ফৌজদারি অপরাধ তদন্তে ‘ফেইন্ট’ পদ্ধতি

মোঃ আব্দুর রাজ্জাক
Published : 6 July 2018, 11:10 AM
Updated : 6 July 2018, 11:10 AM

ফৌজদারি অপরাধের তদন্তের ক্ষেত্রে সাক্ষাৎকার ও জিজ্ঞাসাবাদ প্রায় ক্ষেত্রেই নিয়ামক ভূমিকা পালন করে। তাই একজন তদন্তকারীর সাক্ষাৎকার ও জিজ্ঞাসাবাদের আধুনিক ও বৈজ্ঞানিক কলাকৌশলগুলোর উপর পর্যাপ্ত তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক জ্ঞান থাকা দরকার। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয় আমাদের দেশের পুলিশিং অনুশীলনে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় গুরুত্বারোপ করার হয়না।

এতে করে তদন্তকারী তথা পুলিশের বিরুদ্ধে প্রায়শই বলপ্রয়োগ ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ উঠে। জিজ্ঞাসাবাদের বৈজ্ঞানিক কৌশলগুলো আয়ত্ত করে তা প্রয়োগ করতে পারলে পুলিশের পেশাদাত্বি বাড়বে এবং মানবাধীকার লঙ্ঘনের দায় থেকেও তারা রক্ষা পাবে বলে আমার বিশ্বাস।         

জিজ্ঞাসাবাদের বৈজ্ঞানিক কৌশলে সন্দিগ্ধকে কিছু প্রশ্ন করে সে সব প্রশ্নের উত্তর বিশ্লেষণের মাধ্যমে তাদের দোষী বা নির্দোষ হিসেবে শনাক্ত করার একটি বিশেষ পদ্ধতির নাম হলো ফরেনসিক মূল্যায়ন সাক্ষাৎকার (Forensic Assessment Interview বা সংক্ষেপে FAINT)।

এমআইটিটি পদ্ধতি ব্যবহারে মাত্র পাঁচ মিনিটের সাক্ষাৎকারে একজন সন্দিগ্ধ ব্যক্তির আলোচিত অপরাধে জড়িত থানা বা না থাকা সম্পর্কে একটি যৌক্তিক অনুমান করা যায়।

মরগানের ইন্টারভিউ থিম টেকনিক বা এমআইটিটি (MITT) পদ্ধতি প্রয়োগ করে  মোটামুটি শতকরা ৩০ ভাগ ক্ষেত্রে আসামীর নির্দোষতা বা সম্পৃক্ততা সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়। ফরেনসিক মূল্যায়ন বা ফেইন্ট পদ্ধতি এমআইটিটি পদ্ধতির চেয়ে আরো বেশি নির্ভরযোগ্য। জন রিডস পরিচালিত একটি গবেষণা অনুসারে ৯১% সত্যবাদী এবং ৮০% প্রবঞ্চক সন্দিগ্ধদের সম্পর্কে পূর্বানুমান সঠিক বলে প্রমাণিত হয়েছে।

ফেইন্ট সাক্ষাৎকার প্রকৃত পক্ষে দুই ধরনের সাক্ষাৎকারের সমন্বয় যেখানে মৌখিক বা ভাষিক ও আচরণগত – উভয় মূল্যায়নই উপস্থিত থাকে। মৌখিক মূল্যায়নটি করা হয় কিছু প্রক্ষেপণমূলক প্রাসঙ্গিক এবং তুলনামূলক প্রশ্নের মাধ্যমে।

সাক্ষাৎকার শুরু করা হয় কিছু অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্ন দিয়ে । এসব প্রশ্নের ফলে সাক্ষাৎকার গ্রহণকারীর পেশাদারিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পাশাপাশি সন্দিগ্ধের সাথে একটি ইতিবাচক সম্পর্কও তৈরি হয়। প্রথম দিকে থাকবে কিছু অভয়সূচক সাধারণ আলোচনা। এরমধ্য দিয়ে সন্দিগ্ধের সত্যবাদীতার অনুমান করা হবে।

সন্দিগ্ধ ও তদন্তকারীর মধ্যকার কিছু সাধারণ বিষয় নিয়ে কথা হতে পারে- যেমন, পড়াশোনা, পূর্ববতী চাকরি বা পেশার কথা, সন্দিগ্ধের , শখ, ভাল লাগার বিষয়বস্তু, পারিবারিক খোঁজখবর ইত্যাদি। এসবের মাধ্যমে সাক্ষাৎকার গ্রহণকারী ও সন্দিগ্ধের মধ্যে একটি উঞ্চ সম্পর্ক তৈরি হবে।

এরপর শুরু হবে প্রক্ষেপণমূলক প্রশ্নের পালা। প্রশ্নের উত্তরদানকালে সন্দিগ্ধের অলিখিত ভাষিক যোগসূত্রসমূহ পর্যবেক্ষণ ও মূল্যায়ন করতে হবে। প্রক্ষেপণমূলক প্রশ্ন এমনভাবে প্রস্তুত করতে হবে যে সন্ধিগ্ধ ব্যক্তির উত্তর প্রদানকালেই তার অপরাধে জড়িত থাকার বিষয়টির উপর প্রতিষ্ঠিত হয়। সাক্ষাৎকারের সময় প্রক্ষেপণমূলক প্রশ্ন মূখ্য হলেও এর মাঝে মাঝে প্রাসঙ্গিক ও তুলনাকারী প্রশ্নও জুড়ে দিতে হবে।

সন্দিগ্ধকে প্রশ্ন করার সময় পশ্নের নম্বর, ক্রম ও  ধরন অবশ্যই সামদঞ্জস্যপুর্ণ হতে হবে। প্রত্যেক সন্দিগ্ধকে একই প্রশ্ন একই ক্রম ও ধরন ঠিক রেখে জিজ্ঞাসা করতে হবে। এ সংক্ষিপ্ত ও সমান্তরাল সাক্ষাৎকার কাঠামোর মধ্যেই সকল সন্দিগ্ধের মৌখিক সাড়ার তুলনামূলক বিশ্লেষণের মাধ্যমে সন্দিগ্ধদের সত্যবাদীতা ও প্রবঞ্চনার পাথর্ক্য নির্ণয় করা হবে।

সত্যবাদী ও প্রবঞ্চক সন্দিগ্ধদের তদন্ত সম্পর্কিত মনোভাবের মধ্যে দুটো মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। সত্যবাদী সন্দিগ্ধ মনে-প্রাণে চান তদন্তকরাী যেন সফল হয়। তিনি যেন প্রকৃত সত্য উদ্ঘাটন করতে পারেন। কারণ সত্যবাদী সন্দিগ্ধ জানের যে তিনি কোনও অপরাধ করেননি কিংবা কোনোভাবে অপরাধের সঙ্গে সম্পর্কিতও নয়।

কিন্তু প্রবঞ্চক সন্দিগ্ধের সম্পূর্ণ বিপরীত উদ্দেশ্য থাকে । তিনি চান জিজ্ঞাসাবাদকারী যেন ব্যর্থ হয়। তিনি চান সত্য যেন গোপন থাকে । এজন্য সে সাক্ষাৎকার পর্বে এমন আবহ তৈরি করতে তৎপর হন যাতে মনে হয় যে তিনি এ অপরাধ করেননি, এমনকি  এর সাথে তার কোনও সম্পর্কই নেই।

মনোভাব ও প্রত্যাশার এ মৌলিক পার্থক্যের জন্যই সত্যবাদী ও প্রবঞ্চক সন্দিগ্ধরা প্রাসঙ্গিক, তুলনাকারী ও প্রক্ষেপণমূলক প্রশ্নের উত্তরের ধরনে বিস্তর পার্থক্য থাকবে।

সত্যবাদী সাক্ষাৎকারদাতারা সাধারণত সাক্ষাৎকারকালে সহযোগিতা করবে। এর অর্থ এই নয় যে সত্যবাদী সাক্ষাৎকারদাতারা ভড়কে যায় না । সবচেয়ে সত্যবাদী সন্দিগ্ধও আশঙ্কা করে যে সে নির্দোষ হওয়া সত্ত্বেও অপরাধে অভিযুক্ত হতে পারে। তবে সাক্ষাৎকার কিছুটা অগ্রসর হতেই সে বুঝতে পারে যে সে একজন চৌকস, সৎ ও কর্মক্ষম তদন্তকারীর হাতে পড়েছে। সত্যবাদী সন্দিগ্ধ অপেক্ষাকৃত বেশি প্রগলভ বা বাচাল হবে এবং সকল প্রশ্নের উত্তর সাবলিলভাবে দিয়ে থাকে যাতে তদন্তের বিস্ত্বতি সংকীর্ণ করে  সঠিক অপরাধীকে স্বল্প সময়ে শনাক্ত করা যায়।

প্রবঞ্চক সন্দিগ্ধরাও ভয় পায়। তবে তারা ভয় পায় এই ভেবে যে দক্ষ তদন্তকারী অপরাধের সঙ্গে তার সম্পৃক্ততা উদ্ঘাটন করে ফেলবে।  জিজ্ঞাসাবাদকারী সামর্থ্য বুঝতে পেরে তাদের উদ্বেগ আরো বেড়ে যায়। তারা সাধারণত কম কথা বলে। কারণ তারা জানে তারা যত বেশি কথা বলবে তত বেশি সত্য গোপন বা বিকৃতি করতে হবে। নিরবে প্রবঞ্চনা, তথ্য গোপন করে মিথ্যা বলা তাদের ক্ষেত্রে প্রকট হয়ে ওঠে।

এসব কারণে দোষী ও নির্দোষ সন্ধিগ্ধদের প্রশ্নের উত্তরের ভাষায় উল্লেখযোগ্য পার্থক্য ঘটে। কোনও অপরাধ বর্ণনাকালে সত্যবাদী সন্দিগ্ধ সাধারণত জোরালো পরিভাষা ব্যবহার করে এবং নৈতিক মূল্যবোধের প্রসঙ্গ তোলে । তারা ঘটনার সাথে নিজেদের সম্পৃক্ত করে এবং ধর্ষণ, চুরি কিংবা হত্যার মতো শব্দগুলোও ব্যবহার করতে  দ্বিধা করে না ।

অপরদিকে মিথ্যাবাদী সন্দিগ্ধরা  তদন্তাধীন ঘটনা থেকে সবসময় নিজেদের দূরে রাখার চেষ্টা অব্যহত রেখে অপরাধ উদ্ঘাটনে বাধা সৃষ্টি করে। তারা সাধারণত অপেক্ষাকৃত কম দোষমূলক শব্দ ব্যবহার করে । তাদের শব্দচয়ন হয় বিভ্রান্তিমূলক।

বর্ণিত অপরাধে কে কে জড়িত থাকতে পারে কিংবা কাদের জড়িত থাকার সুযোগ ছিল এটা সত্যবাদী সন্দিগ্ধরা বলে দিবেন। নিজেরা জড়িত না থাকলেও কে কে ঘটনায় জড়িত থাকতে পারে কিংবা কারা নির্দোষ এটাও তারা বলে দিবে। তারা বোঝে যে এসব তথ্য তাদের নির্দোষ সাব্যস্ত করতে সহায়তা করবে। এর ফলে তদন্তের  পরিধিও ছোট হয়ে আসবে।

প্রবঞ্চক সন্দিগ্ধরা প্রায়শই তাদের ঘটনার সাথে জড়িত না থাকার দাবি করে একটা যেনতেন ব্যাখ্যা দেয়ার চেষ্টা করবে। উদাহরণস্বরূপ, শিল্প প্রতিষ্ঠানের ভল্ট থেকে অর্থ চুরির অপরাধে সন্দিগ্ধ ব্যক্তি ব্যাখ্যা দিতে পারেন যে তিনি এক সময় ভল্টের কাছে গিয়েছিলেন। কিন্তু তার পক্ষে অর্থ সরানোর সুযোগ ছিল না ।

কারণ ঐ সময় সেখানে একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ছিলেন। অথবা তারা বলতে পারেন যে ঘটনার সাথে তাদের কোনই সম্পর্ক নেই। এর ফলে তদন্তের পরিধি ছোট না হয়ে বড় হতে থাকবে।  এরা এমন ভান করবেন যে তাদের কাছে কোনই তথ্য নেই এবং অন্য কারো জড়িত থাকার বিষয়েও তারা মুখ খোলেন না। এমনকি কারো প্রতি কোনও ঈঙ্গিতও করে না।

সত্যবাদী, সন্দিগ্ধরা ঘটনা প্রবাহের প্রতি উৎসাহিত বোধ করে। কারণ অপরাধ উদ্ঘাটিত হওয়া তাদের স্বার্থসিদ্ধ করবে। প্রবঞ্চক সন্দিগ্ধরা সব সময় ঘটনা থেকে নিজেদের দূরে রাখতে চায়। সাক্ষাৎকারকালে তারা নির্বিকার থাকে। তার আশা করে যে অপরাধ উদঘাটন ছাড়াই তদন্ত শেষ হবে।

সত্যবাদী সন্দিগ্ধ নিজেদের সত্যিকারভাবে নির্দোষ দাবি করেন। তারা সরাসরি বলবেন যে তারা অপরাধ করেননি। অপরদিকে প্রবঞ্চক সন্দিগ্ধরা নিজেদের আইনগতভাবে নির্দোষতা দাবি করেন। তারা পাল্টা পশ্ন করতে পারেন, আমি যে জড়িত তার প্রমাণ কী?

ফরেনসিক মূল্যায়ন ইন্টারভিউতে প্রবঞ্চনা নির্দেশক দুইটি গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশক আছে।  প্রথমত, প্রবঞ্চক সন্ধিগ্ধরা অপরাধ সম্পর্কে তাদের নিজস্ব সংজ্ঞা তৈরি করেন। দ্বিতীয়ত,  তারা তাদের বক্তব্যের ব্যাখ্যা ও কার্যকারণে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন যুক্তি তুরে ধরেন।

অপরাধের নিজস্ব সংজ্ঞা বা Personal Coding হল কোনও অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডকে অপরাধী এমন ভাবে ব্যাখ্যা করে যে তা আদৌ কোন অপরাধ নয় কিংবা অপেক্ষাকৃত লঘু প্রকৃতির অপরাধ।

সত্যবাদী সন্দিগ্ধর জন্য অপরাধের নিজস্ব সংজ্ঞা দেয়ার প্রয়োজন নেই । কারণ তারা প্রচলিত সংজ্ঞার মধ্যেই নির্দোষ। এক্ষেত্রে সাক্ষাৎকার গ্রহণকারীকে কিছু কিছু সন্দিগ্ধের অপরাধ সম্পর্কে সচেতন থাকা জরুরি।

অপরাধের ব্যাখ্যা ও কার্যকারণে পরিবর্তন (How and why) হল  প্রবঞ্চক সন্দিগ্ধরা অপরাধটি কীভাবে ঘটল বা কী কারণে ঘটল এ সম্পর্কে মৌখিক বা লিখিত জবানবন্দিতে অপ্রাসঙ্গিক বা অযৌক্তিক বিষয়ের অবতারণা করবেন।

ফেইন্ট  জ্ঞিাসাবাদে  সত্যবাদী ও প্রবঞ্চক সন্দিগ্ধের প্রেষণা ও আচরণে নিম্নলিখিত পার্থক্য সূচিত হবে-

ক্রমিক  নং               সত্যবাদী সন্দিগ্ধ                  প্রবঞ্চক প্রবঞ্চক
 সত্যের প্রকাশ কামনা করে সত্যের উদ্ঘাটন চায় না।
বেশি কথা বলে কম কথা বলে
তদন্তে সহায়তা করে তদন্তের পরিধি সংকীর্ণ করতে সহায়তা করে কোন তথ্য দেয়না/তদন্তের পরিধি বৃদ্ধি করতে চায়
যথাযথ ও শক্তিশালী প্রত্যয় ব্যবহার করে কোমল ও দ্ব্যর্থক প্রত্যয় ব্যবহার করে
প্রকৃত অনুভুতি প্রকাশ করে নিজেদের আলাদা করে দূরে সরিয়ে রাখে
সুযোগের কথা স্বীকার করে সুযোগের কথা অস্বীকার করে; বিবেচনাহীন ব্যাখা/ঘোষণা দেয়
প্রকৃত নির্দোষতা দাবী করে আইনগত নির্দোষতা দাবী করে
নিজস্ব সংজ্ঞার ব্যবহার করে না নিজস্ব সংজ্ঞার ব্যবহার করে
ঘটনার ব্যাখ্যা তথা কার্যকারণে  স্থীর থাকেঘটনার ব্যাখ্যা ও কার্যকারণ পরিবর্তন করে।

ফেইন্ট  সাক্ষাৎকারের জন্য প্রযোজ্য কিছু নমুনা প্রশ্ন ও সেগুলোর সম্ভাব উত্তরের ক্ষেত্রে সত্যবাদী ও প্রবঞ্চক সন্দিগ্ধ নিম্নলিখিত ব্যাখ্যা দিতে পারে-

ক্রমিক

নম্বর

         প্রশ্নসত্যবাদী সন্দিগ্ধের উত্তরপ্রবঞ্চক সন্দিগ্ধের উত্ত
১.আমাদের তদন্তের উদ্দেশ্য কি বলে মনে করেন?দ্রুত উত্তর দিবেন। শক্তিশালী পরিভাষাসহ উদ্দেশ্য  বর্ণনা করবেন।দেরিতে উত্তর দিবেন। তদন্ত সম্পর্কে কিছু জানেন না বলবেন। অপরাধ বর্ণনায় কম শক্তিশালী ও দ্ব্যর্থক শক্ত ব্যবহার করবেন।
২.আপনাকে সাক্ষাৎকারের জন্য কেন ডাকা হয়েছে জানেন? কারণ ব্যাখ্যা করে বলবেন। স্বীকার করবেন যে অপরাধটি করার সুযোগ তার ছিল।কিছু জানেন বলে ভান করবেন কিংবা একটা যেমন তেমন কিছু উত্তর দিবেন।
৩.সাক্ষাৎকারে এসে কেমন লাগছে আপনার?ঘাবড়ে যাওয়ার কথা স্বীকার করবেন।তবে ইতিবাচক মনোভাব প্রদর্শনপূর্বক তদন্ত সফল হওয়ার প্রত্যাশা ব্যক্ত করবেন।সাক্ষাৎকারের প্রতি একটা বিরূপ ভাব দেখাবেন। নেতিবাচক ও অসহযোগিতামূলক আচরণ করবেন।
৪.ঘটনা সম্পর্কে আপনি যা জানেন বিস্তারিত বলুন/লিখুন।প্রচুর কথা বলবেন। বক্তব্যে পর্যাপ্ত তথ্য থাকবে। ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ থাকবে। বক্তব্য উত্তম পুরুষে অতীত কালে হবে এবং স্থানকালপাত্রের সংগতি রক্ষিত থাকবে। এ পর্যায়ে তারা নিজেদের সস্পৃক্ততা অস্বীকার করবেন যদিও সে প্রশ্ন করা হয়নি।খুবই সংক্ষিপ্ত হবে।তেমন কোন তথ্য থাকবে না। গুরুত্বপূর্ণ তথ্য বাদ দিয়ে কথা বলবে।বক্তব্যে  সর্বনামের ঘাটতি থাকবে বা সর্বনামের অত্যধিক ব্যবহার থাকবে যেখানে আগ্রহের স্থুলতা থাকবে।
৫.আপনি তদন্তকারী হলে এ তদন্ত কিভাবে পরিচালনা করতেন?রহস্য উদ্ঘাটনে সহায়ক গঠনমূলক তথ্য দিবেন। কারণ রহস্য উদ্ঘাটিত হলে তিনি ছাড়া পাবেন বলে বিশ্বাস করেন।তেমন কোন তথ্য দিবেন না। কারণ সন্দিগ্ধ  জানেন যে রহস্য উদ্ঘাতি হলে তিনি দোষী সাব্যস্ত হবেন।
৬.এ ঘটনার পিছনে সম্ভাব্য পাঁচটি কারণ কি কি হতে পারে? সহজেই কিছু সম্ভাব্য কারণ বলবেন ওবং কারণের স্বপক্ষে শক্তিশালী পরিভাষা যেমন লোভ, চুরি, আত্মসাৎ, মানসিক রোগ ইত্যাদি ব্যবহার করবেন। ইতস্তত করবেন। এমন কিছু কারণ বলবেন অপরাধের সঙ্গে যেগুলোর কোন সম্পর্ক নেই, যেমন, ব্যক্তিগত অসুবিধা ইত্যাদি।
৭.এ জাতীয় কাজ করার কথা আপনি কখনো ভেবেছিলেন কি?দ্রুত না বলবেন।একটু সময় নিয়ে না বলবেন। এমন বলতে পারেন যে অনেকে এমনটা করতে পারে। তবে আমি কখনও এমন চিন্তা করিনি।
৮.বিগত বছরে (অপরাধ সংগঠনের দু বছর পূর্বে) আপনি কি কোন চুরি ,  প্রতারণা কিংবা মারামারি ইত্যাদি ঘটনায় জড়িয়ে পড়েছিলেন?প্রশ্ন শুনে কিছুটা ভড়কে যাবেন। সাধারণভাবে ইতস্ততবোধ করবেন। কিছু ছোটখাট ঘটনার কথা স্বীকার করবেন কিংবা এড়িয়ে যাবার মতো উত্তর দিবেন।কোন উদ্বেগ প্রকাশ করবেন না। কারণ এগুলো তার কাছে সাধারণ বিষয়। সাধারণত দ্রুত না বলবেন।
৯.আপনি কি এ অপরাধটি করেছেন?প্রশ্ন শুনে ঘাবড়াবেন না। কারণ তারা সন্দিগ্ধ জড়িত না। খুব দ্রুত অস্বীকার করবেন।প্রশ্ন শুনে ঘাবড়াবেন। কারণ এতে তারা জড়িত। তিনিও অস্বীকার করবেন। তবে অতটা দ্রুত বা তীব্রভাবে নয়। সাধারণভাবে দ্ব্যর্থক উত্তর দিবেন, যেমন- আমি কেন টাকা চুরি করব? আমার কি টাকার অভাব আছে? প্রশ্নটি পুনরায় বলার অনুরোধ করবে। অনেক সময় চ্যালেঞ্জ করবে। আপনি কি আমাকে চোর বানাচ্ছেন?
১০.আপনি যা বলেছেন, তা অত্যন্ত গোপনীয়। কিন্তু এতেও মনে হয়না আপনি সঠিক। যাহোক, এক্ষেতে আপনার  কাকে কাকে সন্দেহ হয়?

 

নিরুৎসাহিত বোধ করবেন। তারপরও তদন্তের বিস্তৃতি কমানোর স্বার্থে তাদের সন্দহযুক্ত ব্যক্তিদের কথা বলবেন।দ্রুত বলবেন, তিনি কাউকে সন্দেহ করেন না। তারপরও তদন্ত জটিল করার জন্য কারো কারো নাম বলতে পারেন। কিংবা দাবী করতে পারেন যে অপরাধটি ঘটেইনি।
১১.আপনি ছাড়া আর কে কে নিশ্চিতভাবে কাজটি করেনি বলে আপনার মনে হয়?দ্রুত কিছু নাম বলবেন। এতে তদন্তের পরিধি ছোট হয়ে আসবে।অন্য কারো জড়িত না থাকার কথা বলবেন না। কিংবা কেউ জড়িত নয় বলে বলতে শুরু করবেন।
১২.আমরা যখন প্রকৃত অপরাধীকে শনাক্ত করব তখন তাদের ভাগ্যে কি ঘটবে বলে মনে করেন?সাধারণ কঠিন শাস্তির কথা দ্রুত বলবেন।সাধারণত বলবেন, আমি জানি না, আমি এ বিষয়ে চিন্তা করি না। এ বিষয়ে রায় দেবার আমি কেউ না। অনেক সময় সত্য উত্তরও দিতে পারে। কারণ সন্দিগ্ধ ধরে নিতে পারে যে তাকে শনাক্ত করা হয়েছে।
১৩.অপরাধীদের শোধরাবার সুযোগ দেয়া উচিৎ বলে মনে করেন কি? প্রায়ই না বলবেন।শোধারাবার সুযোগদানের কথা বলবেন। তবে তা অবস্থার উপর নির্ভর করবে।
১৪.আমরা  এ অপরাধের তদন্ত খুবই নিবিড়ভাবে করব। আমরা সবাইকে জিজ্ঞাসাবাদ করব। সবারই ফরেনসিক পরীক্ষা করাব। তদন্তে আপনার নাম আসলে কি হবে? আপনি এটা করেছেন কিনা?খুব দ্রুত পূর্ণ আবেগের সাথে দাবী করবেন যে তিনি তদন্তে নির্দোষ প্রমাণিত হবেন।অনিশ্চিত ভাব দেখাবেন যেন বিষয়টি বোঝেননি। আমি আশা করি, আমি প্রার্থনা করি, আমি নির্দোষ প্রমাণিত হব। কিংবা জানতে চাইবেন, কি জাতীয় ফরেনসিক পরীক্ষা হবে?
১৫.যদি এমন কোন প্রমাণ যেমন প্রত্যক্ষদর্শী, হস্তরেখা, পদচিহ্ন, রক্তের দাগ, বীর্জের দাগ ইত্যাদি পাওয়া যায় যে আপনি জাড়িত, তখন?কোন যৌক্তিক কারণ না থাকলে  দ্রুত ও তীব্রভাবে অস্বীকার করবেন। কিংবা ইতোপূর্বে এমনটি স্বীকার করে থাকবেন।অস্বীকার করার পুর্বে বেশ সময় নিবেন। কিংবা কোন দ্ব্যর্থক ও অযৌক্তিক কারণ দেখিয়ে বলবেন, এমটা হতে পারে।
১৬.( কর্মচারী কর্তৃক চুরির ক্ষেত্রে) আমাদের দায়িত্ব হল চুরি যাওয়া টাকা উদ্ধার করা। আপনি কি আপনার নেয়া টাকাটা ফেরত দিতে রাজি আছেন যাতে  তদন্ত থেকে আমরা আপনাকে বাদ দিতে পারি।চুরি না করলে তা ফেরত দেয়ার কথা চিন্তা করবেন না। প্রকৃত অপরাধীকে খুঁজে বের করার অনুরোধ করবে।এই বলে অস্বীকার করবেন, আমি এত টাকা দিব কোত্থেকে। অথবা কিছু টাকা ফেরত দিতে রাজি হবেন এই ভেবে যে এতে তদন্ত বন্ধ হয়ে তিনি রক্ষা পাবেন।
১৭. ঘটনাটি সম্পর্কে আপনি কি কাউকে জানিয়েছিলেন কিংবা আপনি যে আজ সাক্ষাৎকার দিতে আসছেন এটা কাউকে জানিয়েছিলেন কি? এ ধরনের সাক্ষাৎকার সন্দিগ্ধের জীবনের একটি বড় ঘটনা। তাই এ বিষয়ে তিনি পরিবার বা বন্ধু-বান্ধবদের সাথে কথা বলবেন।এ বিষয়ে প্রবঞ্চক সন্দিগ্ধ কাউকে কিছু বলবেন না। কারণ অন্যরা বিষয়টি পরবর্তীতে জানতে চাইবেন। কিংবা তারা ধরা পড়তে পারেন বলে ভয় করেন।
১৮.কেউ যে এমন একটি কাজ করেছে তা আপনি কিভাবে ব্যাখ্যা করবেন?এটা তাদের ধারণার বাইরে। কিংবা তারা অপরাধীকে খারাপভাবে বর্ণনা করবেন, যেমন- মাদকাসক্ত, অসুস্থ, চোর-বাটপাড়।প্রায়সই না বলবেন। দোষস্খলনমূলক ব্যাখ্যা দিবেন। সঠিক কারণওবলতে পারেন। তবে এটাকে তাদের মতো করে যৌক্তিক করে দেখাবেন।
১৯.( অগ্নিসংযোগ, চুরি ইত্যাদির ক্ষেত্রে)  আপনার কি মনে হয়? এটা কি পরিকল্পিত ঘটনা, না দুর্ঘটনাক্রমে ঘটেছে?নিশ্চিত করবেন যে একটি অপরাধ ঘটেছে।নিশ্চিত করে কিছু বলবেন না। অনেক সময় কোন অপরাধই ঘটেনি বলে তদন্ত দ্রুত শেষ করার তাদিগ দিবেন।
২০.এ ঘটনা সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদে কি আপনি কোন অসত্য বলেছেন?প্রশ্ন শুনে না ঘাবড়িয়ে দ্রুত না বলবেন।প্রশ্নের প্রাসঙ্গিকতায় ঘাবড়ে যাবেন। দায়সারা গোছের উত্তর দিবেন।
২১. সংকট থেকে বের হয়ে আসার জন্য জীবনে কখনও বড় সড় মিথ্যা বলেছিলেন কি?তুলনামূলক এ জাতীয় প্রশ্নে ঘাবড়ে যাবেন। ইতস্তত করবেন। দ্ব্যর্থক উত্তর দিবেন কিংবা স্বীকার করবেন।দ্রুত না বলবেন।
২২.আপনি কি এ কাজটি করেছেন?প্রশ্ন শুনে ঘাবড়াবেন না। দ্রুত অস্বীকার করবেন।ঘাবড়ে যাবেন । বিব্রত হবেন। দুর্বল উত্তর দিবেন কিংবা এড়িযে যাওয়ার মতো কোন উত্তর দিবে।
২৩.মনে করেন, আপনি মামলাটির তদন্ত করছেন। ঘটনাটি উদ্ঘাটনের লক্ষে তিনটি প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করতে হলে আপনি কোন তিনটি প্রশ্ন করবেনতিনটি শক্তিশালী প্রশ্ন করবেন।রহস্য উদ্ঘাটনের মতো কোন প্রশ্ন করবেন না।
২৪.আমি পূর্বেই বলেছি যে আমি  এ নিয়ে একটি নিবিড় তদন্ত করব। আপনাকে সাক্ষাৎকারের জন্য আবার ডাকা হতে পারে। আপনার কোন সমস্যা হবে?কোন সমস্যা নেই বলবেন। পূর্ব সহযোগিতার আশ্বাস দিবেন।অনিচ্ছামূলকভাবে রাজি হবেন। সাক্ষাৎকার দ্রুত শেষ হল বলে কিছুটা আশ্চযান্বিত হবেন। কারণ তিনি চিন্তা করেছিলেন যে সাক্ষাৎকারে তাকে শনাক্ত করা হবে এবং জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করা হবে।

এখানে বলতেই হবে, মরগানের থিমেটিক টেস্ট(এমটিটি) পদ্ধতি ও  আলোচিত নিবন্ধে ফরেনসিক অ্যাসেসমেন্ট টেস্ট(ফেইন্ট) এর কোনটিই সরাসরি কোন সন্দিগ্ধের কাছ থেকে স্বীকারোক্তি আদায়ের জন্য যথেষ্ট নয়।

তবে এ টেস্ট দুটি কোন সন্দিগ্ধ বা সাক্ষীর সত্যবাদিতা নিরূপনের জন্য মোক্ষম অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হতে পারে। সাক্ষীর সাক্ষ্য বা বর্ণনা সত্য না হলে তদন্তকারীর তদন্ত দুরূহ হয়ে পড়ে। অ

ন্যদিকে সন্দিগ্ধের সত্যবাদিতা বা প্রবঞ্চনা নিশ্চিত হতে না পারলে তাকে সাক্ষাৎকার বা জিজ্ঞাসাবাদরে পরবর্তী ধাপে নিয়ে যাওয়া অসম্ভব হয়ে পড়ে। এমআইটিটি ও ফেইন্ট পদ্ধতি একজন তদন্তকারীকে একদিকে যেমন তার তদন্তের পরিধি সংকীর্ণ করে নিয়ে আসতে সহায়তা করে, তেমনি সন্দিগ্ধকে সাক্ষাৎকার বা জিজ্ঞাবাদের পরবর্তী ধাপে নিয়ে যাওয়ার পথ প্রশস্ত করে।

তথ্সূত্র:
Effective Interviewing and Interrogation Techniques (3rd Edition) by Nathan J. Gordon & William L.Fleisher (Elsevier Ltd)

ছবিসূত্র:
https://undark.org