফাজতে অসুস্থ হলে কিংবা  আসামী  শরীরিক নির্যাতনের অভিযোগ করলে আদালত ডাক্তারি পরীক্ষার সনদ ভিন্ন ঐ আসামীকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দিবেন না। অধিকন্তু হেফাজতে নির্যাতন বিরোধী আইনের বিপরীতে মহামান্য হাইকোর্টের সাম্প্রতিক রুলের কারণে নির্যাতনকারী পুলিশ অফিসারের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেয়া আদালতের কর্তব্যও বটে।

এর অর্থ হল, অভিযোগকারিনীর অভিযোগ সংশ্লিষ্ট আদালতের নজর এড়িয়ে পাবলিক ফোরামে আসাটা রীতিমত মিডিয়া ট্রায়ালের অপচেষ্টার নামান্তর।

পরিশেষে বলব, কক্সবাজার থানা পুলিশ বিশেষ করে এসআই মানস বড়ুয়ার বিরুদ্ধে আনিত জীবন আরার অভিযোগগুলোর সঠিক অনুসন্ধান বাদী-বিবাদী উভয়ের জন্যই মঙ্গলজনক। আর একই সাথে এ ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার পুলিশ বিভাগের সাংগঠনিক স্বার্থেই জরুরি।

(১৯ এপ্রিল, ২০১৭, ইউএন হাউজ, জুবা, দক্ষিণ সুদান)