অপরাধীর ‘স্বীকারোক্তি’ মনস্তত্ত্ব

মোঃ আব্দুর রাজ্জাক
Published : 9 Nov 2020, 06:46 PM
Updated : 9 Nov 2020, 06:46 PM

ছবি – বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম

পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদের মূল উদ্দেশ্য সামগ্রিক সত্য উদ্ঘাটন করা হলেও  আসামি বা সন্দিগ্ধের কাছ থেকে স্বীকারোক্তি আদায় করা এর প্রথম অগ্রাধিকার। এ স্বীকারোক্তি আদায় নানা কারণে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। অনেক সময় ঘটনার সম্পূর্ণ দিকগুলো উন্মোচন করা, অপরাধীর সহযোগীদের বিচারের আওতায় আনা কিংবা নিরপরাধ মানুষকে অব্যাহতি দেওয়া ইত্যাদি কারণে আসামির স্বীকারোক্তি আদায় জরুরি হয়ে পড়ে।

তবে আইনগত দিক দিয়ে আসামির সাজা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রেও দোষ স্বীকারোক্তি কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। আমাদের সাক্ষ্য আইনে আসামির দোষ স্বীকারোক্তি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কেবল আসামির দোষ স্বীকারোক্তির ভিত্তিতেই তার সাজা হতে পারে। অনেক মামলায় আসামি ও তার সহযোগীদের সাজার ক্ষেত্রে দোষ স্বীকারোক্তি নিয়ামক ভূমিকা পালন করে।  এক ব্রিটিশ গবেষণায় দেখা গেছে, ইংল্যান্ড ও ওয়েলসে যেসব মামলায় আসামির সাজা হয় তাদের ৩০ শতাংশের বেলায় আসামির দোষ স্বীকারোক্তি নিয়ামক ভূমিকা পালন করে। এর বিপরীতে ফরেনসিক সাক্ষ্যের ভূমিকা থাকে মাত্র ৭ শতাংশ মামলার ক্ষেত্রে।

অধুনা অপরাধ বিজ্ঞান ও পুলিশিং নিয়ে গবেষণার ক্ষেত্র ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাই দোষ স্বীকারোক্তি তথা জিজ্ঞাসাবাদ নিয়ে গবেষণার সংখ্যাও কম নয় । এ বিষয়ের উপর পুলিশ গবেষক ও অপরাধ বিজ্ঞানীগণ নানা মাত্রিক তত্ত্ব উপস্থাপন করছেন।

একজন আসামী কেন দোষ স্বীকার করবেন, কেন তিনি পুলিশের কাছে তার কৃত অপরাধের বর্ণনা দিবেন, কেন তার সহযোগীদের পরিচয় উদ‌ঘাটন করবেন এবং কেনই বা তাকে ও তার সহযোগীদের জড়িত করে আদালতে দোষ স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দেবেন তা নিয়ে তদন্তকারী ও জিজ্ঞাসাবাদকারীদের স্বচ্ছ ধারণা থাকা দরকার। 

সম্পৃক্ততা প্রমাণিত হওয়ার বিশ্বাস

দোষ স্বীকারোক্তিদানের সবচেয়ে বড় কারণ হল এই যে, আসামী বিশ্বাস করে যে তদন্তকারীগণ ইতোমধ্যেই তার কৃত অপরাধের সব কিছুই জেনে গেছে। তাই নিজের সম্পৃক্ততার কথা আর গোপন করে লাভ কি। স্বীকারোক্তিদানকারী আসামীদের উপর পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা গেছে যে  ৫৫% আসামী এই বিশ্বাস থেকে স্বীকারোক্তি দিতে রাজি হয়েছিল যে তাদের অপরাধের খুঁটিনাটি সম্পর্কে পুলিশ ইতোমধ্যেই সব জেনে ফেলেছে (Gudjonsson & Petersson 1991) ।

এ তথ্য থেকে অনুমান করা যায়, অভিযুক্ত সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করে অপরাধে তার সম্পৃক্ততা সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট বিশ্বাসযোগ্য সাক্ষ্য প্রমাণ হাজির করতে পারলে আসামীর দোষ স্বীকারোক্তির সম্ভাবনা বহুলাংশে বেড়ে যায়। তদন্তকারী আসল ঘটনা না জেনেও বিশ্বাসযোগ্যভাবে দৃঢ়তার সাথে তা জানার ভান করে আসামীকে চ্যালেঞ্জ করলেও আসামী দোষ স্বীকার করবে। তবে এক্ষেত্রে জিজ্ঞাসাবাদকারীকে আসামীর সাথে এক মানসিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অবতীর্ণ হতে হবে। পেশাদার অপরাধীগণ মানসিক দিক দিয়ে শক্তিশালী থাকে। তাই জিজ্ঞাসাবাদকারীর তথ্যের ঘাটতি ও মানসিক দুর্বলতা তারা সহজেই অনুমান করে বার বার ঘটনা অস্বীকার করতে পারে এবং একবার অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করলে প্রশ্ন সংখ্যার সাথে সাথে অস্বীকৃতিও বেড়ে যেতে পারে । কারণ তখন সন্দিগ্ধ বিশ্বাস করা শুরু করে যে পুলিশ তার অপরাধ সম্পর্কে তেমন কিছুই জানে না । তারা অন্ধকারে ঢিল ছুড়ছে। বস্তুত তার অপরাধ পুলিশ অন্য কোনভাবে উদঘাটন করতে পারবে না। এমনি ঘটলে আসামীর  স্বীকারোক্তি আদায় করা জিজ্ঞাসাবাদকারী পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়ে।

অপরাধ সম্পর্কে আসামির যৌক্তিকীকরণ

আসামি তার কৃত অপরাধ নিয়ে সম্পূর্ণ নিজস্ব যৌক্তিক প্রক্রিয়া অনুসরণ করে। প্রত্যেক ব্যক্তিই তার কৃতকর্ম যুক্তিপূর্ণ বলে দাঁড় করাতে চায়। তাই অপরাধটি সংগঠনের ব্যাপারে তাকে কিছু গ্রহণযোগ্য যুক্তি দিতে পারলে তিনি পুলিশের কাছে দোষ স্বীকার করেন।

কৃতকর্মকে সঠিক প্রমাণ করার চেষ্টা মানুষের জন্মগত। অপারাধীরা এ নিয়ে আরো একধাপ এগিয়ে থাকে। আমার অর্থ নেই, কিন্তু তোমার একাধিক গাড়ি আছে; তাই আমি একটি গাড়ি নিয়ে নিলাম। তোমার পকেটে অনেক টাকা কিন্তু আমি কপদর্কশূন্য। তাই তোমার পকেট থেকে কিছু টাকা আমি নিতেই পারি- এ  ধরনের যুক্তি বিজ্ঞজনদের কাছে গ্রহণযোগ্য না হলেও অপরাধীদের মনে এসবের বড় স্থান রয়েছে।

কোনো অপকর্মের পর ধরা পড়লে অপরাধীদের মনে এমন সরল যৌক্তিকীকরণ ভীষণভাবে ক্রিয়া করে। তাই এক প্রকার সরলীকরণ যুক্তিতেও অপরাধীগণ স্বেচ্ছায় দোষ স্বীকার করেন।

অনেক অপরাধী তাদের কৃতকর্মের পেছনে নানাবিধ হিসাব-নিকাশ করে থাকেন। অপরাধের পর ধরা পড়ার ভয়, ধৃত হলে তার পরিণতি কী হতে পারে এবং এর ফলে তার প্রকৃত লাভ-লোকসান কতটুকু হবে  তা চুলচেরা বিশ্লেষণ করেও অনেক অপরাধী অপরাধ কর্মে লিপ্ত হয়।

কিন্তু একবার ধরা পড়লে তাদের যুক্তির মোড় ঘুরে যায়। তারা সরল যুক্তিতে নেমে আসে। আর এসব যুক্তি যতই অগ্রহণযোগ্য বা খণ্ডনযোগ্য হোক তারা তা তুলে ধরে দোষ স্বীকার করতে পারে।

অপরাধবোধ

সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে বিজ্ঞ আদালত পর্যন্ত মনে করে যে মানুষ অপরাধবোধ থেকে দোষ স্বীকার করে। প্রকল্পটি গবেষণা দ্বারাও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। 

গাডজনসন ও পেটারসনের গবেষণায় ৪২ শতাং স্বীকারোক্তিকারী বলেছেন যে, তারা দোষ স্বীকারের পর মানাসিকভধাবে তৃপ্তিবোধ করেছেন।  গবেষণায় এক-তৃতীয়াংশ স্বীকারোক্তিকারী বলেছেন, স্বীকারোক্তিদানের পর তাদের মন প্রশান্তিতে ভরে গেছে। তারা এখন নিজেদের হালকাবোধ করছেন। তাদের বুকের উপর থেকে একটি বড় পাথর সরিয়ে গেছে।

তবে অপরাধবোধ থেকে দোষ স্বীকারোক্তি দেওয়া অল্প বয়সী এবং প্রথমবার অপরাধীদের ক্ষেত্রেই বেশি প্রযোজ্য। পেশাদার অপরাধীদের ক্ষেত্রে এই যুক্তি তেমন কাজ করে না। কারণ তারা অপরাধকে তাদের জীবিকার বাহন বলে মনে করে এবং অপরাধ করতে করতে তাদের অপরাধবোধ ভোতা হয়ে যায়।

নাম-যশ কামানো

পেশাদার অপরাধীগণ তাদের নিজ দল বা গোষ্ঠীর কাছে নিজেদের অপ্রতিরোধ্য নায়করূপে  প্রতিষ্ঠিত করার জন্য সর্বদা উন্মুখ থাকে। তাই তারা যে কোনো ঘটনায় নিজেদের বুদ্ধিমত্তা ও সাহসের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের অপেক্ষায় থাকে। তারা নিজেদের জঘন্যতর করে উত্থাপন করতে চায়। একই সাথে তারা তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী গোষ্ঠী বা দলগুলোর কাছেও নিজেদের জঘন্যতা প্রমাণ করতে চায়।

তাই কোনো অপরাধে গ্রেফতার হলে সম্ভাব্য নেতৃত্বাকাঙ্খি উদীয়মান অপরাধীরা নিজেদের জড়িত করে দোষ স্বীকারোক্তি দিয়ে থাকে। এমনকি কোনো প্রকার সংশ্লিষ্টতা না থাকলেও অপরাধ দলের উদীয়মান সদস্যরা নিজেদের জঘন্যতর প্রমাণের জন্য হত্যা কিংবা অন্য কোন অপরাধের দায় স্বীকার করতে পারে।

হরমোন নিঃসরণ

কোনো অপরাধ বা গোপনকর্ম করার পর ব্যক্তির অভ্যন্তরে এড্রেনালিন হরমোন নিঃসরণ শুরু হয়। এর ফলে অপরাধীর মধ্যে মানসিক পরিবর্তন শুরু হয় যা শারীরিকভাবেও প্রকাশিত হয়। তখন তার মন থেকে অপরাধবোধ ও ধরা পড়ার ভয় দুটোই  বিদূরিত হয়। এ সময় সে তার গোপন কথা বা অপরাধ সম্পর্কে অন্যকে বলার প্রচণ্ড আগ্রহ প্রকাশ করে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এক জোড়া-খুনের আসামি এক ট্রাক ড্রাইভার ও তার বান্ধবীকে খুন করে তাদের সর্বস্ব লুট করে তার কিছু পরেই একটি পার্টিতে যোগ দেয়। ঐ পার্টিতে সে অন্যদের কাছে তাদের অপরাধ সম্পর্কে অবহিত করে। এখান থেকে পুলিশ বিষয়টি জেনে তাকে ও তার বান্ধবীকে গ্রেফতার করে। পুলিশের কাছেও সে সব কথা অকপটে স্বীকার করে।

এড্রেনালিন নিঃসরণ সাধারণত অপরাধকর্ম করার সাথে সাথেই শুরু হয়। এটা কয়েক ঘন্টা পর্যন্ত চলতে থাকে। তারপর ক্রমান্বয়ে বন্ধ হয়ে যায়। হরমোন নিঃসরণকাল পর্যন্ত কোনো অপরাধীকে গ্রেফতার করা গেলে তার কাছ থেকে তাই স্বীকারোক্তি আদায় সহজ হয়।

ঘটনাস্থলে ধরা পড়া অপরাধীরা যে সব কারণে সহজেই সব কিছু স্বীকার করে, হরমোন নিঃসরণ তার মধ্যে অন্যতম। সাধারণত যে ব্যক্তি প্রথম ঘটনাস্থলে যায় কিংবা অপরাধী তার অপরাধকর্ম শেষে প্রথম যার সাথে মিলিত হয়, সে যদি তার বিশ্বাসভাজন হয়, তবে তার কাছে সে সব কিছু খুলে বলে। একবার কেউ তার অপরাধের কথা কারো কাছে স্বীকার করলে তার পরবর্তী স্বীকারোক্তি সহজতর হয়।

গোপন কথাটি  রবে না গোপনে

মানুষ তার ভাব অন্যের কাছে প্রকাশ করতে চায়। একজনকে অন্য জনের কাছে তুলে ধরতে চায়। আর যে কথাটি গোপন সেটাতে মানুষের আকর্ষণ বেশি। তাই পৃথিবীতে মানুষের জন্য সবচেয়ে কঠিন কাজ হল গোপন কথাটি গোপন রাখা।

অন্য মানুষের প্রতি বিশ্বাস,  কৃতীত্ব জাহির কিংবা অনেক সময় কেবল গোপন প্রকাশের স্বাভাবিক গরজ থেকেই মানুষ গোপনকর্ম প্রকাশ করে। অনেক সময় কারাগারের ভিতরে পুলিশ অপরাধীদের মধ্য থেকে সোর্স নিয়োগ করে কিংবা পুলিশ অফিসার নিজেই অপরাধী সেজে কারাগারে গিয়ে কোনো জঘন্য অপরাধীর অপরাধের কথা জানার চেষ্টা করে। গোপন কথা প্রকাশের সহজাত প্রবৃত্তি আছে বলেই সেটা সম্ভব হয়।

অন্যকে রক্ষা করা

অনেক ক্ষেত্রে এক ব্যক্তি অন্য ব্যক্তিদের বাঁচানোর জন্য অপরাধের সকল দায়দায়িত্ব নিজের কাঁধে নিয়ে দোষ স্বীকারে উদ্বুদ্ধ হয়। সাধারণত অপরাধ যখন উদ্ঘাটিত হয় এবং গোপন করার আর সুযোগ থাকে না তখন অপরাধ সংশ্লিষ্টদের কেউ অন্যের হয়ে সব দোষ নিজের ঘাড়ে নেয়।

পিতা তার পুত্রকে, স্ত্রী তার স্বামীকে কিংবা আদর্শিক বা সংঘবদ্ধ অপরাধীদলের একজন অন্যদের অপরাধ আড়াল করার জন্য  ঘটনার সকল দায় নিয়ে স্বীকারোক্তি দিয়ে থাকে। এ ধরনের স্বীকারোক্তির মধ্যে মিথ্যা স্বীকারোক্তির হার বেশি। কারণ অপরাধী অন্যকে বাঁচানোর জন্য ঘটনার মধ্যে অনেক তথ্য গোপন রাখবে বা বানিয়ে বানিয়ে মিথ্যা কথা বলবে।

টোপ ফেলা

অনেক সময় ধূর্ত অপরাধীরা জিজ্ঞাসাবাদকারীর দৃষ্টি সরিয়ে নেওয়ার জন্য অপেক্ষাকৃত কর্ম গুরুত্বের কিছু কিছু অপরাধের কথা স্বীকার করে।

কোনো সিঁধেল চোর  বাণিজ্যিক এলাকায় বড় ধরনের চুরির মামলায় জিজ্ঞাসাবাদের সময় ভাংচুর বা ছোটখাট ছিনতাইয়ের কথা স্বীকার করতে পারে। এতে তার করা বড় ধরনের চুরির তদন্ত থেকে গুরুত্ব সরিয়ে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদকারী অন্য একটি অপ্রাসঙ্গিক ও কম গুরুত্বের বা দূরবর্তী বিষয় নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়বে।

আবার আসল অপরাধের জিজ্ঞাসাবাদ রেখে ফালতু কোনো অপরাধ নিয়ে গুরুত্ব দেওয়া শুরু হলে সন্দিগ্ধ ধরে নিবে যে তার প্রকৃত অপরাধ সম্পর্কে পুলিশ তেমন কিছু জানে না। তাই আসল অপরাধের তথ্য সে আরো বেশি আত্মবিশ্বাস নিয়ে গোপন করা শুরু করে।

এ ধরনের ঘটনায় জিজ্ঞাসাবাদকারীকে সন্দিগ্ধের অন্য অপরাধের স্বীকারোক্তিটি হাতে রেখে মূল বিষয়ে চলে আসতে হবে এবং মূল অপরাধের জিজ্ঞাসাবাদ শেষ করে সন্দিগ্ধের অযাচিতভাবে স্বীকার করা অপরাধ নিয়ে প্র্রশ্ন করা শুরু করতে হবে।

পারস্পরিক দেওয়া-নেওয়া

অপরাধীদের কিছু কিছু বাস্তব বা তাৎক্ষণিক সুবিধা দেওয়ার বিনিময়ে তাদের কাছ থেকে স্বীকারোক্তি আদায় করার অনুশীলন বহু পুরাতন। এ চর্চা পৃথিবীর প্রায় সকল দেশের ফৌজাদারি বিচার ব্যবস্থায় বিদ্যমান। আমাদের দেশে কোনো অপরাধীকে সকল তথ্য উদ্ঘাটন ও দুষ্কর্মের সহযোগীদের সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য প্রদানের বিনিময়ে তাদের রাজসাক্ষী করার বিধান পুলিশ রেগুলেশনে বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য পাশ্চাত্য বিচার ব্যবস্থায় নিজেকে দোষী দাবি করার ব্যবস্থা বিদ্যমান। অনেক সময় সরকারি বা প্রসিকিউশন পক্ষ স্বীকারোক্তির বিনিময়ে আসামিকে সাজার হার কমিয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে থাকে এবং আদালত তা আমলে নেন।

অনেক সময় ফাঁদ পেতে অপরাধী ধরার জন্য সোর্স নিয়োগ করা হয় যারা অপরাধীর সাথে থেকে অপরাধ করে পরে আদালতে স্বীকার করে অন্যদের বিচারের সমুখীন হতে সহায়তা করে। তবে এ ধরনের দেওয়া-নেওয়া চুক্তির অধীন অপরাধীর স্বীকারোক্তি আদালতের কাছে কম গুরুত্ব বহন করে।

অস্বস্তিকর অবস্থা থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার আকাঙ্খা

অনেক সময় সন্দিগ্ধ ব্যক্তি অপরাধের ফলে উদ্ভূত  অস্বস্তিকর অবস্থা থেকে বাঁচার জন্য স্বীকারোক্তি দিয়ে থাকে। তারা বুঝতে পারে যে তাদের অস্বীকৃতি কোনই কাজ দিচ্ছে না। অন্যদিকে এ ঘটনার প্রেক্ষিতে তারা পরিবার ছাড়া হয়েছে, বন্ধু-বান্ধব হারা হয়েছে। তাদের চাকরি বা পেশা সবই ভেস্তে যেতে বসেছে। তাই তারা দোষ স্বীকার করাকেই নতুন জীবনে প্রবেশের একমাত্র উপায় মনে করে।

ধরনের স্বীকারোক্তি পুরোপুরি আবেগ নির্ভর এবং অন্য কোনো উপায় না থাকলেই কেবল কোনো সন্দিগ্ধ এ ধরনের স্বীকারোক্তির দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে।

এটা কোনো অপরাধই ছিল না

কোনো কোনো অপরাধের ক্ষেত্রে সন্দিগ্ধ বিশ্বাস করেন যে তিনি যা করেছেন, তা কোনো অপরাধই ছিল না। এটা হতে পারে তার অন্ধ বিশ্বাস, কোনো আদর্শিক উদ্যোগের অংশ বা আইনের প্রতি অশ্রদ্ধা থেকে।

আদর্শিক কারণে ধর্মীয় সন্ত্রাসীগণ হত্যা, অপহরণ বা বোমা হামলা চালায়। তারা এটাকে  আদর্শ প্রতিষ্ঠার হাতিয়ার মনে করে। তাই এ ধরনের অপরাধীগণ পুলিশের কাছে তার অপরাধের কথা স্বীকার করে। তবে আদর্শিক কারণে তারা অনেক তথ্য গোপনও রাখতে পারে। গর্ভপাতের বিরুদ্ধচারণকারী ব্যক্তি গর্ভপাত করানো হাসপাতালে বোমা হামলা করলে সেটা তার কাছে যৌক্তিক মনে হবে।

অনেক সময় আইনি অজ্ঞতা বা আইনের অপব্যাখ্যা গ্রহণ করেও অপরাধী তার কাজকে যৌক্তিক ও আইনসিদ্ধ মনে করতে  পারে। বাস্তুভিটার সুরক্ষার জন্য কেউ তার বাড়ির চারদিকে বৈদ্যুতিক ফাঁদ দিতে পারে। এ ফাঁদে পড়ে কোনো চোর নিহত হলে, গৃহকর্তা সেটাকে তার সম্পত্তির ব্যক্তিগত আত্মরক্ষার অধিকার হিসেবে দাবি করে ঘটনার দায়দায়িত্ব গ্রহণ করতে পারে।

অনেক সমাজে প্রতিশোধ গ্রহণ বা ধর্মীয় বা গোষ্ঠগত কারণে হত্যা, ধর্ষণ ইত্যাদি অপরাধ সংঘটিত হয়। এক্ষেত্রে অপরাধী জানে যে তার কাজটি আইনগতভাবে অবৈধ। কিন্তু সে তার নৈতিক দিক দিয়ে সেটাকে বৈধ মনে করে স্বীকারোক্তি দিতে পারে।

জিজ্ঞাসাবাদকারীর প্রতি পূর্ণ বিশ্বাস

জিজ্ঞাসাবাদকারীগণ অনেকটা দোকানের সেলসম্যানের মতো।   গুণাগুণ সম্পর্কে আকর্ষণীয় ভঙ্গিতে যখন কোনো দোকানদার খদ্দেরের কাছে দ্রব্যসামগ্রী উপস্থাপন করেন, খদ্দের তাতে আকর্ষিত হয়ে তা কেনার সিদ্ধান্ত নেয়। অনেক সময় নিম্নমানের দ্রব্যও সেলসম্যানের কারণে খদ্দের বেশি দামে কেনার সিদ্ধান্ত নেয়। এর কারণ, ক্রেতা বিশ্বাস করে যে দ্রব্যটি ভাল এবং তা ক্রয় করা লাভজনক।

একটি আদর্শ  জিজ্ঞাসাবাদের সময় জিজ্ঞাসাবাদাকারী সন্দিগ্ধের সাথে এমন অন্তরঙ্গতা তৈরি করেন যে সন্দিগ্ধ তাকে বিশ্বাস করতে শুরু করে। সন্দিগ্ধ জিজ্ঞাসাবাদকারীকে তার শুভাকাঙ্খী বলে বিশ্বাস করতে শুরু করে। তার অনুরোধ সন্দিগ্ধ উপেক্ষা করতে পারেন না। কারণ এতে জিজ্ঞাসাবাদকারী মনক্ষুন্ন হতে পারে বলে তিনি বিশ্বাস করেন। মানুষের স্বভাবই এই যে যাকে বিশ্বাস করা হয়, তার বিরুদ্ধচারণ করাটা কঠিন হয়ে পড়ে।

বাঁচার আকুতি

কোনো কোনো অপরাধী উপলব্ধি করে যে সে নিজেই নিজের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। সে মানসিকভাবে অপরাধ অব্যহত রাখতে না চাইলেও অভ্যস বা পরিস্থিতি তাকে পুনরায় অপরাধে জড়িয়ে ফেলে। অথচ সে আর অপরাধ জগতে থাকতে চায় না। তাই সে অন্ধকার জগত থেকে বের হয়ে আসার একটি পথ খোঁজে।

জিজ্ঞাসাবাদকারীর কাছে জীবনের সকল অপরাধ স্বীকার করে তার মাধ্যমে সে স্বাভাবিক জীবনে ফেরার প্রত্যাশা করে। অভ্যাসগত ধর্ষক বা  চোর এ ধরনের অপরাধীগণ বাঁচার আকুতি নিয়ে স্বীকারোক্তি দিতে পারে।

'না' বলতে অপারগ

কিছু কিছু মানুষ অনুরোধ উপেক্ষা করতে পারেন না। একটু তোষামোদ বা অনুরোধ করলেই তারা মোমের মতো গলে যান।  অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, এসব ব্যক্তির নিজস্ব কোনো মত নেই। কোনো বিষয় সম্পর্কে অন্যজন যে মত পোষণ করেন কিংবা ঘটনাকে অন্যরা যেভাবে ব্যাখ্যা করেন, তারা তাই গ্রহণ করেন। সাধারণত মানসিকভাবে অপরিপক্ক, মাতাল, নেশাখোর ব্যক্তিরা এমন ধরনের স্বীকারোক্তি দিয়ে থাকেন। এ ধরনের ব্যক্তিরা মিথ্যা স্বীকারোক্তিপ্রবণ হয়ে থাকে।

শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন

আসামিকে শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন করে দোষ স্বীকার করার পদ্ধতি আদিম কালের। কিন্তু সভ্য জগতে শারীরিক নির্যাতন করা বা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে স্বীকারোক্তি আদায় করা নিষিদ্ধ। পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদের ক্ষেত্রে নির্যাতনকে তৃতীয় মাত্রা বা থার্ড ডিগ্রি ম্যাথোড বলে।

নির্যাতনের ফলে দেওয়া স্বীকারোক্তি প্রায়ই মিথ্যা হয়। এতে জিজ্ঞাসাবাদকারী যা বলতে বলেন, অভিযুক্ত হয়তো তাই বলেন, তাই স্বীকার করেন। কিন্তু প্রায় ক্ষেত্রেই তা আদালতের শর্ত পূরণ করে না।

আদালতে বাদী-বিবাদ পক্ষের আইনজীবীদের জেরা, পাল্টা জেরার মাধ্যমে মিথ্যা স্বীকারোক্তির অসারতা প্রমাণিত হয়। সাধারণত অল্প বয়সী, আরামপ্রিয় এবং বেশি বয়সের ব্যক্তিরা নির্যাতনের ফলে স্বীকারোক্তি দিয়ে থাকে।

আসামির দোষ স্বীকারোক্তি আদায় করাই জিজ্ঞাসাবাদের চূড়ান্ত উদ্দেশ্য নয়। জিজ্ঞাসাবাদের মাধ্যমে সত্য উদ্ঘাটনের চেষ্টা করাই যৌক্তিক। কিন্তু জিজ্ঞাসাবাদকারী পুলিশ কর্মকর্তারা বিষয়টি হয় বোঝেন না কিংবা বুঝেও পাত্তা দিতে চান না। জিজ্ঞাসাবাদের মাধ্যমে অপরাধের রহস্য উদ্ঘাটন করে মামলার তদন্ত দ্রুত শেষ করাই তাদের মুখ্য উদ্দেশ্য থাকে। তাই তারা যত বেশি পারে একটি দ্রুততম পন্থায় আসামির দোষ স্বীকারোক্তি নিতে তৎপর হয়।

কিন্তু আসামি কেন দোষ স্বীকার করবে, তার অন্তর্নিহিত রসায়ন কী এসব তাত্ত্বিক জ্ঞান না থাকলে তদন্তকারী বাস্তব ক্ষেত্রে হাতুড়ে বলে প্রমাণিত হন।  আসামির ব্যক্তিত্বের ধরন নির্ধারণ করে করে সুনির্দিষ্ট পদ্ধতিতে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলে কোনো প্রকার নির্যাতন বা প্রতারণা ছাড়াই দোষ স্বীকারোক্তি আদায় করা সম্ভব।

সূত্র: Practical Aspects of Interview and Interrogation by  David E. Zulawski and Douglas E. Wicklander, (2002), 2nd edition,  CRC Press