প্রশ্নপত্র ফাঁস: যার ঘর চুরি গেছে সে অন্তত একটা মামলা করুক

মোঃ আব্দুর রাজ্জাক
Published : 1 July 2017, 06:44 AM
Updated : 1 July 2017, 06:44 AM

দেশে প্রশ্নপত্র ফাঁসের একটা সংস্কৃতি শুরু হয়েছে অন্তত এক যুগ আগেই। প্রাথমিক বিদ্যালয় এর সমাপনী পরীক্ষা থেকে শুরু করে, চাকরির নির্বাচনী পরীক্ষার প্রশ্নপত্র পর্যন্ত দেদারছে ফাঁস হচ্ছে। কিন্তু যারা এই ফাঁসের সাথে জড়িত তাদের গোমর কেউ ফাঁস করতে পারছে না। তারা থেকে যাচ্ছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। প্রশ্নপত্র ফাঁসকারীদের এ ধরনের ইনডেমনিটির কারণ হল, প্রশ্নপত্র তৈরি, ছাপান, সংরক্ষণ ও বিতরণ প্রক্রিয়ার সাথে যারা জড়িত, এটা ফাঁসের সাথে তারাই জড়িত। তার অর্থ হচেছ, ক্ষেত খানা আসলে বেড়ায় খেয়ে থাকে। ক্ষেত আমার বেড়াও আমার। তাই কার বিরুদ্ধে মামলা করব?

দেশে প্রায় এক যুগ ধরে প্রশ্নপত্র ফাঁস ফাঁস খেলা চলছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোন কর্তৃপক্ষ এর বিরুদ্ধে থানায় একটি মামলা করল না। মামলা হয়না বলে তদন্তও হয় না। বরং ঘটনার পরেই কর্তৃপক্ষ সরাসরি এটাকে গুজব বলে অস্বীকার করে। আবার অনেক সময় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ তাদেরই লোক দিয়ে একটা অনুসন্ধান কমিটি তৈরি করে যে লোক দেখানোর বাইরে কিছু না। অবশ্য অনেক সময় সত্যকে স্বীকার করে পরীক্ষা বাতিল কিংবা স্থগিতের খবরও পাওয়া যায়। কিন্তু প্রশ্নপত্র ফাঁসের সাথে কারা জড়িত সেটা জনসম্মুখে আনা হয় না। অবশ্য সেটা সম্ভবও নয়। কারণ অপেশাদার বিভাগীয় ও নিজস্ব লোক দিয়ে তৈরি অনুসন্ধান কমিটি তো অপরাধীদের গ্রেফতার বা আইনের আওতায় আনা তো দূরের কথা তাদের চিহ্নিত পর্যন্ত করতে পারে না।

আসলে অনুসন্ধান আর তদন্তের মধ্যে বিস্তর পার্থক্য আছে। আমি ফৌজদারি কার্যবিধির সংজ্ঞায় যাচ্ছি না। কেবল পুলিশি তদন্ত আর অপুলিশ বা অপেশাদার কর্তৃপক্ষ কর্তৃক তদন্তের  মধ্যেই আমার আলোচনা সীমাবদ্ধ রাখছি। পুলিশের তদন্ত প্রক্রিয়ার সাথে যে কর্তৃত্ব, ক্ষমতা কিংবা গ্রেফতারের সম্ভাবনা থাকে বিভাগীয় এমনকি বিচার বিভাগীয় তদন্তে সেটা অনুপস্থিত থাকে। তাই পুলিশ যতদূর যেতে পারে, যতটা ঘাঁটতে পারে, অন্যরা তা পারে না। পুলিশ যখন তদন্ত করে সেটা হয় একটি বিধিবদ্ধ প্রক্রিয়ার অংশ। যে মামলাটি থানায় রুজু হয়, তার নিষ্পত্তি পুলিশ কর্তৃপক্ষের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না। এটার মালিকানা চলে যায় আদালতের কাছে। তদন্তকারী কর্মকর্তার উপরে থাকেন তদারককারী কর্মকর্তা। যদিও তদন্ত পর্যায়ে আদালত পুলিশের কাজে হস্তক্ষেপ করবে না, তবুও তদন্ত প্রতিবেদন গ্রহণ-বর্জনের ক্ষেত্রে আদালত স্বাধীন। তদন্ত যদি সঠিক বলে মনে না করেন, আদালত পুলিশের সে প্রতিবেদন গ্রহণ করবেন না। তাই পুলিশের কাছে থাকা তদন্তকে অন্তত ন্যূনতম মান বজায় রাখতে হয়।

 পুলিশের তদন্ত ভিন্ন অন্য কোন বিভাগ বা ব্যক্তির অনুসন্ধানের উপর ভর করে অপরাধের বিচার কাজ সম্পন্ন করলে কি বিড়ম্বনা হয় তার একটি ছোট্ট উদাহরণ দিব। নারী ও শিশু নির্যাতন আইনের অপহরণ ধারার এক মামলায় মৌলভী বাজার জেলার নারী ও শিশু নির্যাতন ট্রাইবুনাল একজন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে অনুসন্ধানের ভার দিয়েছিলেন। উপজেলা নির্বাহী অফিসার তার অনুসন্ধানে ঘটনার সত্যতা পেয়ে আদালতে প্রতিবেদন দেন। সেই অনুসন্ধানের ভিত্তিতে ট্রাইবুনাল মামলা আমলে নিয়ে কাজের মেয়েকে গুম করার অপরাধে জামালপুর জেলা নিবাসী এক স্বামী-স্ত্রীকে কারাদণ্ড দিয়েছিলেন। ঐ স্বামী-স্ত্রী জামালপুর কারাগারে সাজা ভোগরত অবস্থায় তাদের কষ্টের কথা, নির্দোষীতার কথা জামালপুরের পুলিশ সুপারকে জানালে, পুলিশ সুপার নিজ প্রচেষ্টায় বহলা তবিয়তে থাকা সেই কাজের মেয়েকে উদ্ধার করে কথিত স্বামী-স্ত্রীকে জেলমুক্ত করেছিলেন।

তাই প্রশ্নপত্র যাদের ফাঁস হয়েছে তাদের কাছে অনুরোধ, বিভাগীয় অনুসন্ধান নয়, বিচারিক অনুসন্ধান নয়, অন্তত একটি মাত্র নিয়মিত মামলা করে পুলিশকে দেন, আর ধৈর্য ধরুন, দেখবেন, আসল অপরাধীরা এক এক করে নয়, দল ধরে বেরিয়ে পড়বে। আর অবশ্যই নিজেদের লোকদের গ্রেফতার, বিচার আর সাজা দেখার জন্যও প্রস্তুত থাকুন। দেশকে প্রশ্নপত্র ফাঁসের সংস্কৃতি থেকে মুক্ত করার জন্য এগিয়ে আসুন।

অনেকে বলবেন, এজাতীয় অপরাধের প্রতিকারের জন্য কি পুলিশের স্ব-উদ্যোগে কিছুই করার নেই? হ্যাঁ আছে। যতটুকু আছে পুলিশ কিন্তু ততোটুকু করছে। প্রায়শই এ ধরনের প্রতারকদের গ্রেফতার করা হচ্ছে। রংপুরের  ভিন্ন জগৎ থেকে এ ধরনের শতাধিক ক্লায়েন্ট ও প্রতারককে গ্রেফতার করা হয়েছিল। কিন্তু যাদের ঘর চুরি গেছে তারাই যখন চুরির প্রতিকারে আগ্রহী হন না, তখন আর বাইরের লোকের প্রচেষ্টা কতটুকু সফল হয়?